ধূসর ভালোবাসা পর্ব-১৪

0
834

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব -১৪

নিয়াজ আমাদের নিয়ে আমার মায়ের বাসায় চলে আসলো। বাবা মা সব কথা শুনে, নিয়াজকে খুব করে বোঝালেন। যেন নিয়াজ তার বাবার উপর রাজ না করে। কিন্তু নিয়াজ প্রচন্ড রেগে আছে ওর বাবার উপর। নিয়াজ জেদ ধরে বসে আছে যে নিজেই ব্যবসা করবে। এর পর নিয়াজ নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিল। বাবা নিয়াজকে আশ্বস্ত করলো যে, ব্যবসার যা টাকা লাগবে বাবা দিবে।

নিয়াজ নতুন উদ্যমে ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য কাজ শুরু করলো। যেহেতু খুব ছোট থেকেই সে তার বাবার ব্যাবসা দেখা শোনা করে তাই ব্যবসার সাথে জড়িত সবার সাথেই নিয়াজের সম্পর্ক ভালো এবং ব্যবসার সব নিয়ম নিয়াজের নখদর্পনে।

বেশ কিছুদিন সময় লাগলো, তবে মোটামোটি সব কিছু ঠিক হয়ে এসেছে। নিয়াজ বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করেছে। বাবা পুরো বাড়ি সাজিয়ে দিলেন।

শুরু হলো আমার সংসার, আমার নিজের। সব কিছু নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছি। ছোট্ট সংসারে আমার স্বপ্ন অজস্র। নিয়াজের ভালোবাসা এ সংসারের প্রধান খুঁটি। নিয়াজ আগের চেয়ে অনেক পাল্টে গেছে। এখন তার পুরোটা জুড়েই আমি। এতোদিনে মনে হচ্ছে, আমার ধৈর্য্যের মূল্য পেয়েছি। আমার সংসার, আমার অবন্তি আর নিয়াজের ভালোবাসা এই নিয়ে খুব ভালো আছি আমি।

প্রায় রোজ বিকেলে বাবার ওখানে যেতে হয় নইলে বাবা অস্থির হয়ে যায় অবন্তির জন্যে। দিন গুলো আমার আবার আগের মতো খুব ভালো কাটছে। আমি মাঝে মাঝে কলেজে যাই, নিয়াজ তেমন আর কিছু বলে না। অবন্তিকে মায়ের কাছে রেখে চলে যাই কলেজে।

নিয়াজ আমাকে নিয়ে এখন প্রায় বেড়াতে যায়, পছন্দ মতো অনেক কিছু কিনে দেয়। আগের থেকে বেশ পাল্টে গেছে নিয়াজ।

ফার্ষ্ট ইয়ার পরীক্ষা হয়ে গেলো। বেশ ভালো হলো পরীক্ষা। নিয়াজের ব্যবসাও এখন বেশ ভালো চলছে। এভাবে কেটে গেলো বেশকিছু দিন।

আমার নিজের সংসারের বয়স সাত মাস। আমার শাশুড়ি এসেছেন, উনি এসেছেন তাই খুব খুশি হয়েছি আমি। উনি খুটিয়ে খুটিয়ে আমার সংসার দেখলেন। খুশি হলেন বলে মনে হলো না। নিয়াজ বাসায় আশার পর থেকে, আমার শাশুড়ি নিয়াজকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য জোর দিতে লাগলেন। নিয়াজ রাজি না হওয়ায়, তিনি কয়েকদিন রয়ে গেলেন। আমার শাশুড়ি সারাদিন আমার কাজের খুঁত ধরতে থাকেন, আর নিয়াজ বাড়িতে আসলে সেগুলো নিয়াজকে বলতেন। ধিরে ধিরে নিয়াজ ও কেমন যেন বিরক্ত হতে শুরু করলো আমার উপর।

আমার শাশুড়ি চলে গেলে, নিয়াজ আবার আগের মতো হয়ে গেলো। আবার আগের মতোই আমাকে নিয়ে ভালো করে চলতে শুরু করলো।

এর পর থেকে আমার শাশুড়ি দেবর ননদ আমাদের বাসায় প্রায় আসতে শুরু করলেন। তবে খেয়াল করলাম যে আমার শাশুড়ি দেবর, এরা বাসায় আসলে। নিয়াজ কেমন পাল্টে যায়। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। অবন্তির সাথেও ভালো ব্যবহার করে না।

আবার শশুর বাড়ির লোকজন চলে গেলে কিছুদিন পর থেকে আবার আগের নিয়াজের মতো ব্যবহার করে।

