ধূসর ভালোবাসা পর্ব-১৩

0
808

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব -১৩

জীবন এক বিচিত্র জায়গা, এখানে প্রতিটা মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার পেছনে থাকে হাজারো অপূর্ণতার হা-হা কারের গল্প। অনেক সময়ই এই অপূর্ণতার গল্প গুলো অধিকাংশই প্রকাশ পায় না, অ প্রকাশিত রয়ে যায়। সময়ের অতলে তলিয়ে যায়। গল্প গুলোকে যে বহন করে, যন্ত্রনা গুলোকে সেই বহন করে আমৃত্যূ।

একদিন রাতে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো, রাতেই নিয়াজ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সারারাত প্রচন্ড কষ্টে পার হলো। সকালে আযানের কিছু পরে আমার কোল জুড়ে আসলো আমার নয়নের মনি, চাঁদের টুকরো একটা মেয়ে। তাকে হাতে নিয়ে মনে হলো যে, আমার চেয়ে সুখি আর কেউ নেই। আমার নিজেকে তখন খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিল।

আমার শাশুড়ি, আমার মেয়ের মুখ দেখলেন না। বললেন,

– মেয়ে হয়েছে, দেখার কি আছে।

ভেবেছিলাম নিয়াজও তাই বলবে, কিন্তু আমার ধারনা ভুল প্রমানিত করে, নিয়াজ তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে আটখানা হয়ে গেলো। সন্তানের কানে আযান দিল। আর সবাইকে বলল,

– আমার ঘরে ছোট্ট একটা পরি আসছে। সবাই দোয়া করে আমার পরিটার জন্য। মিষ্টি এনে পুরো হাসপাতালের সবাইকে খাওয়ালো।

নিয়াজ আমার মাতৃত্বকালীন সময়ে খুব সেবা করেছে, খুব ভালোবেসেছে। আবার অবহেলাও করেছে বর্ননা-তীত। এমন অনেক কিছু আমি বুঝতে পেরেছি, জানতে পেরেছি, যা কখনো কল্পনাও করিনি।

তবে আজ নিয়াজের অন্য রুপ। সে আজ বাবা। তার চোখে মুখে আজ বাবা হবার খুশি। আমি নিয়াজকে আর চিনতে পারিনা। যখন ভালোবাসে, পুরো পৃথিবী উজাড় করে ভালোবাসে। আবার ….

আমার কাছে এসে, আমার হাত দুটো ধরে, কপালে একটা আদর দিয়ে বলল,

– ধন্যবাদ, এমন চাঁদের টুকরো মেয়ে উপহার দেবার জন্য। খুব কষ্ট হচ্ছে?

নিয়াজের হাতটা শক্ত করে ধরেছিলাম। আমি এভাবে ঠিক এই নিয়াজ-টাকে নিয়ে পুরো জীবন পার করতে চাই। এই নিয়াজ-টাকে নিয়ে সব কষ্ট ভুলে, সুখের ভেলায়, বড় বড় দুংখ আমি খুশি মনে পাড়ি দিতে পারি।

নিয়াজ কেন বুঝে না, আমি তাকে কতটা ভালোবাসি। তার ভালোবাসার আগুনে পুড়তে চেয়ে, অনেক গুলো চাদনী রাত আমি চোখের পানিতে কাটিয়েছি। কিন্তু নিয়াজ আমাকে কষ্টের অনলে পুড়িয়ে অঙ্গার করেছে। তবুও তো আমি নিয়াজকে ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না এখন।

জীবনের বহু কথাই আর এই ডায়রিতে লিখতে মন চায় না। কারন জীবন নিয়ে যা ভেবেছিলাম, যেমন টা করে আমার জীবনের গল্প গুলো লিখতে চেয়েছিলাম, তা লেখার মত কলমের কালি আমার জীবনের কোথাও আর নেই। সব কলমের কালির রঙ আজ ধূসর প্রায়।

এখন আমার জীবনের সব পাওয়া আমার মেয়ে, অবন্তি। সে হাসলে আমি হাসি, সে কাঁদলে আমিও কাঁদি। তার চাওয়াই আমার চাওয়া। আমার জীবনটাকে আমি তার মাঝেই দেখি, তার সকল আবদার এখন আমার চলার পথের পাথেয়।

অবন্তি নামটা আমার রাখা, নিয়াজ অন্য কিছু রাখতে চাইলেও পরে আমার নামটাই পছন্দ করেছে। এখন আমার সময় নাই, চিন্তা করার, মন খারাপ করার। আজ সারাক্ষনের পুতুল আমার মেয়ে।

মেয়ের বয়স ছয় মাস, তখন বাবার বাসায় বেড়াতে আসতে দিল নিয়াজ। মেয়ে হবার পর নিয়াজের মাঝে বেশ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। উপর ওয়ালা যেন সত্যি নিয়াজের সৎ বুদ্ধি দেন।

অনেক দিন পর নিজেদের মানুষের মাঝে এসে মনে হচ্ছে একটু প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। বহুদিন পর ভাইয়ের সাথে দেখা। সবাই মিলে আড্ডা গল্প। সেই আগের মতো করে কিছুটা দিন কাটল। ভাইয়ের ডাক্তারি পড়া শেষের দিকে।
ভাই বললেন,

– আফিফা, আমার ইচ্ছা তুই আবার পড়া শুরু কর।

– কিন্তু ভাইয়া।

– কোন কিন্তু নয়, তুই আবার ভর্তি হবি। আমি নিজে তোকে ভর্তি করাবো।

আমি ভাইয়ার উপর দিয়ে কোন কথা বলতে পারলাম না। পরের দিন আমার সেই আগের কলেজে, আমি আর ভাই। ভাই আমাকে অনার্সে ভর্তি করালেন, একাউন্টিং এ।

খুব ভালো লাগছিল নতুন করে জীবন শুরু করতে পেরে, আবার ভয় লাগছিলো, নিয়াজ জানতে পেরে কিনা কি বলে?

