নীল চিরকুট’ পর্ব-২১

0
4184

# নীল চিরকুট
# লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

২১.

শাহবাগের ছোট্ট একটি কফিশপে বসে আছে নম্রতা। টিপটিপ বৃষ্টি আর ঠান্ডা হাওয়ার মাঝেও দরদর করে ঘামছে সে। গায়ে থাকা গাঢ় নীল ওড়না দিয়ে কপাল আর গলার ঘাম মুছল নম্রতা। শুকিয়ে আসা খড়খড়ে ঠোঁটটা জিহ্বা দিয়ে বার কয়েক ভিজিয়ে নিয়ে কফিশপের দরজার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে অস্থির চোখে হাতে থাকা ঘড়িটির দিকে তাকাল নম্রতা। বামহাতে থাকা ছোট্ট ডায়ালের ঘড়িটি জানান দিচ্ছে এখন শেষ বিকেল। কিছুক্ষণ পরই আসরের আজান পড়বে। নম্রতার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। নিষাদের নাম্বারটা তৃতীয় বারের মতো ডায়াল করল সে। কল রিসিভ হলো না। দুই মিনিটের মাথায় কফিশপের স্বচ্ছ কাঁচের ওপাশে লম্বা, ফর্সা দেখতে এক যুবককে দেখা গেল। গায়ে কালো চেইক শার্ট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছে শার্টের অনেকটা। লোকটি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই নম্রতার দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে এক গাল হেসে বলল,

‘ কেমন আছো নম্র?’

নম্রতা চমকে তাকাল। সামনে দাঁড়ানো যুবকটিকে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না সে। নম্রতা কপাল কুঁচকাল,

‘ আপনি?’

‘ নিষাদ। আশ্চর্য! চিনতে পারছ না?’

নম্রতা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। দুই একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

‘ সরি! আমি ঠিক চিনতে পারিনি।’

নিষাদ হাসল। সামনের চেয়ারটা ডানহাতে টেনে নম্রতার মুখোমুখি বসল। নম্রতার দিকে তাকিয়ে সহজ কন্ঠে বলল,

‘ দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।’

নিষাদের কথায় সম্বিৎ ফিরল নম্রতার। চট করে বসে পড়ে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। ডানহাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁটের উপরের ঘামটুকু মুছে নিয়ে জোড়াল শ্বাস ছাড়ল। নিষাদ বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘ তুমি কি কোনো কারণে আমায় ভয় পাচ্ছ নম্র? তোমাকে রেস্টলেস দেখাচ্ছে।’

নম্রতা এবার চোখ তুলে তাকাল। নিষাদের ক্লান্ত মুখে চিন্তার ছাপ। চোখদুটোতে চকচক করছে কৌতূহল। নম্রতাকে নীরব তাকিয়ে থাকতে দেখে সামনে থাকা পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল নিষাদ। শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আই থিংক, পানিটুকু তোমার প্রয়োজন।’

নম্রতা বিনাবাক্যে গ্লাসটা তুলে নিল হাতে। এক নিঃশ্বাসে পুরো গ্লাস ফাঁকা করে দিয়ে আবারও নিষাদের দিকে তাকাল। নিষাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে-মুখে কৌতূহল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। নম্রতা জোড়াল নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। নিষাদের চোখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল,

‘ কেমন আছেন?’

নিষাদ হাসল। টেবিলের ওপর দু’হাত রেখে সোজা হয়ে বসল। মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ ভালো। তুমি কেমন আছ নম্র?’

‘ ভালো। আমিও ভালো আছি।’

‘ তোমাকে দেখে কিন্তু তেমনটা মনে হচ্ছে না। কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। যায়হোক, এতো জরুরি তলবের কারণ কি? এনিথিং সিরিয়াস নম্র?’

