নাটাই ঘুড়ি পর্ব-২২

0
468

#নাটাই_ঘুড়ি
।।২২।।
বড় ভাইয়া নাকি? এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে নাইমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে গেল একজন।
“কানা নাকি? একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে, চোখে দেখেন না?”
কঠিন ধমক দেওয়ার জন্য পিছু ফিরতেই চমকে উঠল নাইমা।
“ইমরুল, দাঁড়া! এই ইমরুল!”
গেটম্যান আর শাহীনের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল নাইমা। কিন্তু ইমরুলকে ধরতে পারল না।
নিচে নেমে যেন মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে সে। নাইমা যখন নিচে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে ততক্ষণে শাহীনও নেমে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে।
নাইমা সরোষে খেদোক্তি করল, “ইস, পালিয়ে গেল, ধরতে পারলাম না!”
শাহীন আপনমনে বলল, “কিন্তু, আমি ভাবছি অন্য কথা। ইমরুল জানল কীভাবে তোমাদের আব্বা এখানে আছে?”
চমকে উঠল নাইমা। “তাই তো!”
“তার মানে সে তোমাদের বাসার সব খবরই রাখে! নিয়মিত সব আপডেট পায়। তা না হলে এই হাসপাতালে কোথায় আছে জানতে পারত না।“
“সেটা কীভাবে সম্ভব?”
“তোমাদের বাসার কারো সাথেই যোগাযোগ আছে তার, খোঁজ নিয়ে দেখ। বাসায় গিয়ে সবাইকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ কর। কার সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিল, চিন্তা করে বের কর।“
বলতে বলতেই চমকে উঠে বলল শাহীন, “ছিঃ ছিঃ আমি আপনাকে তুমি করে বলতে শুরু করে দিয়েছি ভুল করে!”
“না না, ঠিক আছে, আমি তো আপনার চেয়ে বয়সে ছোট, তুমিই তো বলবেন!” বলতে বলতে অকারণ রক্তোচ্ছ্বাসে একটু কি লাল হলো নাইমার গাল?
————————————————————————–
মুশফিকের চেহারা হয়েছে উদ্ভ্রান্তের মত। রিম্মি প্রায় আঁতকে উঠল তাকে দেখে।
পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, “তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন?”
জায়গাটা রিম্মির ডিপার্টমেন্টের সামনে। কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ ঘুরে তাকিয়ে দেখছে তাদের দুজনকে।
“ফোন কেন ধরছি না সেই জবাবদিহি তোকে দিতে হবে নাকি? আমার ইচ্ছা তাই আমি ফোন ধরছি না!”
ভীষণ রাগ মুশফিকের চেহারা ফেটে বের হচ্ছে। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে।
নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। রিম্মি প্রমাদ গুণল।
“তুমি আমাকে এভয়েড করছ রিম্মি আপু?”
“সেটা বোঝার মত বুদ্ধি তোর আছে? আর যদি বুঝেই থাকিস তাহলে তোর লজ্জা শরম নেই?”
“কিন্তু কেন? কী করেছি আমি?”
রিম্মি হাল ছেড়ে দিল। গলা নামিয়ে বলল, “আস্তে কথা বল! এখানে সিন ক্রিয়েট করছিস কেন?”
“অন্য কোথাও তোমাকে পাওয়া যাচ্ছে কোথায়?”
“দেখ! আমি একটা ম্যারিড মেয়ে, আমি থাকি শ্বশুরবাড়িতে। ছুটির দিনেও এভাবে আমাকে ফোনের পর ফোন, সব জায়গায় আমাকে এভাবে ফলো করলে আমার অসুবিধা হয়!”
