# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২৪
গত দুদিন যাবত ধ্রুবর শরীর ভালো নেই। জ্বর, মাথাব্যথা, বমি! ক্ষুধামান্দ্য। ওষুধ খাওয়ার পরেও জ্বর কমার কোন লক্ষণই নেই। দুদিন সারাদিন বিছানায় শুয়ে ছিলো। কিন্তু দুষ্টুমি কমলো না। বিছানায় শুয়েও হাসতে হাসতে বললো,”ভালোবাসার কি টান দেখেছো? তোমার সাথে সাথে আমারও প্রেগন্যান্সির সিম্পটম শুরু হয়েছে! আই অ্যাম ভেরি প্রাউড অফ মাইসেল্ফ!”
এই পাগলকে নিয়ে কি করবো আমি বুঝতে পারলাম না। হেসে ফেললাম। তারপরেরদিন একটু সুস্থ হতেই বিকেলে আমাকে চেকাপে নিয়ে বেরোলো। আন্টিও আমাদের সাথে বেরোলেন তবে তিনি হস্পিটালে গেলেন না। ধ্রুব চলে যাওয়ার পর অনেকদিন যাবত তরুর সাথে তাঁর দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছিলো না। তাই সু্যোগ পেয়ে বেড়াতে চলে গেলেন!
আমার চেকাপ শেষে ডাক্তার জানালো সব ঠিক আছে। প্রেগন্যান্সির সময় কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন।
হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় ধ্রুবর হাত ধরতেই প্রচন্ড গরম অনুভূত হলো। আমি ওকে নিয়ে আবার জোর করে হস্পিটালে ঢুকলাম। ও বিরক্ত হচ্ছিলো। বারবার করে বাসায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে বললো,” এখানে আর পাঁচমিনিট থাকলে আমি এমনিতেই অসুস্থ হয়ে যাবো।” আমি ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম দুর্বল শরীরে হস্পিটালে বসে থাকা বাস্তবিকই ওর পক্ষে কষ্টকর। তবুও নরম গলায় বললাম,”হস্পিটালে যখন এসেছি তখন ডাক্তার দেখিয়েই যাও! প্লিজ!” ও মুখ ভার করে বললো,”ঠিক আছে চলো।”
ডাক্তারের কাছে ধ্রুবর অসুস্থতার বর্ননা সব আমিই করলাম। ও চুপচাপ বসে ছিলো আর মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে মুখটিপে হাসছিলো। আমি চোখ পাকাতেই হেসে উঠে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো,”হেই, ডক্টর ডু ইউ নো দ্যাট, ফিভার ইজ দ্যা মোস্ট ডেডলি ডিজিজ ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড! জ্বর হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে একটি! আপনাকে যদি জ্বর ছাড়া আর একটা সিরিয়াস টাইপ রোগের নাম বলতে বলা হয়,যেই রোগ হলে মানুষ মরে যায়, পারবেন? পারবেন না! কারন জ্বরের মত ভয়াবহ রোগ আর কিছু হতেই পারে না। ঠিক বলেছি না নিশাত? ”
বয়স্ক ডাক্তার হাসলেন। আমি ধ্রুবর ঠাট্টা গা করলাম না। ও এমনই! ইঞ্জেকশন দেওয়ার জন্য, ওষুধ খাওয়ার জন্য আমাকে হাজারটা কথা শুনিয়ে দিতে পারবে কিন্তু নিজের বেলায় সব ভুলে যাবে। আমিও নিজের মনোভাবে অটল থেকে জোরগলায় ওকে উদ্দেশ্য করে ডাক্তারকে বললাম,” আপনি হাসছেন কেন ডাক্তার? এটা কি হাসির কথা? হতে পারে জ্বর তেমন কোন সিরিয়াস কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে কি জ্বর হলে মানুষ ওষুধ খাবে না? চিকিৎসা করবে না? ”
ধ্রুব আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,”রাগছো কেন নিশাত? আমিও তো সেটাই বলেছি। জ্বর কিন্তু খুবই সিরিয়াস ডিজিজ, অবশ্যই ওষুধ খাওয়া দরকার! তাই না ডাক্তার?”
