নিশি রাতের ডাক ‘পর্ব :২২ শেষ পর্ব

0
1172

#নিশি_রাতের_ডাক
#পর্ব_২২ (শেষপর্ব)
#সুমাইয়া_আক্তার

গিয়ে দেখি জয় রক্তাক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে…কিন্তু আমি দেখেও চুপ করে আছি…মামা আমার দিকে ভয়ার্ত ভাবে তাকিয়ে বলছে,,,,আমি যা দেখছি তুই ও কি তাই দেখছিস????

আমি ঢোক গিলে বললাম,,,হু মামা…কিন্তু জয় এখানে কি করে এলো মামা???জয় তো মারা গেছে তাই না মামা??

মামা এবার আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,,,তুই সব জানিস…তুই জানিস কে বা কারা খুন করছে…??এই কথা বলেই মামা আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো…তখনি জয় মামার হাত ধরে টান দিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়…
পুকুরে ফেলে দিয়ে জয় বলে উঠলো,,.. এত বড় সাহস তোর???ফাহমিনের গায়ে হাত তুলিস??তোকে এখনো কিছু করিনি এটাই তোর সৌভাগ্য… তোকে দেখে নেব অপেক্ষায় থাক… পালাবি কোথায় তুই???

মামা ভয়ে কাঁপতে থাকে… আর দারোয়ান আঙ্কেল ভয়ে পালিয়েছে…জয় অদৃশ্য হয়ে যায়…আমিও চলে আসি…মামা এখন কোথায় আছে জানিনা…হয়ত লুকিয়ে পড়েছে কোথাও….

কিন্তু লুকিয়ে তো বাঁচতে পারবে না…পাপ করেছে পাপের শাস্তি তো পেতেই হবে… পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না…
দারোয়ান আঙ্কেল ও কিছুটা ভয়ে ভয়ে আছেন…তখন যেভাবে দৌড়ে পালিয়েছেন…!!!

আমি দারোয়ান আঙ্কেলের কাছে গেলাম…..গিয়ে দেখি দারোয়ান আঙ্কেল বসে বসে কি যেন বিড় বিড় করছে…আমি আঙ্কেল বলে ডাক দিতেই হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বুকে থুথু দিতে লাগলেন…
আমি বললাম,,,কি হয়েছে আঙ্কেল???ভয়ে আছেন মনে হচ্ছে???কিছু করেছেন আপনি???

তখন আঙ্কেল থতমত খেয়ে বললেন,,,না ভয় পাবো কেন???আমি আল্লাহ আল্লাহ জিকির করছিলাম… আর কি করব আমি???কিছু করিনাই আমি….

আচ্ছা তাহলে থাকেন…আমি আসি….দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে চলে এলাম রুমে….রুমে এসে গুনগুন করে গান গাইছি…
আমার গান গাওয়া দেখে সায়মা বলল,,,কিরে আজকে মন এত ফুরফুরে কেন???কি মনে করে গান গাইছিস???

হু ইচ্ছা হলো তাই গাইছি…এনি সমস্যা???

ওমা এটা আবার কেমন ইংরেজি??? এনি সমস্যা???
এই কথা বলেই অনন্যা, সায়মা,রিদিতা, নাফিসা জোরে জোরে হাসতে লাগলো…সাথে আমিও হেসে উঠলাম…
সারাদিন অনেক গল্প করলাম…হোস্টেলে যা কিছু হচ্ছে না নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নাই আমাদের…বরং পাপী রা শাস্তি পাচ্ছে…এটা ভেবেই ভালো লাগছে….

রাতে সবাই মিলে শুয়ে শুয়ে গল্প করছি…আর ভাবছি এর পরের মিশন কি???কেউ তো কিছু বলল না…গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি…সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই মিলে ক্যান্টিনে নাস্তা করতে গেলাম…নাস্তা শেষে রুমে ঢুকতে যাবো তখন ক্লাস সিক্সের নাতাশা এসে বলছে,,,আপু আপু দারোয়ান আঙ্কেলের লাশ পাওয়া গেছে….সবাই দেখতে গেছে…

আমরা সবাই ছুটে গেলাম…গিয়ে দেখি দারোয়ান আঙ্কেলের চোখ দুটো খুবলে নেওয়া হয়েছে…হাত দুটো উল্টো হয়ে পড়ে আছে…সাথে গোপনাঙ্গ ও উপড়ে ফেলা হয়েছে….
উনার মাথার পাশে একটা কাগজে লেখা,,,,এই হাত দিয়েই তো আমাকে ছুঁয়েছিলি… দিলাম হাত দুইটা উল্টো করে…. এই চোখ দিয়েই তো আমার শরীর দেখেছিলি… চোখগুলো কে উপড়ে ফেললাম….

পুলিশ কোন ভাবেই খুনের কারণ গুলো খুজে পাচ্ছেনা…তাই খুনের মামলা ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে…
মামা কাল রাতে হোস্টেলেই ছিল… ভয়ে কোথাও বের হয়নি….

