ধূসর ভালোবাসা পর্ব-২৭

0
661

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব ২৭

আবীরের বেশ কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করেও ওর খোঁজ পেলাম না। তারপর ঠিক রাত বারোটার দিকে আবীর, কলিং বেল টিপেছে। মামনি আবীরকে দেখা মাত্র থাপ্পড় দিলেন। খুব বকলেন। আবীর একটা কথাও বললো না। ঘরে চলে গেলো। আমি মামনিকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে ঘরে গেলাম। ঘরে গিয়ে দেখি আবীর শান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলকনিতে মেঝেতে বসে আছে। পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বললাম,

– ভাই কি হয়েছে তোর? কিছু লাগবে তোর? কেউ কিছু বলেছে?

অনেকক্ষন চুপ করে বসে রইল। তারপর আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আবীর ঠাঁই তাকিয়ে আছে আকাশে। আমি বুঝতে পারছি, আজ তার বুকের খুব গভীরে কষ্ট হানা দিয়েছে। মুখের ভাসায় এই কষ্টের বহি:প্রকাশ সম্ভব নয়। এমনটা আমার সাথে বহুবার হয়েছে। আমি জানি, এমন কষ্টে চোখের নানা জল শুকিয়ে যায়। রয়ে যায় বুকের ভেতরের কিছু দীর্ঘশ্বাস। যা কিনা তিক্ত কষ্ট গুলোকে লালন করে।

– ভাই কি হয়েছে, আমাকেও বলা যায় না? কোথায় ছিলি?

– রাস্তায় হাঁটছিলাম আপু।

-কেন, এতো রাতে রাস্তায় কেন? আমাকে কি কিছুই বলা যায় না ভাই? আমাকে তোর কষ্টের ভাগি করতে পারিস না?

– আপু আমার সাথে যারা পড়তো, বোর্ডিংএ। তাদের কয়েক জন আমার সাথে এখানেও পড়ছে। ওরা আমার মতো ভালো রেজাল্ট করতে পারে না। বোর্ডিং স্কুলেও ওরা আমাকে হিংসা করতো। আমার সম্পর্কে আজে বাজে কথা বলতো। সে কারনেই আমি ওখানে আর যেতে চাইনি। আমি এখানে ভর্তি হয়ে দেখি ওরাও এখানে পড়ছে। সারাক্ষন ওরা আমাকে বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করে। এবার ওরা সব বন্ধুদের বলেছে, যেন আমার সাথে না মেশে। আমি নাকি ভালো না, কারন আমার পরিবার ভালো না। আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়েছে, আর তাই আমার সাথে মেশা উচিৎ না। কয়েকদিন থেকেই দেখছি আমার ক্লাস মেটরা আমাকে এড়িয়ে চলছে। আজ আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ের সাথে কথা বলছি তখন ওকে ডেকে ক্লাসের অন্যরা কি যেন বললো। তারপর সবাই চলে গেলো। পরে একটা ছেলেকে খুব করে রিকুয়েস্ট করলাম যেন আমাকে বলে যে কি হয়েছে। তারপর সে সব বললো আমাকে। বলো আপু এখানে আমার কি দোষ?

আমি নির্বাক, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি। ঐ যে, সেই পুরোনো আকাশ, পুরোনো গল্প। পুরনো জীবনের কিছু আবছায়া আমি নিজেও দেখতে পাচ্ছি। মনে পড়ে গেলো, স্কুলে কয়েকটা ফ্রেন্ড আমার সাথে ঠিক এমনটাই করে ছিল। বাবা ড্রিংক করে, বাবার বাহিরে অনেকের সাথে উঠা বসা। তাই স্কুলে আমাকে এমন অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। কখনও মামনিকে বলেছি, কখনও নিজে নিজেই পুড়েছি কষ্টের নীল শিখায়। পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে আবার নিজেকে প্রস্তুত করেছি আগন্তুক কষ্টের জন্য। এখনও কি আমি এই কষ্টের উর্ধ্বে?

– ভাই, শোন, কিছু মানুষকে বিধাতা খুব স্পেশাল করে তৈরি করেন। বিধাতা তাদের অনেক ভালো বাসেন, তাই তাদের জীবনে রাজ্যের কষ্ট দিয়ে দেন। আর সেসব কষ্ট গুলোর কোন শেষ নেই। বিধাতা এভাবে তার ভালোবাসার মানুষ গুলোর পরীক্ষা নেন। তুমি উপর ওয়ালার কাছে খুব প্রিয়, তাই তোমার কষ্ট বেশি। তুমি কষ্ট পাবে, তখন উপর ওয়ালাকে বলবে, আমি জানি তুমি আমার পাশে আছো। তুমি উপর ওয়ালার উপর আস্থা রাখবে, তিনি একদিন না একদিন তোমার সব কষ্ট দূর করে দেবেন। এভাবে উনাকে স্মরণ করবে, দেখবে শান্তি লাগবে।
তোমার পরিচয় তুমি মানুষ। এখন তুমি ভালো মানুষ না খারাপ তা তোমাকে দেখে কেউ বুঝবে না। আর তাই ধৈর্য্য ধরো, তুমি তোমার মতো করে পথ চলো। সব বন্ধু ফেরত আসবে, যখন তারা বুঝবে যে তুমি আসলেই ভালো মানুষ। তখন ওরাই ক্ষমা চাইবে, তোমার সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করবে। আর সেটাই হবে, আসল বন্ধুত্ব। এখন ধৈর্য্য ধরো। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকো, আর নিজের যোগ্যতা তৈরী করো। যেন বাবা মায়ের পরিচয়ে তোমাকে মানুষ বিচার না করে, তোমাকে তোমার পরিচয়ে বিচার করতে পারে। পারবে না ভাই?