নম্রতা অনেকটা ফিসফিসিয়েই বলল,

‘ আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি নিষাদ সাহেব। সেই উত্তরগুলো আপনার থেকেই এক্সপেক্ট করছি। আপনি কি আমায় সাহায্য করবেন?’

নম্রতার কথায় বেশ অবাক হলো নিষাদ। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ প্রশ্ন? কেমন প্রশ্ন নম্র? তোমার কথাগুলো ঠিক ধরতে পারছি না। একটু খুলে বলবে, প্লিজ?’

নম্রতা এবার সরাসরি প্রশ্ন করল,

‘ শাহাবাগ গ্রন্থগার থেকে বেশ কিছুদিন আগে একটা বই ধার এনেছিলেন আপনি। দর্শনের বই। সেই বইটা সম্পর্কে জানতে চাইছি।’

নিষাদের পুরু ভ্রু আরও খানিকটা কুঁচকে গেল। অবাক হয়ে বলল,

‘ মানে? কোন বইয়ের কথা বলছ তুমি? আমি ক্যামেস্ট্রি টিচার। দর্শনের বই কেন আনতে যাব হঠাৎ? তাছাড়া ফিলোসোফির প্রতি খুব একটা আকর্ষণও আমার নেই।’

‘ আপনি বলতে চাইছেন বইটা আপনি আনেননি?’

‘ না। আনিনি। কিন্তু একটা বই নিয়ে এতো জিগ্যেসাবাদের কারণ কী? তোমাকে অস্থিরও দেখাচ্ছে। বইটার কি কোনো বিশেষত্ব আছে? যদি থেকেও থাকে সেই বিশেষত্বটাই বা কী?’

নম্রতা উত্তর না দিয়ে বলল,

‘ লাইব্রেরির রেজিস্ট্রার খাতা তো অন্য কথা বলছে নিষাদ সাহেব। ওখানে স্পষ্ট লেখা আছে কিছুদিন আগে আপনার কার্ড দিয়েই বইটা ধার নেওয়া হয়েছিল। বইটা কালই আবার লাইব্রেরিতে ইস্যু করা হয়েছে। আপনি যদি ঢাকার বাইরে থেকে থাকেন তাহলে আপনার হয়ে বই দেওয়া-নেওয়া করছেটা কে? হু ইজ দিস পার্সোন?’

নিষাদ থমকাল। কপালে গভীর ভাঁজ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ নীরব বসে রইল। ভ্রু কুঁচকে নম্রতাকে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বলল,

‘ সেই বইয়ের সাথে তোমার কি কানেকশন নম্র? সামান্য একটা বইয়ের জন্য এতো উতলা হচ্ছ কেন?’

নম্রতা উত্তর না দিয়ে বলল,

‘ বইগুলো দেওয়া-নেওয়া কে করছিল নিষাদ সাহেব?’

নিষাদ ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমি লাইব্রেরিতে লাস্ট গিয়েছিলাম এক-দুই সপ্তাহ আগে। যেদিন রাজশাহী যাওয়ার কথা ছিল সেদিন বিকেলে। সেখানে গিয়ে হঠাৎই আমার বন্ধুর সাথে দেখা। ওর কিছু বইয়ের প্রয়োজন ছিল। এদিকে আমার তাড়া, বাবা-মাকে নিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। তাই কার্ডটা বন্ধুকে দিয়ে। লাইব্রেরিয়ানের সাথে কথা বলে আগেই রেজিস্ট্রিতে সাইন করে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমার বন্ধু কোন দুটো বই নিয়েছে জানি না। সেই বইয়ে তোমার বলা বইটা আছে কি-না সেটাও জানি না।’

শ্বাস আটকে রেখে প্রশ্ন ছুঁড়ল নম্রতা,

‘ আপনার বন্ধু? আপনার বন্ধু কেন নিয়েছিল বইটা?’

