#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_৮
ঘড়ির কাটায় রাত ১টা। চারিদিকে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে চাঁদের কণাটা আবছা হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়েই আরেকটি সিগারেট ধরালো মেসবাহ। বাড়িতে যাবার কারণে বেশ কিছুদিন যাবৎ সিগারেটের স্বাদ নিতে পারেনি সে। বাবার সামনে সিগারেট হাতে দাঁড়ানোর সাহস তার নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট টেনে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে নির্ঘুম রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। পায়চারী করতে শুরু করলো ব্যালকনিজুড়ে।
আজ কঠিন একটি সত্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে হাপিয়ে উঠেছে। আটাশ বছরের এই জীবনকে অনর্থক ঝামেলা লাগছে। অস্থির লাগছে বাচ্চা একটি মেয়ের পাশাপাশি চলে… চিন্তার জগতে বিচরণ করতে করতেই চোখজোড়া লেগে এসেছিল মেসবাহর। তবে পাশ থেকে আসা মেয়েলী স্বরের কাকুতিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে ঢুকতেই ড্রিমলাইটের ঝাপসা আলোয় তার নজরে এল উল্লাসীর নিষ্পাপ মুখ। গুটিসুটি মেরে মেঝেতে শুয়ে ছটফটিয়ে যাচ্ছে সে। মেয়েটির অসহায়ত্বর কাছে হেরে আজ তাকে নিজের ঘরে থাকার অনুমতি দিয়েছে মেসবাহ। যদিওবা ঘর ফাঁকা পরে থাকতে মেয়েটিকে নিচে শোয়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। তবে ব্যাকুল স্বরে উল্লাসীর আকুতি মিনতি বুকের ভেতরটায় কাঁটার মতো বিঁধছিল তার। তাই কোনো উপায় না পেয়ে নিজের ঘরে নিচে বিছানা করে শোবার যোগাড়যন্ত্র করে দিয়েছে সে। কিন্তু হঠাৎ উল্লাসী এভাবে ছটফট করছে কেন? ধীর গলায় উল্লাসীকে কয়েকবার ডাকলো মেসবাহ। তবে অপরপাশ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তার কপালে হাত রাখলো সে। যা ভেবেছিল সেটিই। মেয়েটির গা গরম হয়ে উঠেছে। তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে হয়তো খুব বেশিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল উল্লাসী। যার ফলে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর বাধিয়ে ফেলেছে সে।
জ্বর মেপে দেখে ঔষধ সহ এক গ্লাস পানি এনে সাইড টেবিলে রাখলো মেসবাহ। তারপর এসে আবারও উল্লাসীর পাশে বসে তাকে কয়েকবার জোর গলায় ডাকতেই বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসলো উল্লাসী। কিছুসময়ের জ্বরেই ফর্সা মুখ তার লাল টকটকে হবার উপক্রম হয়েছে। চোখ দুটিও রক্তের কুন্ডলী পাঁকিয়ে রক্তলাল বর্ণ ধারণ করেছে। ভয়ংকর সেই চোখের দিকে একনজর তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল মেসবাহ। নরম গলায় বললো,
-“শীত করছে?”
-“করছে..”
-“বিছানায় উঠে শোও।”
-“তাহলে আপনি কোথায় শোবেন?”
সে কথার জবাব না দিয়ে হাত ধরে উল্লাসীকে উঠালো মেসবাহ। তারপর তার দিকে ঔষধ এবং পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“খেয়ে নাও…”
-“আপনি এঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না তো?”
-“না..”
-“সত্যিই?”
-“হ্যাঁ..”
-“কসম কাটুন।”
-“কাটলাম..”
