নীল চিরকুট’ পর্ব-১৯

0
4868

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১৯.

বর্ষার শেষ। তবুও সারাদিন ব্যাপী মুশলধারার বৃষ্টি। নাদিম পাজেরো সেডান গাড়িতে বসে আছে। বৃষ্টির তোড়ে ঘোলা হয়ে আসছে উইন্ড শিল্ড। ড্রাইভার উইপারগুলো সক্রিয় করে দিয়ে হালকা কাঁশলো। মুখভঙ্গি গম্ভীর করে বলল,

‘ শাহবাগের রাস্তায় দুই দিন আগে গর্ত খুঁড়া হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে নাজেহাল কান্ড। গাড়ি যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার এখানেই নামতে হবে।’

নাদিম বিরক্ত চোখে তাকাল। বাইরে টানা বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে বেরুনো মাত্রই কাক ভেজা নিশ্চিত। এই চকচকে লাল পাজেরো গাড়িটা তার নয়। তার বড়লোক ছাত্রী মৌশির। টিউশনি করে ফেরার সময় একরকম জোর করেই গাড়িতে উঠানো হয়েছে তাকে। প্রথম দফায় মুখ-চোখ গম্ভীর করে ‘না’ হেঁকেছিল নাদিম। এসব চকমকে গাড়িতে চলার অভ্যাস তার নেই। সে মাটির মানুষ, দুই-এক ঘন্টার বৃষ্টিতে কিছু হয় না। কিন্তু বড়লোক বাবার মেয়েদের মধ্যে একটা ন্যাকা ন্যাকা ভাব থাকে। এরা ‘রিজেকশন’ জিনিসটা সহ্য করতে পারে না। অল্পতেই চোখ-মুখ অন্ধকার করে টলমলে চোখে তাকায়। সুন্দরী মেয়েদের টলমলে দৃষ্টি উপেক্ষা করা কঠিন। নাদিমও পারেনি। এক সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে চকচকে গাড়িতে উঠতে হয়েছে। সেইসাথে ড্রাইভার নামক উল্লুক বস্তুটির বক্র চাহনীর শিকার হতে হয়েছে। বড়লোকের সুন্দরী মেয়েরা যতটা ঢঙ্গী হয়, তাদের ড্রাইভারগুলো হয় ততটাই হারামি। এদের ভাবসাব গাড়ির মালিক থেকেও উঁচু। মালিকের সুন্দরী মেয়েরা নাদিমের মতো ছাল-চামড়াহীন উদ্ভট ছেলেদের দিকে মায়া মায়া চোখে তাকালেই এদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দৌঁড়াতে শুরু করে। ওসব ছাল-চামড়াহীন ছেলেগুলো হয়ে দাঁড়ায় রাজ্যের বিতৃষ্ণার বস্তু। যেন সুযোগ পেলেই রাজত্বসহ রাজকন্যা নিয়ে ভেগে যেতে পারে এসব ভন্ড ছেলের দল। নাদিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ বাইরে তো বৃষ্টি। এখানে নামলে ভিজে যাব না?’

‘ এমনিতেও তো ভিজেই আসতেন। সামনে রাস্তা খারাপ থাকলে আমি কী করব? পানি ঢুকে ইঞ্জিন গেলে, স্যার তো ছেঁড়ে কথা বলবে না।’

নাদিমের মেজাজ চটে গেল। সে-কি ইচ্ছে করে গাড়িতে উঠেছে নাকি? যেচে পড়ে গাড়িতে তুলে এসব রং-ঢং অপমানের মানে কী? নাদিম তার নিজের ক্যারেক্টারে ফিরে এলো। পেছনের সীটে গা এলিয়ে দিয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

‘ অন্য কোনো রাস্তা ধরুন। শাহবাগ যাওয়ার আগে আমি নামব না।’

ড্রাইভার সন্দিহান চোখে তাকাল। বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ অন্য কোনো রাস্তা চিনি না। সব রাস্তায় জল আটকে আছে। আপনাকে এখানেই নামতে হবে।’

‘ আপনার ম্যাডামকে ব্যাপারটা জানান। উনি কী বলেন শুনেই নেমে যাব।’

ড্রাইভার ঢোক গিলল। ফন্ট গ্লাসে নাদিমের দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপচাপ বসে রইল। নাদিমকে চিন্তাহীন বসে থাকতে দেখে বাধ্য হয়েই ম্যাডামকে ফোন লাগাল। দুই এক মিনিট হু-হা করে চরম বিরক্তি নিয়ে গাড়ি চালাতে মন দিল। কয়েক মিনিট চলার পর নাদিম তার নিজস্ব কায়দায় বলল,