আমি থার্ড ইয়ারে উঠার পর ভাইয়া আসলেন বাসায়। বাবা মা, ভাইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রি দেখছেন। ভাইয়ের কথা হলো, আগে বাবা মাকে ঢাকায় নিয়ে যাবেন। তারপর বিয়ে করবেন।
বাবা জানালেন যে,

– আমি বগুড়ায় বাড়ি করে বগুড়াতেই থাকবো বাপ।

ভাইয়া বললেন,

– বাবা সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ঢাকায় তোমরা আমার সাথে কিছুদিন থাকবা তারপর তোমরা অন্য-কোথাও যাবে।

বাবা বেশ কিছুক্ষন ভেবে রাজি হলেন, আর বললেন,

– ঠিক আছে, তবে আমরা ঢাকায় যাবার পরই তোমার বিয়ে দেবো।

– আচ্ছা বাবা, আগে চলো।

আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। বাবা মা ঢাকায় চলে গেলে, আমি একা হয়ে যাবো।

আমার অনার্স ফাইনাল এর পর বাবা মা ঢাকায় চলে গেলো। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। পুরো পৃথিবী আমার শূন্য হয়ে গেলো। বাবা মা কাছে ছিল, অন্য রকম শান্তিতে ছিলাম। চাইলেই ছুটে আসতাম মায়ের কাছে। সব সমস্যা বাবা এক মূহুর্তে সমাধান করে দিতো।

সবচেয়ে কষ্ট পেলো অবন্তি, কারন অবন্তিকে আমার ছোট বোন ইরা খুব আদর করে, সারা-ক্ষন আগলিয়ে রাখতো। অবন্তি প্রায় ইরার জন্য খুব কান্না কাটি করে।

নিয়াজ এখন মাঝে মাঝেই দিনাজপুরে যায়। নিয়াজ ওর বাবার বাসায় যায়, আর সেখান থেকে আসার পর আমার সব কাজে সব কথায় ভুল ধরতে শুরু করে।

নিয়াজ একদিন এসে বললো,
-চলো আমরা আব্বা মায়ের ওখানে অর্থাৎ দিনাজপুরে চলে যাই।

আমার ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেলো। আমার শাশুড়ি কয়েকদিন এসে থাকলেই, নিয়াজ কেমন অন্য রকম হয়ে যায়। আমাকে সহ্য করতে পারে না। আর যদি আমি ওদের বাসায় চলে যাই তাহলে হয়ত আমার সংসার আর হবে না।

সাথে সাথে আমি নিয়াজকে বলি যে,
– আমি দিনাজপুরে যাবো না।

নিয়াজের সাথে এটা নিয়ে আমার বেশ বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে নিয়াজ আমার গালে চড় দেয়। আমি রেগে গিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে, নিয়াজ মাফ চেয়ে নেয়। এবং বাড়িতে নেবার কথা আর বলে না।

তবে সে নিজে দিনাজপুরে প্রায়ই যায়। আমি কখনও বাঁধা দেইনি। বরং সব সময় বলেছি, বাবা মায়ের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করতে।

নিয়াজের ব্যবসা এখন একদম সফল হয়ে গেছে। ছোট বাড়ি থেকে আমরা একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিলাম। আমাদের জীবন যাপন আগের থেকে অনেক পাল্টে গেলো। নিয়াজ এখন খুব ব্যস্ত সময় পার করে। এখন সে সব সময় তার ব্যবসা নিয়েই থাকে। আর আমি ও অবন্তি থাকি আমাদের জগতে।

হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, নিয়াজের গায়ে সেই আগের সেই সুগন্ধ। আমি চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

– নিয়াজ তুমি ড্রিংক করেছো?

নিয়াজ হেসে বলল,

– ঢাকা থেকে ক্লাইন্ট এসেছে। তাদের সাথে একটু খেতে হয়ে আফিফা, নইলে খারাপ দেখায়।

আমি খুব কেঁদেছি সারারাত, নিয়াজ কথা দিয়েছে আর কখনো সে এসব খাবে না।

অবন্তি এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। আমার মাষ্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা সামনে, কিন্তু অবন্তিকে কোথায় রেখে আমি পরীক্ষা দিবো, সেই চিন্তায় মন খারাপ।
নিয়াজকে বললাম,

– আমার পরীক্ষার সময়টা তুমি অবন্তিকে তোমার কাছে রেখো।

– আমি পারবো না, আর মাস্টার্স পরীক্ষা তোমার দেয়া হবে না। তোমার এতো পড়ার কোন দরকার নাই।