-“এভাবে না। ভালো করে কাটুন।”
ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মেসবাহ ক্ষীণ স্বরে বললো,
-“তুমি শুয়ে পড়ো উল্লাসী।”
-“আচ্ছা.. তবে আপনি কিন্তু এঘরে আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবেন না।”
-“ঠিকাছে, যাবো না।”
কাথা গায়ে চাপিয়ে উল্লাসী শুয়ে পড়তেই চেয়ার টেনে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো মেসবাহ। তারপর চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড বইটি খুলে তাতে মনোযোগ দিল।
শরীরের উষ্ণতা কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে চারিপাশে চোখ বুলালো উল্লাসী। তবে ঘরে কোথাও মেসবাহর দেখা না পেয়ে ধীর পায়ে সে এগুলো পাশের ঘরের দিকে। ঘুমন্ত মেসবাহকে এক পলক দেখে আবারও সে ফিরে এল ঘরে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খানিক্ষন শহুরে সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করলো। বেশ ফুরফুরে লাগছে এখন তার শরীরটা। কিছুক্ষণ আগের ম্যাজমেজে ভাবটাও কেটে গেছে। লম্বা কিছু দম ছেড়ে ঘরে ফিরে গতকাল বিকেলের কেনা কিছু সালোয়ার কামিজের মাঝে একটি উঠিয়ে সে এগুলো গোসলের জন্য।
পাউরুটিতে জেলী মাখিয়ে দুটো প্লেটে রাখলো মেসবাহ। তারপর উল্লাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এখন কী একটু ভালো লাগছে?”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো উল্লাসী। সেদিকে তাকিয়ে মেসবাহ বললো,
-“এত সকালে গোসল করেছো কেনো?”
-“বিয়ের পর সকালে গোসল করতে হয় বলে।”
উল্লাসীর এমন উত্তরে ধাক্কা খেলেও নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। চোখেমুখে একরাশ অস্বস্তি ফুটিয়ে বললো,
-“আর করবে না। এসবের কোনো দরকার নেই।”
-“কিন্তু আপনার আম্মা যে বলে দিয়েছেন! প্রতি সকালে গোসল করে নাপাক শরীরকে পাক পবিত্র করতে।”
-“আম্মা বলে দিয়েছেন তো গ্রামে গেলে এসব করবা। এখানে যতদিন আছো প্রতি সকালে গোছলের কোনো দরকার নেই।”
আবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে পাউরুটিতে হাত দিল উল্লাসী। অধীর আগ্রহে মেসবাহকে দেখে তাকে অনুসরণ করে পাউরুটিতে কামড় বসালো সে।
-“আপনি কাল আমাকে একা ঘরে রেখে পাশের ঘরে এসে ঘুমিয়েছিলেন.. তাই না?”
প্লেট থেকে নজর সরিয়ে উল্লাসীর দিকে দিল মেসবাহ। ঠান্ডা গলায় বললো,
-“উহু.. সারা রাতই ওঘরে ছিলাম। ভোরের দিকে এসে এঘরে শুয়েছি।”
-“অহ..”
-“সব ভয় তো তোমার রাতে। দিনে তো কোনো ভয় নেই। নাকি আছে?”
-“জানি না..”
-“জানতে হবে। আর তোমাকে তা জানাতেই আমি এখন কিছুক্ষণের জন্য বের হবো।”
বুকটা ছ্যাত করে উঠলো উল্লাসীর। ঢোক গিলে সে বললো,
-“কোথায় যাবেন?”
-“এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বেশিক্ষণ না এই ধরো এক’দু ঘন্টার মাঝেই ফিরবো। কোনো ভয় নেই। নিজের ইচ্ছেমতো তুমি এটুকু সময় কাটাও।”
চোখমুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। ব্যথিত গলায় সে বললো,
-“আচ্ছা…”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেসিনের দিকে এগুতে এগুতে মেসবাহ বললো,
-“দুপুরের রান্নাটা কী তুমিই করবে? নাকি আমি আসার পথে খাবার নিয়ে আসবো?”
-“আমিই করবো..”
