ধূসর ভালোবাসা পর্ব-৬

0
920

#ধূসর_ভালোবাসা
৬ষ্ঠ পর্ব

বাবা আমাকে মহিলা কলেজে ভর্তি করালেন, ভর্তির পর প্রথম যে পরীক্ষা হলো তাতে আমি প্রথম হয়েছি। বাবা খুব খুশি হয়েছেন। কলেজেও আমার পরিচিতি বাড়লো। টিচারদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখন আমার বেশ অনেক গুলো বান্ধবী হয়েছে।

কলেজ জীবনটা আসলেই অনেক সুন্দর। যেহেতু মহিলা কলেজ তাই আমাদের অবাধ বিচরণ। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা গল্প, অনেক সুন্দর কাটছে দিন গুলো। তবে পড়াশোনায় আমি খুব সিরিয়াস। যত যাই করি, পড়াশোনা আমার সবার আগে।

আমাদের সবচেয়ে বড় বিনোদন হচ্ছে সিনেমা হলে সিনেমা দেখা। বাবা মা সহ, পাড়া প্রতিবেশি সহ সকলে এক সাথে সিনেমা দেখা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আমাদের সাথে এক বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকতেন যে আংকেল উনার পরিবার সহ, উনি সিনেমা হলের ম্যানেজার। আর তাই প্রায়ই সবাই মিলে খুব আনন্দ করে বেড়াতে যাওয়া হতো দুপুরের খাওয়ার পরে বের হতাম সবাই। ঘুরে বেড়ানোর পর কিছু খাওয়া হতো বাহিরে তারপর ছয়টা থেকে নয়টা সিনেমা দেখে বাড়ি আসা। এতো আনন্দে কাটে দিন গুলো।

দিনাজপুরেও আমরা অনেক ভালো প্রতিবেশি পেয়েছিলাম, আবার রংপুরেও আমাদের প্রতিবেশিরা খুব ভালো। মনে হয় যেন অনেক গুলো বাড়ি মিলে একটা পরিবার। পাশের বাসার লিয়াকত চাচা আমাকে অংক করাতেন। লিয়াকত চাচার ছোট ভাই আনিস চাচা উনার কাছে সাইন্সের বাকি বিষয় গুলো পড়তাম। উনারা এতো সুন্দর করে বুঝাতেন যে আমার বাহিরে খুব একটা পড়তে যেতে হয়নি।

এইচ এস সি এর প্রথম বর্ষ পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হলো, আমি ফাস্ট হয়েছি পুরো কলেজে, সব কটা সেকশনে মানে আর্স, কমার্স সহ। কলেজের শিক্ষকরা আমার নম্বর দেখে মহা খুশি, উনারা সবাই বললেন যে
– তুমি এভাবেই পড়বে, তাহলে বোর্ড স্ট্যান্ড করবে।

আমিতো মহা খুশি। বাবা মা সহ বাসার সবাই খুশি। লিয়াকত চাচা আমাকে একশ টাকা দিলেন খুশি হয়ে, আর বললেন – তোমার যা ইচ্ছা তুমি কিনে নিবে।

বাবা বললেন,
– বিকেলে তোকে বাজারে নিয়ে যাবো মা, তোর যা পছন্দ হয় আজ আমি তাই কিনে দেবো, তবে ফাইনালে এর থেকেও ভালো রেজাল্ট করতে হবে।

বিকেলে বাবার সাথে বাজারে গেলাম। বাবা সত্যি সত্যিই আজ অনেক কিছু কিনে দিয়েছেন। সব কিছু আমার পছন্দের। তবে আমি ইরার জন্যেও বেশ কিছু জিনিস নিয়েছি।

বের হয়ে রিক্সায় বসে আছি, মনে হলো নিয়াজের বন্ধু ওয়াসিমকে দেখতে পেলাম। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, কই কাউকে সে রকম আর দেখতে পেলাম না।

বাসায় এসে রিক্সা থেকে নেমে বাবার হাত থেকে বাজার করা জিনিস গুলো নিচ্ছি, দেখি কি ওয়াসিম। ঠিক আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে। আমি চমকে গেলাম। পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেলো। আবার পুরাতন বিপদ সামনে আসবে না তো?

আমি খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকে গেলাম। আমার রেজাল্ট ভালো হবার কারনে মা সবাইকে খাওয়াবেন কাল, তাই কাল কলেজে যাবো না। রান্নার প্রস্তুতি মা আজ থেকেই শুরু করেছেন। আশপাশের চাচিরা এসে মাকে রান্নায় সাহায্য করছেন। আমাদের সবার এই একতা টা খুব সুন্দর। কোন একজনের মেহমান আসলে, সবাই ঝাপিয়ে পড়ে কাজে সাহায্য করতে। কারো বাসায় বেশি মেহমান আসলেও অসুবিধা নাই। আশে পাশের সবার বাসা থেকে থালা বাসন গ্লাস নিয়ে মেহমান বিদায় করা কোন ব্যাপার না।

এই একতা এটাই বড় সম্বল। এক জনের আনন্দ সবার খুশির কারন। আবার কারো বেদনা সকলের কষ্টের কারন। সমাজের এই একতার কারনে আমরা যারা একসাথে বড় হচ্ছি। আমাদের মাঝে ঝগড়া ভেদাভেদ খুব কম।

পরদিন দুপুরে আশে পাশের সবাই আমাদের বাসায় এসেছেন দাওয়াত খেতে। সবার একই কথা ফাইনাল পরীক্ষায় এর থেকে বেশি আনন্দ করবো। মা বাবা আজ খুব খুশি।