– কেন তুমি এমন করে বলছো, সামনে আমার পরীক্ষা।

এটা বলার সাথে সাথে নিয়াজ আমার গালে একটা চড় দিলো, আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। বলল,

-একবার বললে বোঝা যায় না, পড়া হবে না মানে হবে না।

তবে নিয়াজ দিনে দিনে কেমন পাল্টাতে শুরু করলো। রাতে অনেক দেরি করে ফিরতে শুরু করলো, প্রায়ই ড্রিংক করতে শুরু করলো। এখন নিয়াজ আর আমার কথা শুনতে চায় না। সে অনেক পাল্টাতে শুরু করেছে।

দিনাজপুরে যাবার পরিমান এখন খুব বেশি হয়ে গেছে, ব্যবসাতে লস হতে শুরু করছে। এরপর নিয়াজ দিনাজপুরে কম যেতো। তবে রংপুরে ওর বেশ কিছু বন্ধু তৈরি হলো যাদের দেখলে কেমন খারাপ মানুষ মনে হয়। তাদের সাথেই নিয়াজের এখন বেশি মেলা মেশা। কিছু বলতে গেলেই, নিয়াজ গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হয়, তাই আমি এখন মুখ বুজে অনেক কিছুই সহ্য করি।

বেশ কয়েকবার ঢাকায় বাবার বাসায় চলে গেছিলাম রাগ করে, কিন্তু কয়েকদিন পরেই নিয়াজ গিয়ে বাবা মাকে বলেছে যে, সে আর ভুল কিছু করবে না, ভালো ভাবে চলবে। কি আর করা আবার নিয়াজকে বিশ্বাস করে চলে এসেছি। তবে প্রতি বারই ধোকার সম্মুখীন হয়েছি।

আমার সংসারে আরেক অতিথী চলে আসলো, আমার আরেক নয়নের মনি। আমার দিত্বীয় সন্তান, আমার ছেলে, আবীর।

অবন্তি এখন স্কুলে পড়ে। অবন্তি আর আবীরকে নিয়ে আমার সুখের সংসার। কিন্তু নিয়াজ, সে আবার কেমন যেন হতে শুরু করেছে।

এখন অনেকের মুখেই নিয়াজ সম্পর্কে অনেক উল্টো পাল্টা কথা শুনতে থাকি। কিন্তু নিয়াজ কোন কথাই স্বিকার করে না।

ছেলে মেয়েরা এখন বড় হচ্ছে। নিয়াজের ব্যবসা এখন বিশাল বড়। নিয়াজের এখন অনেক টাকা, সে এখন একেবারে বেপরোয়া একজন মানুষ।

আমি বহু বুঝাই সারাক্ষন, কিন্তু নিয়াজ এখন চরম বেপরোয়া। তার আগের সব রকম নেশাই সে করছে এবং তা প্রকাশ্য। ছেলে মেয়ে বড় হয়েগেছে বলে আমি চুপচাপ অনেক কিছুই সহ্য করছি। কিন্তু আর কত। বাবা মায়ের বেশ বয়স হয়ে গেছে, তাদেরকে আর কত বলবো। উনারাও ক্লান্ত নিয়াজের কান্ড-কারখানা দেখে।

তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়, আমার শাশুড়ি আসলে, ইনি আমাদের কোন ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না। সংসারে উন্নতিও না কিংবা ব্যবসার উন্নতিও না। লোক মুখে শুনতে পাই, আবার নিয়াজও মাঝে মাঝে বলে যে, মা অনেক টাকা নিয়ে গেছে। উনি প্রায় এ কাজটা করেন। টাকা না দিলেই কান্না কাটি করেন, অভিশাপ দেন। ইত্যাদি।

একদিন এমন হলো, যে খবর আসলো নিয়াজের বাবা মারা গেছে। আমার মনে কেমন সন্দেহ হলো যে মিথ্যে কথা। নিয়াজ কান্না কাটি করতে শুরু করলো। আমি বললাম,
– তুমি গিয়ে আগে দেখো, উনি কেমন আছে। তারপর আমি যাবো।

– কেন, তুমিতো শুনতে পেলে না?বাবা মারা গেছে, আর কি শুনতে হবে?

– তুমি যাও, আমি পরে আসবো।

নিয়াজ রাগ করে চলে গেলো। সাথে কয়েকটা কর্মচারিকে নিয়ে গেলো। আমি সাথের লোক গুলোকে বললাম যেন আমাকে কি হচ্ছে তার খবর দেয়।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here