ধূসর ভালোবাসা পর্ব-২৩

0
819

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব ২৩

কিছু সময় পরে আবার ফোন বেজে উঠলো, আমি ধরতেই মামনিকে চাইল। আমি বললাম,

– মামনি বাসায় নেই, আমি অবন্তী বলছি। আপনি কে?

– আমাকে চিনবে না, আমি তোমার ছোট ফুপুর স্বামী, অর্থাৎ তোমার ফুপা। তোমার বাবা মারা গেছে, আমি বহুক্ষণ যাবত ফোন দিচ্ছি।

আমি কোন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। কিছুক্ষন থেমে আবার বললাম,

– কিভাবে?

– তোমার ছোট চাচার বিয়ে। তোমার বড় ফুপুর বাসায় গেছিলো, কোন কারনে তোমার বড় ফুপু রাগ করে বিয়েতে আসতে না করেছে। তাই তোমার বাবা তোমার ফুপুকে আনতে গেছিলো, ফেরার সময় কারেন্টের পোল ভেঙ্গে পড়ে তাদের রিক্সার উপর। তোমার ফুপু বেঁচে যায়, কিন্তু তোমার বাবা গুরুতর আহত হয়। যে কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল, শুধু তোমার আম্মার আর তোমাদের কথা বলছিল। তোমাদের জন্যই কাঁদতো সব সময়। আর তোমার আম্মার কথা সবসময় বলতো। তোমাদেরকে জানাতে চাইলে, অনেকেই আমাকে মানা করেছে, যেন তোমাদেরকে না জানাই। কিন্তু তোমার বাবা বার বার করে বলেছে, সে মারা গেলে যেন তোমাদের জানাই। উনার ইচ্ছা ছিল একবার হলেও তোমাদের দেখার। আমি এই কয়টা দিন সবসময় উনার সাথেই ছিলাম, এক মুহুর্তের জন্য উনি তোমাদের ভুলে নাই। সব সময় বলছিলেন, যে উনি অন্যায় করেছেন তোমাদের সাথে। তোমার আম্মার সাথে। শেষ কটা দিন, উনি খুব কাঁদতেন তোমাদের জন্য। তোমরা কি আসবে শেষবার উনাকে দেখতে?

– জী আসবো, কিন্তু কোথায় আসবো?

– লাশ তোমার দাদা বাড়ি, দিনাজপুরে নেয়া হবে। ওখানেই আসো।

আবীর আমার পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, নিরব নিথর স্তব্ধ। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু পানি, তা গড়িয়ে পড়ছে। আমি কেন যেন ভাষা পাচ্ছি না। অনুভূতি গুলো ব্যক্ত করার। মাত্র কিছুক্ষন আগে আমরা দুই ভাইবোন হেসেই কুটি কুটি হচ্ছিলাম। তখন আমাদের বাবা মৃত্যূ যন্ত্রনায় কাতর ছিলেন। আর আমাদের বাবা ধীরে ধীরে মারা গেলেন। বাবা আমাদের দেখার জন্য ব্যাকুল ছিলেন, এটা শুনে আমরা যেনো আরও ভেঙ্গে পড়েছি। বাবাকে দেখিনি কতদিন, কত-মাস কিংবা কত গুলো বছর। বাবা এতোদিন আমাদের মনে করেননি কিংবা মনে করতে চাননি। কিন্তু মৃত্যূর সময় তিনি আমাদের জন্য কেঁদে কেঁদে মারা গেছেন, এটা কেন যেন বুকে বিধছিলো।

আমার ছোট সোনা ভাইটা আমার কোলের মধ্যে ছোট্ট হয়ে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো, নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। আমি নিজেও গগনবিদারী আর্তনাদ দিয়ে কেঁদে ফেললাম,

বাবা তুমি কোথায়, বাবা। কতদিন তোমাকে দেখিনি গো, বাবা। তুমি কখনই বুঝতে চাইলে না, তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তুমি কখনই বুঝলে না, ও বাবা। বাবা তুমি কোথায় গেলে। শেষবার কেনো ডাকলে না। একবার তোমার মুখটা দেখতাম। না বলা অনেক কথা বলতাম। তোমার কাছে বহু কথা জানার ছিল, যে। এখন কোথায় পাবো উত্তর। বাবা বাবা ……………

