#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব- ১২
অবন্তি অবন্তি এই অবন্তি কথা বলছিস না কে?
বড় মামার ডাকে আমি চেতনা ফিরে পেলাম। মায়ের ডায়রির ভেতর ডুবে ছিলাম। কিরে আফিফার খবর কি মা? বড় মামা জিজ্ঞেস করলেন।
আমি বললাম,
-মামা, মামনির এম আর আই, সিটি স্ক্যান সহ আরো অনেক গুলো টেষ্ট করা হয়েছে। রিপোর্ট কিছু আজ আসবে, আর বাকি গুলো কাল আসবে।
– আফিফা এখন কেমন আছে মা?
– মামা, মায়ের অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইন্টারনাল খিঁচুনি হচ্ছে। যার কারনে মামনিকে আই সি ইউতে আরো থাকতে হবে।
– আফিফা তো ভালোই ছিল মা, তাহলে কেমন করে এমন হলো?
মামার সাথে কথা বলতে বলতে ইরা খালামনি চলে আসলেন। তারপর খালামনিও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন এটা জানার জন্য যে কেন মামনি হঠাৎ অসুস্থ হলেন।
আমি সবাইকে নিয়ে করিডোরে আসলাম। আর বলতে শুরু করলাম,
– যেদিন রাতে মামনির এমন হয় সেদিন সন্ধ্যায় দাদি ফোন দিয়েছিল, মামনির ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে অফিসের কিছু কাগজ দেখছিল। দাদি বলল, আগামীকাল নিয়াজের বিয়ে দিচ্ছি। এবার আমার পছন্দের মেয়ের সাথে নিয়াজের বিয়ে দিবো। এরপর মামনি আর কারো সাথে কথা বলেনি। রাতে সানেকা খালা ঘরে গেলে মামনিকে এ অবস্থায় দেখে। তারপরে হাসপাতালে।
বড় মামা রেগে গিয়ে বললেন,
– নিয়াজ দ্বিতীয় বিয়ে করবে? ছেলে মেয়ে এতো বড় হয়ে যাবার পরও সে আর ভালো হলো না? আমি এখন দেশে আছি, এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল!
ইরা খালামনি খুব রেগে গেলেন, বললেন,
– আর কতো জ্বালাবে আমার বোন টাকে, সহজ সরল মানুষ পেয়ে সারাজীবন বোকা বানিয়ে গেলো।
আবীরটা এগুলো জানতো না, সব কথা শুনে কেমন যেন রাগে গজ গজ করতে লাগলো। আজ আবীরকে দেখে খুব ভয় করছে আমার। কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে কথা বলছে আমার সাথে। সে বলছে,
– কেন এতোক্ষন আমাকে এগুলো বলোনি?
– তুই ছোট মানুষ ভাই, তোকে কি বলবো?
– আমি ছোট এটা সত্য, তবে এটাও সত্য যে আমি মানুষ।
ভাই উঠে দাঁড়ালো, আমি বললাম,
– কোথায় যাচ্ছিস ভাই?
– ঐ লোকটাকে বিয়ে করার শখ মেটাবো।
– বাদ দে শোনা, বাবার যা খুশি করুক।
– তাই বলে বিয়ে করতে দেবো?
– হ্যা দিবি! কারন আমি চাই যে সে চিরতরে মামনির জীবন থেকে চলে যাক। মামনি স্বাধীন ভাবে সুখে বাঁচতে শিখুক।
– তাই বলে সে বিয়ে করবে?
– হ্যা করবে, সে তার নিজের জীবন নিয়ে ব্যাস্ত থাকলে মামনির পিছু ছাড়বে। নইলে এভাবেই জ্বলতে হবে সারা জীবন। আর এ সত্যটা মামনিকে বুঝতে হবে।
– আমার মা মৃত্যূর সাথে লড়াই করছে দেখেছো?
