ধূসর ভালোবাসা পর্ব-১

0
2988

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-১

বাবার বিয়ে আগামীকাল। দাদি কিছুক্ষণ আগে ফোনে মামনিকে জানালেন। দাদি বললেন,

– শোন আফিফা, আমার ছেলের বিয়ে কাল, এইবার আমার পছন্দের লক্ষী মাইয়া দেইখ্যা আমার পোলার বিয়া দিমু। তুমিতো আমার আর আমার পোলার জীবনটা নষ্ট কইরা ফালাইসো।

মা ফোনটা লাউডস্পিকার দিয়েছিলেন হয়তো ভুল করে, তাই কথা গুলো আমি শুনতে পেলাম। নইলে দাদি কিংবা বাবার কোন কথা মা কখনোই আমার সামনে বলেন না।

রাতে মা কিছু খেলেন না, সানেকা খালা আমাকে অনেক বার ডাকতে আসলেন খাওয়ার জন্যে। কিন্তু মা না খেয়ে আছেন, আমি কি খেতে পারি? সানেকা খালা বহুদিন থেকে নানীর কাছে থাকে। মাঝে বিয়ে হয়েছিল, স্বামি ভালো না, অন্য কোথাও চলে গেছে।

আমি মামনির ঘরের সামনে গেলাম, দরজা ভিজিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে বারান্দার রকিং চেয়ারে বসে আছে। খুব ইচ্ছে করছে মায়ের পাশে গিয়ে বসতে। মামনির হাতটা শক্ত করে ধরে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে যে ‘আমি আছি মামনি তোমার পাশে’

কিন্তু মামনিকে আমি খুব ভয় পাই, মামনির ওপর টা অনেক শক্ত। একটুতেই রেগে যান কিন্তু আসলে উনি ভেতরে অনেক নরম। তবে রেগে গেলে মামনির কোন খেয়াল থাকে না। আবার মামনির মত করে পৃথিবীর কেউ মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না।

সাত বছর হলো নানু মারা গেছেন, নানী একাই থাকতেন। যেদিন মামনি বাবার বাসা ছাড়লেন, সেদিন থেকে আমরা নানু বাসায় আছি। আমি নানী আর মামনি একসাথে আমাদের পথ চলা। আমার ছোট একটা ভাই আছে সে বোর্ডিং স্কুলে থাকে। মামনি চান না যে, বাবার কোন ছায়া আমার ভাই অর্থাৎ আবিরের উপর পড়ুক। মায়েরা তিন ভাইবোন। মামনি মেজ। বড় মামা অস্ট্রেলিয়ায় সেটেলড। ফ্যামেলি নিয়ে উনি সেখানেই থাকে। নানীকে অনেক বার বড় মামা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নানী কখনোই নানুর এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তিনি মৃত্যূ ছাড়া এই বাড়ি ছাড়বেন না। ছোট ইরা খালামনি, সে বিয়ের পর চিটাগং এ সেটেল্ড।

মামনি রাতে খান নি, তাই নানীও কিছু খায় নি। মামনি বারান্দাতে বসে আছে। আমি নানীর কাছে গিয়ে বসলাম। নানীর মন আজ খুব খারাপ, খুব। নানী নানুর ছবিটা হাতে নিয়ে বসে আছেন। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি নানীর পাশে বসলাম। এই একটাই মানুষ যে আমাকে খুব বোঝে।

– নানী, তুমি একটু মায়ের পাশে বসো প্লিজ।

– তোমার মায়ের আজ একা থাকাই ভালো বুবু, নিজের জীবন নিয়ে নিজেকেই ভাবতে দাও অবন্তী।

