#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব -২
নতুন পরিবেশে বেশ ভালো ভাবেই মিলে মিশে গেলাম আমরা। মা অনেক খুশি। বিয়ের পর এই প্রথম সে নিজের, একার সংসার পেয়েছেন। রোজ কিছু না কিছু জিনিস বাবা মা কিনে নিয়ে আসেন। নতুন নতুন জিনিসপত্র কিনে মা বাবা সংসার সাজাচ্ছেন। আমাদের তিন ভাইবোন বাসায় নতুন নতুন জিনিস দেখে খুব আনন্দ লাগছে।
আমাকে আর ভাইয়াকে বাবা স্কুলে ভর্তি করালেন। তাহনীম ভাইয়া বয়েজ স্কুলে ভর্তি হলেন, আর আমি গার্লস স্কুলে। আমার ছোট বোন ইরা, সে খুব ছোট তাই পাড়ার প্রাইমারি স্কুলেই ভর্তি হলো।
এর পরের দিন গুলো খুব সুন্দর কাটলো। আমি স্কুলে খুব ভালো রেজাল্ট করি। আর ভাইয়াও খুব ভালো রেজাল্ট করছেন। বাবা খুব খুশি, আমাদের রেজাল্ট দেখে।
আমাদের এই ৩ নম্বর ব্লকে, অনেক প্রোগ্রাম হয়।যেমন মঞ্চ নাটক, খেলার প্রতিযোগিতা, মহিলাদের খেলা। আর প্রায়ই পিকনিক হয়। এখানে সবাই এতো আনন্দ প্রিয়। আমাদের দেশের বাড়ির জন্য মন খারাপ হওয়া অনেক কমে গেছে। আর আঁশে পাশের মানুষ গুলো এখন পরম আত্নীয়।
আমার বাবা আমার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় এবং ভালোবাসার মানুষ। বাবা মানেই আমার কাছে খুব সুন্দর একটা জগৎ। বাবার অফিসের বাহিরে সবটা সময় আমাদের সাথেই কাটান।
বাবা যতক্ষন বাসায় আসেন না, মা দুপুরের খাবার খান না। শেষ দুপুরে অর্থাৎ বিকেলের কিছু আগে বাবা অফিস থেকে ফিরলে, বাবা মা একসাথে দুপুরের খাবার খান। বাবা মাকে ছাড়া কোথাও তেমন একটা যান না। বাবার আলাদা করে বন্ধু খুব কম। বেশির ভাগ সবাই ফ্যামিলি ফ্রেন্ড অর্থাৎ কলিগদের পরিবারের সবাই একসাথে বন্ধুত্ব। উনারা আমাদের বাসায় আসে আর আমরাও তাদের বাসায় যাই।
বাবার চিন্তা চেতনা একদম গোছানো, সে খুব সাদা মাটা সাধারন মানুষ। ভাইয়া সব সময়ই পড়া পাগল মানুষ। আমাদের ভাই বোনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হচ্ছে বাবা। আর মা বেশ বুদ্ধিমান মানুষ তবে রাগটা একটু বেশি। সব কথা আমরা নির্দ্ধিধায় বাবাকে বলতে পারলেও মাকে বলতে পারি না।
দিন যেতে লাগলো, আসতে আসতে আমরা বড হতে লাগলাম। আমি ক্লাস নাইনে উঠে গেলাম, আর ভাইয়া এস এস সি দিবে।
এর মাঝে আমরা আমাদের গ্রামে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। গ্রামে আমরা যখন যাই, যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দাদা দাদি কিযে খুশি হয়। খেলার সঙ্গীরাও এখন বড় হয়ে গেছে। অনেক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রামে খুব ছোটতেই বিয়ে হয়ে যায়। আমার চাচাত বোনদেরও অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে।
আমার দাদা আশে পাশের পাঁচ গ্রামের মোড়ল, উনি কিছুতেই পছন্দ করেন না যে তার বংশের ছেলে মেয়ে পড়া শুনা করে অন্যের চাকরী করবেন। উনি সরকারি চাকরিও পছন্দ করেন না। আর তাই আমাদের বংশে অনেকেরই পড়া শুনায় আগ্রহ কম। আমার বাবা চুপ করে পড়েছেন। উনার পড়ার কাহিনী আরেকদিন লিখবো।
ভাইয়ার এস এস সি পরীক্ষার আগে পর্যন্ত আমি আর ভাইয়া এক সাথে স্কুলে যেতাম। কিন্তু ভাইয়ার পরীক্ষার পর থেকে পাড়ার মেয়েদের সাথে স্কুলে যাই।
ক্লাস নাইনের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন স্কুল বন্ধ থাকার পর যখন স্কুল খুলেছে, আমি বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যাচ্ছি, এমন সময় সামনে একটা ছেলে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। আমার বান্ধবী পারভীন আর খুকি খুব রেগে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল,
– কি চাই ?
