নীলকণ্ঠা পর্ব-৪

0
2224

#নীলকণ্ঠা

৪।
বসার ঘরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। মইনুর শেখ সোফায় বসে আছেন গম্ভীর মুখে। তার ডান পাশে ভেজা শার্টে দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ আর বাম পাশে ভেজা শালওয়ার কামিজে দাঁড়িয়ে আছে রেনুকা। তার ডান বাহুতে কাদা মাটি শুকিয়ে আছে। বাম হাতের কব্জিতে শুকনো কাদা লেগে আছে, শালওয়ারেও কাদা মাটির চিহ্ন। রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফায়াজের দিকে। ক্ষানিক দূরে দাঁড়িয়ে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে আতর আলি আর আমেনা।

নিরবতা ভেঙ্গে মইনুর শেখ কথা বললেন। গম্ভীর তার কণ্ঠস্বর। কি হয়েছিল বাহিরে?

প্রশ্নটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রেনুকা ফায়াজকে দেখিয়ে বলল,
ইনি আমাকে চড় মেরেছেন।

ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো রেনুকার দিকে। মইনুর শেখ ফায়াজের দিকে তাকালেন। বললেন,
কারনটা কি জানতে পাড়ি?

ফায়াজ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
রেনুকা পরীকে মেরেছেন।

আমি মারি নি। শাসন করেছি। দ্রুত গতিতে রেনুকা বলল।

ফায়াজ তাচ্ছিল্য হাসলো। তাহলে তো বলতে পাড়ি আমিও আপনাকে শাসন করেছি।

আপনি আমাকে শাসন কেন করবেন? আমি একজন সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ। কোন অন্যায় করি নি, কারো কথা অমান্য করি নি।

আপনি পরীর উপর নির্যাতন করেছেন।

রেনুকা অবাক হলো। মইনুর শেখের দিয়ে তাকিয়ে বলল,
স্যার, স্যার দেখেছেন কি বললেন ইনি?

মইনুর শেখ ডান হাত তুলে ইশারায় রেনুকাকে থামতে বললেন। মইনুর শেখের ইশারা বুঝে রেনুকার জ্বলে উঠা জেদ নিভে গেল। মইনুর শেখ নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর রাখলেন। শব্দহীন শ্বাস নিয়ে ফায়াজকে বললেন,
দেখো ফায়াজ, তোমাকে গতকালও বলেছি এটা আমার পারিবারিক ব্যপার আর আমার মেয়ের ভালো মন্দের জন্য আমি রেনুকে রেখেছি। রেনু ভালো বুঝবে কোনটাতে পরীর ভালো আর কোনটাতে খারাপ। পরীর বাহিরে যাওয়া নিষেধ তবুও সে নিষেধ অমান্য করে বাহিরে গিয়েছে তাই হয়ত রেনুকা মেরেছে। এখানে আশা করছি তৃতীয় কোন ব্যক্তির মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।

মইনুর শেখের বিস্তর কথা শুনেও ফায়াজ দমলো না। অসন্তোষের সুরে বলল,
বাহিরে যাওয়া নিষেধ হবে কেন? ডাক্তার তো বলেছেন পরীকে বাহিরে ঘুড়াতে, পছন্দের জায়গায় নিয়ে যেতে, হাসি আনন্দের মধ্যে রাখতে। কি বলে নি?

ফায়াজের কথা শুনে মইনুর শেখ সরাসরি আমেনার দিকে তাকালেন। দৃষ্টি বিনিময় হতেই আমেনা চোখ নামিয়ে ফেললো। মইনুর শেখ ফের তাকালেন ফায়াজের দিকে। বললেন,
এভাবে বাহিরে নিয়ে গেলে অভ্যাস হয়ে যাবে। ব্যস্ততার মধ্যে বা কোন কারনে নিয়ে যেতে না পাড়লে এভাবে লুকিয়ে যাবে। যদি কোথাও হারিয়ে যায়, বিপদ আপদ হয় তখন কি হবে?

নাকি আপনি চাচ্ছেন না পরী স্বাভাবিক জীবনে আসুক?