কয়েকদিন পরেই নিয়াজ চলে আসলো আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। কয়েকদিন পর মেয়েকে দেখে নিয়াজ কেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলো। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে।

বাবা আর ভাই এটা দেখে হেসে ফেলেছেন। বাবা বললেন,

– নিজের মেয়ের বয়স কয়েক মাস তাতেই না দেখতে পেয়ে তোমার এ অবস্থা। তাহলে আমার মেয়েকে এতোদিন পর দেখছি, আমার কি অবস্থা?

নিয়াজ খুব লজ্জা পেয়েছে। বাবা মায়ের কাছে নিয়াজ খুব ভালো ছেলে কারন বড় দেরকে খুব সন্মান দিয়ে কথা বলে। আর মিষ্টি কথার জুড়ি নাই নিয়াজের।

ভাই নিয়াজকে ডেকে বললেন,

– নিয়াজ আমি গতকাল আফিফাকে অনার্সে ভর্তি করে দিয়েছি। কলেজের বড় আপার সাথে কথা বলেছি, ক্লাস না করলেও চলবে। কিন্তু সঠিক সময় পরীক্ষা দিতে নিয়ে আসবা তুমি।

– ঠিক আছে ভাইয়া।

নিয়াজের মন আজ খুব ভালো। আমার শশুর বাড়িতে থেকে নিয়াজ আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারে না। বাহিরে গেলে বাসার সবাইকে নিয়ে যেতে হয় তাই। নিয়াজ আমাকে ডেকে বলল,

– চলো তুমি আর আমি বাহিরে থেকে ঘুরে আসি।

– চলো।

আজ আমার খুব খুব ভালো লাগছে। নিয়াজ আর আমি আজ অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার পড়া নিয়ে নিয়াজ কোন কথা বলেনি। আমার সামনে অন্য এক নিয়াজ। অনেক কেনাকাটা করেছে নিয়াজ, আমার জন্যে, অবন্তির জন্যে।

নিয়াজ বলল যে, নিয়াজ দের বাসায় যেন বলি যে এগুলো আমার বাবা কিনে দিয়েছে। আমি হাসলাম আর মাথা নাড়ালাম।

পরদিন আবার দিনাজপুরে ফিরে এলাম, আবার পুরোনো জীবন। আসার সময় বাবা মা অনেক কিছু সাথে করে পাঠালেন। প্রথম নাতনী তাই সোনার চেন, চুড়ি আর বাবুর প্রয়োজনীয় সব কিছু। আমার শাশুড়ি আর শিরিন খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখলেন। পছন্দ না হলে কথা শুনাতেন, যেহেতু পছন্দ হয়েছে তাই চুপ করে থাকলেন। তবে বাবার কিনে দেয়া ও নিয়াজের কিনে দেয়া বেশ কয়েকটা শাড়ি থেকে দুটো শাড়ি শিরিন হাতে তুলে নিয়ে বলল,

– এগুলো আমার পছন্দ হয়েছে, আমি নিলাম।

আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, তাছাড়া আমার আর কিছুই করার নাই।

নিয়াজ এটা শুনে খুব রেগে গেলো, আমি তাকে শান্ত করে বললাম, এগুলো আমার সয়ে গেছে। শুধু তুমি আমার কাছে থাকো তাহলেই হবে।

অবন্তি আমার শাশুড়ি ননদের আদর খুব কম পেয়েছে। অবন্তি হবার পর থেকে আমার শাশুড়ির আর আগের মতো আমাকে ভালোবাসে না। এতে যে আমার ননদের সম্পুর্ণ হাত তা আমি খুব বুঝতে পারি। কারন আমি নিজে কানে বহু দিন আমার ননদকে আমার নামে কান ভাঙ্গাতে দিতে শুনেছি, আমার শাশুড়ি ও শশুরকে। আর আমার শশুর শাশুড়ির তাদের মেয়েকেই বেশি বিশ্বাস করলেন। এসব নিয়ে আমি আর ভাবিনা।

অবন্তির বয়স ৯ মাস, হঠাৎ আমার শশুর এসে নিয়াজকে খুব বকাবকি করতে শুরু করল, কারন অফিস থেকে মোটা অংকের টাকা নাই। আর সে টাকাটা নাকি নিয়াজের দায়িত্ব ছিল। বাবা ছেলের কথা কাটাকাটি চরম পর্যায়ে চলে গেল। এক পর্যায়ে নিয়াজ রাগ করে আমার হাত ধরে বলল, চলো এখানে আর না। যারা আমাকে চোর প্রমাণিত করতে চায়, তাদের মাঝে আর না।

আমার মন কিছুতেই চাইছিল না যে বাড়ি ছাড়ি। কিন্তু নিয়াজ আমার কোন কথাই শুনল না। অবশেষে অবন্তিকে নিয়ে নিয়াজের হাত ধরে শশুর বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here