নানান বরণ মানুষ রে ভাই পর্ব-৬

0
1138

# নানান বরণ মানুষ রে ভাই
৬ষ্ঠ পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

হলে সিট পেয়েছি। ভেবেছিলাম ভয়ংকর বাধা আসবে আম্মুর পক্ষ থেকে।এলো না। আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন আম্মু আমার বিষয়ে। আমিও বাসায় যাইনা,আম্মুও হলে আসেন না।মোবাইলেও যোগাযোগ নেই। আব্বু, বড় দুলাভাই, মেজ আপা,মেজ দুলাভাই, ছোট মামা কিংবা মামী,খালারা মাঝেমধ্যে আসেন। তিথি ভাবী প্রায় আসেন,এই হলে থেকে তিনি লেখাপড়া করেছেন। আমাকেও দেখা হয়, পুরানো মিষ্টি মিষ্টি স্মৃতিগুলোও ঝালিয়ে নেওয়া হয়। তিথি ভাবী আসলে সাধারণত বাবুনিকে নিয়ে আসেন। কি যে ফুটফুটে বাবু। ও এলে আমার বান্ধবীদের মধ্যে ওকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়, বন্ধুদের জ্বালায় আমি আমার ময়নাটাকে ভালো করে কোলে নিতে পারিনা। সবাই আসে, আম্মু আসেন না।

মেজ আপা বলে,”সপ্তাহে -দু’ সপ্তাহে একবার বাসায় গেলেই তো পারিস। হাজার হোক,মা তো।”

আমি চুপ করে থাকি। মেজ আপা হতাশ স্বরে বলে,”আম্মুকে যদি হোস্টেলে আসতে বলি, তিনিও এইরকম চুপ করে থাকেন। থাক তোরা যে যার ইগো নিয়ে। মা-মেয়ের সম্পর্ক থেকে ইগোর গুরুত্ব বেশি। ”

আমার কষ্ট হয়,কিন্তু ওইদিনের পর হতে আমার কি যেন একটা হয়েছে, আব্বু বা আম্মুর প্রতি কোনো ফিলিংস কাজ করেনা।ভালোও না,মন্দও না। বাসার মানুষগুলো আমাকে টানেনা,বাসাটাও আমাকে টানে না। এতোগুলো মাস কেটে গেলো, আব্বু এতোবার এলেন, আম্মু কোনোরকম খাবার পাঠান নি আব্বু বা মেজ আপার হাতে।প্রায়ই আব্বু বলেন,”তুমি যা করছো ঠিক করছো না।বাসায় চলো। আম্মুর কাছে একবার গেলেই সে নরম হয়ে যাবে।”
আমি আব্বুর কথা শুনিনা।চুপ করে থাকি।

মাঝে মাঝে রাতে ঘুম আসতে চায় না।মনে হয়, আমার সাথে যে মানুষগুলোর রক্তের সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের পরিণতি কি?কি হবে শেষ পর্যন্ত? আম্মুর সাথে কখনো আর দেখা হবে না? সত্যি বলতে কি,দেখা না হলেও আমার কষ্ট হবে না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত নয় কি?

একেক সময় মনে হয়,আমি খুবই অন্যায় করছি। আমার যাওয়া উচিৎ গর্ভধারিনীর কাছে। তখন ঐ কথাগুলো মনে পড়ে যায়,”মরে গেলে ওর লাশটাও যেন এই বাসায় না আসে।” কিংবা,”হলে যেয়ে থাকলেই ভালো।বাড়িতে কুত্তা -বিলাই যতো থাকে,বাড়ি ততোই নোংরা হয়। আপদ বিদায় হলে হোক।” আম্মুর এই ডায়ালগগুলো মনে পড়লে আমার মন পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। বাসায় যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়।

বড় আপা লন্ডনে চলে গেছে। দুলাভাইকে ডিভোর্সও দিয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি আপা ওখানে তার বসের সাথে আছে। বিবাহিত বসের সাথে আপার মাখামাখির কথা হাসপাতালে সবাই জানতো। কিন্তু হাতে কোনো প্রমাণ ছিলো না। আবার ইদানিং এমনই এক যুগ পড়েছে, কারোর অন্যায় দেখে প্রতিবাদ বা নিষেধ করলে সেটা হয়ে যায় অনধিকার চর্চা, অন্যের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। আপা যাওয়ার তিন মাস আগে বস লন্ডনে চলে গেছে পার্মানেন্টলি, প্ল্যান অনুযায়ী আপাও দুলাভাইকে ডিভোর্স দেওয়ার ব্যবস্থা করে উড়াল দিয়েছে।