আবীরটা ছোট বাচ্চার মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই গেলো। আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমিও জড়িয়ে ধরেছি, একটু সরতে দেইনি। ভাই কেঁদে আজ বুক ভাসিয়ে ফেল। ওরা বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু বাবার অধিকার কি করে কাড়বে, তোর আর আমার কাদার অধিকার ওরা নিতে পারেনি।

সানেকা খালা ইরা আন্টিকে ফোন করেছে, ইরা আন্টি আমাকে ফোন করেছেন। আন্টি কাঁদছেন। আমি বললাম,

– খালামনি মামনিতো নেটওয়ার্কের বাহিরে। আমি কি করবো?

– তুমি যাবে মা। তুমি যাবে। শেষ বার তাকে অবশ্যই দেখবে। আরও দেখবে তোমাদের ছাড়া তার সুখের জীবনটাকে। তোমরা যাও। যাও মা।

বড় মামাকে ফোন করলাম,

– মামা বাবা মারা গেছে। মামা আমরা কি করবো?

– তোমরা দুই ভাইবোন যাও, কিন্তু কিভাবে যাবে। কার সাথে যাবে?

– আমি গাড়ি নিয়ে যাবো মামা, সাথে আমার কয়েকটা বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে নেবো।

– তুমি, আবীর আর সানেকা বুবুকে নিয়ে যাও। সাথে আমার মামাতো ভাই, তোমার রাজু মামাকে সাথে নাও। আমি রাজুকে বলে দিচ্ছি।

– জী, ঠিক আছে মামা।

– হঠাৎ, কিভাবে মারা গেলো মা?

মামাকে সব খুলে বোল্লাম। মামা বললেন, যেন ভোর বেলায় রওনা দেই। ড্রাইভার চাচাকে বললাম। রাজু মামার সাথে কথা বলে সব ঠিক করলাম।

আমার পেছনে পেছনে আবীর, যে কোন বিপদে আবীর অনেকটাই ছোট শিশুর মতো হয়ে যায়। সারা-ক্ষন আমার পেছনে, একে বারে আমার সাথে লেপ্টে থাকে।

রাত প্রায় ১২ টা, বাসায় কেউ আমরা কিছুই খাইনি। সানেকা খালা এসে বললেন,

– কাল ভোরে ওতো দূরে যাবা, একটু করে খেয়ে শুয়ে পড়ো। নইলে কাল শরীর খারাপ করবে।

– তুমি খাবার টেবিলে দাও খালা, আমরা আসছি। আবীর চল ভাই, একটু খাবি।

– খাবোনা আপু, ক্ষুধা নাই।

– তুই না খেলে আমিও যে খেতে পারবো না সোনা। আমি খাইয়ে দেই।

– ঠিক আছে আপু, এক প্লেটে খাবার আনো। একসাথে খাই।

বহুদিন পর একসাথে খেতে বসেছি। আগে প্রায়ই আমরা এক প্লেটে খেতাম। এখন তা সময়ের সাথে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু খাবার নিয়ে এসেও খুব উপকার হলো না। আমরা দুই ভাইবোন খুব সামন্যই খেতে পারলাম। খেতে খেতে আবীর চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। আবীর যখন খুব ছোট ছিল, বাবাকে ছাড়া খেতো না। বাবা আবীরকে পাসে বসিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। আবীর যখন ছোট ছিল তখন বাবা আবীরের অনেক আবদার শুনতেন। আবীর ছোটতে জেদ করতো, বাবা সে গুলো খুব সুন্দর করে পালন করতেন। কিন্তু আবীর একটু বড় হবার পর থেকে বাবা কেমন যেন পাল্টে গেলেন। বাবা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে থেকে অনেক সরে গেলেন, বনে গেলেন অন্য কারো আপন। তবে শেষ অবধী যে টুকু শুনেছি যে, বাবার সেই রঙ্গীন দিনের সঙ্গী বেশিদিন বাবার পাশে ছিলেন না। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সে বাবার জীবন থেকে সরে গিয়ে নতুন ডালে বসেছে। নতুন করে কারো সংসার ভাঙ্গার জন্যে।

