নীল চিরকুট পাঠ-১৫

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১৫.

মনের সব ঝাঁঝ ইনবক্সে মিটিয়ে দিয়ে অসভ্য লোকটাকে ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দিল নম্রতা। আহ্ শান্তি। কিন্তু সেই শান্তি বেশিক্ষণ টিকল না। কিছুক্ষণ পরই নম্রতার মনে হলো, এবার বড্ড হ্যাংলোপনা করে ফেলেছে সে। এই বয়সে এসে এমন ইমম্যাচিয়ুরদের মতো কাজ কী তাকে শোভা পায়? এমন বাচ্চামো প্রতিশোধের কি কোনো মানে হয়? ওই আত্ম অহংকারী লোকটা কী ভাববে? নম্রতাকে নিশ্চয় প্রচন্ড গেঁয়ো আর ন্যাকা ভাববে? নম্রতার হঠাৎ-ই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। কেউ তাকে ফালতু আর বিরক্তিকর ভাবছে ভাবতেই মনটা তেঁতিয়ে গেল। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে আরফানকে আনব্লক করল নম্রতা। কিছুক্ষণ ফোন নিয়ে অযথাই ঘাটাঘাটি করল। মনের কোথাও একটা আপেক্ষা তাড়া দিচ্ছে তার। যদি লোকটি ম্যাসেজের উত্তর দেয়! যদি কিছু বলে! এই ভাবনাতেই কেটে গেল সুপ্ত অপেক্ষার প্রহর। কিন্তু ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও ওপাশ থেকে কোনোরূপ উত্তর এলো না। ওই অসভ্য লোকটি প্রতিটা ম্যাসেজ সীন করার পরও কোনোরূপ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল না। নম্রতার আত্মসম্মানবোধটা যেন এবার খন্ড বিখন্ড হয়ে গেল। লোকটা কী তবে নম্রতাকে ম্যাসেজের উত্তর দেওয়ার মতো অতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করল না? নম্রতার শরীর-মন অপমানে টনটন করে উঠল। এই লোকটা ভারী হিসেবী ধরনের। কোথায় কোন কাজ করলে অপর পাশের মানুষকে শতাধিক অপমান করা যাবে, অপদস্ত করা যাবে তা যেন এই লোকের অস্থিমজ্জায় জানা। এই যে, এই মুহূর্তে লোকটি যদি কোনো উত্তর দিত। নম্রতার সাথে কথা কাটাকাটির চেষ্টা করত, পাল্টা অপদস্তের চেষ্টা করত তাহলেই তো অপরাধবোধ, অপমানবোধটা কমে যেত নম্রতার। কিন্তু ওই অসভ্য লোকটি সে সুযোগ দিল না। একদম নীরব থেকে নম্রতার জাগ্রত আত্মসম্মানবোধে তীব্রভাবে আঘাত করে গেল, নম্রতা টেরও পেল না। আচ্ছা? নীরবতার মতো ভয়ানক ছুঁড়ি কী আদৌ কিছু হয়? নম্রতার সতর্ক মস্তিষ্ক উত্তর দিল, না হয় না। এই পৃথিবীতে নীরবতার মতো ভয়ানক ছুঁড়ি আর কিছু হয় না। হতে পারে না। নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বেয়াদব মনটা আফসোসের শিষ তুলে বলল, কি দরকার ছিল যেচে পড়ে নক দিয়ে লোকটিকে এত কথা শোনানোর? শখ করে নিজেকে উপহাসের পাত্র বানানোর? তুমি সবসময়ই এমন উৎপটাং কান্ড কেন কর নম্রতা? তোমার কি আত্মসম্মানবোধ নেই? তুমি কি ব্যক্তিত্বহীন সস্তা মানবী? নম্রতার বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। চারপাশের সবকিছু বিষাক্ত হয়ে উঠতে লাগল। আত্মগ্লানি আর অপমানবোধে তেঁতো হয়ে উঠল মুখ। তার এই মন খারাপ ভাবটা রাতের গভীরতার সাথে সাথে কষ্ট হয়ে নেমে এলো চোখে। জীবনের সব না-পাওয়াগুলো, হারিয়ে ফেলার স্মৃতিগুলো বেয়াদব মনটাকে কাঁদিয়েই ছাঁড়ল। সেই স্বার্থপর হারিয়ে যাওয়া ‘সে’ কে ভেবে রাত-ভোর করে কাঁদল নম্রতা। পূর্ব আকাশে যখন আলো ফুটলো। লালাভ লজ্জায় রাঙা হলো বিশাল আকাশ। ঠিক তখনই দু’দন্ডের ঘুম নেমে এলো নম্রতার চোখে। জ্বালাপোড়াময়, ফোলা চোখদুটো নিয়ে ঘন্টাখানিকের জন্য চোখ বোজল নম্রতা। ঘুমের মাঝেও নম্রতা দেখতে পেল পুরাতন সেই বই। হাজার হাজার নীল চিরকুট আর তার মাঝে নীল পাঞ্জাবি গায়ে সুদর্শন এক পুরুষ। নম্রতা ধরফরিয়ে উঠে বসল। গলা, বুক ঘেমে চিপচিপে হয়ে আছে । নম্রতা ডানহাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট আর নাকের ঘাম মুছল।

