ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৩

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩

আমার সম্মতি পেয়ে বাবা ছেলের সব খোঁজখবর নেওয়ার জন্য লোক লাগিয়ে দিলেন। প্রায় রাতেই তিনি এবং মা মিলে গভীর আলোচনায় বসতেন। মাঝেমাঝে ছোটমামার কাছে টেলিফোন করে কিসব খবরাখবর নিতেন। আমার সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কারণ সেমিস্টার ঘনিয়ে এসেছে। অতএব পড়াশোনা করতে হবে। তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। যদিও আমি খুব ভালোছাত্রী নই। কিন্তু তাই বলে তো পরীক্ষার সময় হাত পা গুটিয়ে থাকলে চলবে না। তাই পরীক্ষার আগের দিনগুলো পড়াশোনাতেই ব্যয় করলাম।

দেড়মাস বাদে পরীক্ষা শেষ হলো। ধ্রুব গিয়েছে প্রায় ছয়মাসের মত হয়ে গিয়েছে। শুনেছি বাসায় এসেছে তবে আমার সাথে দেখা হয় নি। আমি ওদের বাসায় যাই না। বেশ কয়েকদিন বাদে একদিন বিকেলে দিকে ছাদে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ হাতে টান অনুভব করতেই চমকে উঠলাম! ধ্রুব আমার হাত চেপে ধরেছে। ও ছাদে উঠেছে কখন আমি খেয়াল করি নি। আমি প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। বিকেলবেলা ছাদে ফুরফুরে বাতাস থাকে। বসে থাকতে খুব ভালো লাগে। আমি নিঃশব্দে উপভোগ করছিলাম। ওকে আচমকা আমার হাত ধরতে দেখে ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকালাম। তার কারণ কেউ দেখে ফেললে আমার মানসম্মান সব শেষ! আমি ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করলাম। ও আমাকে টেনে সিঁড়িপথে নিয়ে এলো। বিরক্তমুখে জিজ্ঞেস করলো আমার এসব পাগলামির উদ্দেশ্যে কি?

আমি বুঝতে পারছিলাম ও হয়ত আমার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। তবুও না বোঝার ভান করে বললাম,”কোনসব পাগলামি?”

আমি যে খুব সহজে কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো না সেটা বুঝতে পেরেই ধ্রুব সরাসরি প্রশ্ন করলো,”তোমার বিয়ে?”

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,”আশ্চর্য! এখানে পাগলামির কি হলো? আমার বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সেটাকে আপনার পাগলামি মনে হচ্ছে কেন?”

ধ্রুব আমার নাটকে পাত্তা দিলো না। বললো,”হচ্ছে। কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না তুমি বাধা দিচ্ছো না কেন?”

আমি পুনরায় অবাক হয়ে বললাম,”আমি বাধা দেবো ? কেন? আমার কি বাধা দেওয়ার কথা ছিলো?”

এই কথা শুনে ধ্রুব অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। পরোক্ষনেই আত্মসংবরণ করে বললো,”তোমার বাধা দেওয়ার কথা ছিলো না?”

আমি দৃঢ় কন্ঠে বললাম,”না। আর থাকলেও আমি বাধা দিতাম না। বাবা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”

ভেবেছিলাম কথাটা বলার পর ধ্রুব হয়ত রেগে যাবে। আমাকে অনেক কথা শোনাবে। ও সেসব কিছুই না করে বললো,”ঠিক আছে। তোমার তুমি বলতে না পারো তো আমি কথা বলবো তোমার বাসায়!”

আমি বাধা দিয়ে বললাম,”আপনি কেন বলবেন?”

—“কেন বলবো আবার? আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই।”

আমি পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ দৃঢ় কন্ঠ বললাম,”না। আপনি কিচ্ছু বলবেন না।”

ধ্রুব রেগে গেলো। চোখলাল করে বললো,”না কেন? তুমি নিজেও বলবে না, আমাকেও বলতে দেবে না কেন?”

—“কারণ আপনার সাথে আগেই আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। এখন আপনি আমার কাছে শুধুমাত্র আমার এক্স!”

—“তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

—“না।”

ধ্রুব অবাক করা দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো। আমি ছাদ থেকে নেমে আসতে চাইলাম। ধ্রুব পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”তুমি সিউর, তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

আমি একই রকমভাবে বললাম,”না। বাসি না।”

ধ্রুব ফের প্রশ্ন করলো, “বাসো না?” ওর চোখেমুখে স্পষ্টত অবিশ্বাস। আমি জোর দিয়ে বললাম, “বললাম তো বাসি না।”

ধ্রুব তখনো আমার হাত ধরে ছিলো। নরম গলায় বললো,”আমি যে তোমার জন্যই এসেছিলাম!”