আমি চোখ গরম করে ওর দিকে তাকালাম। এর মানে,’আর একটা কথাও বলবে না তুমি।” ডাক্তার সাহেব আমার গম্ভীর মুখখানার দিকে খেয়াল করে বললেন,”রিলেক্স মিসেস ধ্রুব, এত প্যানিকড হওয়ার কিছু নেই। সামান্য জ্বর, ওষুধ দিলেই সেরে যাবে। তবুও আপনার সেটিসফ্যাকশনের জন্য আমি উনার কিছু টেস্ট দিচ্ছি। চাইলে এক্ষুনি করিয়ে নিতে পারেন।”
ডাক্তার টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া টেস্ট, সিটি স্ক্যানসহ আরো কিছু টেস্ট এর নাম লিখে দিলেন। ধ্রুব আমাকে নিয়ে রিসিপশনের দিকে যেতে যেতে বলল,”এই জন্য মহিলাদের নিয়ে বেরোনো উচিৎ না। হস্পিটাল হোক কিংবা শপিং মল, একগাদা টাকা খরচ করিয়েই ছাড়বে।”
আমি হেসে ফেললাম। টেস্ট শেষে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন। আমি আর ধ্রুব পাশাপাশি চেয়ার টেনে বসলাম। ডাক্তার একে একে রিপোর্টগুলো দেখতে দেখতে বললেন,”চিন্তার কিছু নেই, এভ্রিথিং ইজ অলরাইট!” ধ্রুব হাসলো,বললো,”শুনেছো?”
আমি ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে তার মনোভাব পর্যবেক্ষণ করছিলাম। এইমুহূর্তে তার হাতে সিটি স্ক্যান এর রিপোর্ট! মুখ গম্ভীর! আমার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হলো। ভয়ার্ত চোখে ডাক্তারের দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি নোটবুক বের করে আরো কিছু ডায়াগনোস্টিক টেস্ট এর নাম লিখলেন। ধ্রুব আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ডাক্তারের দিকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করলো,” এনিথিং সিরিয়াস?”
ডাক্তার এবারেও কিঞ্চিৎ হাসলেন। তবে এবারের হাসিটা আগের মত নির্ভার নয়। এই হাসিতে স্পষ্টত চিন্তার ছাপ। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে চেয়ে রইলাম। বৃদ্ধ ডাক্তার চিন্তিতমুখে বললেন,”মি.ধ্রুব আমি সিউর হতে পারছি না। ভালো হবে আপনি যদি অতিসত্তর একটা এম আর আই করে নেন।” ডাক্তার কি বলছে কি বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু তিনি যে খারাপ কিছুর আশংকা করছেন বেশ বুঝতে পারলাম। আমি ধৈর্য রাখতে পারলাম না। দুশ্চিন্তায়, আতংকে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলাম,”হোয়াট ইজ ইউর প্রেডিকশন স্যার? আপনি কি বলে ধারনা করছেন?”
ডাক্তার কিছু বললেন না। ফোন করে কাকে যেন ভেতরে আসতে বললেন। একটুপরই একটা তরুণ বয়সী ছেলে এসে ভেতরে ঢুকলো। ডাক্তার ধ্রুবকে বললেন,”আপনি ওর সাথে যান, এম আর আই টা করিয়ে আসুন।”
ধ্রুবর চোখে ভয়! মুখ ফ্যাকাশে! আমার অবস্থাও একইরকম। বুক ধড়ফড় করছে! চোখে পানি চলে এসেছে! আমার আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে ধ্রুব হেসে ফেললো। এম আর রুমে ঢোকার আগে ফিসফিস করে বললো,”এদের উদ্দেশ্যটা কি? আমার কিডনী,বেঁচে দেবে না তো আবার?” যদিও আমি ঠাট্টা সহ্য করার পরিস্থিতিতে ছিলাম না। তথাপি কৃত্রিম হাসার চেষ্টা করে বললাম,”আল্লাহকে ডাকো!”
এম আর আই রিপোর্টের জন্য একসপ্তাহের মত অপেক্ষা করত হলে। এই এক সপ্তাহ ধ্রুবর মাঝে কোন চিন্তাই ছিলো না। দিব্যি হাসাহাসি করছে, হৈ-হুল্লোড় করছে আর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রিপোর্টের কথা বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে! কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারলাম না। মনের মধ্যে কু ডাকছিলো। রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারি নি। ভয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো। রোজ রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখলাম। ভয়ে বুক কাঁপতো!
এম আর আই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর ধ্রুবকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করলেন। আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলাম,”ইয়া আল্লাহ, আমাকে যত ইচ্ছা কষ্ট দাও, কিন্তু আমার ধ্রুবর কিছু হতে দিও না মাবুদ! তুমি ওকে রক্ষা করো!” ধ্রুব আমার পাশে চুপচাপ বসে ছিলো। হঠাৎ ডাক্তার বিষন্ন মুখে বললেন,”ইউ আর রাইট মিসেস ধ্রুব! ইট ওয়াজ নট ফান!’