নিষাদ হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ সেটা তো জানি না।’

নম্রতা বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। মাথাটা কেমন ধপধপ করছে তার। ঘাড়ের কাছটা ঝিমঝিম করছে। নম্রতা একহাতে কপাল চেপে ধরে চুপ করে রইল। নম্রতার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল নিষাদ,

‘ তুমি ঠিক আছো?’

নম্রতা ছোট্ট করে শ্বাস টেনে নিয়ে মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থেকে মাথা তুলে নিষাদের দিকে তাকাল। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ আপনি বলতে চাইছেন, বইটার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই?’

‘ আমি প্রথম থেকে এমনটাই বলছি নম্র।’

‘ তাহলে আপনি আমাকে জানেন কিভাবে? আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয় আপনি আমার পূর্ব-পরিচিত। কিন্তু কিভাবে?’

নম্রতার এমন কথায় যেন বেশ ধাক্কা খেল নিষাদ। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,

‘ তুমি আমাকে এখনও চিনতে পারোনি? এজন্যই এতোক্ষণ ‘নিষাদ সাহেব’ ‘নিষাদ সাহেব’ বলে সম্বোধন করছিলে। তোমার মুখে এমন সম্বোধন শুনে খুব অস্বস্তিবোধ করছিলাম। অবাকও হচ্ছিলাম।’

এবার নম্রতার অবাক হওয়ার পালা। বড় বড় চোখদুটোতে খেলে গেল বিস্ময়ের তারা। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘ আমার কি আপনাকে অন্যকিছু বলে সম্বোধন করার কথা?’

নিষাদ বেশ হতাশ হলো। নম্রতার দিকে খানিক চেয়ে থেকে বলল,

‘ তোমার নাজু খালাকে ভুলে গিয়েছ নম্রতা?’

নম্রতা এলোমেলো মস্তিষ্ক নিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করল। বেশ কিছুক্ষণ বাদে চোখ বড় বড় করে নিষাদের দিকে তাকাল।

‘ নাজু খালাকে আপনি কি করে চিনেন নিষাদ সাহেব?’

নিষাদ দূর্বোধ্য হাসল। নম্রতা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ নিশুদা? আপনি নিশুদা? নাজু খালার ছেলে নিশুদা?’

নিষাদ তৃপ্তির হাসি হেসে বলল,

‘ এতোক্ষণে চিনলে তবে? আমি তো প্রথম দিনই চিনে ফেলেছিলাম।’

নম্রতার বিস্ময় এখনও কাটেনি। সে হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে বলল,

‘ প্রায় চৌদ্দ/পনেরো বছর পর দেখা। কিভাবে চিনলেন?’

নিষাদ হাসল। মুখ টিপে হেসে বলল,

‘ দুই-তিন বছর পর আগে আম্মুর পরিচিত এক ঘটক তোমার ছবি দেখায়। আমরা তখনও জানতাম না যে তুমিই সেই ছোট্ট নমু। যথারীতি তোমার বাড়িতেও আলাপ হচ্ছিল এবং এই আলাপচারিতার মধ্যেই হঠাৎ জানতে পারলাম তোমরা আমাদের পূর্ব-আত্মীয়। তোমার পরিচয় জানার পর আম্মু তোমাকে বউ বানাতেই উঠে পড়ে লাগলেন। হাজার হলেও পুরাতন বান্ধবীর মেয়ে, ব্যাপারটাই আলাদা। তোমার পরিবারও বেশ এগিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন খবর এলো তুমি মানা করে দিয়েছ। বিয়ে-শাদি নাকি করবে না। বেশি চাপাচাপি করলে বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাবে। আম্মু প্রায় এক বছর অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তোমাকে এখনও রাজি করানো যায়নি শুনে সব আশা ত্যাগ করে নতুন উদযোগে পাত্রী খুঁজতে লেগে পড়েছেন। তোমাকে প্রথম ছবিতেই দেখেছিলাম। তারপর হঠাৎ কক্সবাজারে। প্রথমে চিনতে পারিনি। কিন্তু নাম বলার পর চিনে গিয়েছি।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল নিষাদ। নম্রতা অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,

‘ মাই গড! এতোকিছু ঘটে গিয়েছে?’

