নাটাই ঘুড়ি পর্ব-২১

0
511

#নাটাই_ঘুড়ি
।।২১।।
শিহাব ফোন করেছিল খোঁজ নিতে। প্রতিবেশী হিসেবে এম্বুলেন্সের আনাগোনা চোখে পড়েছিল তাদের।
কথায় কথায় মীরা সবই জানিয়ে দিল তাকে। বাড়ি মর্টগেজ রাখার কথা, ব্যাংকে ইনস্টলমেন্ট বাকি পড়ার কথা, এসব আচমকা জানতে পেরে দাদার স্ট্রোক করবার কথা।
“তোমাদের ঠিক কত টাকা বাকি পড়েছে মীরু?”
“আমি তো সঠিক জানি না ভাইয়া!”
“আচ্ছা, দাঁড়াও আমি আম্মুকে পাঠাচ্ছি খোঁজ নিতে।“
শিহাবের ফোন রেখে মনমরা হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল মীরা। বাড়ি ক্রোক হয়ে যাচ্ছে এই দুঃখের চেয়েও তার এত ভালো ছোট চাচার দিকে টাকা চুরির মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, এই কষ্টটাই তাকে বেশি করে পীড়িত করছে।
মীরার দৃঢ় বিশ্বাস টাকা জমা না হওয়ার পেছনে ছোট চাচার কোনো ভূমিকা নেই। থাকতেই পারে না।
কিছু একটা ভুল হচ্ছে সবার। তার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে সবাইকে জানিয়ে দিতে ছোট চাচা কোথায় আছে।
মীরপুর দশ নাম্বারে একটা সুপারশপের শো রুমে চাকরি হয়েছে ইমরুলের। বেতন খুবই সামান্য।
মীরা ফোনে জানিয়েছে দাদার অবস্থা, দাদাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছে, অপারেশন লাগবে এই সবই জানিয়ে দিয়েছে। ইনস্টলমেন্টের টাকা ঠিকমত জমা না হওয়ায় বাড়ী যে ক্রোক হতে বসেছে এবং এর দায়ভার যে অনুপস্থিত থাকা ইমরুলের ওপরেই চাপানো হচ্ছে সেটাও তার অজানা নয়।
কী এক অজানা অবসাদ চেপে বসেছে তার মধ্যে। এই অপবাদ কাটানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করা দূরে থাকুক, সে বরং মীরার ওপরে আরো কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে কোনোভাবেই যেন তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বাসায় কিছু জানানো না হয়।
সারাদিন পর কামরানের বাসায় ফিরতে ক্লান্ত লাগে ইমরুলের। বাস থেকে নেমেও কিছুদূর হাঁটতে হয়।
হাঁটার পথে থরে থরে ঘরগুলো সাজানো। একেকটা ঘরে চলে এক একটা পরিবারের নানান নাটকের মহড়া, কয়েকটা জীবনের কয়েকটা গল্প।
প্রতিদিনই তাদের জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকে রূম্পা। কামরানেরও ফিরতে দেরি হয়।
দুই বন্ধু একসাথেই খায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের জন্য বরাদ্দ ক্যাম্প খাটের ছোট্ট জায়গাটুকুতে টান টান করে শরীরটাকে মেলে দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় ইমরুল।
যে কঠিন সত্য সে জেনেছে, নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে আবার করেও না। বাসার কাউকে না জানিয়ে বসুন্ধরা লিংক রোডে এপোলো হাসপাতালের কাছে আর পি এলের একটা আবাসিক প্রোজেক্টে ১৩৮৫ স্কোয়্যারফিট আয়তনের একটা ফ্ল্যাট কিনেছে বড় ভাই।
মাসিক ইনস্টলমেন্ট ৩৫,০০০ টাকা দিয়ে।
দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোই যায়, সবাইকে জানিয়ে দেওয়াই যায়। খুবই সহজ কাজ, আর সেটাই হয়ত উচিত।
কিন্তু ইমরুলের ইচ্ছা করে না। তার এই ছোট্ট ক্যাম্প খাটে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়তেই বেশি আরাম লাগে।
গতকাল আলিমুল হাসানের অপারেশন হয়ে গেছে, পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের বাইরে নাইমা পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে। ডাক্তাররা বলেছেন চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছুই বলা যাবে না।
নাইমার ব্যাংক খোলা ছিল বলে আসতে পারেনি গতকাল। আজকে শুক্রবার, তাই এসেছে।
কী মনে করে শাহীনও এসেছে। নাইমাই ফোনে কথায় কথায় বলছিল গতকাল সবাই এসে দিনে দিনেই ঘুরে গেছে, বাসায় পৌঁছেছে অনেক রাতে।
আজকে সকালে মনে হয় কেউ আসবে না। একা একা আসতে ইচ্ছা হচ্ছিল না নাইমার, শাহীনকে বলতেই সে রাজি হয়ে চলে এসেছে।
যদিও এখন খুব অস্বস্তি হচ্ছে নাইমার। তার কাছে মনে হচ্ছে নিজের অজান্তেই শাহীনের প্রতি একটা নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে তার, জন্ম নিচ্ছে কিছু প্রত্যাশা, কিছু অধিকারবোধ।
যেমন সে যেন ধরেই নিয়েছিল যে সে ডাকলে শাহীন না এসে পারবে না। কিন্তু যদি না আসত, নাইমা কি তাহলে কষ্ট পেত!