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। বুকের ভেতর বেসামাল ধুকপুকানি শুরু হলো।ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো জিজ্ঞেস করলেই যদি খারাপ কিছু শুনি। ধ্রুবই সাহস করে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে স্যার?”
ডাক্তার মিনিট খানেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরাশ মুখে বললেন,”সরি টু স্যে মিসেস ধ্রুব, আই থিংক মি.ধ্রুব হ্যাজ আ সেকেন্ডারি ব্রেইন টিউমার হুইচ ইজ ক্যান্সারাস!”
আমি এবং ধ্রুব বিস্ফোরিত নয়নে একে অপরের দিকে তাকালাম! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! ভোঁ ভোঁ করে আমার চারপাশটা ঘুরতে শুরু করলো। চোখেমুখে অন্ধকার হয়ে এলো। ঢলে পড়ে যাচ্ছিলাম ধ্রুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেললো। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে পানি খাওয়ালো। আমি ধ্রুবর হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। কর্তব্যরত অন্যান্য চিকিৎসক এবং নার্সেরা আমার চিৎকার শুনে এগিয়ে এলো। ধ্রুব আমার হাত ধরে অসহায়ের মত চেয়ে রইলো!
বৃদ্ধ ডাক্তার আমার কান্না দেখে বারবার সান্ত্বনা দিয়ে বললো,”এখনো এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই মিসেস ধ্রুব। আপনি শান্ত হোন! রোগ যেমন আছে রোগের চিকিৎসাও আছে। মেডিকেল সাইন্সে এখন এসব রোগের চিকিৎসা করাটা কোন ব্যাপারই নয়। হতাশ হবেননা। ধৈর্য রাখুন! ”
ধ্রুব নির্বাক! মুখে অন্ধকার ভর করেছে। ডাক্তার ওকে পরামর্শ দিয়ে বললো,”মি. ধ্রুব আপনি বরং এঞ্জিওগ্রাফিটাও করিয়ে ফেলুন। তারপর ভেবে চিন্তে আমরা ট্রিটমেন্ট শুরু করবো।” ধ্রুব মাথা নেড়ে সায় জানালো।
হস্পিটাল থেকে বাসায় পৌঁছানো অব্দি ধ্রুব একটা কথাও বললো না। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটার মত বেজে গেলো। আন্টি এখনো তরুর বাসা থেকে ফেরেন নি! আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম ধ্রুব চুপচাপ সোফায় বসে আছে। নিজেকে শক্ত করে ওর পায়ের কাছে বসলাম। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম,”কি ভাবছো?” উত্তর করলো না। আমি আবারো শক্ত থাকার চেষ্টা করে বললাম,”ডাক্তার ঠিকই বলেছে ধ্রুব। রোগ থাকলে রোগের চিকিৎসাও আছে! কিচ্ছু হবে না তোমার! তুমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। ইনশাআল্লাহ তুমি ভালো হয়ে যাবে।”
ধ্রুব তখনো নিশ্চুপ! সোফার হাতলে কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম,”এই কি হয়েছে তোমার? কথা বলছো কেন? প্লিজ কথা বলো। আমি বলছি তো, তোমার কিচ্ছু হয় নি। তুমি ভালো হয়ে যাবে! দোহাই তোমার স্বাভাবিক হও!”
আমি যখন ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, ধ্রুব আমার বাহু চেপে ধরে আমাকে সোজা করলো। ওর চোখ লাল, মুখ গম্ভীর। আমি ওর মুখে থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় অসহায় চাতকের মত চেয়ে রইলাম। ধ্রুব নিষ্পলকভাবে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললো,”আমার কথা শোনো নিশাত! বাচ্চাটাকে অ্যাবোরশন করাতে হবে।” আমি প্রচন্ড বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম! কি বলছে ধ্রুব! হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে এলো! ধ্রুব দুহাতে আলতো করে আমার মুখটা তুলে ধরে বললো,”ইমোশনাল হয়ো না নিশাত। আমার কিছু হয়ে গেলে তোমার আর আমার বাচ্চাটার কি হবে?” বলতে বলতেই ও কেঁদে ফেললো।
আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম শুধু! আমার ধ্রুব কাঁদছে! এই দৃশ্য দেখার আগে কেন আমি মরে গেলাম না! কোন অপরাধে শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো খোদা! কেন তুমি আমার ধ্রুবকে এভাবে কাঁদাচ্ছো! এত নিষ্ঠুর হয়ো না খোদা। ওর কিছু হলে আমি মরে যাবো!
.
.
.
চলবে