– হ্যা দেখছি, সে আমারও মা। কষ্টের আগুনে পুড়ে, মামনিকে বাস্তব জীবনে আসতে হবে। নইলে কারো মুক্তি নেই। এবারের লড়াইটা মামনির একা, তাকে একাই লড়তে দাও। তুমি কারো সাথে এ বিষয়ে কথা বলোনা ভাই। বাবাকেও তার নিজের মতো থাকতে দাও। নইলে ভবিষ্যত আরো খারাপ।
– আপু আমার খুব ভয় করছে মামনির যদি কিছু হয়ে যায়?
– আল্লাহর উপর ভরসা রাখো ভাই, আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন।
কোন রকমে আবীরকে সামলালাম, এটারই ভয় পাচ্ছিলাম। তবে বড় মামা আর খালামনি খুব রেগে আছেন, যেভাবে রেগে আছেন তাতে করে, উনারা কি করবেন আমি জানি না।
মামনির কাছে বড় মামা ও ইরা খালামনিকে রেখে আমি আর আবির বাসায় গেলাম, আমার এখন মামনির ডায়রিটা পড়তে মন চায় সব সময়। আমরা দুই ভাই বোন দুপুরের খাবার খেয়ে, আমার রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। আবীর আমার পাশে, আমার হাত ধরে পাশে শুয়ে রইল। আমি শুয়ে শুয়ে আবার মামনির ডায়রি পড়তে লাগলাম।
মামনির ডায়রিতে এরপর লিখা ছিল যা,
আমার বিদায়ের সময় বাবা, গহনা ও আমার ঘরের আসবাব পত্র সহ সংসারের অনেক কিছু সাথে দিলেন। তবুও আমার শশুর শাশুড়ির মন কেমন করে থাকলো, যেন আরো কিছু উনারা আশা করেছিলেন। যারা তিনদিন ধরে থাকলেন, তাদের সবাইকে কাপড চোপড় দিলেন।
শশুর বাড়িতে আসার পর থেকে আমি আবার আগের মতো জীবন যাপন করতে শুরু করলাম। আমার মেডিকেল কলেজের ক্লাস শুরু হবার সময় এগিয়ে আসলো।
আমি নিয়াজকে বললাম যে,
– আমার ক্লাস শুরু হতে আর বেশি দিন নাই, আমি রংপুরে যাবো। তারপর রাজশাহী যাবো।
– তুমি কোথাও যাবে না।
– মানে?
– কেন আমি কি অন্য ভাষায় বলছি?
– আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, আমার যেতেই হবে।
– কেন, তোমার ফুপাতো ভাই! কি যেন নাম, হ্যা, রাব্বানী। ওর সাথে প্রেম করবা তাই যেতে চাও?
– ছি, ছি, বাজে কথা বলবে না? রাব্বানী আমার ভাই, তার সম্পর্কে এমন কথা কি করে বলতে পারলে?
– যা সত্য, তাই বলেছি।
– আমি কালই রংপুরে যাবো।
কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নিয়াজ আমার গালে একটা চড় দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এর পর বলল,
– আমার সাথে থাকতে হলে, পড়াশোনার কথা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে। নইলে
– নইলে কি করবে তুমি?
– কি করতে পারি বুঝতে পারোনি?
– তুমি এতো খারাপ ?
– হুম, আমি খারাপ। কিন্তু তোমার কিছুই করার নাই। কারন তুমি এখন যদি আমার কথা না শোন, তাহলে আমি এমন কিছু করবো যে তোমার বাবা দাদা নানা কারো মান সন্মান থাকবে না।
– তুমি এমন করতে পারো না!
– আমি বহু কিছু পারি, যা ধীরে ধীরে তুমি বুঝতে পারবে। হা হা হা।
আমি সারারাত কেঁদেছি। নিয়াজ বুঝতে পেরেও, আমাকে সান্তনা পর্যন্ত দিলো না। সকালে ছোট চাচি আমার মুখ দেখে, কি বুঝলো জানি না। উনি আমাকে উনাদের বাসায় নিয়ে গেলেন, আর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– কি হয়েছে মা তোমার?