মুশফিকের ওপরে মনে হয় কিছু একটা ভর করেছে আজকে। দোতলার রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ওরা।
মুশফিক রিম্মিকে রেলিং এ প্রায় ঠেসে ধরল। ওর শরীরের স্পর্শ এড়ানোর জন্য রিম্মি পেছাতে পেছাতে রেলিং এর গায়ের সাথে মিশে গেল প্রায়।
সেই শান্ত মুখচোরা মুশফিককে এখন যেন আর চিনতে পারছে না রিম্মি। প্রায় ছয় ফিট উচ্চতার মুশফিককে এখন কেমন যেন হিংস্র দেখাচ্ছে। চোখের সাদা অংশে স্পষ্ট হয়ে ফুলে উঠেছে লাল লাল শিরা।
সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “ঠিক আছে। আমি আর কোনো দিন তোমার সামনে আসব না। আমাকে তুমি আর খুঁজলেও কোনো দিন পাবে না।“
কথাগুলো বলেই হন হন করে হেঁটে চলে গেল মুশফিক। রিম্মির তখন চোখ ফেটে প্রায় পানি বেরিয়ে এসেছে।
একবার বুঝি ভুলে বলে ফেলেছিল রিয়াসাতের সাথে তার সম্পর্ক ভালো নয়, সে ডিভোর্সের কথা ভাবছে। সেটাই ভুল হয়েছিল।
রিম্মির অসহায়ত্ব যে ঠিক কোথায়, সেটা সে মুশফিককে কীভাবে বোঝাবে! জীবনের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু চায়নি সে।
নির্ঝঞ্ঝাটে পড়াশোনাটুকু শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত তাকে তো শ্বশুরবাড়ির এই আশ্রয়টুকু ধরে রাখতেই হবে। ডিভোর্স নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে গেলেও না কোনো স্বর্ণ সিংহাসন না কোনো লাল গালিচা অভ্যর্থনা অপেক্ষা করে থাকবে তার জন্য।
নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য এত কিছুতে নিজেকে জড়িয়েছিল রিম্মি, কে জানত এর ছিদ্রপথেই ঢুকবে বেহুলার সাপ! ভালোবাসার বিষে রিম্মি নিজেও আকণ্ঠ জর্জর হলেও মুখ ফুটে বলার উপায়টুকু নেই।
প্রবাসী স্বামীর স্ত্রী, কেউ যেন চরিত্রে সামান্যতম দাগটুকু না লাগাতে পারে সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করে চলেছে রিম্মি এতদিন। এত সামলে চলেছে নিজেকে, আজ বুঝি সব ব্যর্থ হতে চলল!
নিজের মান বাঁচাতে ডিপার্টমেন্টের সামনের কৌতূহলী জোড়া জোড়া চোখের সামনে থেকে সরে পড়ল রিম্মি। আজ আর ক্লাস করা হবে না।
ইমরুলের বড় অস্থির লাগছে আজকে, তিথিমণি খুব কাঁদল ফোনে। আর বুঝি ফেরানো যাচ্ছে না, বিয়েটা এবার হয়েই গেল বুঝি।
ইমরুলের বাসায় সবাই মোটামুটি ইমরুলকেই চোর বলে ধরে নিয়েছে, সুতরাং দুই পরিবারের মধ্যে কথা বলে বিয়ে ঠিক করার মত পরিস্থিতিটুকু এখন আর অবশিষ্ট নেই। ইমরুলের আব্বা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, ওদের বাসা থেকে তিথিদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসার মত কেউ নেই এখন।
আর তিথির বাসা থেকে কথা বলতে গেলেও ইমরুলের বাসা থেকে সাফ জানিয়ে দেবে যে ইমরুল টাকা চুরি করে নিরুদ্দেশ হয়েছে। সুতরাং বিষয়টার সুন্দর সমাধানের উপায় আর নেই।
তিথি ঠিক করে রেখেছে যে কোনো দিন ইমরুলের কাছে চলে আসবে, তারপর বাকিটা যা হওয়ার হবে। ইমরুল সামলাক বাকিটা।
এইসব বলছিল আর খুব কাঁদছিল তিথি। ইমরুল জবাবে কী বলবে ভেবে পায়নি।
এ কথা সত্যি যে তিথিকে অন্য কেউ এসে নিজের ঘরণি করে নিয়ে যাবে এই কল্পনা করতে গেলেও মনে হয় হৃদপিণ্ডটা বুঝি কেউ দুহাতের মুঠোয় চেপে ধরে পিষে ফেলছে। কিন্তু তিথি চলে আসলে ইমরুল তিথিকে নিয়ে উঠবেই বা কোথায়।
তাই ফোনের ওপাশ থেকে তিথির অঝোরে অশ্রু বর্ষণের উত্তরে কিছুই বলার ছিল না তার, শুধু নীরব থাকা ছাড়া।
“আপনার মন খারাপ?”
চমকে উঠল ইমরুল। রূম্পা!
এই মেয়েটা বিড়ালের মত নিঃশব্দে চলাফেরা করে। কখন এসে ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি সে।
“কী হইছে? আমাকে বলা যাবে?”