আমারো খুব ইচ্ছে এইচ এস সি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে ডাক্তারি পড়ার। খুব ছোট থেকেই আমার ডাক্তার হওয়ার খুব ইচ্ছা।

বাবার বেশ কয়েকজন কলিগও আসলেন। এদের মধ্যে একটা কলিগের ফ্যামেলি আসলো, ইনারা দিনাজপুরে থাকতেন, উনার নাম সালাম চাচা। সাথে সালাম চাচার ছোট ভাই এসেছেন। উনার নাম রফিক, ইনাকে আমি কোথাও দেখেছি। মনে পড়েছে, নিয়াজের সাথে দেখেছি। এই রফিক নামের ছেলেটা নিয়াজের বন্ধু, একে আমি দিনাজপুরে দেখেছিলাম। তাইতো বলি, ছেলেটা আমাকে দেখার পর থেকে মুখ টিপে হাসছে।

আমার এখন খুব ভয় লাগতে শুরু করেছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতেও পারছি না, সবার মন এতো ভালো, এর মধ্যে কাউকে কি করে এগুলো বলবো।

দুইদিন পর কলেজে গেলাম। বার বার মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে দেখছে। কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না।

ক্লাসে বসে আছি, আমার বান্ধবী সেলি এসে আমাকে বলল,

– কিরে আফিফা? তুই যে ডুবে ডুবে জল খাস, তাতো জানতাম না।

আমি খুব অবাক হলাম সেলির কথায়।সেলিকে জিজ্ঞেস করলাম,

– সেলি তুই কি বলছিস, খুলে বল।

– কাল রফিক ভাই মিশুর সাথে দেখা করার জন্য এসেছিল কলেজের সামনে, আমি মিশুর সাথেই ছিলাম। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো, দিনাজপুর থেকে কোন মেয়ে এসেছে নাকি? যার নাম আফিফা, আর তোর চেহারার বর্ননা দিল। ওদের সাথে নিয়াজ নামের একটা ছেলে ছিল। ঐ ছেলেটার সাথে তোর নাকি সম্পর্ক আছে? তুই রংপুরে এসে ওর সাথে যোগাযোগ করিস নি। ছেলেটা তোকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমি পাথরের মতো জমে গেলাম মনে হচ্ছে, হাত পা অবস লাগছে। কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না, এর মাঝে ক্লাসে টিচার চলে এসেছে।

কলেজ শেষে, কলেজ গেটের বাহিরে পা রেখে আমি চমকে গেছি। মনে হচ্ছিল, এক দৌড়ে পালিয়ে যাই। কেন আমার সাথে এমনটা হচ্ছে?

আমার সামনে নিয়াজ দাঁড়ানো। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। আমি টান পায়ে একটা রিক্সা ডাকলাম।

নিয়াজ রিক্সা ওয়ালাকে চলে যেতে বললো, আর আমার সামনে এসে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর বললো,

– তোমাকে কতো খুঁজেছি জানো। বগুড়ায় তোমার দাদার বাসা, তাই বহুদিন বগুড়ায় থেকেছি। বগুড়ার সব কলেজের সামনে যেয়ে কয়েকদিন করে দাড়িয়ে থাকতাম। একদিন না আসলে আরেকদিন তো আসবে। কিন্ত তোমাকে পাইনি। তোমার বাবা যে ব্যাংকে চাকরি করে তার সব ব্রাঞ্চে গিয়ে দাড়িয়ে থেকেছি। এভাবে তিন মাস বগুড়ায় থেকেছি।
এরপর দিনাজপুরের ব্যাংকের পিয়নকে হাত করে জানতে পারি তোমার বাবা রংপুর এ বদলি হয়ে এসেছে। কিন্তু কোন ব্রাঞ্চে তা বলতে পারেনি। এখানেও তোমাকে প্রতিটা কলেজে আর তোমার বাবাকে ব্যাংকের ব্রাঞ্চ গুলোতে খুঁজেছি। গত পরশু ওয়াসিমের কাছে তোমার খোজ পেয়ে আমি আনন্দে আত্নহারা। গতকাল রফিক তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমাকে দেখেছে। আমি গত পরশু দিন রংপুরে চলে এসেছি। তোমাকে দেখতে পেয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমার চাওয়ার আর কিচ্ছু নেই। তুমি খুশি হওনি আফিফা আমাকে দেখে?

আমি চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

– মোটেও না, আমি মোটেও খুশি হইনি। আমি আগেও আপনাকে বলেছিলাম যে আমি আপনাকে ভালোবাসি না কিন্ত আপনি ভয় দেখিয়ে জোর করে আমার সাথে সম্পর্ক করতে চেয়েছেন। আমাকে বাধ্য করেছিলেন মিথ্যে বলতে। আমি আপনাকে আর ভয় পাই না। আর আমি কখনো কোনদিন আপনাকে ভালোবাসি নি, আর ভবিষ্যতেও আপনার ইচ্ছে পূরন হবে না।

এই বলেই রিক্সায় উঠে আমি বাসায় চলে আসলাম।

বাসায় এসে দেখি বাবার খুব জ্বর। বাবা অফিস থেকে চলে এসেছেন। বাবা শুয়ে আছেন আর মা মাথায় পানি ঢালছেন।

বাবার এমন অবস্থা দেখে ইরা খুব কাঁদছে। আমি ইরাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করলাম।মা ততোক্ষণে পাড়ার অনেক কেই খবর দিয়েছেন।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here