-“ঠিকাছে। তবে আমি আসার পর তুমি রান্না শুরু করবে। নয়তো আবার হাত পা পুড়িয়ে বসবে!”
লিমনে সঙ্গে দেখা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হলো মেসবাহর। উল্লাসীর জন্য বেশ চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটি আবার ভয়টয় পেল না তো? সকল ভাবনা একপাশে রেখে কয়েকবার কলিংবেল টিপলো মেসবাহ। তবে ওপাশ থেকে উল্লাসীর সাড়া না পেয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। হাতে থাকা ফলভর্তি পলিথিন ব্যাগ ডাইনিং টেবিলে রেখে উল্লাসীর নাম নিতে নিতে সে এগুলো ঘরের দিকে।
মেসবাহর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়ে ছিল উল্লাসী। তবে বেশি একটা সময় টিকতে পারলো না সে ঘুমের সেই রাজ্যে। বেশ ঠান্ডা কিছুর উপস্থিতি কপালে অনুভব করতেই ঘুমভাবটা কেঁটে গেল তার। আতংকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল উল্লাসী। তবে পরমুহূর্তেই মেসবাহকে দেখামাত্র আত্মায় পানি ফিরে এল তার। বুকে থুতু দিয়ে সে বললো,
-“না, জ্বর নেই।”
-“ভয় পেয়েছো?”
-“হুম…”
চিন্তিত মনে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মেসবাহ বললো,
-“আমি হসপিটালে যাওয়া শুরু করলে তুমি কিভাবে সময় কাটাবে তা ভাবাচ্ছে আমাকে। এজন্যই তোমায় আনতে চাইনি। আব্বা যে কোনো প্রতিটা জিনিসে জোরাজুরি করে!”
কি বলবে ভেবে পেল না উল্লাসী। নীরবে খানিক সময় সেভাবেই কাটানোর পর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই পাশ থেকে মেসবাহ বললো,
-“তুমি কিচেনে যাও। আমি জামাকাপড় ছেড়ে আসছি।”
চুলো জ্বালিয়ে উল্লাসীকে একেএকে সব দেখিয়ে দিল মেসবাহ। তারপর বাড়ি থেকে আনা গরুর মাংস ফ্রিজ থেকে বের করে তা পানিতে ভিজিয়ে বললো,
-“বরফ ছাড়লে ভালোভাবে ধুয়ে তারপর রাঁধবে।”
-“আপনি রান্না জানেন?”
-“তেমন জানি না.. তবে চলে। ভাত, ডিম ভাজি, আলু ভর্তা এসব আর কি!”
-“আর মাছ মাংস?”
-“তেমন একটা খাই না। কখনো খেতে ইচ্ছে হলে বাইরে থেকে আনিয়ে নেই।”
বলেই রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। মেয়েটিকে একা রেখে পুরোটা দিন হাসপাতালে কি করে কাটাবে সে, যেখানে ঘন্টা তিনেকের জন্য তাকে ফেলে বাইরে গেলেই মেয়েটি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে! অবশ্য গ্রামের বাচ্চা একটি মেয়ের পক্ষে অচেনা এক জায়গায় এসে একা একটি ফ্ল্যাটে সময় কাটানো বেশ কঠিনও। তাহলে এখন কী উপায়? মেয়েটির জন্য কী এখন চাকরি বাদ দিয়ে ঘরে বসতে হবে তার! হঠাৎ দরজায় বেজে উঠা কলিংবেলের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়লো মেসবাহর। উদাস মনে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই তার সামনে ভেসে উঠলো লিমনের ভাষ্যমতে ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি।
-“ভালো আছো?”
-“জ্বি, আছি। আপনি ভালো আছেন?”