আমি চাচিকে সব খুলে বললাম। এটাও বললাম যে,
– নিয়াজ একটা শিক্ষিত ছেলে, নিজে মাষ্টার্স পাস অথচ আমাকে কেন পড়তে দিবে না?
– কি বললে? কে মাষ্টার্স পাশ? নিয়াজ?
– হুম।
– তোমাকে কে বলেছে?
– নিয়াজই বলেছিল, আমাকেও বলেছে আর বাবাকেও তাই বলেছে।
– নিয়াজ ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে এবং তার পর আর পড়াশোনা করেনি।
এর পর আর কিছু মনে নেই, জ্ঞান ফিরে দেখি যে আমি হাসপাতালে। ডাক্তার আমাকে কিছু প্রশ্ন করে বলল যে
– পেশেন্ট মা হতে চলেছে।
আজ কেমন দিন আমার সামনে, আমার ভালবাসার মানুষ, তাকে আমি চিনতে পারছি না। আবার আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ আমার ভেতরে বসে আছে। আমি কাঁদবো নাকি হাসবো। নিজেকে নিয়ে আমি আর ভাবতে পারছি না।
আমার শশুর, বাবাকে খবর দিলেন যে আমি অসুস্থ। বাবা মা পরের দিন চলে আসলেন। আমার অবস্থা দেখে উনারা আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু নিয়াজ যেতে দিল না। আর এটাও বলে দিল যে,
– আফিফার এই অবস্থায় পড়াশোনা করা অসম্ভব, তাই আফিফা মেডিকেল কলেজে যেতে পারবে না।
বাবা চুপচাপ সব শুনলেন, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন বেশ কিছুক্ষন। আর কিছু বললেন না। আমি মাকে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে বললাম,
– আম্মা, আমাকে নিয়ে চলেন। আমি এখানে আর থাকতে চাই না। আমি ভুল করেছি আম্মা, আমাকে নিয়ে চলেন।
আম্মা আমার গালে কয়েকটা থাপ্পর দিয়ে বললেন,
– মেয়েদের এক বারই বিয়ে হয়, ভালো হোক খারাপ হোক তোকে এখানেই থাকতে হবে। একবার মুখ হাসিয়েছিস। এবার কি কোথাও মুখ দেখানোর যোগ্যতা রাখবি না?
তোকে এখানেই থাকতে হবে।
বাবা মা চলে গেলেন। আমি বাবাকে এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারলাম না। আমার দিন গুলো আর আগের মতো নেই। সব দিকেই অন্ধকার দেখি। আমার আজীবনের স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া আর পুরন হলো না। ভাবতে গেলেও মাথার মধ্যে কেমন যেন করে।
আমার প্রেগনেন্সির দুই মাস চলছে, আমার শশুর আমাকে ডেকে বললেন,
– আফিফা, তোমার বাচ্চা হবে। নতুন জীবনের শুরু হতে যাচ্ছে। তোমার বাবার উচিত এখন তোমার ভবিষ্যত গুছিয়ে দেয়া। নিয়াজ আমার ব্যবসা দেখে, কিন্তু নিজেরও তো কিছু করা দরকার। তোমার বাবার কাছে থেকে টাকা এনে দেও নিয়াজকে, যাতে নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারে। কালই তোমার বাবাকে চিঠি লিখে জানাবা।
আমার মন খুব খারাপ হলো, ছোট চাচির কাছে যেয়ে খুব কেঁদেছি। চাচি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
– তুই আমার মেয়ের বয়সের, তাই তোকে মেয়ের মতই ভালোবাসি। তুই কি সত্যি নিয়াজের সম্পর্কে জানতি না?
– কি জানবো চাচি?
– নিয়াজের চরিত্র সম্পর্কে?
