ধূসর ভালোবাসা পর্ব-১৭

0
932

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-১৭

জীবনে এতোটা পথ পার করে আমি ক্লান্ত, প্রতিটা মুহুর্ত আমি আমার হিসেব মিলাই, যার ফলাফল শুধু শূন্যের কোঠায়। প্রতিটা নতুন দিনের সূর্য মানুষকে আগামীদিনের সন্ধান দেয়, কিন্তু আমি খুঁজে পাই আমার আটপৌডে পুরোনো জীবন। নতুন যে পথে চলছি, বাঁকে বাঁকে রঙ্গীন ছায়ার হাতছানি। এই রঙ্গীন পৃথিবীতে আমি বুঝি বেমানান। আমি পুরোনোকে বুকে ধরে রঙ্গীন জীবনে ছায়া মাড়িয়ে নতুনত্বের সুভ্র সকাল দেখতে চাই।

সন্তানদের বেড়ে ওঠা দেখা, আমার জীবনের সবচেয়ে মনোরম দৃশ্য। ওরা স্ব স্ব স্থানে সাফল্যের সাথে বেড়ে উঠছে। সবচেয়ে বড় পাওয়া ওরা আমাকে বোঝে। বাবার দেয়া কষ্ট গুলো আমার সন্তানেরা বুকে লালন করে তবে ধারন করে না। ওদের কষ্টকে ওরা শক্তিতে রুপান্তরিত করেছে। এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের একজন যোদ্ধা মায়ের সন্তান হিসেবে তৈরী করছে, এবং সকল প্রতিকূলতায় ওরা নির্ভয়ে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।

যদিও আমি কখনই ওদের বুঝতে দেই না যে আমি তাদের প্রতি কতটা সন্তষ্ট। আমি ওদেরকে বহুদিন বুক ভরা আদর করিনি। কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরিনি। ভয় করে আমার যদি ওরা আমার দূর্বলতা বুঝে যায়। যদি ওদের বুকের আগুন ঠান্ডা হয়ে যায় আর বাবার মতো ভুল পথে হাটে।

বহুদিন মন খুলে ওদের সামনে কথা বলতে পারিনা, খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু পরোক্ষনেই……
আমার সন্তানেরা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ওরাই আমার সমস্ত কিছু। আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন।

অবন্তি অনেক কঠিন ও সাহসি মেয়ে। আমি জানি, যে কোন কঠিন পরিস্থিতি সে সামলে নিতে পারে তবে আবীর খুব তীক্ষ্ণ মেধা সমপন্ন হলেও মেধার সঠিক ব্যবহার এখনো শিখতে পারেনি। তবে সেও খুব ভালো মানুষ। দিনশেষে আমার শান্তি এটাই যে, আমি দুটো সুন্দর মনের মানুষের মা। ওরা অন্যের কোন কিছুতেই লোভ করে না। আমার সন্তানেরা কুটিল নয়, ওরা সহজ সরল মনের মানুষ। এ পর্যন্ত আমার সন্তানেরা আমার মনের মতো করেই বড়ো হচ্ছে। বাকিটা জানিনা।

বহুদিন পর নিয়াজের মা ফোনদিয়েছে, কাল নিয়াজের বিয়ে। নিয়াজ পারবে বিয়ে করতে? সেতো আমি চলে আসার পরও দিব্যি তার দৈনন্দিন জীবনের সব অভ্যেস আয়েস করেই পালন করেছে। আমি যে তার প্রতিক্ষায় পথ চেয়েই রয়েছিলাম। আমিতো এক মুহুর্ত নিয়াজকে ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। শুধু এই জীবন নয় পরকালের জন্যেও আমি নিয়াজের পথ অনুসারী হতে চাই।

