ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ২৩

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৩

ধ্রুব চলে যাওয়ার দুমাসের মাথায় হঠাৎ করেই আমার ঘন ঘন বমি, খাওয়া দাওয়ায় অরুচি, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা সহ আরো বেশ কি শারীরিক সমস্যা দেখা দিলো। আন্টিকে জানাতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন,”ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এসব প্রেগন্যান্সির সাইন সিম্পটম!”
সিউর হওয়ার জন্য পরেরদিন সকালে তিনি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন টেস্ট করানোর জন্য। টেস্ট শেষে ডাক্তার জানালো, রেজাল্ট পজেটিভ!

আমি বিস্ময়ে, খুশিতে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না! আমার ভেতর ছোট্ট আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে ভাবতেই নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছিলো!
শুধু একটাই আফসোস এইমুহূর্তে ধ্রুব পাশে থাকলে আমার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হতো।হাসিমুখে মা এবং আন্টি, দুজনকেই সালাম করলাম। আন্টির তো খুশিতে কেঁদে ফেলার অবস্থা! ধ্রুব, তরু, আত্মীয়স্বজন আর কাউকে বাদ রাখলেন না, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ফোন করে জানালেন। তারপর থেকে আমার কাছে একেরপর এক ফোন আসা শুরু হলো। সবার অভিনন্দন নিতে নিতে রীতিমত হাঁপিয়ে গেলাম। ধীরেসুস্থে যে ধ্রুবর সাথে একটু কথা বলবো সেই সুযোগটুকুও নেই। রাতে ধ্রুবই ফোন করলো। রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলো,”ফ্রি আছো? কথা বলা যাবে?”

—“হুম।”

—“কেমন আছো?”

—“ভালো।”

—“ফোন বন্ধ কেন?”

—“চার্জ ছিলো না।

তারপর দুজনেই চুপচাপ! পিনপতন নিরবতা! মাঝেমাঝে নিশ্বাসের শব্দ! ভাবছিলাম ধ্রুব পাশে নেই তো কি হয়েছে, হৃদয়ের কাছাকাছি তো আছে! একান্ত আপন দুটো মানুষ একে অপরের খুশিটুকু অনুভব করার চেষ্টা করলাম! মিনিট খানেক অতিবাহিত হওয়ার পর ধ্রুবর হাসির শব্দ শোনা গেলো। মিষ্টিমধুর কন্ঠে হেসে বললো,”কংগ্রাচুলেশনস বাবুর আম্মু!”

আমি লাজুক হেসে বললাম,”বাবুর বাবাকেও কংগ্রাচুলেশনস!”

—“শুকনো কংগ্রাচুলেশনে তো বাবুর বাবার মন ভরবে না।”

—“তবে কিসে ভরবে?”

—“সেটা এলেই দেখতে পাবে!”

আমি লজ্জা পেলেও প্রকাশ করলাম না। ভেংচি কেটে বললাম,”শখ কত! কচু দেবো তোমাকে!” ওপাশ থেকে ধ্রুব প্রাণখোলা হাসির শব্দ শোনা গেলো। ভেজালহীন, নিখাঁদ হাসি! অনবরত হেসেই যাচ্ছিলো। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম ধ্রুবর এই খুশিটার জন্যে হলেও আমার মা হওয়াটা স্বার্থক!

তারপর থেকে ধ্রুব রোজ দুইতিনবার করে ফোন করে আমার খোঁজখবর নিতো। কখনো আন্টির কাছে কখনো আমার কাছে। কবে ও দেশে ফিরবে তার প্রতিক্ষায় দিন কাটাতে লাগলাম। মাসখানেক বাদে একদিন আন্টি জানালো ধ্রুব দেশে ফিরছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে আন্টিকে জড়িয়ে ধরেই নাচতে শুরু করলাম! আন্টি তো হেসে কুটিকুটি! হঠাৎ মনে পড়লো হায় আল্লাহ কি করছি আমি! লজ্জায় সরে দাঁড়ালাম। আন্টি আমার আরক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন,”আর লজ্জা পেতে হবে না। তুই এখানে পাগল হয়েছিস আরেকজন ওখানে পাগল হয়ে আছে। দেশে ফেরার জন্য উতলা হয়ে আছে। কতবার যে ইনিয়েবিনিয়ে তোর কথা জিজ্ঞেস করছে!” আমি আবারো মুচকি হাসলাম।