-“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি। শুনলাম তুমি নাকি গ্রাম থেকে কাজের মেয়ে এনেছো।”
চোয়াল শক্ত হয়ে এল মেসবাহর। গম্ভীরমুখে সে বললো,
-“বোন.. দুঃসম্পর্কের বোন। কাজের মেয়ে নয়।”
-“অহ.. তাই বলো! তা কোথায় তোমার সেই বোন? ডাকো তো ওকে। একটু দেখা সাক্ষাৎ করে যাই। ভাই, তোমরা তো পুরুষেরা যে যার যার কাজে বেরিয়ে যাও! আর বাড়িতে বসে পঁচে পঁচে মরতে হয় আমাদের। কথা বলার মত পাশে একজন থাকলে বেশ লাগে!”
বলেই হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন মুন্নি সরকার। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে তার পিছু নিল মেসবাহ। ডাইনিং প্লেসে যেতেই তাকে থামিয়ে বললো,
-“ভাবি আপনি এখানে বসুন। আমি ওকে ডেকে আনছি। আপনি কেনো শুধুশুধু এত গরমের ভেতর আগুনের কাছে যাবেন! আপনি বসুন…”
তারপর দ্রুত পায়ে মেসবাহ এগুলো রান্নাঘরের দিকে। এই মহিলাকে একদম পছন্দ নয় তার। অবশ্য শুধু এই মহিলা নয়, আগবাড়িয়ে খাতির জমাতে আসা সকল ব্যক্তিই চক্ষুশূল তার।
-“যা বলেছি বুঝেছো তো?”
-“হুম..”
-“তাহলে বলো উনার সামনে আমাকে কী ডাকবে?”
-“ভাই..”
-“গ্রেট। আর হ্যাঁ, বেশি কথা বলবে না। রান্নার বাহানা দেখিয়ে দ্রুত চলে আসবে।”
-“আচ্ছা।”
-“চল এবার।”
সব শিখিয়ে পড়িয়ে উল্লাসীকে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারে বসলো মেসবাহ। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
-“ওই উল্লাসী।”
-“উল্লাসী? সুন্দর নাম তো। কীসে পড়ো তুমি?”
মুন্নি সরকারের প্রশ্নে হাত কচলাতে কচলাতে উল্লাসী জবাব দিল,
-“ক্লাস এইট।”
-“বেশ ছোট। অবশ্য ছোট মেয়েকে এনেই ভালো করেছো মেসবাহ। আরও ছোট মেয়ে হলে ভালো হত। আজকালকার মানুষের যা মনোভাব! তারা ভাইয়ের সঙ্গেও বোনকে জড়াতে দুবার ভাবে না!”
গলা শুকিয়ে এল মেসবাহ। কোনোমতে ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে মুন্নি সরকারের কথায় সম্মতি জানালো সে। অপরদিকে মুন্নি সরকার উল্লাসীর উদ্দেশ্যে বলেই যাচ্ছে,
-“আমি কিন্তু ফ্রি হলেই গল্প করতে চলে আসবো তোমার সাথে। তুমি তো বেশ ছোট। আমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে তুমি। রান্নাবান্না বলো বা টুকিটাকি জিনিস। তোমার সমস্যা নেই তো?”
উল্লাসীর জবাবের জন্য একদন্ড অপেক্ষা করে মুন্নি সরকার আবারও বললো,
-“তুমি দেখছি খুবই কম কথা বলো! বসো না! দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
-“আমি ঠিকাছি।”
-“আরে বসো তো। বাড়ি কোথায় তোমার?”
পাশ থেকে মেসবাহ জবাব দিল,
-“আমাদের গ্রামেই।”
-“কেমন বোন হয় ও তোমার?”
-“আমার চাচাতো ভাইয়ের মামাতো বোনের ফুপাতো ভাইয়ের খালাতো বোনের নানার দুঃসম্পর্কের বেয়াইয়ের ছেলের মেয়ে উল্লাসী।”
ভ্রু কুঁচকে ফেললো মুন্নি সরকার। উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
-“বেশ দূরের সম্পর্ক তো!”
-“জ্বি। বেশ দূরের..”
(চলবে)