– না, চাচি আপনি আমাকে সব সত্যি করে বলেন, প্লিজ।
– নিয়াজ ছোট থেকেই ওর বাবার ব্যবসা দেখা শোনা করে, ছোট থেকেই ওর হাতে অঢেল টাকা। আর এটাই ওর নষ্টের মুল কারন। আরও একটা কারন আছে। তোর শাশুড়ি খুব লোভি মানুষ। নিয়াজ যেই দোষ ই করুক, এসে ওর মায়ের হাতে টাকা দিয়ে দেয়। আর তোর শাশুড়ি নিয়াজকে কোন শাসন করে না, আবার তোর শশুরকেও নিয়াজের দোষ সম্পর্কে কিছু বলে না। এমন করতে করতে নিয়াজ সব সময় ছাড পেয়েছে এবং একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিয়াজ এস এস সি পরীক্ষার পর থেকে নেশা করে, আর অনেক মেয়ের সাথেই নিয়াজের সম্পর্ক। তুই কি কিছুই বুঝতে পারিস না?
– না চাচি, আমি কখনও এমন মানুষ দেখিনি। আমার বংশে কোন মানুষ এমন না। তাই আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে অনেকেই আমাকে এভাবে বলেছে চাচি, আমি বিশ্বাস করিনি। এখন আমি কি করবো চাচি, বাবার কাছে থেকে টাকা আনতে বলছে? এমন তো না যে, আমার শশুরের টাকার অভাব, উনাদের এতো বড় ব্যবসা। এতো সম্পত্তি তবুও কেন আমাকে টাকা নিয়ে আসতে বলছে?
– পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ থাকেন যে, তাদের হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা থাকলেও, মন ভরে না। তোর শশুর শাশুড়ি ঠিক তেমন মানুষ। তুই হয়ত জানিস না, নিয়াজ যা কিছু করুক, ওর মা সব জানে। নিয়াজ সব সত্য কথা ওর মায়ের সাথে বলে। তোর সম্পর্কে সব কথা ওর মা জানতো। তুই যে বড়লোকদের মেয়ে, তোর বাবা বড় অফিসার সব জানত নিয়াজের মা। তোকে নিয়ে আসছে, সেটাও জানতো। পরে তোর শশুরকে জানায়। আর এ কারনেই সবাই তোকে এতো ভালোবাসে।ওদের বাড়ির মধ্যে তোর শশুর একটু ভালো মানুষ তবে তোর শাশুড়ির উপর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। তোর বাবার অনেক সম্পত্তি আছে বলেই নিয়াজ তোকে বিয়ে করেছে। আর তোর শাশুড়ি সব মেনে নিয়েছে।
আমি এতোটাই ভেঙ্গে পড়েছি যে চোখে ঝাপসা দেখছি। মাথা ঘুরে উঠলো, পায়ের নিচে মাটি মনে হচ্ছে সরে যাচ্ছে।
– চাচি, আমি এখন কি করবো?
– শোন তুই যাতে তোর ভবিষ্যতটা ঠিক করতে পারিস তাই তোকে আজ এগুলো বললাম। যে করেই হোক তোকে পড়তে হবে। এখন সব সহ্য কর, চুপ চাপ থাক । তবে যেভাবেই হোক নিয়াজকে বুঝিয়ে পড়াশোনা শুরু করবি। তবে এখন ধর্য্য ধর। সময় আসুক তখন তুই অবশ্যই আবার পড়া শুরু করবি। এখন তোর বাবুটা যেন সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসে, সেদিকে খেয়াল রাখ।
নিয়াজ এভাবে ধোঁকা দিবে, তা ভাবতেও পারিনি। পৃথিবী কেমন যেন ধূসর লাগছে। আমার চতুর্দিকে সব শেষ। ভালোবাসা বলতে মনে হচ্ছে, এমন একটা বিষাক্ত সাপ। যা আমাকে দংশন করে, তিলে তিলে শেষ করে ফেলছে।
#সিরাজুম_মনিরা