সপ্তাহখানেক বাদে ধ্রুব দেশে ফিরলো। আন্টি দরজা খুলতেই তাঁকে সালাম করে ভেতরে ঢুকলো। তারপরই শুরু হলো মা ছেলের চিৎকার চেঁচামেচি। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সজোর চিৎকার শুরু করে দিলো। চিৎকার চেঁচামেচিতে পুরো বাসা তুলে ফেলার উপক্রম! ধ্রুব আন্টিকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে বললো,”ও মাআআ! আমি বাবা হচ্ছি! বাবা, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।” আন্টি পালটা চিৎকার দিয়ে বললেন,”আমি দাদু হচ্ছি! দাদু,আমাদের বাসায় নতুন অতিথী আসছে। কি যে আনন্দ লাগছে!”
আমি ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে দুজনের পাগলামি দেখছিলাম আর হাসছিলাম।
অনেক্ষন চিৎকার চেঁচামেচি শেষে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসে পড়লো। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে ধ্রুব রুমের যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। আমিও পেছন পেছন গেলাম।

রুমে ঢুকে দেখলাম হাতদুটো দুদিকে ছড়িয়ে ধ্রুব সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমি খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ও আমার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুললো। মুচকি হেসে বললো,”তারপর? সৎবউ, কি খবর আপনার? আপনি কি কিছু বলবেন?”

আর সবার মত এইসময়টুকুতে আমিও ধ্রুবর কাছে খানিকটা ভালোবাসা প্রত্যাশা করছিলাম। ভেবেছিলাম রুমে ঢুকেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না!

মুখ ভার করে সরে যাচ্ছিলাম। ধ্রুব চট করে আমাকে টেনে ওর পাশে বসালো। আমার কোলের ওর মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর আমার ডানহাতটা টেনে নিজের মাথায় রেখে চুলে বিলি কেটে দিতে ইশারা করলো। আমি নিরবে বিলি কাটতে লাগলাম কিন্তু কোন কথা বলছিলাম না। ধ্রুব এই কথা সেই কথা বলছিলো, কিন্তু আমার কাছে থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। হাতে হাত রেখে মিষ্টি করে হাসলো। আদুরে গলায় বললো,”আমার বউটার মন খারাপ কেন? কি হয়েছে?”

ধ্রুবর আদুরে ডাক বরাবরই আমার অভিমান বাড়িয়ে দেয়। তাই জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ধ্রুব উঠে বসলো। আচমকা আমাকে টেনে শুইয়ে দিয়ে নিজে আমার ওপর ঝুঁকে বসলো। ওর চোখজোড়া আমার সমগ্রমুখে প্রদক্ষিণ করে অভিমানের পাল্লাটা পরিমাপ করে নিলো। বেশ ভারি বুঝতে পেরে চোখেচোখ রেখে মায়াভরা কন্ঠে বললো,”কি হয়েছে তোমার?” আমি অভিমানী কন্ঠে বললাম,”দেখি ছাড়ো। আমার কাজ আছে।”

—“কেন আমাকে ভালো লাগছে না?”

—“আমার ভালোলাগা না লাগা দিয়ে কি আসে যায়! তোমার কি আর সেসব দেখার সময় আছে। তুমি তো এখন বেবি আসার আনন্দে ব্যস্ত!”

আমার চোখে অভিযোগ! ধ্রুবর চোখে ভালোবাসা! বোধকরি এবার ও আমার অভিমানের কারণ বুঝতে পেরেছে। গভীর আবেগে আমার মুখের দিকে চেয়ে অনুচ্চস্বরে ফিসফিস করে বললো,”তুমি ঠিকই বলেছো। আমি খুশি, খুব খুশি! আই এম হ্যাপি, ভেরি হ্যাপি! অ্যান্ড অফকোর্স আই ফিল ব্লিসফুল টু বি আ ফাদার!”

আমি চুপ করে রইলাম। ধ্রব মুচকি হেসে বললো,”আমি অনেক বেশি খুশি ঠিকই ম্যাডাম কিন্তু তারমানে এই নয় যে আমি আপনাকে ভুলে গেছি কিংবা ভুলে যাবো। ফর মি, ইউ আর দ্যা ফার্স্ট! আমার জন্য সবার আগে তুমি!”
রাগ অভিমান নিমিষেই উবে গেলো! মুগ্ধ, মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ও গভীর স্নেহে আমার কপালে চুমু খেলো।

সুযোগ পেয়ে আমিও দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ও প্রথমে কিছু বললো না। আধশোয়া অবস্থায় স্থির হয়ে রইলো। তারপর আমার নাক টেনে দিয়ে বললো,”আপনার জন্য বুকভর্তি ভালোবাসা জমে আছে ম্যাডাম। চাইবা মাত্রই দিতে বাধ্য থাকিবো! কিন্তু দয়া করে এখন আমাকে ছাড়তে হবে! ফ্রেশ হবো! এসেছি থেকে এখনো হাতমুখও ধুই নি।”
লজ্জা পেয়ে আমি ছেড়ে দিলাম! ডাইনিং রুম থেকে আন্টির গলার আওয়াজ শুনে লজ্জা আরো বেড়ে গেলো। তিনি কি ভাবছেন আল্লাহই জানে! আমাকে লজ্জা পেতে দেখে ধ্রুব আবারো দুষ্টুভাবে হাসলো।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here