#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব – ১৮
আজকের সকালটা অন্য দিনের মতো নয়। একেবারেই ভিন্ন। সকালে এক পয়লা বৃষ্টি হয়ে গেলো। বৃষ্টিস্নাত সকালের প্রকৃতি অন্য রুপে সাজে। বাসার সামনের কৃষ্ণচুড়ার গাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। সকালের বৃষ্টির পর কৃষ্ণচুড়া ফুলের গায়ে রোদের আলো, ফুল গুলোতে মনে হচ্ছে মুক্তো পড়ে।
মামনির অসুস্থতায় পুরো পরিবার যেন স্থবির হয়ে পড়েছে। মামনি এখন আগের চেয়ে বেশ সুস্থ। কয়েকদিনের মধ্যেই রিলিজ দিয়ে দেবে।
আমার অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা কিছুদিন পরেই। কিন্তু পড়াশোনা করতেই পারিনি। মামনি বাড়ি ফিরলে তবেই পড়তে মন বসবে।
আবীর কিছুতেই আর বোর্ডিং এ যেতে চাইছে না। সে চায় বাসাতে থাকতে। কিন্তু কি করে বলি, মামনি ওর ভালোর জন্যেই, ওকে দূরে রেখেছে।
বড় মামা, ইরা খালামনি সবাই মামনির কাছে থাকছে সারাদিন। আমার আর নানীর মামনির সামনে গেলেই ভয় হচ্ছে। যদি ভুল করেও বলে ফেলি যে বাবা সত্যিই বিয়ে করেছে। মামনিকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। মামনির জীবন দেখলে ভালবাসার উপর ভরসা হারিয়ে যায়।
আমার জীবনে একজন খুব কাছের মানুষ আছে। সে ঠিক বাবার উল্টো, তবে ভয় করে যে বেলা শেষে যদি সেও আমার বাবার মতো হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস নিয়ে বুঝি মানুষ বাচেঁ। আমিও তাই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে। সে সব সময় আমাকে আগলিয়ে রাখে।
আমাদের শুরুটা হয়েছে বন্ধুত্ব দিয়ে, এই বন্ধুত্ব নিয়েই ছিলাম ইন্টার পরীক্ষা পর্যন্ত। কিছুদিন পরেই বুঝতে পারি সে আমার প্রতি দূর্বল, কিন্তু আমার মনের খবর পড়তে তার সময় লেগেছে দীর্ঘদিন। কারন একটাই, বিশ্বাস করার ক্ষমতা হারিয়েছি বহু আগে। তবে ধীরে ধীরে আমি তাকে পরখ করে দেখেছি, বর্তমানেও পরীক্ষার উপরেই আছে। তবে এটুকু সত্যি, আমাকে পাবার জন্য কিংবা আমার ভালোবাসা পাবার জন্য তার কোন জোর নেই। তার কথা সে আমাকে ভালবাসে। জরুরী নয় যে, আমারও একই অনুভূতি হবে। আমি চাইলে সে আমার পাশে, নইলে সে দূর থেকেই ভালবেসে যাবে। তবে এটাও সত্যি আমি কাউকেই মন থেকে বিশ্বাস করতে পারিনা। হয়ত তাকেও না। তবুও……….।
জীবনের অনেক বিপদ, অনেক দূরহ পথ পাড়ি দিয়েছি তার সাহসে। সে আমাকে সঠিক রাস্তা দেখায়, মনের দৃঢ়তা বাড়ায়। সে সবসময় আমার পাশে থাকে, দূরে থেকেও সে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী।