“কিছু না। না মানে, তেমন কিছু না।“
রূম্পা কেমন অদ্ভুত একটা মুখভঙ্গি করে বলল, “ঠিক আছে, বলতে হবে না। আমি আপনার কে হই যে বলবেন?”
ইমরুল সামান্য অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। এই মেয়েটার কাছে ওর অনেক ঋণ।
বলাই হয়ত উচিত। কিছুক্ষণ দ্বিধা করে ইমরুল সবকিছু খুলে বলল।
কিছু কিছু আগেই জানত রূম্পা, এখন বাকিটুকুও বলল ইমরুল। পুরোটা শোনার সময় দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগল রূম্পা।
আচমকা জিজ্ঞেস করল, “আপনি বেতন কত পান?”
হঠাৎ এই প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল ইমরুল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, “ঊনিশ হাজার পাঁচশো টাকা।“
রূম্পা সামান্য ঝুঁকে এল তার দিকে। তারপর খপ করে ইমরুলের হাত ধরে ফেলে বলল, “এই ছোট ঘরে এইভাবে থাকতে ভালো লাগে আপনার? চলেন আমরা দুইজন কোথাও সাবলেট নিয়ে থাকি!”
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ইমরুলের। নিচের ঠোঁটটা লালা দিয়ে ভিজিয়ে ঢোক গিলে বলল, “তোমার হাজব্যাণ্ড?”
খিল খিল করে হেসে উঠল রূম্পা। “দূর! সেই ব্যাটা তালাকনামা পাঠায়ে দিছে সেই কবে!”
“তোমার আব্বা আম্মা, কামরান, তোমার বোন শুনলে কী বলবে?”
“আপনি এত ডরান ক্যান হ্যাঁ? ভীতু পুরুষ মানুষ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না।“
এই রুমে ফ্যান নেই, একটা মাত্র এক্সহস্ট ফ্যান প্রাণপণে চলে কিন্তু তাতে গরম দূর হয় না। ইমরুলের মনে হলো থেমে গেছে এই সমগ্র চরাচরে বাতাস চলাচল, শুধু সে নিজে আর রূম্পা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কোনো মানুষ নেই।
তারা দুজন যেন পৃথিবীর আদিমতম এবং শেষতম মানব মানবী, তারা ছাড়া আর কোথাও কেউ নেই, কখনো ছিল না।
রূম্পা উঠে এসেছে ইমরুলের ক্যাম্প খাটে। ইমরুলের সামনে মুখোমুখি বসে গাঢ় স্বরে বলছে, “আমাকে ভালো লাগে না আপনার? ক্যান ভালো লাগে না?”
“দেখো রূম্পা, বিষয়টা ঠিক ওরকম কিছু না। আমি…”
ইমরুলের কথা বন্ধ হয়ে গেল ঠোঁটের ওপরে আরো এক জোড়া ঠোঁট চেপে বসায়। রূম্পা কাতর অভিমানী গলায় বলছে, “আপনি কেন আমার দিকে ফিরেও দেখেন না, কী নাই আমার! আমি কি দেখতে সুন্দর না?”
বহুদিনের তৃষিত ঘর বঞ্চিত সংসার বঞ্চিত নারী নোঙর ফেলতে চাইছে। নিজের ভেতরের সবটুকু জল কোনো ঊষর প্রান্তরে ঝরিয়ে ফেলে হালকা হতে চাইছে এক জলভরা ঘন কালো মেঘ।
কিন্তু ইমরুল নিজেই ভাসমান, কাউকে নোঙর করতে দেওয়ার মত স্থিরতা নেই তার। তাছাড়া সে আরেক নারীর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইমরুল ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল রুম্পাকে। প্রত্যাখ্যাত নারী ফুঁসে উঠল আহত বাঘিনীর মত।
“আছে না নাই আপনার?”
পুরুষত্বের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করায় মুখ লাল হয়ে গেল ইমরুলের। গলা নামিয়ে বলল, “কামরান দেখলে কী মনে করবে?”
বিছানা থেকে নেমে উঠে দাঁড়াল রূম্পা। তারপর ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে গেল হন হন করে।
সে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইমরুল দেখল বিছানায় পড়ে আছে একটা ভাঁজ করা কাগজ। দুরু দুরু বুকে কাগজটা খুলল সে।
কাগজে গোটা গোটা হাতে বিভিন্ন ঠিকানা লিস্ট করা।
(পরের পর্ব পেইজে আগেই পোস্ট করা হয়েছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here