—“কেন এসেছেন? আমি কি আপনাকে আসতে বলেছি? বলি নি। তাহলে কেন এলেন? আপনার সাথে তো সেই কবেই আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ইনফেক্ট ঐ সম্পর্কটার কথা আমি ভুলেই গেছি।”

ধ্রুব একদৃষ্টিতে আমার দিয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। ওর সেই দৃষ্টি সার্চলাইটের মত আমার সমগ্র মুখে বিচরণ করছিলো। আমি অস্বস্তি লাগছিলো। ওর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকাতে মাথা নিচু করে ফেললাম।
ধ্রুব অবিশ্বাসী কন্ঠে বললো,”তুমি অনেক বদলে গেছো নিশাত। এই নিশাতকে আমি কখনো ভালোবাসি নি।” তারপর আমার হাত ছেড়ে দিলো। ও এত সহজে রাজী হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারি নি। আমার একটু খারাপ লাগলো। নরম গলায় বললাম,”সরি! আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই নি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।”

সত্যিই এইমুহূর্তে আমার কিছু করার নেই। কারণ বাবা মা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় ধ্রুবর সাথে আমার রিলেশন আছে কিংবা ছিলো তাহলে তারা খুব কষ্ট পাবে। পাত্র হিসেবে তারা ধ্রুবকে পছন্দ করলেও মেয়ে হিসেবে তাদের কাছে আমি খুব ছোট হয়ে যাবো। আমার প্রতি তাদের বিশ্বাসের জায়গাটা সারা জীবনের জন্য নড়বড়ে হয়ে যাবে। ছোটবেলায় জেদের কারণে তারা আমাকে কখনো বিশ্বাস করতে পারে নি। অনেক কষ্টে বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরী করেছি। ধ্রুবর জন্য আমি সেই জায়গা হারাতে চাই না। তাই ধ্রুবকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় নেই। তবে ধ্রুবর জন্য আমার খারাপ লাগছিলো।

ধ্রুব আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে বললো,”ইটস ওকে! সময়ের সাথে সাথে মানুষ পুরোনো অনেক কিছুই ভুলে যায়। তুমিও ভুলে গেছো। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। হয়ত আমারও ভুলে যাওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু কি করবো বলো? তোমাকে ভুলে যাওয়ার কথাটা এতদিনে একবারের জন্যেও মাথায় আসে নি। তবে এবার আর ভুল হবে না। কারণ তুমি নিজমুখে স্বীকার করেছো তুমি আমাকে ভালোবাসো না তাই এইমুহূর্ত থেকে তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।”

খুবই অপ্রত্যাশিত সহজভাবে কথাগুলো বললো ধ্রুব। আমি আশ্চর্য হলাম। খেয়াল করে দেখলাম ওর চোখে কোন রাগ কিংবা অভিযোগ নেই। সম্পূর্ণ ধীরস্থির সৌম্যমূর্তি! যেন এই অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে ফেলেছে সে। আমি হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলাম। আমার অবস্থা দেখে ধ্রুব একটু হাসলো। বললো,” আমি ভালোবাসা প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী, ব্যর্থতায় নই। তুমি আমাকে ভালোবাসো না তারমানে আমি কোনদিন তোমাকে ততটা গভীরভাবে ভালোবাসতেই পারি নি যতটা গভীরভাবে ভালোবাসলে তুমি আমাকে ভালোবাসতে। সুতরাং তোমাকে পাওয়ার অধিকার আমার নেই। আজ থেকে আমার সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক রইলো না। দ্যা রিলেশনশীপ ইজ ওভার ফ্রম নাউ! আমাদের নতুন করে শুরু করা উচিৎ। আশাকরি এতে আমাদের দুজনেরই ভালো হবে। উইশ ইউ আ ভেরি গুড লাক! আসি আমি!”

আমি স্তব্ধ হয়ে ধ্রুব চলে যাওয়া দেখলাম। ও আমাকে আর একটা কথাও বলার সুযোগ দেয় নি। আমাকে রেখেই নিচে চলে গেলো। আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। দারূণ ভাবে ইনসাল্ট ফিল করছিলাম। সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। ভয় করতে শুরু করলো আমার। কারণ আমি জানি ধ্রুবর এইমাত্র বলে যাওয়া কথাগুলো একটাও মিথ্যে নয়। সে যা বলেছে তাই করবে।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here