– পারভীন তোমাকে চাই, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। অনেক দিন থেকে বলতে চেয়েও বলতে পারছিনা।
পাশের ছেলেটা কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আর কি কি যেন বলছিল। আমার খুব রাগ হলো, রাগে যেন কথা গুলো আমার কানে পৌঁছলেন না। রীতিমত চিৎকার করে বলতে শুরু করলাম। ছেলে গুলো একটু পর চলে গেল।
আমরা স্কুল চলে গেলাম, বাসায় ফেরার সময় দেখলাম ছেলে গুলো দূর থেকে আমাদের দেখছে, আর একে অপরকে কিছু বলছে।
আমরা বেশ খুশি হলাম, যে ঐ ছেলে গুলো ভয় পেয়ে আমাদের কিছু বলছে না। আমিতো নিজেকে বেশ সাহসী ভাবতে শুরু করলাম।
কিছুদূর যেতেই খেয়াল করলাম, ছেলে গুলো আমাদের পিছু নিয়েছে। একে বারে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পিছে পিছে আসলো। আমি তো পারিনা যে দৌড়ে বাসায় ঢুকি। বাসায় এসে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। কিন্তু বাবাকে কিছু বলতে পারছিনা।
বাবা সব সময় বলে, যেন রাস্তায় আমরা কারো সাথে কথা না বলি। কি করে বলবো যে, আমি রিতিমত চিৎকার করে বকা দিয়েছি। ভয়ে বাবাকে কিছু বলতে পারলাম না।
ভাইয়াও কোন দিন কারো সাথে গন্ড গোল করেনি, তাকেও কিছু বলতে পারলাম না।
এর মাঝে রোজা চলে আসলো, স্কুল বন্ধ।রোজার দিনে আমাদের বাসায় আমরা সবাই রোজা রাখি। মা রোজ রাতে গরম ভাত তরকারি সব রান্না করে। আর ভোর রাতে মাঝে মাঝে কেউ চিঠি ফেলে দিয়ে যায় বাসায়। তাতে কি লেখা থাকে বাবা মা কোন দিন আমাদের বলে নি। কিন্তু বাবাকে বেশ চিন্তিত দেখা যায় আজ কাল। বাবা পাড়ার রহিম চাচার সাথে এই চিঠি নিয়ে আলোচনা করতে দেখেছি কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে আসলে চিঠিতে কি লেখা আছে।
দেখতে দেখতে ঈদ চলে আসলো। ঈদের দিন আমি পারভীন আর খুকি, পাশের পাড়ায় আমাদের বান্ধবী রুবির বাসায় বেড়াতে গেলাম। সেখানে আমরা খুব ভালো সময় পার করেছি। এখান থেকে আমরা আরেক বান্ধবীর বাসায় যাব। আমাদের সাথে পারভীনের ছোট বোন লাকি আছে। ফেরার সময় আমাদের সামনে সেই দিনের ঐ ছেলে গুলো। সাথে আরো কয়েক জন ছেলে। আমাদের সামনে দাঁড়াতেই আমরা খুব ভয় পেয়ে গেলাম ।
ছেলেটা বলল,
– আমি রিংকু, আমার উপর দিয়ে কথা বলে এরকম মানুষ এ এলাকায় নাই। সেদিন আমার আব্বা আমার সামনে আসছিলো, তাই তোমার চিৎকার আমি চুপচাপ শুনে চলে গেছি। পিচ্চি মেয়ে তোমার সাহস কত। আজ কে বাঁচাবে তোমাকে? তোমাকে দেখাচ্ছি মজা, থামো।
পাশেই মুদিখানার দোকান, দোকানের লোকটা দোকান থেকে বের হয়ে আসতেই ছেলে গুলো চলে গেলো। আমরাও আর এক মূহুর্ত দেরি না করে বাসায় চলে আসলাম।
খুব ভয় পেয়েছিলাম আমরা। আর কোথাও যাইনি আমরা সারাদিন। বাসায় চুপ করে বসে রইলাম। বিকেলে বাবা মায়ের সাথে বাসার সামনে মাঠে বের হয়েছি। তার আগে ভয়ে বাসার সামনেও আসিনি।
চার পাঁচ দিন পর স্কুলে যাবো, ভয়ে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাবাকেও বলতে পারছি না। কিন্তু বাবা স্কুলে যাওয়ার জন্য খুব তাড়া দিচ্ছে।
উপায় না দেখে স্কুলের জন্য বের হলাম। একি বাসার সামনেই রিংকু ঐ ছেলেটা আর সাথে আরো একটা ছেলে। আমাদের সামনে এসে বলছে,
– কি? স্কুল যাও না কেন? ভয়ে?
পেছনে থেকে বাবা বলে উঠলো, কে তোমরা? কি বলছে? আমার মেয়েকে? এই কে তোমরা?
পারভীনের বোন লাকী ওমনি বলে উঠলো,
– আংকেল এই ছেলে গুলো আপুদের খুব বিরক্ত করছে। এদের ভয়ে আপুরা স্কুলে যাচ্ছে না।
মা বলল, এই ছেলে তোমরাই তাহলে হুমকি দিয়ে বাসায় বেনামে চিঠি ফেলো ভোর রাতে?