– পারবো, পারতে আমাকে হবেই আপু।

ছোট মানুষ, এই নির্মম পৃথিবীর কতটা দেখতে এখনও বাকি। আমি জানি, জীবনের বাঁকে বাঁকে এমন অনেক মানুষ থাকে যারা, জীবনে চলার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারা জানেও না, অকপটে তারা আসলে জীবনে বহুকিছু শিখিয়ে যায়। শিখিয়ে যায় কিভাবে প্রতিকূলতায় লড়তে হয়। নিজেকে কিভাবে প্রস্তুত করতে হয়, সকল প্রতিকূলতার বিপরীতে। একদিন আবীরও সব শিখে যাবে। তবে সেদিন ওর শিশু সুলভ মনের মৃত্যূ হবে, জন্ম হবে নতুন এক আবীরের।

রাত গভীরে, সাদের ফোন।

– কাল অফিস শেষে দেখা করতে পারবে প্লিজ। বাসায় যাবো, তোমাকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। নীল রঙ্গের একটা শাড়ি পরো প্লিজ।

– জি, হুকুম পালন করার চেষ্টা করবো।

– প্লিজ।

– ঠিক আছে।

সকালে একটা নীল শাড়ি পরলাম, কপালে নীল টিপ, নীল রঙ্গের রেশমী চুড়ি। মামনি আর নানীর সামনে যেতেই ভয় করছে, কি উত্তর দিবো। সব কিছু গুছিয়ে তাদের সামনে গেলাম। উনারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।

– কি হলো, কি দেখছো?

– তোকে খুব সুন্দর লাগছে মা। অফিসে কোন প্রগ্রাম আছে?

– ঐ যে, অফিস শেষে বান্ধবীদের সাথে একটু বাহিরে দেখা করবো।

– আচ্ছা ঠিক আছে। তবে রাতে তমালিকার বাসায় দাওয়াত আছে মা। সবাই মিলে যাবো কথা দিয়েছি। তুমি কিন্তু সন্ধ্যার পর পরই চলে এসো। রাতে এক সাথে যাবো।

– ঠিক আছে মামনি।

অফিস শেষে সাদের সাথে দেখা করার জন্য বের হতেই দেখি সাদ দাড়িয়ে আছে। হাতে একগুচ্ছ ফুল। আর বেলি ফুলের গাজরা। সাদ আজ একটা নীল রঙ্গের টি শার্ট পরেছে। সাদকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।

– এইযে, মশাই মতলব কি? এতো ম্যাচিং। বুড়ো বয়সে ভীমরতি কেন?

– জানিনা। হঠাৎ মন চাইলো। তোমাকে নীলের মাঝে দেখতে। আর আমিও নীল পরে নিলাম। অবন্তি ..

– বলো?

– তোমাকে আজ অপূর্ব সুন্দর লাগছে।

– মনে হচ্ছে আজ প্রথম দেখছো?

– কি জানি, আমার আজ শুধু তোমাকে দেখে মন ভরেছ না।

– যাও। রিক্সা ডাকো।

দুজনে রিক্সায় বেশ কিছুক্ষন ঘুরলাম। তারপর দুজনে কফি খেলাম। আজ সাদের সঙ্গ আমার খুব ভালো লাগছে। সাদকে আজ কোথাও যেতে দিতে মন চাইছে না। কেন যে বললাম, বাসায় যেতে। এখন কত যে চিন্তা হচ্ছে। সাদকে তা বলতেও পারছি না। তবে সাদকে তার বাবা মায়ের কাছে পাঠানো আমার নৈতিক দায়িত্ব। একজন সন্তান তার বাবা মাকে এভাবে কষ্ট দিতে পারে না। আর সাদের বাবা মা অনেক ভালো মানুষ। অতএব সাদের উচিত তাদের কাছে ফিরে যাওয়া।

– অবন্তি, তুমি আমার সাথে বাস স্ট্যান্ট পর্যন্ত যাবে?

– হঠাৎ, এমন করে এর আগে তো কখনও বলেনি?

