ধূসর ভালোবাসা পর্ব-২৪

0
700

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-২৪

দূর থেকে বাবাকে খাটলিতে শোয়ানো দেখে চিৎকার করে উঠলাম, বাবা ও বাবা ……

আমি গাড়ি থেকে নামতেই আমার চাচারা আমার কাছে দৌড়ে আসলেন। আমি আর আবীর তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। দাদি আর দাদু বাবার মাথার কাছে বসে আছেন। আমাকে জড়িয়ে দাদু কাঁদতে লাগলেন। আবীর আমাকে শক্ত করে ধরে আছে। দাদি আমার পাশে বসলেন, পুরো মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কপালে একটা আদর দিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। কেন যেন, আমার সব রাগ হারিয়ে গেলো। তাকে জড়িয়ে ধরে আমিও কেঁদে ফেল্লাম।

আজ আমি কার উপর রাগ করবো, সে যে সন্তান হারিয়েছে। বাবা মা পাশে বসে আছে, আর তাদের সন্তান সাদা কাফনে জড়িয়ে খাটলিতে শুয়ে আছে। যে কোন বাবা মাই সে সময় জীবন্ত লাশ। প্রকৃতি তার সব কিছুর হিসেব সঠিক ভাবে নেন, তার হিসেবের কোন ভুল হয় না। তবে এটা কোন হিসেব প্রকৃতি মেলালো জানি না।

কিছুক্ষন পর চোখ খুলে দেখলাম, আমি দাদুর কোলে শুয়ে আছি, বাবার থেকে কিছু দূরে। আমার পুরো শরীরে পানি। সানেকা খালা আমার হাত ধরে কাঁদছেন। বুঝলাম, আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

আমরা জোহরের আযানের কিছু আগে পৌছেছি, বাবাকে জোহরের নামাজের পর নিয়ে যাবে মাটি দেবার জন্য।

আমাদেরকে দাদি আর ফুপুরা বাসার ভেতরে নিয়ে গেলেন, পুরো বাড়িতে বহু মানুষ। সবাই মামনির কথা জিজ্ঞেস করছেন। সবার মুখে মামনির সুনাম। সবাই দাদিকে বলছে, ছেলের জীবন থেকে লক্ষী সরাইছো তোমরা, এখন ছেলেই চলে গেলো। নেও এবার দেখ, আল্লাহর হিসাব। দাদি চুপচাপ শুনছেন আর কাঁদছেন। তার বলার মতো কিছু নেই আজ। বাড়ি ভর্তি মানুষের একটাই কথা, অতো ভালো বৌমাকে তোমরা কি অত্যাচার করেছো, মেয়েটাকে স্বামীর সংসার করতে দিলা না। এখন কি করবা? ছেলেইতো থাকলো না। এই ছেলেটাই তোমাদের কথায় ওঠে বসে। তোমাদের কথায় বৌমাকে খুব অত্যাচার করেছে। এখন বাকি যে ছেলে গুলা আছে, তাদের উপর দিয়ে তো কোন কথাও বলতে পারো না। আফিফাকে অসহায় করছিলা, এখন নিজেই সহায় হারালা।

আমাকে আর আবীরকে বাবার চাচার বাসায় গোসল করার জন্য নিয়ে গেলেন। উনি আমার ছোট দাদি। উনার কথা আমি মামনির ডায়রিতে পড়েছি, উনি মামনিকে খুব আদর করতেন। বুকের মাঝে আগলিয়ে রাখতেন, আমাকেও। উনার মুখ দেখেই বোঝা যায়, কতটা মায়া তার অন্তরে। আমাকে ছোট দাদি জিজ্ঞেস করলেন,

– তোমার মা কেমন আছে, দাদু?