আমি চুপচাপ বসে রইলাম। ঘুমাতে গেলাম কিন্তু আমার কোন ঘুম নেই চোখে। আমার আজ মন খুব খারাপ। আমার বাবা, তাকে আমি কোন দিন বুঝতে পারি নি। তবে মামনি বাবাকে খুব ভালো বাসে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার বাবার বেশ কিছু সমস্যা আছে। যেমন সন্ধ্যার পর বাবার কেন জ্ঞান থাকে না। উনি তখন অন্য জগতের মানুষ হয়ে যান।

সমস্যা তখনই শুরু হয়, মামনি কখনোই বাবার এই অভ্যেস গুলো মেনে নিতে পারেননি।

আজ সারা রাত নানী ঘুমাবেন না আমি জানি। নানী মামনিকে নিয়ে খুব চিন্তা করেন, সব সময়।

সানেকা খালা রাত বারোটার দিকে মামনির রুম থেকে চিৎকার দিয়ে কেদে উঠলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি মা রকিং চেয়ার থেকে নিচে পড়ে আছেন। মায়ের জ্ঞান নেই।

এম্বুলেন্স কল করলাম, মামনির হাত পা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। নানী হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলেন।

মামনিকে তুলে আমি আর সানেকা খালা বিছানায় শোয়ালাম। মামনির হাতে একটা ডায়রি ছিল। সেটা টেবিলের উপরে রাখলাম।মামনিকে হসপিটালে নিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। হসপিটালে ফোন দিয়ে এম্বুলেন্স কল করেছি।

হসপিটালে যা যা প্রয়োজন হতে পারে সব কিছু আমি আর সানেকা খালা গুছিয়ে নিলাম।

খুব জরুরী সময় কিংবা কোন দূর্ঘটনার সময় আমার মাথা স্বভাবতই ঠান্ডা হয়ে থাকে। আর তাই মামনির এমন অবস্থাতেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি। এটা মামনির কাছেই শিখেছি।

এম্বুলেন্স আসলে মামনিকে নিয়ে রওনা দিলাম আমরা। সব ফরমালিটিস এর পর মামনির ট্রিটমেন্ট শুরু হল। ডাক্তার আমাকে ডেকে বললেন, আপনার আম্মা স্ট্রোক করেছেন।

আমি নানীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। নানী খুব কাঁদছেন, খুব। নানী আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছেন। উনার হাত ঠান্ডা হয়ে আছে। নানীকে কোন সান্তনা দেবার ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

মামনি ছাড়া আমাকে নিয়ে ভাবার মত আর কেউ নেই। নানীর বয়স হয়ে গেছে, আমার আর নানীর মামনিই পুরো পৃথিবী। মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু নানী ভেঙ্গে পড়বে তাই স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি। আমার পুরো পৃথিবী, আমার মামনি। মামনিকে আমরা সবাই খুব ভয় পাই কিন্তু ভালো বাসি নিজের থেকেও অনেক বেশি। মামনি খুব ভালো মানুষ। উপর থেকে যতটা শক্ত ভেতর থেকে ততটাই নরম।

আজ আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে পড়েছে।

সানেকা খালা বিলাপ করে কেঁদেই যাচ্ছে। খালাকে কোন মতে বুঝালাম, উনি একটু শান্ত হলেন।

বেশ অনেকক্ষন পর ডাক্তার এসে বললেন, মামনি আগের থেকে একটু ভালো আছেন। আই সি ইউতে আছেন।

প্রায় সারা রাত আই সি ইউ এর সামনে বসে আছি, আমি নানী আর সানেকা খালা।

ভোরের দিকে মামনির জ্ঞান ফিরেছে। আমি অল্প কিছু সময়ের জন্য মামনির সাথে দেখা করতে পেরেছিলাম। মামনি মনের দিক দিয়ে অনেক ভেঙ্গে গেছে। আমি খুব জানি, মামনি বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। কিন্তু আমার বাবা?

নানী কাঁদতে কাঁদতে বাহিরে চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে গেছে। নানীর মাথায় হাত রাখতেই, উনি চমকে উঠে গেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

– আমার মেয়েটা কেমন আছে বুবু ।

– নানী আমি মায়ের সাথে দেখা করে আসলাম, জ্ঞান ফিরেছে। ভালো আছে।

– আমাকে একটু দেখাবে বুবু?