আবীর আমার কোলে মাথা রেখে সেই ছোট বেলার কথা গুলো অনর্গল বলেই যাচ্ছে। ছোট বাচ্চার মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি আগলে রেখেছি পরম মমতায়। আবীর আমার কাছে সন্তানের মতো প্রিয়। হয়ত তার থেকেও বেশি। ভাই তুই কাঁদিস না, এইতো আমি আছি। আমি যতক্ষন বেঁচে আছি, ততক্ষন তুই এতিম হবি না। আমি তোর বাবা, আমি তোর মা। যেদিন আমি মারা যাবো, তখন থেকে তুই এতিম।

আবীর আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই গেলো, চোখের পানির আমারও যে কোন বাধ মানছে না। বাবা তুমি দূরে ছিলে, তবুও বেঁচে ছিলে। কিন্তু যখন থেকে শুনেছি তুমি নাই, এক অন্যরকম শূন্যতা আমাকে গ্রাস করেছে। আবীরকে খুব সাহস দিলেও মনে মনে কেমন যেন অসহায় লাগছে। আসলেই আজ থেকে এতিম হয়ে গেলাম। বুকের ভেতর শুকনো ঝড়, সব কিছু ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে। সাদ ফোন দিয়েছে, তাকিয়ে দেখি অনেক গুলো মিসকল।

বারান্দায় এসে সাদের ফোন ধরলাম, সে বলল,

– কখন থেকে তোমাকে ফোন দিচ্ছি, তোমাকে একটা খবর দেবার ছিল।

– বাবা মারা গেছেন।

– তুমি কখন শুনেছো?

– সন্ধ্যায়।

– কি করবা? যাবা উনাকে দেখতে?

– হুম।

– খুব ভালো সিদ্ধান্ত। হাজার হলেও তিনি তোমাদের বাবা। আন্টি যাবেন কি?

– মা নেই বাসায়, নেটওয়ার্ক এর বাহিরে আছে। সুন্দর বনে গেছে।

– তাহলে কে কে যাচ্ছো?

– আমি আবীর আর সানেকা খালা। সাথে যাবেন রাজু মামা।

– কিসে যাবা?

– গাড়ি নিয়ে যাবো। প্রথমে ভেবেছিলাম বাই এয়ারে যাবো, কিন্তু সৈয়দপুর থেকে ট্রান্সপোর্টের সমস্যা হবে। আবার আজই চলে আসবো। তাই সময় বেশি লাগলেও গাড়িই ভালো।

– আমি কি যাবো তোমার সাথে?

– না, দরকার নেই। কোন সমস্যা হলে তোমাকে জানাবো।

বারান্দায় কতক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম, চোখের সামনে সেই ছোট বেলা দেখতে পাচ্ছি। ছোটতে বাবা ঈদের দিন সকালে গোসল করিয়ে দিতেন, সাথে করে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে যেতেন। বাবা আগে শুক্রবারে নিজে রান্না করতেন। বাবাকে সাহায্য করতো কর্মচারীরা। বাবা প্রতি শুক্রবারে পোলাউ করতেন মুগডাল দিয়ে, নইলে মোরগ পোলাউ। সাথে গরুর মাংস আর ইলিশ মাছ। বাবা ডাইনিং টেবিলে বসে খেতেন না, সব কর্মচারি কাজের লোক সহ আমরা সবাই মেঝেতে এক সাথে বসতাম খেতে। বিকালে দাবা কিংবা লুডু খেলতেন মামনির সাথে। তখন আবীর অনেক ছোট। বাবা তখনও নেশা করতেন, কিন্তু কম। সে সময় গুলোতে দাদী কম আসতেন, বলতে গেলে তেমন একটা আসতেন না। সেকারণেই হয়ত জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর কিছু সময় জীবনের ডায়রিতে স্মৃতি হয়ে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