ফায়াজের কথাটা শেষ হতেই হকচকিয়ে গেলেন মইনুর শেখ। ফাকা একটা ঢোক গিললেন নিমিশেই। বুক কাঁপছে তার। মাঝে মাঝে ফায়াজের আন্তাজে বলা কথাগুলো মইনুর শেখের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মইনুর শেখ ফায়াজের সন্দেহকে সত্যি প্রমাণিত করতে চান না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি বাবা হয়ে মেয়ের এটা চাইবো না?

ফায়াজ ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিল,
আপনার কার্যকলাপ সেটা মনে করাতে বাধ্য করছে।

মইনুর শেখ নিশ্বাস ফেললেন। বললেন,
এখন কি করতে হবে?

পরী এ বাসায় বাকি স্বাভাবিক মানুষের মতোই থাকবে।

এটা সম্ভব নয়।

কেন?

ও আমাদের মতো স্বাভাবিক নয়। সুযোগ পেলেই বাহিরে চলে যায়, ভাঙ্গচুর করে, কথার অবাধ্য হয়।

ওর দায়িত্ব আমি নিব। যতদিন এখানে আছি পরীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার।

রেনুকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ। ফায়াজের কথাবার্তা তার কাছে নিতান্তই আদিক্ষেতা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। মইনুর শেখ কিছুক্ষন নিরব রইলেন। এরপর বললেন,
আমার মেয়ের কিছু হলে আমার হাত থেকে বাচবে না তুমি।

ফায়াজ ঠোঁট টেনে হাসলো। রেনুকা অবাক হয়ে তাকালো মইনুর শেখের দিকে। তিনি এভাবে রাজি হয়ে যাবেন ভাবতেই পাড়ে নি। ফায়াজ আমেনাকে ডেকে বলল,
পরীর কাছে যান। আমি আসছি।

আমেনা মাথা নেড়ে পরীর ঘরে গেল। ফায়াজও এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আতর আলিও চলে গেল। বসার ঘরে রয়ে গেল মইনুর শেখ ও রেনুকা। রেনুকা বিরক্তি নিয়ে মইনুর শেখের দিকে এগিয়ে এলো। কিছুটা নিচু স্বরে বলল,
এটা কি করলেন? আপনি রাজি হয়ে গেলেন কেন? আপনি বুঝতে পাড়ছেন এর পরিণতি কি হবে?

মইনুর শেখ সোফায় হেলে হাতলে হাত রেখে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসলেন। স্বাভাবিক ভাবে বললেন,
ফায়াজ একজন বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি। তাকে হালকায় নেয়া ভুল হবে। সে এখানে কিছুদিনের মেহমান। পরীকে দেখে হয়ত তার মায়া লেগেছে তাই এসব করছে কিন্তু সেটা ক্ষানিকের জন্য। পরী আর নয়-দশ জনের মতো স্বাভাবিক নয়। তাই কিছুদিন পর সে এমনিতেই পরীর উপর বিরক্ত হবে। ফায়াজ চলে গেলে পরবর্তিতে পরীকে আমাদের সাথেই থাকতে হবে। পাঁচ- ছয়দিনে সে পরীকে স্বাভাবিক করতে পাড়বে না। আর আজ আমি জাফরের সাথে কথা বলব। ততোদিনে ফায়াজ যা করতে চায় ওকে করতে দাও।

রেনুকা চিন্তিত স্বরে বলল,
তাহলে আমি কি পরীর কাছে যাবো না?

কাছে যাবে না। দূর থেকে নজর রাখবে।

রেনুকা হালকা মাথা নাড়ালো।

_______
আমেনা পরীর পেছনে বসে চুলে বেনুনী বাধছে। ফায়াজ দরজায় দাঁড়িয়ে একপলক তাকিয়ে ঘরে ঢুকলো। আমেনা পরীর পেছন থেকে উঠে দাঁড়ালো। পরী নিচের দিকে তাকিয়ে কি যেন বিরবির করছে আর বিছানায় আঙ্গুল দিয়ে আকিঝুকি করছে। মাথা দোলাচ্ছে। ফায়াজ আমেনার দিকে তাকিয়ে বলল,
টেবিলে নাস্তা দিন। পরী আজ টেবিলে বসে নাস্তা করবে।

