ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৪

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪

বাবা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলো আমার হবু বরের বাবা মানে আমার হবু শ্বশুর দুই বিয়ে করেছেন। ছয় বছর সংসার করার পর তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার হবু বর দ্বিতীয় পক্ষের। প্রথম পক্ষে একটা কন্যা সন্তানও আছে। কন্যাসমেত প্রথম স্ত্রীকে কোন এক অজ্ঞাত কারনে বাড়ি থেকে বের করে দেন তাঁর বাবা। অতএব এখানে সম্বন্ধ ক্যান্সেল। এমন পরিবারে বাবা মেয়ের বিয়ে দেবেন না। ছোটমামা খুব করে বোঝালো ছেলে খুবই ভালো। কিন্তু বাবাকে কোনভাবেই রাজী করানো গেলো না। তিনি কিছুতেই সম্মত হলেন না। সুতরাং বিয়ে ক্যান্সেল।

খবরটা শুনে আমি উচ্ছ্বাস কিংবা উদ্বেগ কোনটাই প্রকাশ করলাম না। আমি আমার মত করে চলছিলাম। তবে মনে মনে আমিও খুশি হয়েছি। কারণ এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কোন ইচ্ছে আমার নেই! নিজেকে আরেকটু চেনার বাকি আছে, জানার বাকি আছে। হঠাৎ করেই কোন দায়িত্ব কাধে নিতে চাই না।

বিয়ে ক্যান্সেল হওয়ার মাসখানেক বাদে একদিন মায়ের কাছে শুনলাম সীমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র ভূমি অফিসার। তাইজন্যই সীমাকে অনেক দিন দেখি না। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় সীমা আর তার মা এলো আমাদের দাওয়াত দিতে। বিয়ে এই বাসাতেই হবে। আগামী পরশু গায়ে হলুদ। সীমা বারবার করে জানালো আমি যেন হলুদের দিন সকালেই ওদের বাসায় পৌঁছে যাই। দেরী করলে চলবে না। আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম আমি ঘুম থেকে উঠেই ওদের বাসায় চলে যাবো।

বিয়ে উপলক্ষ্যে আবার পুরো বাড়িটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। লাইটিং এর আলো আর মেহমানদের আনাগোনায় চারদিক সরব। একেবারে উৎসবমুখোর পরিবেশ। ভালোই লাগছিলো। তবে এই কয়দিনে আমার একবারও ধ্রুবর সাথে দেখা হয় নি। ও আছে কি নেই তাও জানি না। অবশ্য এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথাও নয়। আন্টি বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছিলো। চলে গেকে নিশ্চই উনি বলতেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ধ্রুব বাসায় আছে।

অবশেষে, হলুদের দিন সন্ধ্যাবেলায় ছাদে ধ্রুবর দেখা পেলাম। কালো পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার পরে হিরো সেজে এসেছে। হাতে ক্যামেরা। দারূণ লাগছিলো ওকে। ও আমাকে খেয়াল করে নি। এসেই স্টেজের দিকে চলে গেলো।

আমি ওর কাছ থেকে দূরে দূরে সরে রইলাম। সেদিনের পর থেকে ওর মুখোমুখি হতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। তাই অনুষ্ঠান শুরু হলে মেহমানদের ভিড়ে গিয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব ঘুরে ঘুরে সবার ছবি তুলে দিচ্ছিলো। আমি যখন সীমাকে হলুদ লাগাতে গিয়ে ওর মুখোমুখি হলাম আমি। ও বিনা সংকোচে অন্য সবার মত আমাদেরও ছবি তুলে দিলো। হলুদ পর্ব শেষ হতেই শুরু হলো নাচ গানের পালা। আমাদের ভাড়াটিয়া কয়েকটা মেয়ে, তরু, সীমার দুটো কাজির স্টেজে কয়েকটা হিন্দি বাংলা গানের সাথে নাচলো। ধ্রুবকে দেখলাম ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিডিও করছে। আমি নাচ, গান কিছুই করলাম না। মেহমানদের মত চুপচাপ বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে ধ্রুবর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছিলাম।