তুমি কিভাবে আমাদের সেই স্বর্নালী দিন গুলো ভুলে গেলে। আমাদের বাসর, জীবনের শুরু। আমাদের প্রথম সন্তান অবন্তি, তার প্রথম আগমনের খবর। আমাদের প্রথম সংসার, সেসব দিনে কত স্বপ্ন দেখেছি আমরা একই সাথে। দুইজোড়া আলাদা চোখে একই স্বপ্ন থাকতো। আমরা আগামীর দিন গুলোর ছায়া বুনেছিলাম, আমাদের স্বপ্নলোকে। আমরা সেই সব দিন গুলো হাতে হাত রেখে পার করেছি, যখন তোমার খুব অভাব ছিল। আমি কখনও তোমার হাত ছাড়ার কথা ঐ দিন গুলোনে একবারও ভাবিনি। কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি, তুমি আসলে আমার হাত কখনই ধরোনি। তুমি সময়ের প্রয়োজনে আমার পাশে ছিলে।

তুমি একদিন নেশার ঘোরে আমাকে বলেছিলে, যে জীবনে বহু মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমিই নাকি প্রথম মেয়ে যে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করি। আর তাই তুমি জেদের বসে আমার পিছে পড়েছো। এর পর দিনে দিনে আমি যত প্রত্যাখ্যান করেছি, তুমি ততই নাকি আমার প্রতি আসক্ত হয়েছো। নইলে কাউকে বেশি দিন তোমার ভালোলাগে না। এরপর, আমার বাবার অনেক টাকা, এটা জানতে পেরে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছো। বাবা প্রত্যাখ্যান করলে, আবারও জেদের বশোবর্তি হয়ে রফিককে টাকা দিয়ে কিনেছিলে। যাতে তোমাকে সাহায্য করে। আর সে কারনেই রফিক আমার বাবার এতো কাছে আসে, আর আমাকে বাসা থেকে বের করে আনতে সাহায্য করে তোমাকে। তুমি এতো কিছু করেছো জেদের বশবর্তি হয়ে, আর তারপর করেছো লোভে আবার জেদের কারনে। কিন্তু বিয়ের পর তুমি নাকি সত্যিই আমার প্রতি খুব দূর্বল হয়ে পড়েছিলে। আমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছিলে। সবই আমি চুপচাপ শুনেছিলাম। কারন শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে ভালোবাসো এটা জেনে। কিন্তু তুমি কি সেদিনও নেশা গ্রস্থ অবস্থায় মিথ্যে বলেছিলে?
শুনেছি নেশা করে মানুষ সত্য বলে কিন্তু তুমি?

তুমি প্রতিবার তোমার ভালোবাসায় রক্তাত্ব করবার পর মাফ চেয়ে নিতে, আর বলতে ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও। আর এমনটা করবো না।

কিন্তু তুমি হয়ত কোন দিন কল্পনাও করতে পারবে না, যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। আমি তোমাকে সত্যি মাফ করে দিয়েছি, সেই দিনগুলোত। আমার জীবনে সর্ব প্রথম পুরুষ তুমি ছিলে, আজো তাই আছো সর্ব শেষ হিসেবে। আমি আমার নিজের থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি, বিশ্বাস করো আমি আজও তোমাকে ততটাই ভালোবাসি। জীবনে কতটা রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, এখনও আমি তোমাকে সেই প্রথম দিন যেমন ভালোবাসতাম, আজও তেমনই আমার অনুভূতি।

জানো ঐ দিন গুলোতে তুমি অনেক কষ্ট দিয়েছো, খুব। কিন্তু প্রতিটা মূহুর্ত আমার এই আশাতেই কাটতো, যে তুমি একদিন না একদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবা এবং তুমি আমার কাছে একজন ভালো মানুষ হিসেবে ফিরে আসবে। সে কারনেই তোমার অনেক অত্যাচার মুখ বন্ধ করে সহ্য করেছি। তোমাকে ছেড়ে আসার ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু তুমি আমাকে বাধ্য করেছো।