আমেনা আমতা আমতা করলো। ভীতিগ্রস্ত হয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ফায়াজ নির্ভয় দিয়ে বলল,
আমি সামলে নিব।

পরীকে বাহিরে নেয়ার জন্য তার মনও স্বায় দেয় না তবুও সে পরীর ভালোর জন্য জোরপূর্বক রাজি হলো। আমেনা পরীকে নিয়ে খাবার ঘরে এলো। আমেনা বেগম রান্নাঘরে গেল পরীর জন্য নাস্তা নিয়ে আসতে। পরী খাবার টেবিলের এককোণে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর পাতা কাচে খামচে চলছে। মাথা দোলাচ্ছে আর মৃদু হু হু শব্দ করছে। ফায়াজ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে পরীকে। আমেনা একপ্লেটে দুটো রুটি আর অন্য বাটিতে ভাজি আর ডিম সিদ্ধ নিয়ে টেবিলে রাখলো। পরীর দিকে একনজর তাকিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলতে লাগলো। ফায়াজ এগিয়ে যেয়ে মোলায়েম ভাবে পরীর বাহু স্পর্শ করতেই পরী হুড়মুড় করে ফায়াজের থেকে ছিটকে সরে গেল। আকস্মিক ঘটনায় ফায়াজ হালকা চমকালো।

রেনুকা বসার ঘরে সোফায় বসে ছিল। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। রেনুকার বক্র হাসি চোখ এড়ালো না ফায়াজের। রেনুকার সামনে নিজেকে পরাজিত মনে হলো। ফায়াজ দুহাত নিজের বুকের কাছে তুলে পরীকে বলল,
আচ্ছা, এই যে ধরছি না। শান্ত হও।

পরী ক্ষানিক দূরে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়াচ্ছে, বিরবির করছে। আমেনাকে ইশারা করতে তিনি পরীর কাছে গেল। পরীকে নিয়ে চেয়ারে বসালো। ফায়াজ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমেনার বুক ধুকপুক করছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে পরী যেন কোন গণ্ডগোল না করে। আমেনা পরীর পাশে চেয়ার টেনে বসলো, কম্পিত হাতে রুটির এক টুকরো ছিঁড়ে তাতে ভাজি নিয়ে পরীর মুখের কাছে ধরতেই পরী আমেনার হাত ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিল। জেদ নিয়ে মুখে বিরক্তিকর শব্দ তুললো।

আমেনা করুন চোখে ফায়াজের দিকে তাকালো। ফায়াজ কিছু ভাবলো এরপর নিম্ন স্বরে বলল,
পরী পুকুর ঘাটে যাবে?

চার শব্দের একটি বাক্যে পরী চুপ হয়ে গেল। মাথা ঘুড়ালো ফায়াজের দিকে। একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুড়ালো। ফায়াজ এক কদম এগিয়ে এলো।
কি যাবে?

পরী তার দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুড়াতে ঘুড়াতেই জোরেশোরে উপর নিচে মাথা দোলালো। ফায়াজ পরীর দিকে আরো এক কদম এগিয়ে এসে বলল,
তাহলে খাবার খেতে হবে। সব খাবার শেষ করলেই পুকুর ঘাটে যেতে পাড়বে।

পরী নিরবে ফায়াজের কথা শনে সোজা হয়ে বসলো। আমেনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফায়াজের দিকে। ফায়াজ মাথা নাড়িয়ে আমেনাকে পরীর মুখে খাবার ধরতে বলল এবং আশ্চর্যজনক ভাবে আমেনা রুটির টুকরো মুখের কাছে নিতেই পরী মুখ খুলে হা করলো। মুখে পুরে নিল আমেনার হাতের রুটির টুকরো। আমেনার বিস্মৃত হাসলো। প্রশস্ত হলো ফায়াজের অধর। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো রেনুকার দিকে। জয়ের হাসি ফায়াজের ঠোঁটে। চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে চোখ সরালো রেনুকা।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here