আমার মনে পড়ে, আমি তখন খুব ছোট। বাবা মা একসাথে নামাজ পড়তেন। আমি তাদের ঘাড়ের উপর বসে থাকতাম। জায়নামাজে শুয়ে থাকতাম। বাবা রাগ করতেন না।

আবার এটাও মনে পড়লো, সম্ভবত বড় ফুপুর বিয়ের কথা চলছিল। মামনিকে বাবা সাথে করে নিয়ে যাবে। মামনি যাবে না। রাতে বাবা মামনির গলা চেপে ধরেছিল। সকালে আবার জিজ্ঞেস করলো, মামনি না বললে, বাবা মামনিকে খুব জোরে ধাক্কা দিলেন, আবীর সে সময়টায় মামনির পেটে। মামনি সেলাই মেশিনে পড়ে গেলেন। মাথাটা পড়লো যেয়ে সেলাই মেশিনের পায়ের উপর। পেটটা মাটিতে পড়লো। মেশিনের পা হলো লোহার, মামনির মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। প্রচুর রক্ত। বাবা মামনিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। সে সময় আমার হোম টিউটর আসলেন আমাকে পড়াতে। বাবা টিচারের বললেন, মামনি পানির কল চাপতে যেয়ে পিছলে পড়ে গেছে তাই মাথা ফেটে গেছে। আমি অবাক হয়ে উপলব্ধি করলাম, কিভাবে বাবা মিথ্যে বললেন। বাবা মামনিকে নিয়ে চলে গেলেন ডাক্তারের কাছে। আমাকে টিচার আর বাড়ির কাজের সাহায্য কারীর কাছে রেখে। কিছুক্ষন বাদে মনে হচ্ছিল বাবা বোধ হয় মামনিকে মেরে ফেলবেন। টিচারের বললাম, মামনির কাছে যাবো। উনি রাজি হলেন না। খুব করে বললাম, উনি যেতে দিলেন না। আমি উঠে কাঁদতে লাগলাম, উনি আমাকে খুব বোঝাতে লাগলেন। মাথার মধ্যে কি হলো মনে নেই, টিচার পাঞ্জাবী পরেছিলেন নতুন। উনার গলার কাছে পাঞ্জাবী ধরে একটা টান দিলাম। সাথে সাথে ছিড়ে গেলো। উনি আমাকে আর বাঁধা দিলেন না। একদৌড় দিলাম। ডাক্তার খানা বাজারে, আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। দৌড়ে পড়তে পড়তে, পুরো শরীরে ধুলো মেখে ডাক্তারের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি চেম্বারে মামনি নেই। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ডাক্তারের এসিস্টেন্ট আমাকে চেনেন, বাবার সাথে ডাক্তারের খুব ভালো সম্পর্ক। উনি বললেন,
-অবন্তী কাঁদছো কেন মা?

– মামনিকে পাচ্ছি না।

– ভাবী ভেতরের রুমে। উনার সেলাই চলছে কপালে।

আমি দৌড়ে মামনির কাছে গেলাম। দেখছি ডাক্তার দাদু মামনির কপালের কাটা যায়গাটা ওয়াশ করছেন, আর বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,

– কি করে বৌমার কপাল কাটলো নিয়াজ।

বাবা বললেন, পানির কলে হাত পিছলে পড়ে গেছে। তাই কপাল ফেটে গেছে।

ডাক্তার দাদু বললেন, নিয়াজ আমার চারটা মেয়ে। বৌমাকে দেখে আমার ভয় করছে, হয়ত তাদেরও এভাবে পানির কলে কপাল কাটতে পারে? সেদিন যদি আমি না থাকি, আমার তো ছেলে নেই। তাহলে আমার মেয়েদের কপালের দাগ কে মোছাবে!