নিষাদ হেসে বলল,

‘ হ্যাঁ। ঘটে গিয়েছে। কেন, তুমি জানতে না? আমি তো ভেবেছিলাম সবই তোমার জানা। তাই তোমার ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই বিষয়েই কিছু বলবে। কিন্তু এখানে এসে তো দেখি কাহিনি ভিন্ন। তোমার কাহিনিটা কী বল তো? আমি কনফিউজড।’

নম্রতা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,

‘ সে অনেক লম্বা কাহিনি। অন্য কোনোদিন বলব। আচ্ছা? আপনার যে বন্ধুটা লাইব্রেরি কার্ডটা ইউজ করেছিল তার নামের প্রথম অক্ষর কী ‘ন’? ‘

নিষাদ কপাল কুঁচকে বলল,

‘ না তো।’

নম্রতার আশাভঙ্গ হলো। দুর্বল কন্ঠে বলল,

‘ উনি কি করেন? ভার্সিটি টিচার টাইপ কিছু?’

নিষাদ নম্রতার অসহায় মুখটির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,

‘ হ্যাঁ। টিচার বলা যেতেই পারে। আর আমার যতটুকু ধারণা তুমিও তাকে চিনো।’

নম্রতা আঁৎকে উঠে বলল,

‘ আমি চিনি?’

‘ হ্যাঁ। আরফানকে মনে আছে? কক্সবাজারে যার সাথে ঝামেলা হলো তোমার।’

নম্রতার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল। গলার কাছে আটকে আসতে লাগল নিঃশ্বাস। আরফান? আরফান নিয়েছিল বইটা? কিন্তু কেন? নম্রতার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। চোখের সামনে নেমে এলো রাজ্যের অন্ধকার। কানের কাছে ভেসে এলো আতঙ্কিত কন্ঠস্বর,

‘ নম্র? এই নম্র? আর ইউ ওকে? নম্র?’

নম্রতা চোখ খোলার বৃথা চেষ্টা করে অনেকটা ফিসফিসিয়েই বলল,

‘ ডক্টর আরফানের বোনের নাম কী নিদ্রা?’

ভার্সিটি থেকে ফিরে এসেই লম্বা ঘুম দিয়েছিল নীরা। প্রচন্ড মন খারাপের দিনগুলো ঘুমিয়েই পাড় করে দেয় সে। খালি পেটে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে থাকলে কেমন মাতাল মাতাল ভাব চলে আসে শরীরে। শিরায় শিরায় তৈরি হয় অদ্ভুত ঝিমঝিমানি। নীরার ধারণা, ধমনীর এই ঝিমঝিমভাব তার মন খারাপগুলোকে ভুলিয়ে রাখে। তখন শারিরীক কষ্টগুলো মানসিক কষ্টগুলোকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। দিতে চায় না। এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন হুট করেই বাবা মারা গেলেন। সেদিনই এই মাতাল মাতাল থিওরিটা ধরতে পেরেছিল নীরা। শরীরকে কষ্ট দিলে যে মনকে ভুলিয়ে রাখা যায় সেই শিক্ষাটা সেসব দুঃখী দিনগুলো থেকেই পাওয়া। নীরা টালমাটাল পায়ে ওয়াশরুমে গেল। ঘন্টাময় শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে লাগল তার সংগ্রামী জীবনের কন্টকাপূর্ণ পথটার কথা। এই নীরার নীরা হয়ে উঠার গল্পটা কী আদৌ খুব সহজ ছিল?

#চলবে…

( ভেবেছি ছোট হোক, বড় হোক প্রতিদিন একটা করে পার্ট দেব। তাই ছোট হয়েছে জেনেও দিলাম। রি – চেইকও করতে পারিনি। ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here