জানো যেদিন তুমি আমার স্বপ্ন ভেঙ্গেছিলে, অর্থাৎ ডাক্তারি পড়তে দেওনি, সেদিন আমার যার পরনাই কষ্ট হয়েছিল। একবার ভেবেছিলাম, তোমার সাথে আর নয়। কিন্তু মা বলেছিল, মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়, কষ্ট হলেও আমাকে এখানে কষ্ট সহ্য করেই থাকতে হবে। আমি সেই কথাটাকে নিয়তির লেখা ভেবে, তোমার সব অক্ষমতা ও বদঅভ্যাসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি।

আমি কখনই দুংখ কষ্ট দেখে মানুষ হইনি, কিন্তু তোমার সাথে পথ চলার সময়টাতে আমি কষ্ট ব্যাতীত সুখ ও আনন্দের মুখ খুব কম দেখেছি। তবুও অভিযোগ করিনি।

জানো আজ একা, আমি বড় একা। আমার প্রতিটা সময় কাটে তোমার কথা ভেবে। তুমি আমার পাশে নেই তবুও আছো আমার মনের গহিনে। যেখানে তোমার কোন আত্নীয় এসে তোমাকে কানপডা দিতে পারবে না।

জানো আসার সময় তোমার একটা স্মার্ট আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি, রোজ তোমার ঘ্রান নেই। কেন তুমি এমন পশুর মতো হয়ে গেলে। কেন? পাল্টে গেলে এতোটাই, যেখান থেকে চাইলেই আর ফিরে আশা যায় না।

আমার স্বপ্ন ছিলো, শেষ বয়সে তোমার পাশে পাশে হাঁটবো। তোমায় সেই কথা গুলো শেষ বয়সে বলবো, যা আজীবন বলি বলি করে বলতে পারিনি। শেষ জীবনে আমার পাওয়া না পাওয়া নিয়ে হিসেব মেলাবো, খুনসুটি করবো, কই আর হলো?

বেহিসেবী তোমার জীবনে আমার হিসেব মেলানো আর হলো না। তোমাকে হাযারো আপন করতে চেয়ে, ব্যর্থ হয়ে ঘর ছাড়তে হলো জীবনের অবেলায়। এটা আমার কাম্য ছিলনা মোটেও। তুমি বাধ্য করেছিলে।

একটি বার কি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছো, তোমার নিজেকে। কি পেয়েছো তোমার নিজের জীবন থেকে? কি পেলে আজীবন আমায় কষ্ট দিয়ে? খুব কি সুখ পেয়েছো তুমি আমায় কষ্ট দিয়ে?

জানি আর কখনো তুমি আমার হবে না, এখন থেকে তুমি অন্যের। অন্যের সাথে বেধে ঘর সত্যিই আমায় করতে পর করতে পারবে? আর কখনও কি কোন দিন, কোন আলোর ফাঁকে আমার নামের ছায়া তোমার মনের আকাশে উকি দিবে?

আমার তিলে তিলে গড়া সংসারের প্রতিটি ভাজে আমার স্পর্শ, সেখানে অন্যের আবাস। এটা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানো।

কষ্টটা এতো বেশি হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে আমি বুঝি আর বাচবো না। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে। মাথার মধ্যে সব কিছু ছিডে যাচ্ছে।

যেদিন তোমার হাত ধরে তোমার জীবনে এসেছিলাম, বউ হয়ে। সেদিন অনেক দ্বীধা দ্বন্দের মাঝেও তোমায় নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলাম। বুঝিনি কত বড় ভুল স্বপ্ন দেখেছিলাম সেদিন।

একটা কথা লিখে রাখলাম। যদি আমি তোমার আগে মারা যাই, তুমি আমার মুখ দেখবে না। মাটিও দেবে না। আর আমার আগে তুমি চলে গেলে তোমার মুখ আমিও দেখবো না। কারন অধিকারের সম্পর্ক, তোমার দিত্বীয় বিয়ে করার সাথে সাথেই শেষ। যেখানে অধিকার নেই, সেখানে আবেগের কিউবা মূল্য।

জানো, আমার অনেক স্বপ্ন ছেলে মেয়ের বিয়ে নিয়ে। আমি তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, আর তুমি বুঝি নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই ফুরসত পাও না।

