#ধারাবাহিকগল্প
#ভৌতিক থ্রিলার
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
সে রাত্রিতে আমার বন্ধুটি সারারাত ছেলেটার ঘরে কাটিয়ে দেয়। হয়ত ওরা সে রাতে নিজেদের সামলাতে পারিনি। ছেলেটার বাবাও বাড়িতে ছিলেন না। শুধু বয়স্ক একজন বুয়া ছিলো।
দু,দিন পর ছেলের বাবা বাড়িতে ফিরে এসে ছেলেটাকে বললো,
—–আমি তোমার বিয়ে আমার বন্ধুর মেয়ের সাথে ঠিক করেছি।
ছেলেটি ওর বাবাকে বললো,
—-বাবা, আমি চাঁদনীকে ভালবাসি।
—–তুমি কি করে ভাবলে, একজন নার্সকে আমি আমার পুত্র বধু হিসাবে মেনে নিবো। সেই সাথে এতিমখানায় বড় হওয়া যার তিন কুলে কেউ নেই। ওর বংশমর্যাদা কি তাও জানি না। সুতরাং আমার পক্ষে এই সম্পর্ক মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
—–বাবা বিয়ের পর ও আর নার্সের চাকরি করবে না।
—-শোনো দৃষ্টিকে সবসময় উপরের দিকে প্রসারিত করবে। তাহলে জীবনে সমৃদ্ধি আসবে। আমি তোমার সাথে যার বিয়ে ঠিক করেছি সে তার বাবা মার একমাত্র সন্তান। মেয়েটাও উচ্চশিক্ষিত। বাবার অগাধ সম্পদ রয়েছে। আমি ওদের কথা দিয়ে এসেছি। তুমি যদি আমার সিদ্ধান্ত মেনে না নাও আমি তোমাকে আমার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবো। তোমার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবো।
ছেলেটা ওর বাবার কথাগুলো আমার বন্ধুটিকে জানায়। এর মধ্যে মেয়েটি প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে। ছেলেটিকে জানানো হয়। ও বলে এই মূহুর্তে বাবাকে জানানো দরকার নেই। তবে ছেলেটি আমার বন্ধুটিকে কথা দেয় এই বিষয়টা ও সামলে নিবে। বাবাকে বুঝিয়ে ওকেই বিয়ে করবে। আমার বন্ধুটি সরল বিশ্বাসে ওর প্রেমিকের কথাগুলো মেনে নেয়।
আমার বন্ধুটির সাথে আমার যোগাযোগ হয় ও যখন এতিমখানায় ছিলো তখন থেকে। এতিম খানায় ও অনেক টর্চারের শিকার হয়। আমি সবসময় ওর পাশে থাকতাম। যেমন মাঝে মাঝ ওকে দু তিনদিন খাবার দিতো না। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি তখন বাইরে থেকে খাবার কিনে দিতাম। ওর অসুখ হলে ওষুধ ও পেতো না। আমি তখন ওষুধের ব্যবস্থা করতাম। টাকা লাগলে যোগাড় করে দিতাম। আমাদের অনেক বছরের বন্ধুত্ব। বন্ধুর বিপদে আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারিনি। যাইহোক ও যখন আমাকে বলে ও গরীব বলে ওর প্রেমিকের বাবা এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারছে না। তখন আমি ব্রিফকেস ভর্তি টাকা এনে দেই। মেয়েটির কাছে এতো টাকা দেখে বাবা ছেলে কেউ লোভ সামলাতে পারেনি। ওর বাবা টাকাগুলো আত্মসাত করার জন্য ফন্দি আঁটে। ব্যবসায়িক কাজের ছুঁতোয় ছেলেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
সেদিন ছিলো চাঁদনী রাত। আমি আর আমার বন্ধু ছাদের কিনারে বসে গল্প করছিলাম। ভালবাসার মানুষটিকে ঘিরে ওর দুচোখ ভরা স্বপ্ন ছিলো। ছেলের বাবা জানতো রাতে ছাদে এসে বন্ধুটি ঘুরে বেড়ায়। আসলে ও আমার সাথে গল্প করে। ওদের বাড়িটা তখন একতলা ছাদের বাড়ি। উপরের ঘর তখনও হয়নি। ছেলের বাবা ছাদে এসে বন্ধুটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। কনসিভ করার কারনে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রক্তপাত শুরু হয়। ঐ দিন রাতে আমার বন্ধুটি মারা যায়। সেদিন রাতে আমার চোখের সামনে আমার বন্ধুটিকে মেরে ফেলা হলো। ওকে রক্ষা করার নিজের অক্ষমতায় বন্ধু হারানোর বেদনায় ছটফট করতে লাগলাম। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ওদের বাড়িতে সে সময় সুইমিং পুল তৈরী হচ্ছিলো। সেই পুলের মেঝেতে গর্ত করে ওকে জানাযা না পড়িয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করি আমি এই বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিবো।
—–তোমার বন্ধুর প্রেমিক ফিরে এসে ওর খোঁজ করেনি?