‘ ওই মিয়া? গাড়ি থামাও।’

ড্রাইভার কপাল কুঁচকে বলল,

‘ কেন? ছোট ম্যাডাম আপনাকে হলের সামনে নামিয়ে দিতে বলেছে।’

‘ একটা থাপড়া দিয়া গাল লাল কইরা ফেলমু। যা কইছি করো। গাড়ি থামাইতে কইছি থামাবা, ব্যস।’

মুহূর্তেই নাদিমের কথার টুন পরিবর্তন হওয়ায় খানিকটা থমকে গেল ড্রাইভার। গাড়ি থামিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকাল। নাদিম ভরা বৃষ্টিতে গাড়ি থেকে নামল। জানালার কাঁচে টোকা দিয়ে কাঁচ নামাতে বলল। ড্রাইভার যন্ত্রের মতো গাড়ির কাঁচ নামাল। নাদিম জানালায় দু-হাত রেখে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ তোর ম্যাডামকে গিয়া বলবি এইসব বাল-ছালের গাড়িতে আমি উঠি না। আর হ্যাঁ, পরের বার আমার সামনে এমন পার্ট দেহাইলে জিগারের ডাল দিয়া পিটাইয়া তোর পার্ট ছুটাই দিমু। বুঝছিস কি কইছি?’

নাদিমের কথায় হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল ড্রাইভার। চোখে-মুখে অবিশ্বাস। ড্রাইভারের হতভম্ব দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে নাদিম শাহাবাগের দিকে হাঁটা দিল। চাল-চলনে অদ্ভুত এক সুখ সুখভাব। ভিজে চুপচুপে ফ্যাকাশে শরীরটাতে যেন অনাবিল শান্তি। ড্রাইভারের হতভম্ব দৃষ্টি হঠাৎ-ই সরে গেল না। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাবতে লাগল, হাতিরপুল থেকে শাহাবাগ হেঁটে হেঁটে যাবে নাকি লোকটা?

নাদিম উদ্দেশ্যহীন হাঁটছে। চাল-চলনে কোনো তাড়া নেই। হাঁটু সমান জলে অযথা দৌঁড়া-দৌঁড়ির কোনো মানে হয় না। আস্তেধীরে হাঁটলেও সন্ধ্যার আগে ভার্সিটির নির্দিষ্ট হলে পৌঁছে যাওয়া যাবে । অতো অস্থির হয়ে লাভ নেই। জীবনটা ছোট। এর প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করায় বুদ্ধিমানের কাজ। নাদিম নিজেকে বুদ্ধিমান বলেই দাবি করে। এইযে হাঁটু সমান পানিতে পা উঁচিয়ে উঁচিয়ে হাঁটছে, এই হাঁটাটাও বেশ উপভোগ করছে নাদিম। নতুন ভঙ্গিতে হাঁটতে তার ভালো লাগছে। তাছাড়া, সঙ্গীহীন পথচলায় মুক্ত মস্তিষ্কটা মৌশির কথা ভাবারও সময় পাচ্ছে। এটা প্রয়োজন। মৌশিকে নিয়ে হালকা-পাতলা ভাবার প্রয়োজন তার আছে। নাদিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, মৌশিকে খুব বেশিদিন পড়ানো তার হবে না। মোটা অঙ্কের বেতনের জন্য এতোদিন টিকে থাকলেও সেই টিকে থাকাটা বেশিদিন টিকে থাকবে না। মেয়েটার চাহনী অন্যরকম। কিশোরী মেয়েদের চাহনীতেই সমস্যা। তার থেকেও বড় সমস্যা এরা নাদিমের মতো উলোটপালোট, উশৃংখল ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি। নম্র-ভদ্র, সুশৃঙ্খল ছেলেদের প্রতি তাদের তেমন ফ্যান্টাসি কাজ করে না। মেয়েটা ইদানীং নাদিমের কথায় মুগ্ধ হতে শুরু করেছে। নাদিমের অপছন্দীয় কথাগুলো আজকাল তার ভালো লাগছে। বিষয়টা চিন্তার। ভীষণ চিন্তার।