তোমার আর আমার মনের বহু পার্থক্য, তবুও আমরা ভালোবেসেছিলাম একে অপরকে। ঘর বেধেছিলাম। যদিওবা তুমি হওনি কখনই আমার আপন, কিংবা সম ব্যাথায় ব্যাথিত। কিন্তু আমি তোমাকে সবসময় বোঝার চেষ্টা করেছি জানো? সব সময় নিজেকে তোমার মতো করে তৈরী করেছি। জানিনা কতটা পেরেছিলাম, কেনইবা সব হারালাম। কেনইবা তোমার পথে পায়ে পা মিলিয়ে হাটতে পারলাম না। আসলে তোমার পথ হয়ত চিরদিনই ছিল বাঁকা, বন্ধুর।

তবুও তোমায় ভালোবেসে ছিলাম, সবটুকু সত্তা দিয়ে। ব্যর্থতা তবুও…… হয়ত তোমার…..নইলে আমার।

কি করে নিয়াজ, কি করে….

—————————–

মামনি তার ডায়রিতে আর কিছুই লিখতে পারেনি। এর পরেই মামনিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কারন মামনি এই শেষ কথা গুলো লেখার সময় ব্রেন স্ট্রক করে।

মামনির ডায়রি পড়ার পর, জীবনের নতুন করে উপলব্ধি করলাম। আমাদের জীবনে ভালবাসার মূল্য কতটা, কিভাবে? সত্যিই কি ভালোবাসা সবসময় এমন। হয়ত হ্যা কিংবা না। তবে মামনির জীবন হয়ত অনেকের থেকে আলাদা।

মামনি আগের থেকে একটু সুস্থ হয়েছে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে। মামনিকে আই সি ইউ থেকে কেবিনে দিয়েছে।

আমি নানী আর সানেকা খালা, আরো একটা সত্য জানি। যা কাউকে আমরা বলতে পারিনি। আর তা হলো, বাবা সত্যই বিয়ে করেছে। মামনি যেদিন স্ট্রক করে, তার পরের দিনই।

রংপুরে আমার স্কুল জীবন কেটেছে। সেখানে আমার অনেক বান্ধবী আছে। আছে একজন সুভাকাঙ্খী। তাদের কাছে আমি সব সঠিক খবর গুলো জানতে পারি।

বাবার বিয়ের খবর আমরা তিন জন ছাড়া কেউ জানেনা। কাউকে বলতে পারছি না। কারন বড় মামা আর ইরা খালামনি এমনিতেই বাবার উপর রেগে আছে। আবার এই খবরটা নিতে পারবে না, রেগে গিয়ে আবার কোন ঝামেলা করে ফেলতে পারে।

বাবা আজীবন আবীরকে খুব ভালোবেসেছে। আর আবীরও বাবাকে চরম ভালোবাসে। তাই বাবার বিয়ের খবরে আবীর খুব কষ্ট পাবে। ভেঙ্গে পড়বে।

মামনি যদি এখনই এই খবর পায়, হয়ত আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমনও হতে পারে, এ মুহুর্তে এই খবর মামনির বড় ক্ষতিও করে দিতে পারে।

আর আমার কথা বলতে গেলে, জীবনে এখন আমার চাওয়া পাওয়া অনেক কম। যেমন আছি, যা আছি বেশ আছি। আগে খুব কষ্ট পেতাম, এখন কষ্ট গুলোও আমাকে দেখে অবাক হয়। কারন আমাকে ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা কষ্টের নেই।

রংপুরে আমার যে শুভাকাঙ্খী, সে আমার অন্ধকার আকাশে এক ফালি চাঁদ। আমার হৃদয় বাগানে, হঠাৎ ফুটে ওঠা মূল্যবান গোলাপ। তবে সেও কখনও হারিয়ে যেতে পারে। এই ধারনা নিয়ে আমি তার সাথে পথ চলি। কারন হারিয়ে যাওয়া আমার জীবনের ধারা। পাওয়ার থেকে হারানোর সংখ্যা আমার জীবনে অনেক বেশি।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here