– ভালো আছে।

– তোমার মা আসেনি ভালো করেছে। কোন সম্পর্কে আসবে। ভালো করেছে।

– ছোট দাদি, মামনি এখনও জানে না যে, বাবা বেঁচে নেই। মামনি নেটওয়ার্ক এর বাহিরে আছে। হয়ত কোন উপায় বের হতো চেষ্টা করলে। কিন্তু আমি চাইনি যে, সে এখানে আসুক। সে কারনে জানানোর চেষ্টাও করিনি।

দাদি এসে আমার পাশে বসে খুব কাঁদছেন, ছোট দাদি বললেন, নিয়াজের মা রাগ করোনা। মানুষকে কষ্ট দিলে নিজেকেও কষ্ট পেতে হয়। আফিফা তোমার ছেলের ঘর করার জন্য কতো অত্যাচার সহ্য করেছে তোমাদের। আর তোমরা দিনের পর দিন মেয়েটাকে কত যে জালিয়েছো। আল্লাহ তোমাকে সারাজীবনের কষ্ট দিলো। কি করে সহ্য করবা এখন?

বাড়ির অনেকের মুখেই মামনির সুনাম শুনছি। তাদের অনেককেই আমি চিনি না। তবে মামনির ডায়রির মাঝের অনেক নাম এর মানুষ ক্ষনে ক্ষনে আমার সামনে আসছে।

একজন এসে বলল, আমি রাজু তোমার বাবার বন্ধু। তোমার বাবা আমার ছোট বেলার বন্ধু। মনে পড়েছে ইনার নামও ছিল, মামনির ডায়রিতে। রাজু খুব দু:খ করলেন বাবার জন্য। আর বললেন, তোমার মাকে বলো আমাকে যেন মাফ করে দেয়। আফিফা খুব ভালো মেয়ে, ওর জীবনের এই পরিণতির জন্য আমিও দায়ী। তোমার আম্মাকে বলো, সে মাফ না করলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

গোসল, নামাজ সেরে, ছোট দাদির বারান্দায় বসলাম। এখান থেকে মসজিদ দেখা যাচ্ছে। বাবার খাটলিটা মসজিদের সামনে রাখা আছে। আমি বাবাকে দেখছি শেষ বারের মতো দু চোখ ভরে দেখছি। আবীর মসজিদে, দাদু আবীরের হাত ধরে আছে। আবীরটা কেমন অসহায় এর মতো বাবার দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। ওর দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি বেয়ে যাচ্ছে। ছোট মানুষ, বাবার ভালো স্মৃতি গুলো বুকে জড়িয়ে যেন বাকি জীবন বাবাকে ভালোবাসতে পারে। মন ভরে দোয়া করতে পারে, সেটা মনে মনে ভাবছি। আমাকে নিয়ে আমি কখনও ভাবি না, আমি যেমন পৃথিবীর ভালো রুপ দেখেছি, তেমন খারাপ। নিমিষে বহু কিছু ওলোট পালোট হতে দেখেছি। এখন নিজেকে রোবট এর মতো অনুভূতি হীন মনে হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু তবুও বেলা শেষে আবেগে বুক ভাসাই।

নামাজ শেষে, আমাদের শেষ বারের মতো বাবাকে দেখালেন, বাবার চুল গুলো আগের চেয়ে বেশি পেকে গেছে। ফর্শা মুখটা কালো হয়ে আছে, কারন বাবা এক্সিডেন্ট করলেও, মারা গেছেন স্ট্রোক করে। আর তাই মুখটা কালো হয়ে আছে। খুব কাছে থেকে বাবাকে একবার দেখলাম। কাছে বসে আসতে আসতে বললাম,

– দেখ বাবা আমি এসেছি বাবা, সাথে করে আবীরকে নিয়ে এসেছি। বাবা তুমি আমাকে পর করে দেয়েছিলে, কিন্তু আমি তোমাকে কখনও দূরে সরাতে পারিনি। তোমাকে খুব ভালোবেসেছি, তুমি কখনও তা বুঝোনি। বাবা ও বাবা দেখ, আমরা এসেছি।

আবীর কেমন যেন নিথর হয়ে বাবাকে শেষ বারের জন্য দেখছে। দাদিকে সবাই মিলে ধরে আছে, সে উন্মাদের মতো কাঁদছে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