বারান্দার কোণায় টিমটিমে আলো জ্বলছে। হলদে আলো। বারান্দার রেলিং, মেঝে সব ভিজে একাকার। ফ্লোরের কোণায় পানি জমে আছে। নম্রতা পানিটুকুকে পাশ কাটিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল। চোখের সামনে কালো, অন্ধকার আকাশ। ঠান্ডা, শীতল পরিবেশে শীত শীত করছে নম্রতার। আবার মুহূর্তেই ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরে রাখা মোবাইলটির দিকে তাকাতেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে নীরাকে ভীষণ প্রয়োজন ছিল তার। কিন্তু নীরা নেই। কাল দুপুরেই প্রয়োজনীয় ফোন পেয়ে বাড়ি ছুঁটেছে সে। নম্রতা কাঁপা কাঁপা হাতে নিষাদকে কল করল। প্রতিবারের মতো এবারও কল ঢোকার আগেই কেটে দিল। ঝপঝপে ভেজা ফ্লোরটাতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল সে। আবারও গরম লাগছে। প্রচন্ড গরম। সেই সাথে পানি পিপাসা। নিষাদকে কল করার সাহস বা শক্তি কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। নিষাদকে কল করার পর অবশিষ্ট আশাটুকুও যদি নিরাশা হয়ে যায়? তখন কী নিয়ে বাঁচবে নম্রতা? মোবাইলটা কোলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ উদাসীন বসে রইল নম্রতা। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। প্রচন্ড ঝড়ের পূর্বাবাস হিসেবে নেচে উঠল গাছপালা। শাখা-প্রশাখার আন্দোলনে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠল। কিন্তু নম্রতার সাড়া নেই। কালো মায়াময় চোখদুটো মেলে তাকিয়ে আছে বহু দূরে। দৃষ্টি শূন্য। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর নম্রতা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল। নিজেকে শক্ত করে নিষাদের নাম্বার ডায়াল করল। প্রথমবার বাজল, রিসিভ হলো না। অধৈর্য নম্রতা আবারও ডায়াল করল। কল কেটে যাওয়ার আগ আগ মুহূর্তে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে গম্ভীর ভরাট কন্ঠে সালাম দিয়ে উঠল কেউ। নম্রতা হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পেল না। গলা থেকে কথা বেরুচ্ছে না। বহু কষ্টে সালামের জবাব নিতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ জি, কে বলছেন?’

‘ আপনি নিষাদ সাহেব?’

ওপাশ থেকে খুশ-মেজাজী উত্তর,

‘ সাহেব কি-না বলতে পারছি না তবে নিষাদ নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনি কে? মাফ করবেন, চিনতে পারছি না।’

নম্রতা ভেতরের উথাল-পাতাল চিন্তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি নম্রতা। নম্রতা মাহমুদ।’

‘ নম্রতা! আপনাকে কী আমার চেনার কথা? আসলে, এই নামে কাউকে চিনি বলে মনে পড়ছে না। কিছু মনে না করলে আরেকটু ডিটেইলস পরিচয় দেওয়া যাবে? আমার চেনার মতো।’

নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল মাস খানিক আগে। কক্সবাজারে। আপনার বন্ধুর সাথে একটা ঝামেলা বেঁধে গিয়েছিল আমার। মনে পড়েছে?’

ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর উৎসাহী কন্ঠে উত্তর,

‘ আরে! চিনতে পেরেছি। সরি প্রথমটায় গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কেমন আছ?’

নিষাদের কথায় খানিকটা থমকাল নম্রতা। নিষাদের কথার টুন পাল্টে গিয়েছে। তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, নিষাদ তার পূর্ব পরিচিত। বহু বছর পর হঠাৎ তাদের কুশলাদি বিনিময় হচ্ছে। নম্রতা একটু চুপ থেকে বলল,

‘ আপনি আমায় চিনেন?’

নিষাদের স্বাভাবিক উত্তর,

‘ চিনব না কেন?’

‘ কিভাবে চিনেন?’

‘ তুমি যেভাবে চেনো সেভাবেই।’

নম্রতা বুঝতে না পেরে বলল,

‘ মানে?’

নিষাদ উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ তুমি হঠাৎ আমায় ফোন করলে? কোনো প্রয়োজন ছিল?’

নম্রতার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এই লোকটি ঠিকঠাক উত্তর দিচ্ছে না, নাকি নম্রতা ঠিকঠাক প্রশ্নই করতে পারছে না? নম্রতা কি সোজাসাপ্টা জিগ্যেস করবে? নম্রতাকে চুপ থাকতে দেখে ওপাশ থেকে বলল,

‘ হ্যালো! হ্যালো? নম্র? শুনছ?’

নম্রতা ফট করেই প্রশ্ন করল,

‘ আপনিই কী সে?’