কমন রুমে মামা দরজা বন্ধ করে রেখেছে…. কি করছে কে জানে???আমি গিয়ে দরজা নক করলাম…কিন্তু মামা কোনভাবেই দরজা খুলছে না…অনেক ডাকাডাকির পর মামা দরজা খুললো…চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি…

মামা হুংকার দিয়ে বললেন,,,,কেন এসেছিস তুই এখানে???আমাকে খুন করতে??? কিছু করতে পারবি না তোরা….

আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,,,,মামা যা খেতে ইচ্ছে করে খেয়ে নেও…আর যদি ভাবো যে পালিয়ে যাবে তাহলে ভুল ভাবছো…তুমি যেখানেই থাকো পালিয়ে বাঁচতে পারবে না…কারণ তুমি যা করেছো তার কোনো ক্ষমা হয়না…. তুমি পুরুষ জাতি হিসেবে কলঙ্ক… তুমি বাচবে না মামা…
আমি মামা কে ধাক্কা দিয়ে কমন রুমের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিলাম…যাতে কোথাও বের হতে না পারে…

রুমের দিকে এগোতে যাবো তখন কে যেন আমার হাত টান দেয়…হাত টান দেওয়ার সাথে সাথে আমি জয়ের বুকের উপর গিয়ে পড়ি…জয় আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,ভালোবাসি এত্তগুলা…..তোমাকে তো ছাড়তে ইচ্ছে করছে না…তবুও যেতে হবে….

আমি জয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি…জয় আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,,,কেদোনা পাগলি….আমি আবার আসবো…হয়ত অন্য কোন রূপে..অন্য কোন নামে….

আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে আসি…রুমে এসে কান্না করতে থাকি…আজকে খুব খারাপ লাগছে… আজকের পর থেকে আর জয় কে দেখতে পাবোনা আমি….
রিদিতা আমার কাধে হাত রেখে বলতে থাকে,,,,কাঁদিস না…কেউ তো সারাজীবন বেচে থাকেনা….সবাইকেই একদিন না একদিন চলে যেতে হবে…. শুধু দোয়া করবি আমাদের প্রিয় মানুষ গুলো যেন ওপারে ভালো থাকে….

এখন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বাকি আছে তানিয়া,রুশা আর জয়…
তোমার মামা কোথায় লুকিয়েছে???তাকে বলে দিও লুকিয়ে থাকলে লাভ হবেনা…আমরা ঠিক খুজে বার করব….

আমি পিছন ফিরে দেখি তানিয়া আর রুশা দাঁড়িয়ে আছে…. তানিয়ার কথার জবাবে বললাম,,,মামা কোথাও যায়নি.. হোস্টেলেই আছে…আমি কমন রুমে আটকে রেখেছি মামাকে….

তখনি জয় এসে বলল,,,হুম ঠিক কাজ করেছো…আজকেই আমাদের মিশন শেষ… তারপর সারাজীবনের জন্য চলে যাবো….রাতে তৈরী থেকো…

আমি মাথা নাড়ালাম…অপেক্ষায় থাকলাম রাতের জন্য…খুব অস্থির লাগছে…পায়চারী করছি রুমের মধ্যে… কি হবে আজ??আমি সব সহ্য করতে পারব তো???

ভাবতে ভাবতেই রাত হয়ে গেছে… তারপর রুশা এসে ডেকে নিয়ে গেলো আমাদের…আমি সাথে মায়ের ফোন টাও নিয়েছি…কিছু প্রমাণ থাকলে মাকে দেখাতে পারব…মা তো বিশ্বাস করবে না আমার কথা…

আমরা সবাই গেলাম কমন রুমে….মামা এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে…থরথর করে কাঁপছে মামা…
জয় হুঙ্কার দিয়ে বলল,,,,এবার শুরু করেন…কি কি করেছেন আপনি???
মামা ভয়ে সব বলতে শুরু করে…আর আমি ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং করছি…

মামা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,,,,এবার আমাকে ছেড়ে দেও….আমি ভালো হয়ে যাবো….আর জীবনেও কোন ভুল কাজ করব না…

তখনি তানিয়া মামা কে হাতের ইশারায় দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারে…মামা চিৎকার দিতে থাকে…রুশা আর তানিয়া হাসতে হাসতে বলে,,,, তুই যতই চিৎকার করিস আজ তোর চিৎকার বাহিরব যাবেনা…চিৎকার করতে থাক তুই…যত পারিস চিৎকার কর…

ওরা তিনজন মামা কে একের পর এক দেয়ালে আছাড় মারছে…আমি সহ্য করতে পারছিনা সেই দৃশ্য… তারপর তানিয়া মামার দুই হাত ভেঙ্গে দিয়েছে….রুশা মামার চোখ দুটো তুলে ফেলেছে… জয় মামার গোপনাঙ্গ টা টেনে ছিঁড়ে ফেলে…টুকরো টুকরো করে ফেলে গোপনাঙ্গ…