অনুষ্ঠান শেষে একে একে সবাই নিচে নেমে গেলো। আমিও নেমে যাচ্ছিলাম হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থমকে গেকাম। ধ্রুব ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তরুর সাথে কথা বলছে। আমার সাথে সুমাইয়া ছিলো। ও আমাকে ইশারা দিয়ে বললো,”ঐ যে ধ্রুব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড! চেনেন আপনি?” আজ আর আমি সেদিনের মত নির্লিপ্ত থাকতে পারলাম না কারণ আজকে ওদের দুজনকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। সেদিনের ধ্রুব এবং তরুর সাথে আজকের ধ্রুব এবং তরুর অনেক তফাত!
মনের মধ্যে খচখচ করে উঠলো। ওদের মাঝে কি সত্যিই কিছু চলছে? আমি কৌশলে সুমাইয়ার কাছ থেকে জানতে চাইলাম সে কি করে ধ্রুব এবং তরুর সম্পর্কের কথা জানলো। সুমাইয়া জানালো, তরুই নাকি ওকে আর সীমাকে তার এবং ধ্রুব রিলেশনের কথা জানিয়েছে। সে নাকি ধ্রুবকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। অবশেষে অনেক দিন অপেক্ষা করার পর ফাইনালি তারা দুজন এক হয়েছে।

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সব মিথ্যে বলে মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ আমার মনে পড়লো তরু যখন স্টেজে উঠেছিলো তখন কেউ একজন ‘ধ্রুবর’ নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো। আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। বুকের ভেতর প্রবল ধাক্কা অনুভব করলাম। ধ্রুব আর তরু কি তাহলে সত্যি সত্যি..! আর কিছু ভাবতে পারলাম না। তীব্র হতাশা অনুভব করলাম।

ওদের দুজনকে এদিকে এগিয়ে আসছিলো। ধ্রুব আমাদের কাছে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,”কি ব্যাপার তোমরা নিচে নামবে না?”

প্রতিউত্তরে আমি এবং সুমাইয়া মুচকি হাসি দিলাম। সুমাইয়া কেন হেসেছে আমি জানি না কিন্তু আমি হাসলাম ধ্রুবর সামনে নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণ করার জন্য। তরু এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। সুমাইয়ার সাথে দুষ্টুমি করছিলো। মেয়েটার কথাবার্তা শুনে মনে হলো বেশ ম্যাচিউর। বয়সে বোধহয় আমার চেয়ে একটু বড় হবে। আমি ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম বাচ্চাসুলভ কোন পাগলামি নেই তাদের দুজনের মাঝে। থাকলে হয়ত আমি খুশিই হতাম। নিজেকে বোঝাতে পারতাম এরা দুজন ন্যাকা! এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। কিন্তু সেরকম কিছুই আমার চোখে পড়লো না! ওদের প্রেমটা খুব গাঢ় মনে হচ্ছে। ধ্রুবর মুখ দেখে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমার ওপর রাগ কিংবা অভিযোগ করে নয় ধ্রুব সত্যি সত্যিই নতুন করে শুরু করেছে। ওর মাঝে কোন পাগলামি নেই। ধ্রুব বরাবরই বিচক্ষণ এবং স্ট্রং পার্সোনালিটির একজন মানুষ। আজ আবারও সেটা প্রমাণ করে দিলো সে। ও বলেই হয়ত সবকিছু পজেটিভলি নিয়ে নতুন করতে শুরু করতে পেরেছে। অন্য কেউ হলে এত সহজে সবকিছু ভুলতে পারতো না। এই প্রথম আমি কিছু হারানোর অনুভূতি উপলব্ধি করলাম। অথচ ওর সাথে ব্রেকাপের পরেও কখনো এই ফিলিংস হয় নি।