– জানি না, আজ শুধু তোমার সাথে থাকতে মন চাইছে। মনে হচ্ছে, তোমার হাতটা শক্ত করে ধরি। কখনোই যেন না ছাড়ি। অবন্তি তুমি সারা জীবন আমার পাশে থেকো, তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার জন্য খুব কঠিন। আমি বাবা মাকে খুব ভালোবাসি। সেই সাথে তোমাকেও। ছোট্ট বেলা থেকে তুমি আমার জীবনে মনের ভেতর ভালোবাসার আসনে বসে আছো। ওটা শুধু তোমার স্থান। তুমি আমার পুরোটা জুড়ে।

– সাদ, আমার জীবনে ভালোবাসা প্রেম শব্দটা খুবই তিক্ত, বাবার কারনে। তুমি আমাকে বুঝতে শিখিয়েছো যে, প্রেম মানেই খারাপ নয়, তা এক স্বর্গীয় সুখ হতে পারে। ভালোবাসা নিয়ে সব দু:খ হাসি মুখে পাড়ি দেয়া যায়। ভালোবাসা মানেই ভোগ নয়, ত্যাগ ও মমত্ববোধ। তুমি আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছো সাদ, তুমি না থাকলে এই ঘুনে ধরা জীবন হয়ত কোথাও হারিয়ে যেতো। তোমার অস্তিত্ব আমার জীবনে তুলনাহীন। আমি কখনও চাইনা, তোমার হাত ছাড়তে। তোমাকে ছাড়া আমি কখনো আমার জীবন কল্পনাও করতে পারি না। আমার জীবনে তোমার বিকল্প কোন কিছুই নেই। বাড়ি যাও। ভালো ভাবে ঘুরে আসো।

সাদের সাথে বাসস্ট্যান্ড এ বসে আছি। বাস চলে আসলে, আমার মন কেমন করে উঠলো। সাদ উঠে গেলো বাসে,

– অবন্তি, অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি এক সাথে। আর খুব অল্প পথ। এর পরেই তুমি আর আমি অনন্ত পথ হাঁটবো হাত ধরে অবিরাম। ভালো থেকো।

সাদ হাত নেমে বিদায় নিল। আমিও বিদায় জানালাম। কিন্তু কেন যেন বুকের মধ্যে চিন চিন করছে। মনে হচ্ছে পাঁজর থেকে কি যেন সরে গেলো। শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছি। তুমি ছাড়া আমি নিস্ব, সাদ তুমি ফিরে এসো খুব জলদি।

ঘুরে দাঁড়ালাম, চোখে ঝাপসা দেখছি। চোখের পানিতে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষন ঠাঁই বসে রইলাম। তারপর রওনা দিলাম, বাসার দিকে।

মামনি সহ সবাই তৈরী হয়ে বসে আছে। আমি এসে ফ্রেশ হয়ে মামনিদের সাথে রওনা দিলাম। শাড়ি পরেই রওনা দিলাম।

মামনির অফিসের কলিগ এবং বান্ধবী তমালিকা আন্টির বাসায় দাওয়াত। সেখানে অনেকেই আমার পরিচিত। কারন ছোট থেকেই ইনাদেরকে মামনির পাশে দেখছি। তাই এই পরিবেশটা আমার বেশ প্রিয়। তাদের সবার পরিবারের সাথে আমাদেরও বেশ ভালো সম্পর্ক।

তবে আন্টি এবার অনেককেই দাওয়াত করেছেন। আন্টি মাঝে মাঝে সবাইকে দাওয়াত করেন। কোন কারন ছাড়াই। আন্টি সবাইকে নিয়ে আসলে, ভালো সময় কাটাতে চায়। কারন সে চায়, সবার মাঝে নিজের দু:খ গুলো ভুলতে।

আমারও বেশ লাগে তমালিকা আন্টির এই আয়োজন। মামনিরা সবাই কিছু না কিছু রান্না করে নিয়ে আসছে। প্রথমে অনেক গল্প, তারপর তমালিকা আন্টির কন্ঠে গান। সবাইকেই কিছু না কিছু করতে হয়। হয় সে গান, নইলে কবিতা। নইলে অন্য কিছু। সব মিলিয়ে খুব ভালো সময় যাচ্ছে।

তমালিকা আন্টি তার খালাতো বোনের সাথে পরিচয় করে দিলেন। উনার নাম, তহমিনা। উনি খুব মিশুক মানুষ। আমার সাথে উনার বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। আন্টি আমাকে দাওয়াত করলেন, উনার বাসায়। উনি খুব মজার মানুষ, কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।

খুব সুন্দর একটা সন্ধ্যা পার করলাম। তমালিকা আন্টির বাসার প্রতিটা মানুষ খুব ভালো এবং সহজ সরল। জীবনের বেশ সুন্দর স্মৃতি গুলো আছে আন্টিকে ঘিরে।

#সিরাজুম_মনিরা

একজন লেখকের একটা পর্ব লিখতে নিম্নে ৪/৫ ঘন্টা সময় লাগে। সেটাকে ঠিক ঠাক করে পাঠকের কাছে তুলে ধরেন আমাদের খুশির জন্য। আমরা ৪/৫ মিনিটে সেটা পড়ে শেষ করে একটা লাইক দিয়ে next লিখে চলে যাই। এটা না করে একটু ৮/১০ সেকেন্ড খরচ করে ছোট্ট সুন্দর একটা কমেন্ট করলে লেখকের লিখায় আরও স্পৃহা আসে, কষ্টটা কে সার্থক মনে হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here