ইশ সহ্য হচ্ছেনা আমার…মামা ছটফট করছে…তারপর জয় মামার গলায় হাতের নখ বসিয়ে দেয়..খামচি দিয়ে গলার অর্ধেক অংশ ছিঁড়ে ফেলে…
খুব সহজেই মামা মারা যায়…পুরো কমন রুম রক্তে ভেসে যায়….
ধীরে ধীরে রুশা, তানিয়া আর জয় অদৃশ্য হতে থাকে…আর দেয়ালে লেখা ভেসে উঠতে থাকে,,,, আমরা কারো ক্ষতি করতে আসিনি….রিটন আহাম্মেদ ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে একজন চরিত্রহীন, লম্পট….আমাদের খুন করে সে…তাই আমরা তাকে খুন করে আমাদের প্রতিশোধ নিয়েছি…রিটন আহাম্মেদের খুন সারা পৃথিবীর কাছে শিক্ষা হয়ে থাকবে… যাতে পরবর্তীতে কেউ এরকম কাজ করার সাহস না পায়…..

আমি মামার লাশের পাশে বসে কান্না করতে থাকি…রিদিতা, নাফিসা, অনন্যা আমাকে টেনে রুমে নিয়ে যায়…আমি কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ি…জ্ঞান ফিরলে দেখি মা বাবা উদ্বিগ্ন অবস্থায় আমার মাথার পাশে বসে আছে….মা কে ফোনের ভিডিও টা দেখানো হয়..মা হতবাক হয়ে যায়..বাবা ও মামার থেকে এটা আশা করেনি…..
হোস্টেলে পুলিশ এসে ভরে গেছে…মামার লাশ নিয়ে যেতে চায় ওরা পোস্টমর্টেম এর জন্য…মা বাবা দেয়নি…কারণ মামা কে যেভাবে খুন করা হয় তাতে আর পোস্টমর্টেম করে কোন লাভ হতোনা…এই পর্যন্ত যে কয়জন খুন হয়েছে কারো খুন ই স্বাভাবিক নয়…

এরপর হোস্টেল টা বন্ধ করে দেওয়া হয়…আমাকে নিয়ে আসা হয় বাড়িতে….নবনী কে ওর বাবা মায়ের কাছে দিয়ে আসা হয়…আমি প্রায় একমাস অসুস্থ ছিলাম…না খেতে পারতাম না কারো সাথে কথা বলতাম…কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছিলাম…চারিদিকের সব কিছু কেমন অসহ্য লাগতো… মা বাবা সারাদিন আমার পিছনে পড়ে থাকতো…আমাকে খাইয়ে দেয়া,গোসল করানো যাবতীয় কাজ মা করে দিত… আমার স্বাভাবিক হতে দুমাস সময় লেগেছিলো….

আমাকে বাড়ির পাশের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়…আবার স্কুলে যেতে থাকি আমি…এর মধ্যে মোটামুটি সব কিছু ভুলে যেতে সক্ষম হই..অনন্যা,রিদিতা,নাফিসা, সায়মা ওদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়…..জানিনা কেমন আছে ওরা???

দুই বছর পর…

আজ আমার কলেজের প্রথম দিন…বাবার হাত ধরে স্কুলের প্রথম দিনের মতো কলেজের গন্ডিতে পা রাখলাম….প্রথম দিনেই আমার অনেক ফ্রেন্ড হয়….তবে সেই কলেজে সায়মা, রিদিতা আর নাফিসা কেও পেয়ে যাবো ভাবতে পারিনি….ওদের দেখে অনেক খুশি হই আমি….

ক্লাস করার সময় একটা ফর্সা, লম্বা ছেলে ছুটতে ছুটতে ক্লাসে ঢুকে…ক্লাসের সময় আধা ঘন্টা পার হয়ে যায়…হাপাতে হাপাতে ক্লাসে ঢুকে ছেলেটা… ছেলেটা মাশা আল্লাহ অনেক সুন্দর…ক্লাসের প্রত্যেক টা মেয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে….আর আমার যেন কেমন জেলাসফিল হচ্ছে….

ছেলে টা এসেই আমার বাম হাতের সারির পাশের সিটে বসেছে….আমি সেদিকে খেয়াল না করেই পড়ায় মন দিলাম…
হঠাৎ মনে হলো আমার কপালে ঠান্ডা বাতাস লাগছে…কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ে একপাশে সরে গেছে…আমি পাশ ফিরে তাকাতেই ছেলে টা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলছে,,,,বলেছিলাম না আমি ফিরে আসবো….এই যে আমি ফিরে এসেছি….

আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকি… কি বলছে এই ছেলে????তাহলে কি জয়???না এ কি করে সম্ভব???

আজ প্রথম দিন তাই বেশি ক্লাস হয়নি….ক্লাস শেষে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে ছেলেটা কে খুঁজতে থাকি….ইশ ছেলেটার নাম ই তো জানা হলো না….ভাবতে ভাবতে কলেজের গেইটে চলে আসি…হঠাৎ কানের কাছে মুখ এনে কেউ বলছে,,,,আমার কথাই ভাবছিলে তো???আমার নাম ইরফান হোসেন জয়…কি চিনতে পেরেছো????

আমি পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি সেই ছেলেটা……

(সমাপ্তি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here