‘ তুমি আমাকে খুঁজছিলে। তো, আমি যে সে হবো এটাই স্বাভাবিক।’

নম্রতা কী বলবে বুঝতে পারছে না। নিষাদ কথার প্রেক্ষিতে কথাটা বলল নাকি সবটা বুঝে বলল সেটাও বুঝা যাচ্ছে না। নম্রতা বুঝল এভাবে সম্ভব নয়। সরাসরি কথা বলে মিটমাট করতে হবে। তাছাড়া, কথাগুলোও গুছিয়ে নিতে হবে। নম্রতার সময় দরকার। নম্রতা বেশ ভেবেচিন্তে বলল,

‘ আমি খুব প্রয়োজনে ফোন দিয়েছি আপনাকে। কিন্তু প্রয়োজনটা ফোনে বুঝাতে পারছি না। আপনার সাথে একটু দেখা করা যাবে? প্লিজ?’

নিষাদ খানিক চুপ থেকে বলল,

‘ আমার সাথে দেখা করতে হবে কেন?’

‘ দেখা হলে বলি?’

নিষাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ বেশ! তবে আজ-কালের মধ্যে সম্ভব হবে না। বাবা আর মাকে নিয়ে রাজশাহী এসেছি। এখানে পার্সোনাল কিছু সমস্যার জন্য দু-চারদিন থাকতে হচ্ছে। আমি ঢাকায় ফিরে তোমায় কল দিই?’

অনিশ্চিত সময়ের অপেক্ষায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল নম্রতা। ছোট্ট করে বলল,

‘ আচ্ছা।’

ওপাশ থেকে হাস্যোজ্জল কন্ঠে বলে উঠল নিষাদ,

‘ পড়াশোনা কেমন চলছে? নাকি এখনও ফাঁকিবাজি চলে?’

নিষাদের একটা প্রশ্নেই দুনিয়া ঘুরে গেল নম্রতার। কে এই নিষাদ? নম্রতা সম্পর্কে কিভাবে জানে এতো? তাহলে কী সত্যিই নিষাদই সেই? নম্রতার উত্তর না পেয়ে আবারও কথা বলল নিষাদ,

‘ তুমি সত্যিই এতো কম কথা বলো? নাকি পাল্টে গিয়েছ?’

‘ আপনি কে? কিভাবে চিনেন আমায়?’

‘ তুমি জানো না কিভাবে চিনি? তুমি আমাকে চিনে ফেলছ অথচ আমি তোমায় চিনব না? অদ্ভুত!’

নম্রতা শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি আপনাকে চিনি না।’

নিষাদ অবাক হয়ে বলল,

‘ তাহলে খুঁজছ কেন?’

নম্রতা কিছু বলবে তার আগেই ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠল নিষাদ,

‘ বাবা ডাকছে নম্র। এখন আর কথা বলতে পারছি না। তোমায় বরং ঢাকায় ফিরে কল করি? রাজশাহীর এই জায়গাটাতে নেটওয়ার্ক একটু স্লো।’

‘ রাজশাহী কি করছেন?’

নিষাদ ইতস্তত করে বলল,

‘ এসেছি দুটো কাজে। এখানে জমিজমা সংক্রান্ত কিছু ঝামেলা হচ্ছে। খারিজ টারিজ করতে স্থানীয় ভূমি অফিসে ভীষণ দৌঁড়ঝাপ চলছে। আর দ্বিতীয় কাজটা হলো বাবা-মা একটা মেয়ে দেখছেন।’

নম্রতার হঠাৎ রাগ লাগল। এই লোক যদি ‘সে’ হয়ে থাকে তাহলে তার ‘সে’ বিয়ে করে ফেলছে? আর নেচে নেচে সেই খবরও দেওয়া হচ্ছে! নম্রতা তপ্ত কন্ঠে বলল,

‘ তো বিয়ে করা হচ্ছে!’

নিষাদ খানিক ইতস্তত করল। খানিক চুপ থাকল। তারপর কন্ঠটাকে যথাসম্ভব সহজ করে বলল,

‘ এখনই হচ্ছে না। তবে কথা চলছে। বয়স হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে তো করতেই হবে। আর বাবা-মাও চাপ দিচ্ছে।’

নম্রতা চাপা তেজ নিয়ে বলল,

‘ ভালো। করে ফেলুন বিয়ে। তার আগে..’