এ কথা বলেই মা রিংকু নামের ছেলেটাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিলো।
কথা বলতে বলতেই পাড়ার রহিম চাচা চলে এসেছেন।
বাবা মাকে ধরে নিলো ততক্ষনে পাড়ার আরো অনেকেই চলে এসেছে। আর রিংকু নামের ঐ ছেলেটাকে ধরে রেখেছে। আক্কাস চাচার কথায় পাড়ার সব সিদ্ধান্ত হয়, উনার উপর দিয়ে কেউ কথা বলতে পারে না।চাচা, রিংকু নামের ছেলেটাকে বেশ কটা থাপ্পর দিল। বাকি সবাই খুবই বকল।
বাবা মাথা ঠান্ডা করে জিজ্ঞেস করলো, ওদের বাসা কোথায়? বাবার নাম কি? ইত্যাদি। তারপর মাথায় হাত রেখে বেশ অনেকক্ষন বুঝালো যে, এগুলো ভালো না। পড়া শুনা করো। ভালো পথে চলতে হয়। আরো অনেক কথা।
তারপর রিংকুদের ছেড়ে দিলো। পরের দিন বাবা ঐ রিংকু ছেলেটার বাবার সাথে দেখা করেছে বাবা আর আক্কাস চাচা । এবং সব খুলে বলেছে।
বাবা পাড়ার আংকেলদের ও ব্যাপারটা জানিয়ে রাখলেন। এখানে আমাদের আপন কেউ নেই। পাড়া প্রতিবেশি গুলোই আমাদের আপন। আর প্রায় ৬/৭ বছর হয়ে গেছে আমাদের এখানে আশা। তাই পাড়ার সবাই কেমন যেন আত্নার আপন হয়ে গেছে।
সে কারনেই বাবা সবাইকে জানিয়ে রাখলো। বাবাকে কেমন চিন্তিত লাগছে। বার বার বলছে এসব ছেলেরা ভালো হয় না। কেন যে মারতে গেল আফিফার মা।
এর পর বাবা বেশ কিছু দিন স্কুলে যেতে দিলেন না। কিন্তু পড়া শুনা আমার খুব প্রিয়। স্কুলে যেতে পারবো না পড়তে পারবো না, এটা ভাবতেও আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায় আর কান্না পায়। আমার মনে হচ্ছে বাবা বুঝি আর কোন দিন আমাকে স্কুলে পাঠাবেন না।
একদিন বিকেলে আমাদের স্কুলের ক্লাস টিচার আমাদের বাসায় আসলেন, বাবার সাথে দেখা করতে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– আফিফা স্কুলে আসছে না কেন? ওর অসুখ করেনিতো?
– না ভাই ,এমনি স্কুলে যাইনি ।
– ভাই, অন্য কোন ছাত্রীর ব্যাপার হলে আমি খোঁজ নিতাম না। কিন্তু আফিফা সবার থেকে আলাদা। ও পুরো স্কুলের গৌরব। ওর জন্য স্কুল ভালো নাম করবে। আফিফা মাধ্যমিকে অনেক ভালো রেজাল্ট করবে। আপনার ঘর রত্ন জন্ম নিয়েছে। তার ভবিষ্যত টা নষ্ট হতে দিয়েন না।
বাবা বললেন,
– ঠিক আছে ভাই, কাল থেকে আফিফা স্কুলে যাবে।
আমি খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম। কাল থেকে আমি যাব। সেকি আনন্দ।
বাবা ভাইয়াকে বার বার বলেছেন যেন, এই ছেলে গুলোর থেকে সাবধানে থাকে। ভাইয়ার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। ভাইয়াকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। তাই বাবা ভাইয়াকে কেন ঝামেলায় জরাতে দিতে চান না।
বেশ কয়েকদিন পর স্কুলে যাচ্ছি। আমি যে রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাই সেটার একটা তিন রাস্তার মোড় পরে। একটা রাস্তা যায় স্কুলের দিকে, আরেকটা আমাদের বাসার দিকে। অন্যটা কবরস্থানের দিকে। মোড়ের উপর একটা দোকান আছে। সবাই বলে ওয়াসিমের দোকান। লোক মুখে শুনতে পেয়েছি।
একদম মোড়ের উপর ওয়াসিমের দোকানে রিংকু সহ আরো বেশ অনেক গুলো ছেলে বসে আছে। আমি পারভীন ও খুকি খুব ভয় পেয়েছি। ভয়ে আমি কাপছি, আর মাথা নামিয়ে হেটে যাচ্ছি।
রিংকু চিৎকার দিয়ে বললো,
– নিয়াজ, ঐ দেখ, ঐ পিচ্চি মেয়েটা। ঐটাই।এটারই ব্যবস্থা করতে হবে।
#সিরাজুম_মনিরা