—–খুব প্রিয় আপনজন হারিয়ে গেলে আমরা যেমন শোকে বিহ্বল হয়ে যাই। তেমনি কিছু জিনিস হারিয়ে গেলে আমরা স্বস্তি ফিরে পাই। আমার বন্ধুর প্রেমিক মনে হয় স্বস্তি ফিরে পেলো।
এরপর ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে ওরা অভিজাত এলাকায় ফ্লাট কিনে চলে যায়। আর আমি ওদেরকে হত্যা করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। আমি আমার বন্ধুটিকে যেখানে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে সেখানেই থেকে যাই।
জয়া আবারও নুপুরের শব্দ শুনতে পেলো। আজ যেন নুপুর পড়া মেয়েটার অবয়ব দেখতে পেলো। চাঁদের আলোতে জয়া স্পষ্ট দেখতে পেলো থেতলে যাওয়া মাথা পুরো শরীর রক্তে ভিজে আছে। পেটের দিকটা একটু ফুলে আছে। আস্তে আস্তে ও পুলের পানিতে নেমে গেলো। তারপর যেন পানিতেই মিলিয়ে গেলো। জয়া যখন মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিলো ওর পাশে জিন্নাতও হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
এরপর জয়া রুমে চলে আসে। ফজরের আযান দেয়। রশ্নির রুম থেকে চিৎকার ভেসে আসে। জয়া দৌড়ে রশ্নির রুমে চলে যায়। রশ্নির ফোন হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-জয়া আমার শ্বশুর মারা গিয়েছে। ওনার মৃত্যুটা নাকি অস্বাভাবিকভাবে হয়েছে।
জয়া আর রশ্নি হাসপাতালে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে ওর শ্বশুরের মাথাটা থেতলানো রয়েছে। রশ্নি ওর বাবাকে জিজ্ঞাসা করে
——কিভাবে এই ঘটনা ঘটলো।
ওর বাবা বলে,
—-উনি অনেকটা সামলে উঠেছিলেন। আইসিইউতে মাঝরাতে সবাই তখন ঘুমিয়ে আছে। উনার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হয়। ওয়ার্ডবয় ওনাকে বাথরুমে বসিয়ে দেয়। আর উনাকে বলে সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাথরুম শেষ হলে ডাকলে সে এসে বেডে শুইয়ে দিবে। কিন্তু বাথরুমে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার চিৎকার শোনা যায়। দরজা খুলে ওয়ার্ড বয় দেখে উনি মাথা থেতলানো অবস্থায় হাইকোমডে বসে আছে। সবাই অবাক হয়ে গেলো কমডে বসা অবস্থায় মাথাটা কিভাবে থেতলানো হলো। ওয়ার্ড বয় কোনো শব্দ শুনতে পায়নি। শুধু চিৎকার শুনেছিলো। তারপর উনাকে বেডে নিয়ে আসার পর দেখা গেলো উনি আর বেঁচে নেই। এক মাসের মধ্যে দুটো জলজ্যান্ত মানুষ ওপারে পাড়ি জমায়।
লাশ নিয়ে সবাই বাসায় চলে আসলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো এ বাড়িতে রশ্নিরা আর থাকবে না। ঢাকায় চলে যাবে। লাশের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হলো। জয়া জব্বার মিয়াকে ডেকে সুইমিংপুলের নিচে মাটিটা খুঁড়তে বললো। রশ্নি প্রথম আপত্তি করলেও জয়া যখন বলে,
—-রশ্নি এখানেই রায়হান আর তোর শ্বশুরের হত্যার রহস্য লুকিয়ে আছে।
তখন রশ্নিও মত দেয়। পুলটা খোড়া হলে ওখানে নুপুর পড়া এক কঙ্কাল খুঁজে পায়। তারপর রায়হানের পাশে জানাযা পড়িয়ে কঙ্কালটাকে আবারও কবর দেওয়া হয়। ওদের পাশে রায়হানের বাবার কবর হয়। জয়া যেন দূর থেকে জিন্নাতকে চোখে জল নিয়ে হাসতে দেখা যায়। লোভ লালসা মানুষকে পাপের অধঃপতনে নিয়ে যায়। এভাবেই হয়ত রায়হান আর ওর বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়।
রশ্নি জয়াকে জিজ্ঞাসা করে,
—–পুলের মধ্যে গর্ত করে লাশ রাখা হয়েছে এটা তুই কিভাবে জানলি?
—-আমি জব্বারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম চাঁদনি নামে এ বাড়িতে কেউ কোনদিন ছিল কিনা?
—-ও কি বলেছে?
—-শোন রশ্নি এখন তো কেউ বেঁচে নেই। এসব জেনেও কোন লাভ নেই। তুই রায়হানকে ভালবাসিস। সেই ভালবাসাটাই ধরে রাখিস। এখন এসব জানা অর্থহীন। ওরাতো জীবন দিয়ে ওদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে।
রশ্নি ওখানে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
না ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। রশ্নি বাচ্চা কনসিভ করে। এটাই হয়তো রশ্নির বেঁচে থাকার অবলম্বন। ওকে নিয়ে রশ্নির পৃথিবীটা আবার নতুন করে জেগে উঠবে।