নম্রতার কথার মাঝেই বলে উঠল নিষাদ,

‘ আচ্ছা নম্র। বিয়ে নিয়ে আলাপটা পরে করি? আপাতত রাখতে হচ্ছে। বাবা ডাকছে।’

নম্রতা কিছু না বলে ফোন কাটল। মাথা ভর্তি কনফিউশান আর প্রশ্ন নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। জীবনটা এতো কমপ্লিকেটেড কেন? চারপাশে প্রশ্নের পর প্রশ্ন! উত্তরের খাতাটা সব সময়ের মতোই শূন্য। সাদা।

আকাশে মেঘ নেই। উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। ডিপার্টমেন্টের সামনে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নম্রতা আর তার বন্ধুরা। নাদিম কিছুক্ষণ পর পর হাঁচি দিচ্ছে। চোখ-মুখ লাল। জিহ্বা বিস্বাদ। মন-মেজাজও চটে আছে খুব। ছোট-খাটো কথাতেই রেগেমেগে গলা চড়াচ্ছে, গালাগাল দিচ্ছে। নম্রতার গায়ে সাদা সালোয়ার-কামিজ। চোখ-মুখ ফ্যাকাশে। একটু খেয়াল করলেই চোখের কার্ণিশে দেখা যাবে নির্ঘুম রাতের কালো ছোপ দাগ। অন্তুর গায়ে ঢোলাঢালা টি-শার্ট। হাতে পানির বোতল। কোনো এক অদ্ভুত কারণে কিছুক্ষণ পরপর ঢকঢক করে পানি গিলছে সে। কিছুক্ষণ আগেই ক্লাস শেষ হয়েছে। আড্ডাটাও বেশ জমে এসেছে। আড্ডার মূল বিষয়বস্তু লেখক রিচার্ড ডকিন্সকে নিয়ে যখন সবাই যুক্তি দাঁড় করাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই ধীর পায়ে পাশে এসে দাঁড়াল নীরা। গায়ে তার সবুজ রঙের শাড়ি। মুখে হালকা সাজের রেখা। নীরা পাশে এসে দাঁড়াতেই থমকে গেল সবাই। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার মুখে। পাঁচ জোড়া চোখের নীরব দৃষ্টিতে নীরা কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে হাসার চেষ্টা করল। ছোঁয়া চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘ শাড়িতে তোকে হেব্বি লাগছে। কিন্তু, আজ তো ভার্সিটিতে কোনো অকেশন নেই। শাড়ি পরেছিস কেন দোস্ত?’

নাদিম অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

‘ তুই কইতে টপকাইলি? তুই না বাড়িত গেছিলি? আর এসব মাঞ্জার কারণ কী? মতলব তো সুবিধার না মামা। বিয়া কইরালাইছস নাকি? দাওয়াত দেস নাই, তোর বিয়া মানি না। ফুট।’

নাদিমের সাধারণ কথাটাতেই উপস্থিত একজনের বুক ধ্বক করে উঠল। গলায় আটকে গেল নিঃশ্বাস। হতভম্ব, অসহায় চোখে চেয়ে রইল নীরার ফর্সাটে মুখে। নীরা হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ তোদের না বলে বিয়ে করব নাকি? বাসা থেকে ছেলে ঠিক করেছে। তার সাথেই দেখা করার কথা আজ। ভার্সিটির পাশের রেস্টুরেন্টটাতেই। তাই…’

কথাটা শেষ করতে পারল না নীরা। তার আগেই একজোড়া চোখে আটকে গেল তার চোখ। সেই পাগলাটে দৃষ্টিতে ভেতরটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল নীরার। সেই চোখে চোখ রেখেই শক্ত কন্ঠে কথাটা শেষ করল নীরা,

‘ তাই তোদের সাথে দেখা করতে এলাম। খুব নার্ভাস ফিল করছি। দোয়া কর বিয়েটা যেন হয়ে যায়।’

অন্তুর হাতের বোতলটা ধুমলে মুচড়ে গিয়েছিল সেই অনেক আগে। নীরার কথাটা শেষ হতেই বোতলটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। নিঃশব্দে সরে গিয়ে নিজের বাইকের ওপর বসল। বাইকে স্টার্ট দিতেই চেঁচিয়ে উঠল নাদিম,

‘ ওই হালায়? যাস কই? ক্লাস করবি না?’

নাদিমের কথার কোনোরূপ উত্তর না দিয়েই বাইক ছুটাল অন্তু। সেদিকে তাকিয়ে থেকে একইসাথে পাঁচটা হৃদয় থেকে বেরিয়ে এলো তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। কিই-বা করার আছে তাদের? নীরার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে জান বের করে ছেড়ে দিত তারা। কিন্তু বন্ধুই যখন বন্ধুর প্রতিপক্ষ তখন যে পরিস্থিতিটা বড্ড অসহায়। বন্ধুর জন্য বান্ধবীকে কী আদৌ কিছু বলা যায়? দুজনেই যে আপন। একদম নিজের।

#চলবে….

( রি-চেইক করা হয়নি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here