আমরা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। নানারকম গুজবও কানে আসতো। দুলাভাইকে আমরা কঠিন হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলাম, আমরা মানে আমি, মেজ আপা আর মেজ দুলাভাই।
বড় দুলাভাই বলেছেন, “গুজবে বিশ্বাস করতে নেই। আর যা শুনছি তা যদি সত্যি হয়, তাহলেই বা আমি কি করবো?বাসায় আটকে রাখবো নাকি পা জড়িয়ে ধরে দয়া ভিক্ষা করবো? সত্যি বলতে কি,ওর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস অবশিষ্ট নেই। আমার চিন্তা শুধু বাবুর ভবিষ্যৎ নিয়ে।তোমরা দু’জনে যে ওর আপন বোন,ভাবতেও আমার অবাক লাগে।”মেজ দুলাভাই ফস করে বলে বসেছিলেন, ” উনি হয়েছেন আমাদের শাশুড়ির মতো। শ্বশুর সাহেব আবার সম্পূর্ণ ডিফারেন্ট পদ, সরীসৃপ পদ,অমেরুদণ্ডী আর কি।”
মেজ আপা শীতল চোখে তাকিয়ে ছিল মেজ দুলাভাই এর দিকে, দুলাভাই চোখ নামিয়ে নিয়ে লজ্জিত গলায় বলেছেন, “স্যরি।” আপার ইংল্যান্ড যাওয়ার ব্যাপারে সবাই আপত্তি তুললেও আম্মু ছিলেন আপার দলে।

“ও বিদেশে লেখাপড়ার জন্য যাচ্ছে, এটা কারোর সহ্য হচ্ছে না কেন কে জানে! হাসব্যান্ডের থেকে ওয়াইফ অনেক সুপেরিয়র হয়ে যাবে বলে?
বাচ্চার জন্য ক্যারিয়ার নষ্ট করবে কিসের জন্য? বাচ্চার প্রব্লেমই বা কি হবে? সে তো জন্মের পর থেকেই বাইরের দুধ খায়।”

মেজ আপা বলেছিল,” আপার উন্মাদিনী হয়ে লন্ডনে যাওয়ার পেছনে সম্ভবত আরও গূঢ় রহস্য আছে। তোমার কানেও কিছু কিছু এসেছে। ”

“বাঙালিদের স্বভাব হলো কেউ উপরে উঠতে চাইলে তাকে টেনে নিচে নামানো। রীতুর এমন জ্বলজ্বলে ক্যারিয়ার পরিবারের লোকরাই সহ্য করতে পারছে না,সেখানে বাইরের লোকেরা গুজব ছড়াবে এতে আর আশ্চর্য কি!”

দুলাভাইকে ডিভোর্স দেওয়া আর আপার নতুন বিয়ে হোক কি লিভ টুগেদারের সংবাদে আম্মুর মন্তব্য, “এ বিয়ে তো না টেকারই ছিলো। তেলে-জলে মিশে না। রীতুর উচিৎ ই হয়নি ওর অযোগ্য ছেলেকে বিয়ে করা। অ্যাডজাস্টমেন্ট না হলে ডিভোর্স ই ভালো।”

ছোট মামা বলেছিলেন, “রীতুর সাতজন্মের ভাগ্য এমন স্বামী পেয়েছিলো। নীচ, স্বার্থপর, অসভ্য একটা মেয়ে। জাস্ট অমানুষ। ”

“তোর এতোটা সাহস আমার বাড়িতে আমার সামনে আমার মেয়েকে নিয়ে এমন জঘন্য কমেন্ট করিস।বেরিয়ে যা আমার বাসা থেকে।খবরদার আর আসবি না এখানে।”

“আমার সাহস যে অনেক, সেটাতো তুমি জানো বড় আপা। নাকি এরমধ্যে সব ভুলে গেছো।”

আমার মনে হচ্ছিল আমি মেডিকেলে চান্স পাইনি বলে আম্মুর লজ্জায় মাথা কাটা গিয়েছিল, আর আপার এতোবড় শঠতা আর নির্লজ্জতার পরেও আম্মু বড় আপার প্রতি এতো সহানুভূতিশীল?

মেজ আপা বড় দুলাভাই এর কথা ভেবে কাঁদছিলো। সে বলে উঠলো,”বাবুনিকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাবো। দুলাভাইকে বলবো লক্ষী দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে। মেয়ের পাস্ট আর ফ্যামিলি হিস্ট্রি যেন ভালো করে জেনে নেয়।”

আম্মুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলা উত্তর, “মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি হলে সেই মাসীকে ডাইনি বলা হয়।”

“আমি তাহলে ডাইনিই হতে চাই। তুমিতো নানী,তুমি দায়িত্ব নাও।”

“আমি কি করবো না করবো আমার ব্যাপার। তোমাদের এতো মাথাব্যথা কেন?ওদের মেয়ে ওরা পালবে।”

“ছিঃ আম্মু,তুমি এতো…. ”

“এতো কি? ছিঃ আম্মু,তুমি এতো খারাপ? ছিঃ আম্মু,তুমি এতো নীচ? হ্যাঁ, আমি তাই। যতোটা খারাপ ভাবছো তার থেকেও আমি খারাপ হতে পারি।যাও,সব বের হও আমার চোখের সামনে থেকে।”

আপা মেয়ের কাস্টডি নিয়ে কোনো কথা বলেনি। দুলাভাই তাও টেনশন করেন। যদি বড় আপা মেয়ের কাস্টডি চায়?