তার সাথে পরিচয় স্কুলের শেষের দিকে। আমাদের গার্লস স্কুল এবং বয়েজ স্কুল বেশ কাছে। প্রাইভেটে তার সাথে পরিচয়। এরপর বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব ছিল প্রায় অনেক দিন। আমি নিজের জীবনে কোন ছেলেকে জড়াবোনা এমন টাই ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আচার আচরনে আমি বাধ্য হয়েছি, তার প্রতি দূর্বল হতে। কিন্তু প্রকাশ আজো সেভাবে হতে দেইনি। ভয় করে যদি সেও বাবার মতো হয়। তবে বন্ধু হিসেবে তার মতো আর কেউ হতে পারবে না। তবে কারো উপরে ষোল আনা বিশ্বাস করা এ জনমে আমার দ্বারা আর হবে না।
বন্ধু হিসেবে সে আমার কাছে বেশি আপন। আমার এই নিস্বঙ্গ জীবনে সে বিশ্বস্ত বন্ধু।
সে আমার অতীত জানে, বর্তমানের সঙ্গী। এবং আগামীর পথচলা। মামনির জীবনে প্রেম ভালোবাসা পরিনতি দেখে যতটা ভয় পাই, ঠিক ততটাই ভরসা পাই তাকে দেখে।
ওর কথা মামনিকে বলতে পারিনি। কারন মামনি, তার নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারনে প্রেম ভালোবাসায় আর মোটেও বিশ্বাসী নয়। তবে নানী হয়ত কিছু বুঝতে পারে, তবে মুখে কিছু বলে না।
মামনির সাথে এখন সবাই সারাদিন হাসপাতালের কেবিনে আড্ডা চলে। বড় মামা আর খালামনি সব সময় মামনির পাশে পাশেই থাকে। এক মুহুর্ত মামনিকে একা রাখিনা কেউ। ডাক্তার বার বার করে বলেছে যেন, কোন ভাবেই মামনি কোন টেনশন না করে, সব সময় হাসি খুশি থাকে। এ যাত্রায় বেঁচে গেছে, তবে এমন টা আবার হলে অর্থাৎ এভাবে যদি আবার স্ট্রোক হয় তবে মামনিকে বাঁচানো যাবে না। সে কারনে সবাই খুব সচেতন মামনির ব্যাপারে। আর খালামনি ও মামা সে কারনেই মামনিকে একদম একা ছাড়ে না।
বড়মামা প্ল্যান করেছে যে, সবাই মিলে আমরা কক্সবাজারে বেড়াতে যাবো। মামনির ইচ্ছা যে আমরা আগে বগুড়ায় যাবো তার পর কক্সবাজার। মামনির কথা মতোই সবাই যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু আমার পরীক্ষা সামনে, কি করে আমি যাবো। তবে সে আমাকে বলেছে যেন আমি সবার সাথে বেড়াতে যাই এবং প্রতিদিন সকাল কিংবা সন্ধ্যা কয়েক ঘন্টা যেন পড়ি তাহলেই হয়ে যাবে। তার কথার উপর আমি নির্দ্ধিধায় ভরসা করতে পারি।
বেশকিছুদিন পর বগুড়ায় এসেছি। আমি নানীর সাথে প্রাই আসি গ্রামে। গ্রাম আমার খুব প্রিয়। মেঠো পথ, গরুর গাড়ি, সহজ সরল মানুষ গুলোর নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি। আবার খড়ির চুলায় রান্না। পুকুরে গোসল, লাফিয়ে দাপিয়ে জমির আইল দিয়ে হেটে চলা। এগুলো আমার খুব পছন্দের। গরম গরম পিঠে, আর মুড়ি মুড়কি সেও আমার খুব পছন্দের।
মামনি গ্রামে আসলেই, বড় বাবা মানে মামনির দাদার কবরে আগে যায়। শেষ দেখাটা মামনি দেখতে পাননি, মানে আমার বাবা দেখতে দেননি। এটা মামনিকে খুব কষ্ট দেয়। কবর জিয়ারত করে তারপর বাসায় গেলাম আমরা।
সবাই দেখতে চলে আসলো, গ্রামে আসলে এটা আরেকটা মজার ব্যাপার, কারো বাসায় গিয়ে দেখা করার প্রয়োজন পড়ে না। সবাই এসে দেখা করে যায়। তার উপর যেহেতু মামনি অসুস্থ তাই আরও সবাই দেখতে এসেছে। আবার বড় মামা ও ইরা খালামনি সাথে আছে। পুরো বাড়ি মানুষে ভরে গেছে।