ডাক্তার দাদুর চোখে পানি। তারপর মামনিকে বললেন, মা তোমার গলা লাল হয়ে আছে কেন? কলে পড়লে বুঝি গলা লাল হয়।

মামনি খুব ফর্শা মানুষ। গতরাতে বাবা মামনির গলা টিপে ধরেছিল, তার দাগ গলায় বসেছিল। গালে থাপ্পড়ের দাগ।

ডাক্তার দাদু আবার মামনিকে বললেন, তোমার পেট ব্যাথা বললে যে মা? কয় মাস চলছে তোমার? কোন ডাক্তার দেখাচ্ছো?

মামনি বলল, সাত মাস চলছে আঙ্কেল। নিয়াজ বলেছে ডাক্তার দেখানো লাগবে না। কোন সমস্যা নেই, তাই ডাক্তার দেখাই নি।

এই সাত মাসে তুমি পেটের ভরে পড়েছো মা, বাকি দিন গুলোতে রেস্টে থাকো। নইলে বিপদ হতে পারে।

সেদিনের সব কথা আমার মনে আছে, মনে হচ্ছে চোখের সামনে সেই দিন গুলো। বাবাকে আমি সব রুপে দেখেছি, ভালো খারাপ দুটোই। সে এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন, তবে ভালোর থেকে খারাপ রুপটাই বেশি প্রকাশ পেতে শুরু করলো পরে, কারন আমার দাদী পরের দিকে আমাদের বাসায় বেশি আসতেন। তার একটাই লোভ ছিল, বাবার ব্যবসার টাকা।

বাবা প্রায় ছুটির দিনে বেড়াতে নিয়ে যেতো, ভিন্ন জগত, স্বপ্ন পুরী, কান্তজীর মন্দির, রাম সাগর আরো অনেক যায়গায়। সেসব দিন গুলোও মনে পড়ছে।

আবীর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ফিরে এলাম বর্তমানে। সারা রাত দুই ভাইবোনের ঘুম আসেনি, কত কথা কত স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে।

ভোরে রওনা দিলাম। রাস্তায় বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আবীরটা থেকে থেকেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছে। ৭/৮ ঘন্টার রাস্তা, মনে হচ্ছে যেন অনন্ত কাল ধরে চলছি। রাস্তা শেষই হয়না।

কত নদী, কত গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। বাবার মুখটা কেমন দেখবো? কতদিন পর বাবাকে দেখবো। চুল গুলো কি পেকে গেছে? আমি যখন ছোট ছিলাম, বাবার কাছে গল্প শুনতে চাইলে। বাবা বলতো, আমার পাকা চুল তুলে দাও তাহলে গল্প শোনাবো। বাবা গল্প বলতেন, আমি পাকা চুল তুলে দিতাম। মাঝে মাঝে চুল প্রতি ১ টাকা করে নিতাম। দিন গুলো আজ অনেক দূরের স্মৃতি।

দিনাজপুরের কাছে যখন গাড়ি চলে আসলো, বুকের ভেতর তোল পাড় হতে শুরু করলো। আমি ড্রাইভার চাচাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অনেক আগে বাবার সাথে দাদু বাসায় এসেছিলাম।

যত কাছে যাচ্ছি বাড়ির, ততই খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা আসছি, দাদু বাসার সবাই জানে। রাতে ছোট চাচুর সাথে কথা হয়েছে। যেসব যায়গায় রাস্তা চিনতে পারছিনা, সেসব যায়গায় চাচুকে ফোন করে রাস্তা জেনে নিচ্ছি।

যখন পাড়ার মোড়ে আসলাম, বহু মানুষকে দেখতে পাচ্ছি সাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা পড়ে যেতে। তারা হয়ত বাবার কবরে মাটি দেবার জন্য যাচ্ছেন। আমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। আমরা পৌঁছালে মাটি দেবার জন্য নিয়ে যাবে বাবাকে।

ঐ যে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি গাড়ির জানালা দিয়ে, আমার বাবা শুয়ে আছেন খাটলিতে। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রেখেছে বাবাকে। আমার বাবাকে। শুধুই আমার আর আবীরের বাবাকে।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here