আমি আর মেজো আপা বলেছি,” ঐ মেয়ে জীবনেও মেয়ের কাস্টডি চাইবেনা। যদি চায়, বুঝতে হবে পিছনে ধান্দা আছে।কোর্টে আমরা আপনার পক্ষে থাকবো দুলাভাই। ঐ মহিলার নোংরামি, মেয়ের প্রতি চরম উদাসীনতা জন্মের পর থেকেই, ওর সব কুকীর্তি আমরা বলবো দুলাভাই। আমাদের দুই বোনকে পর করে দিবেন না। আইনি সম্পর্ক না থাকুক, আপনাকে দুলাভাই ই ডাকবো সারাজীবন। আমাদের বড় ভাই নেই। আপনিই আমাদের বড় ভাই। আপনার জন্য আমি নিজে লক্ষী একটা মেয়ে খুঁজে আনবো।আপনি সুখে সংসার করবেন, আমরা গেলে নেগলেক্ট করবেন না কিন্তু। ”

মেজ আপা চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। বড় দুলাভাই আপার মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেললেন এবং কাঁদতেই থাকলেন। কতোদিনের জমানো কান্না, কে জানে। আমারও চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু পারছিলাম না। শুকনো চোখ শুকনোই রইলো।

দুলাভাইদের পক্ষ থেকে আপাকে অনেক গয়না দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের পরেও দুলাভাই দিয়েছেন এবং আপাও সমানে নানা অকেশনে আদায় করে নিয়েছে। সব গয়না নিয়েই আপা পাখা মেলেছে।

বড় দুলাভাই এর বাবা-মা, ভাই-বোনেরা প্রচন্ড রেগে ছিলেন। খালাম্মা আম্মুকে ফোন করে বললেন,”মেয়েকে যা যা দিয়েছিলেন বিয়েতে,সব পাঠিয়ে দিচ্ছি। হিসাব মিলিয়ে নিবেন। আর আমরা যেসব গয়না দিয়েছি,আমার ছেলে যতো গয়নাগাটি দিয়েছে, সেগুলো মেয়েকে ফেরত দিতে বলেন। আমরাতো প্রথম থেকেই কিছু দিতে নিষেধ করেছিলাম আপনাদের, তাও ডাঁট দেখানোর জন্য ফার্নিচার পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো ঘরে রাখতেও ঘেন্না হচ্ছে। মেয়ে মানুষ করেছেন বটে আপনি। একেবারে রত্নগর্ভা। ”

উনাদের রাগ করাটা খুব স্বাভাবিক। আপা তো কম অত্যাচার চালায়নি ওদের সবার উপর। আম্মুও ঘোঁট পাকাতো অনেক। ছোট মামা আব্বু-আম্মুকে বললেন,”আপনাদের অন্তত উনাদের একবার স্যরি বলা উচিৎ। ”

“কি কারণে আমরা উনাদের স্যরি বলবো?আমরা উনাদের গয়না নিয়ে পালিয়েছি নাকি? উনি সাধু?উনারাও যথেষ্ট মানসিক অত্যাচার করেছে আমার মেয়েকে। রীতু আমাকে অনেক কথ শেয়ার করেছে।”

মামা বললেন,”তোমার রীতু হচ্ছে মিথ্যার বস্তা।তুমি নিজেও এটা ভালো করে জানো। তোমার রীতু যদি কিছু তোমাকে বলেও থাকে,ডাঁহা মিথ্যা বলেছে।উনারা আমাদের তুলনায় অনেক উঁচুদরের মানুষ। আর কেমন মা তুমি? মা হয়ে মেয়েকে বিপথে পাঠাচ্ছো? বদমাশ মেয়েকে আরও সাপোর্ট দিচ্ছ?
ছিঃ আপা। কেমন মা তুমি? ”

আম্মু হিস্টিরিয়ার রোগির মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মামার উপরে।
“আমি খারাপ মা,খুব খারাপ মা। ভালো মা কাকে বলে আমি জানি না। আমি জঘন্য মা।তাতে তোর কি?বল্,তাতে তোর কি?”

আজ কেন যেন আম্মুর এই কথাগুলো কান আর মাথার মধ্যে ঝনঝন করছে। কথাগুলোর মধ্যে কি যেন একটা ব্যাপার আছে। হিস্টেরিয়া রোগীর মতো আচরণ, চিৎকার করে বলা কথাগুলো, ছোট মামার আম্মুকে জাপটে ধরা, ঐ রাতে ড্রইং রুমের সোফায় শুয়ে থাকা আম্মুর মাথায় সারারাত জুড়ে আব্বুর হাত বুলানো, ছোট মামার অপরাধী মুখ, চোখে পানি সবকিছুর মধ্যে একটা গল্প আছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here