পরদিন সকালে মামা পুকুরে জাল ফেলেছেন, বিশাল বড় বড় মাছ। টাটকা মাছের ঝোল, অবশ্যই খড়ির চুলায় রান্না, এর আর জুড়ি নাই।
মামনি গ্রামে এসে বেশ ভালো আছে, আগের থেকে। মামনির কথা গুলো এখনো স্পস্ট হয়নি। হাটতেও খুব ভালো করে পারছেন না। হুইল চেয়ারে করে গ্রামের রাস্তায় নিয়ে গেলে মামনি খুব খুশি হন। অস্পষ্ট কন্ঠে কতো গল্প করেন। ছোটবেলার অনেক গল্প করেন মামনি। ইরা খালামনি মামনি আর মামা মনে হচ্ছে একে বারে সেই ছোট বেলাতে ফিরে গেছে। উনারা খুব খুশিতে আছেন।
এতো কিছুর মাঝে আমার আর নানীর মন ভালো নেই। বাবা বিয়ে করেছে সে কারনে যতটা মন খারাপ, তার চেয়েও ভয়ে আছি যদি মামনি আর মামারা জানতে পারে তাহলে কি হবে। মামনিকে বাঁচানোই হয়ত কঠিন হয়ে যাবে।
গ্রামের দিন গুলো খুব ভালো কাটছে। এখান থেকে আমরা যাবো মামনির নানীর বাড়ি। মামনির নানা মারা গেছেন। তবে মামনির মামা খালারা সবাই খুব ভালোবাসে মামনি দেরকে।
গ্রামে আসলে, সব কিছুই কেমন উৎসবের মতো লাগে। সবার বাসায় দাওয়াত। ছোটদের সাথে নানা ধরনের খেলাও হয়। আমার বহু কষ্ট মলিন হয়ে যায়, এই নির্মল বাতাসে থাকলে।
মামনিকে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম, মামনির নানীর বাসায়। সেখানেও কিছুদিন খুব ভালো কাটলো। নানী পুরোনো কতো গল্প করলেন, কোথায় নানা ভাইকে প্রথম দেখেছেন, কোথায় নানী খেলতেন। নানীর খেলার সাথিরা সব বুড়িয়ে গেছেন, কেউবা নাই। যারা আছেন, তাদের সাথে নানীর গল্পের যেন কোন শেষ নেই। এমনকি সারা রাত গল্প করে পার হয়। তবু কুটুর কুটুর করে গল্প করে।
পুতুল খেলা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে নানীর বিয়ে হয়েছে। নানীকে বিয়ের পর আসতে আসতে অনেক কাজ শিখতে হয়েছে। নানুদের বাসায় ৩৫/৪০ জন সদস্য। বাড়ির মানুষ, রাখাল, কাজের লোক, জায়গির, আবার বৈঠক খানায় যদি লোক আসে তারাও খাওয়া দাওয়া করতো।
ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল করে রান্না, রুটি আটা পিঠে একই ভাবে করতে হতে। পালি করে রান্না করতে হতো। সব জা মিলে পালি করতে হতো। কতো গল্প নানীর। গ্রামে আশার পর সবাই কেমন স্মৃতিতে ভেসে যাচ্ছে।
আসলেই মানুষের জীবনের অতিতের স্মৃতি অনেক মধুর। শুধু আমাদের ক্ষেত্রটা ভিন্ন।আবীর গ্রামের ছেলেদের সাথে মিলে মিশে গেছে। সেও খুব আনন্দ করছে।
সেখানে থেকে কক্সবাজার। কিছুদিন ইরা খালুমনির বাসায় থেকে আমরা ঢাকায় চলে আসলাম। আর পুরো সময়টায় আমাদের সাথে ছিলেন, মামনির চাচাতো বোনের মেয়ে রাবেয়া, সে প্যারামেডিকস ডাক্তার। মামনির থেরাপি ও ম্যাসাজ করতেন। উনার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মামনি এখন বেশ সুস্থ।