আমি ধ্রুবকে তরুর সাথে সহ্য করতে পারছিলাম না আবার মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিলাম মা। উভয় সংকটে পড়লাম। ওর সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সাহসও আমার নেই আবার ওর সাথে অন্য কাউকে সহ্য করার ক্ষমতাও নেই। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। সে সাথে অপমানবোধও হচ্ছিলো। ধ্রুব এত সহজে আমাকে ভুলে গেলো! অথচ আমার মনে একবারের জন্যেও প্রশ্নটা জাগলো না সেদিন আমিও তো নিষ্ঠুরভাবে ধ্রুবর মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলাম। নিঃসংকোচে, অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলাম আমি ওকে ভালোবাসি না! তাহলে ও কেন পারবে না? একমুহূর্তেই আমার ভেতরটা ধ্রুবকে ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। পিপাসায় উন্মুখ হয়ে উঠলো নিজের হারানো জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু কি করলে ওকে ফিরে পাবো বুঝতে পারছিলাম না। দুর্ভেদ্য কান্নাটাকে ঠেকিয়ে রাখতে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলাম। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম, কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজে পেলাম না। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। কি করলে সেই ভুল সংশোধন করতে পারবো দিনরাত তাই ভেবে চলছিলাম।

বিয়ের দিন আমি পার্লারে গিয়ে সাজলাম। খুব সাজলাম। সাজ শেষে তৃপ্ত চোখে নিজেকে দেখলাম। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি আমি সুন্দরী। কখনো এমনভাবে নিজেকে দেখি নি। কিন্তু আজ দেখলাম! আমার সাথে অন্যরা যারা পার্লারে সাজতে এসেছে তারাও আমার সাজ দেখে খুব প্রশংসা করলো। এমনকি পার্লারের মহিলা যিনি সাজাচ্ছিলেন তিনিও বললেন সবার চাইতে আমাকেই বেশি সুন্দর লাগছে। আমাকে কখন সুন্দর লাগে তা আমি বুঝতে পারি। সুতরাং আজকের সাজ দেখে আমি বুঝতে পারলাম সবাই মিছেমিছি প্রশংসা করছে না। আমাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে।

বউ নিয়ে পার্লার থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেলো। ঘরে ঢুকতেই সবাই আমাকে নিয়ে পড়লো। আগে কখনো আমাকে এত সাজতে কেউ দেখে নি। সমবয়সীরা নানারকম ইশারা ইঙ্গিতে জানতে চাইলো আজকে কাকে দেখানোর জন্য আমি এত সেজেছি? সবার অবস্থা দেখে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো। আমি সেখান থেকে উঠে বাইরে চলে এলাম।

কিন্তু ধ্রুবকে কোথাও দেখতে পেলাম না। হঠাৎ খেয়াল করলাম সবাই নিচে ছবি তুলছে। আমি নেমে গেলাম। ফটোগ্রাফার ধ্রুব! ছবি তোলার সময় আমি তরুর সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে দেখলাম। নিজের প্রশংসা নয়, বাস্তবিকই তরুর চাইতে আমাকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিলো। ধ্রুবকে যখন ছবি তুলে দিতে বললাম ও নিঃসংকোচে রাজী হয়ে গেলো।

ছবি তোলা শেষে আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তরুও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। ধ্রুব দাঁড়িয়েছিল অপরপাশে। হঠাৎ কেউ একজন ধ্রুবকে ইশারায় তরুকে দেখালো। প্রতিউত্তরে ধ্রুব মুচকি হাসলো। আমার কলিজায় খামচি মেরে উঠলো। এত সাজগোজ সব বেকার মনে হলো। ধ্রুব কোন বাড়াবাড়ি করে নি তরুকে নিয়ে। কিন্তু ঐ একটু মুচকি হাসিই আমাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তরুর প্রতি ঈর্ষা বোধ করলাম। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ধ্রুব আমার ওপর কোন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব করছে না। হি ইজ সিরিয়াস! কারণ ওর মাঝে কোন পাগলামি নেই। আমার ভয়টা আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলো। খেতে বসে কিছুই খেতে পারলাম না। সবকিছু বিষাদ মনে হচ্ছিলো। শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে বাসায় চলে এলাম।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here