– নানী, তোমাকে গ্লাসের বাহির থেকে দেখতে হবে। ভেতরে এখন যেতে দেবে না।

– ঠিক আছে বুবু, আমি বাহির থেকেই দেখবো।

নানী মামনিকে বাহির থেকে দেখে কাঁদতে লাগলেন। নানী লাইভ সাপোর্ট দেখে ভয় পেয়েছেন। নানীকে বুঝালাম যে, ভয়ের কিছু নেই। মামনি ভালো আছেন। তবে এখানে থাকতে হবে বেশ কিছু দিন নানু। তাই তুমি আর সানেকা খালা বাসায় যাও। আমি এখানে আছি। আমি বাসায় গেলে তোমরা এখানে এসো।

অনেক বুঝিয়ে নানী আর সানেকা খালাকে বাসায় পাঠালাম। মামনির মুখ দেখার পর থেকে বুকের মধ্যে একটু শান্তি লাগছে।

মুখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে একটা কফি খেয়ে আবার আই সি ইউ এর সামনে বসলাম।

ব্যাগ পাশে রাখতেই মনে পড়লো যে, আমার ব্যাগে মায়ের ডায়রি আছে। ডায়রি টা হাতে নিয়ে, খুব পড়তে মন চাইলো। মামনির অনুমতি ছাড়া পড়া কি উচিত হবে?

ডায়রি ব্যাগে রাখলাম। কিন্তু খুব মন চাইলো ডায়রিটা পড়তে। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না।

ডায়রি টা আবার হাতে নিয়ে, কোলের উপর রেখে পড়তে শুরু করলাম।

অনেক আগের লিখা গুলো একটু ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে পড়তে কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

সময় -১৯৭৬ সালের দিকে। তারিখ গুলো অস্পষ্ট, তাই ঠিক বুঝতে পারছি না।

লিখা গুলো এমন ছিল –

আমি আফিফা রহমান। আমার বাবা আরিফ রহমান। আমরা দাদু বাসা থেকে রওনা দিব আগামীকাল দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। বাবার ট্রান্সফার হয়েছেন দিনাজপুরে। তাই আজ সবার সাথে দেখা করলাম। দাদু চাচা, চাচাত ভাইবোন আত্নীয় স্বজন ছেড়ে আমাদের যেতে হবে দিনাজপুর। আমার দাদু বাসা বগুড়া শহর থেকে একটু দূরে। বাবা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। এতো দিন বাসা থেকে অফিস করেছেন কিন্তু বাবার প্রোমোশন হয়ে ট্রান্সফার হয়ে গেছেন। এখন বাবার ইচ্ছা যে আমরা বাবার সাথে দিনাজপুর যাবো এবং বাবার ইচ্ছা, পড়াশুনা করিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করার। আর তাই বাবা চান যেন আমরা বাবার সাথেই থাকি। আর তাই আমরা কাল বাবার সাথেই রওনা দিবো।

খুব কান্না পাচ্ছে, সবাইকে ছেড়ে যেতে।খেলার সাথী গুলোর সাথে দেখা করে খুব কান্না পাচ্ছিল।

কিন্তু যখন দিনাজপুরে আমাদের নতুন বাসায় আসলাম, আঁশে পাশের সবার সাথে পরিচিত হলাম। বেশ ভালো লাগলো। নতুন পরিবেশ নতুন বাসা কিন্তু আঁশে পাশের মানুষ বেশ ভালো। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা সবার সাথে মিলে মিশে গেলাম।বাসার সাথে ছোট্ট একটা বাগান, আমার খুব ভালো লাগলো। বাসার সামনে বিশাল খেলার মাঠ, খুব সুন্দর সে মাঠটা।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here