এই প্রশ্নের উত্তর নিজেই জানে না নাইমা। মানুষ অনেক সময় নিজের মনের খবর নিজেই ভালো করে বুঝতে পারে না।
সারা গায়ে নানা রকম নল লাগানো অচেতন বাবাকে দূর থেকে দেখে ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলে ফ্যাকাসে মুখে বেরিয়ে এল নাইমা। শাহীন কোনো প্রশ্ন করল না তাকে।
শুধু বলল, “চলুন নিচে ক্যান্টিন থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসি। চা খেলে ভালো লাগবে আপনার।“
বেশি কিছু না বলে নাইমাও রাজি হয়ে গেল প্রায় সাথে সাথেই। আসলে কথা বলার শক্তিও ছিল না তার।
ইমরুল তখন ক্যান্টিনে বসে নাস্তা করছিল। দূর থেকেই দেখল নাইমা ঢুকছে একজনের সাথে।
মীরা ইমরুলকে ফোনে বলেছিল গতকাল সবাই এসে দেখে গেছে দাদাকে, অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বাসায় পৌঁছাতে। আজকে শুক্রবার সকালে মনে হয় কেউই হাসপাতালে যাবে না।
নাইমার আসবার সিদ্ধান্ত মীরা জানত না, ইমরুলও জানতে পারেনি তাই। মাথা নিচু করে মুখটা যথা সম্ভব আড়াল করেই বসল ও।
অতি দ্রুত চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে ইমরুল, নাইমার সামনে পড়তে চায় না সে।
দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে শাহীন জানতে চাইল, “তাহলে এখন আপনার আব্বার সাথে হাসপাতালে কেউই থাকবে না?”
“বড় ভাইয়া আছে তার শালীর বাসায়, নিকেতনে। তার নাম্বার দেওয়া আছে ফাইলে, ফোন করলেই চলে আসবে। আর এখন তো আব্বার সাথে থাকতে দেবেও না। কেবিনে দিলে তারপর না থাকতে দেবে।“
“আমার নাম্বারটাও দিয়ে আসুন ওদেরকে, আমি তো কাছাকাছিই থাকি! কোনো প্রয়োজন হলে আমি তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারব।“
“সম্পর্ক জিজ্ঞেস করলে কী বলব?”
শাহীন এক মুহূর্ত থমকে থেকে বলল, “ফ্যামিলি ফ্রেণ্ড বলবেন।“
“আচ্ছা।“
ওরা দুজন কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেই ইমরুল মুখ লুকিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে। আব্বাকে দেখেই বেরিয়ে যেতে হবে।
চা শেষ করে নাইমা আবার ওপরে উঠল, ডিউটি ডাক্তার নার্সকে বলতে হবে ফাইলে শাহীনের নাম্বারটাও লিখে রাখার জন্য। শাহীন ঠিকই বলেছে, কোনো জরুরি প্রয়োজন হলে নিকেতন থেকে বড় ভাইয়া আসার আগে শ্যামলী থেকে শাহীনের আসতেই কম সময় লাগবে।
নাইমা ভেতরে ঢোকার জন্য অনুমতি চাইতেই গেটে থাকা মানুষটি বলল, “এক রোগীর কয়জন এটেণ্ড্যান্ট ঢুকবেন একসাথে?”
“মানে?”
“মানে চার নাম্বার বেডের একজন এটেণ্ড্যান্ট তো ঢুকল মাত্রই! উনি বের হওয়ার আগে তো আপনি যেতে পারবেন না!”
“কে আবার ঢুকল? আর কারো কি আসার কথা? কই আমি তো জানি না!”
(পরের পর্ব পরশু দিন সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here