দাদু আর আবীর বাবার খাটলি ধরার জন্য এগিয়ে গেলো। সাথে আমার চাচারা। আমি পৃথিবীর নির্মম কোন দৃশ্যের সাক্ষি হতে যাচ্ছি। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। দাদু ভেঙ্গে যাচ্ছেন। দাদুর পা, পায়ে পায়ে বাড়ি খাচ্ছে। পৃথিবীতে এর থেকে হয়তো আর কোন কিছুর ওজন বেশি হয় না। ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ’। চোখের সামনে এমনটাও দেখার ছিল। আমাকে আত্নীয় স্বজনেরা দাদু বাসায় নিয়ে গেলো। দাদু বাসায় যাবার ইচ্ছা হচ্ছিল না, কারন সেখানে ঐ মহিলাটা ছিল আর তার সন্তান। সবাই এসে দেখা করছে আমার সাথে। কেউ দাদা হয়, কেউ চাচা, কেউ দাদি আবার কেউ ফুপু। আমার এতো আত্নীয় আছে, অথচ আমরা দুই ভাইবোন একাই মানুষ হয়েছি। সবাই খুব আদর করছেন।

সবাই কবরস্থান থেকে ফিরে আসলে, আবীর দৌড়ে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি জানি সোনা, এ মূহুর্তে আমি ছাড়া এখানে কেউ তোমার আপন নেই, শুধু আজ নয় বাকিটা পুরো জীবন আমি তোমার সহায় হয়েই থাকবো। শক্ত করে তোর হাতটা ধরে রাখবো।

বাবার আগের অনেক বন্ধু এসে পরিচিত হলেন, তাদের মাঝে অনেকের নাম আমি মামনির ডায়রিতে পড়েছি। কত আপন জন আজ আমার আশে পাশে।

সব আত্নীয়দের সাথে দাদি আমাকে পরিচয় করে দিচ্ছেন। এর মাঝে পরিচয় করে দিলেন,

– এটা তোমার মা, আর এই দুটো তোমার ভাই।

– ইনি আমার বাবার বৌ, এটাই উনার পরিচয়। এর বাহিরে তাদের সাথে আমাদের কোন পরিচয় নাই। দাদি সন্ধ্যার আগে রওনা দিলে আমরা রাত ২/৩ টার মধ্যে ঢাকায় পৌছে যাবো। আমরা রওনা দেবো।

– কেন তোমরা আজকে থাকবে এখানে।

– না, তা সম্ভব না। আমরা রওনা দেবো।

আমরা চলে যাবো শুনে সমস্ত আত্নীয় স্বজন আমাদের কাছে আসলেন, দেখা করার জন্য। সবার সামনে আমি বললাম,

– বাবা নেই, তবে বাবা তার জীবনের সব কিছুই রেখে গেছেন। আর রেখে গেছেন বেশ কিছু…….
আমি ও আমার ভাই, বাবার কোন সম্পত্তি নিবো না। আমার বাবার সমস্ত সম্পত্তি তার নতুন সম্পর্কের মানুষদের মাঝে দিয়ে দিবেন।

এটা বলেই আমি সবার কাছে বিদায় নিলাম। কিন্তু কেউ রাজি হলেন না, আমাদের আসতে দিতে। মনে মনে বললাম, আজ যে অধিকারে আমাদের আটকাচ্ছ, কেন এতো দিন তা ফলাওনি। সন্ধ্যা নেমে আসলো, রাতে রওনা দিতে আমি আর সাহস পেলাম না। সবাইকে নিয়ে রাতটা রয়ে গেলাম। তবে শর্ত একটাই, আমার বাবার নতুন সম্পর্কের ওরা যেন আমাদের সামনে না আসে।

সন্ধ্যার কিছু পরে বাবার একজন বন্ধু আসলেন, আমরা দাদুর ঘরে বসেছিলাম, উনি নিজেই পরিচয় দিলেন,

– আমি তোমার বাবার বন্ধু রাজু। তোমরা চিনবা না আমাকে, তোমাদের আম্মা আমাকে চিনে।

আবীর বলল, আপু এই আঙ্কেল আমার সাথে ছিল বাবার কবর দেবার সময়। ইনি বাবার খুব কাছের বন্ধু। আমি সালাম দিলাম। উনি বসলেন।