মামনি ছুটি নিয়ে কয়েক মাস বাসায় থাকলেন। এর পর আসতে আসতে চলতে শুরু করলেন। তবে একেবারে স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
আসতে আসতে মামনি অফিস যাওয়া শুরু করেছেন। সামনে আমার পরীক্ষা, তাই আমিও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। মামা চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়ার। সবাই প্রায় খোঁজ খবর রাখে মামনির।
সাদ, যে কিনা আমার বন্ধু, এবং আমার সঙ্গী। তাকে বন্ধু ভাবতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি আমি। পরীক্ষার পর সে আসলো ঢাকায়। সে থাকে চট্টগ্রাম এ। ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে, ফাইনাল ইয়ারে, চুয়েটে। অনেক দিন পরে দেখা। সারাদিন একসাথে পার করলাম। সারাটা দিন আমাদের জমানো কত গল্প, কত স্বপ্ন, অনেক ঘুরা-ঘুরির মধ্যে পার হলো। আমার ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড-রা জানে সাদের কথা, তাই সবাই মিলে চুটিয়ে আড্ডা দিলাম। রাতের ট্রেনে সে রংপুরে চলে গেলো।
সাদের ছোট বোন আর আমি একসাথে স্কুলে পড়তাম। প্রাইভেট একসাথে। সে কারনে আমরা খুব ভালো বান্ধবী ছিলাম। আর যেহেতু আমরা ব্যাচে পড়তাম, তাই সাদ ও আমাদের সাথে পড়তো। সেই দিন গুলোতে আমরা সবাই মিলে খুব দুষ্টুমি করতাম। যে টিচারের কাছে আমরা পড়তাম, সে খুব বন্ধু সুলভ ছিলেন। মাঝে মাঝে স্যারই আমাদের সাথে দুষ্টুমিতে যোগ দিতেন। তবে স্যার দুর্দান্ত পড়াতেন। আর পড়া না পারলে বেত দিয়ে চাপকাতেও ভুল করতেন না। ঐ দিন গুলোতে সাদের বোন আফরিন, আমাদের বাসায় প্রায় আসতো, আমিও যেতাম আফরীন দের বাসায়। আফরীনের আম্মা আমাকে খুব আদর করতেন। আফরিনের বড় বোন, আইরিন, সেও আমাকে খুব ভালবাসতেন।
একটা সময় আফরীন দের বাসায় আমি একজন সদস্যের মতোই হয়ে গেলাম। এবং আমার আর সাদের সম্পর্ক তাদের বাসাতেই বেশি আন্তরিক হয়। আফরীনের বাবা একজন খুব ভালো মানুষ। উনিও আমাকে খুব পছন্দ করে। এখন ফোনে কথা হয়।
আফরীনের আম্মার সাথে আমার মামনির যোগাযোগ ফোনে, বাস্তবেও তারা একে অপরকে কখনও দেখেনি। মামনির আফরীন কে বেশ পছন্দ করে। তবে যেখানে প্রাইভেট পড়তাম, তার পাশেই আফরীন দের বাসা হওয়াতে, আমি প্রায় যেতাম আফরীন দের বাসায়। আফরীন দের বাসায় আমার খুব ভালো লাগতো, কারন বাসার সবাই মিলে প্রায় আড্ডা হতো। আঙকেল তার পুরো পরিবারটাকে নিয়ে সময় পার করতে বেশি পছন্দ করতেন। যা আমার বাসায় কখনও হয়নি। ওদের বাসায় আমি সেই ভালোবাসা দেখতে পেতাম, সেই ভরসা দেখতে পেতাম যা সারাজীবন আমার কল্পনায় ছিল।
বাসায় পৌছে ফ্রেশ হয়ে মায়ের সাথে দেখা করে ঘুমিয়ে গেছি। ভোরে সাদ ফোন দিয়েছে, জানালো যে, আমার বাবার নতুন বৌয়ের ঘরে ছেলে সন্তান হয়েছে। সাদের মুখে কথা শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। সাদের মনটাও খুব খারাপ মনে হলো।
#সিরাজুম_মনিরা