তারপর বললেন, তোমাদের সাথে কিছু কথা বলবো বলে আসলাম।

– জী আঙ্কেল বলেন।

– আমি তোমার বাবার খুব ছোট বেলার ফ্রেন্ড। আমরা একসাথে বড় হয়েছি, পড়াশোনা করেছি।

মনে মনে বললাম, আমি জানি। মামনির ডায়েরি থেকে ইনার সম্পর্ক পড়েছি। ইনি তাহলে সেই রাজু। যার কাছে থেকেই সব ঘটনার শুরু।

– আঙ্কেল আপনার সাথে মাঝে হয়ত বাবার যোগাযোগ কম ছিল, কারন আপনাকে বাবার সাথে আমি কখনও দেখি নাই।

– হুম, মাঝের বছর গুলোনে জীবন গোছাতে আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম, তোমার বাবাও খুব একটা যোগাযোগ করেনি। কিন্তু তোমরা চলে যাবার বছর খানিক পর থেকে সে আমার কাছে আসে। এবং আমি দেখি যে আমার সামনে ভিন্ন এক নিয়াজ। যে নিয়াজ ছিল জেদি, একরোখা, বদমেজাজী। অথচ সেই নিয়াজ বনে গেছে একেবারেই অন্য এক নিয়াজ। সে আমার কাছে এসে, আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। বলে যে তার সব শেষ। সে সব হারিয়ে ফেলেছে। তোমার বাবা যার মোহতে পড়ে তোমাদের ভুলতে বসেছিল, সে তোমরা যাবার পরপরই তোমার বাবার কাছে থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। তোমরা যথেষ্ট বড় হয়ে গেছো, এবং অনেক কিছুই জানো তাই তোমাদের এ কথা গুলো আসলে বলছি। আর আমি মনে করি এগুলো তোমাদের জানা দরকার।

– আঙ্কেল আপনি বলন, সমস্যা নাই।

– এর পরের দিন গুলোতে তোমার বাবা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে, সে সম্পুর্ন একা হয়ে গেছে। তার পাশে তার একান্ত আপন বলে কেউ নেই। সারাদিন পর বাসায় ফিরলে, কাজের লোকেরা টেবিলে খাবার দেয়, কিন্তু যত্ন করে খাওয়ানোর কেউ নেই। বাবা বলে জড়িয়ে ধরার কেউ নেই। একটা পর্যায়ে সে বুঝতে পারে, যে জীবনে সে কি ভুল করেছে। কতটা অপরাধ করেছে তোমাদের সাথে। ততদিনে তোমাদের সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। আমার সামনে অন্য নিয়াজ। জীবনের কাছে হেরে যাওয়া অসহায় একটা মানুষ। সেদিন আমি বলেছিলাম, বন্ধু যাকে নিয়ে জীবন সাজাতে চেয়েছিলে, সে যদি তোমাকে ছেড়ে না যেতো? তুমিকি আফিফা আর বাচ্চাদের অভাব বুঝতে পারতে? তুমি কি তাদের ফেরত চাইতে?
সে কারনেই বন্ধু, আমি আর আফিফার সামনে যেতে পারলাম না। কারন সত্যি যদি, সে না চলে যেতো, আমি হয়তো আফিফা ও বাচ্চাদের অভাব খুব কমই বুঝতে পারতাম। তুই বল, রাজু আমি এখন কি করবো? সে উত্তর আমার কাছে নাই নিয়াজ। তোমার বাবা সে সময় খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন। এরপর থেকে আমার আর নিয়াজের আবার আগের মতো যোগাযোগ হতো। আমাকে প্রায়ই সব সময় নিয়াজ বাধ্য করতো, যে সব ছেড়ে তোমার বাবার কাছে ছুটে যেতে হতো।

দাদু আসলেন, উনি আমার পাশে বসলেন। বেশ কিছু আত্নীয় আসলেন আমাকে আর আবীরকে দেখতে। সবাই অবাক, নিয়াজের ছেলে মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে! তবুও নিয়াজ শেষ জীবন অবধী পাল্টাতে পারলো না। এতো সুন্দর লক্ষী ছেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ও মানুষ ভালো পথে চলতে শুরু করে। নিজের থেকে সন্তানের জীবন যে বেশি মূল্যবান। আজ এসব কথার কোন মানে নেই, আমার কাছে। কারন সে সব দিন আর কখনই ফিরবার নয়।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here