‘ কখন থেকে ডাকছি তোকে। ক্লাস টাইম হয়ে গিয়েছে। রেডি হবি না? সাড়ে নয়টায় ক্লাস, জলদি ওঠ।’

নম্রতা ফাঁকা মস্তিষ্কে নীরার দিকে তাকাল। নীরা চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। গায়ে তার কাঁচা হলুদ রঙের জামা। ফর্সা গায়ে সুন্দর দেখাচ্ছে কাঁচা হলুদ রং। নম্রতা বোবা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। ওই পুরুষটা! ওই নীল পাঞ্জাবি পরনে পুরুষটার চেহারা মনে পড়ছে না তার। অথচ স্বপ্নে কত পরিচিত লাগছিল তাকে। মনে হচ্ছিল কত আপন, কত ভালোবাসাময় সেই মুখ, সেই ঠোঁট আর সেই নীল রঙা পাঞ্জাবি। নীরা আবারও তাড়া দিতেই অলস ভঙ্গিতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল নম্রতা। কালো প্লাজুর সাথে পরা ঢলঢলে টি-শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করতে করতেই সিদ্ধান্ত নিল, আজ আবারও গ্রন্থাগারে যাবে সে। সেই বইটাকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকবে অনেকক্ষণ। মলাটের নিচের গন্ধ শুঁকবে। এতোগুলো বছরের আদান-প্রদানেও সেখানে কী ‘সে’ এর নিজস্ব মিষ্টি গন্ধটা জমা হয়নি? একটুও না?

নম্রতা ওয়াশরুমে যাওয়ার পর পরই ভার্সিটির বই গুছাতে মন দিল নীরা। ক্লাস অনুযায়ী বইগুলো নাড়াচাড়া করতেই একটা বই থেকে টুপ করে নিচে পড়ে গেল একটি চিরকুট। নীরা ভ্রু কুঁচকে চিরকুটটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভারি বিস্ময় নিয়ে তুলে নিল ছোট্ট সেই কাগজের টুকরো।
কাগজটা মেলে ধরতেই টানা টানা চির পরিচিত অক্ষরগুলো ভেসে উঠল চোখের সামনে। মাত্র দুটো লাইনের সেই লেখাতেই নীরার বিক্ষিপ্ত, অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে গেল। নীরা টলমলে অনুভূতি নিয়ে সেই লাইন দুটো আবারও পড়ল,

‘ জীবনে আর কখনও ভালোবাসতে বলব না তোকে। তবু কাঁদিস না প্লিজ। আমাকে ভালো না বাসলেও সহ্য করতে পারব। চোখের সামনে অন্য কাউকে ভালোবাসবি সেটাও সহ্য করে নিব। কিন্তু তোর কান্নাটা সহ্য হবে না। এই নীরুপাখি? কাঁদিস না,প্লিজ।’

চিরকুটটা হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়ল নীরা। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউয়ের সাথে উথলে উঠল কান্না। এই ছেলেটা কেন এতো ভালোবাসে তাকে? তার মতো স্বপ্নহীন মেয়েটিকেই কোনো ভালোবাসতে হলো তার? আর কেন-ই বা এমন অদ্ভুত মিষ্টি তার প্রকাশ ভঙ্গি? নীরার মতো পোড়াকপালি মেয়ের জন্য অতো ভালোবাসাও জমা থাকে বুঝি? সেই পাগল প্রেমিক কী জানে না পোড়াকপালিদের ঠিক ভালোবাসতে নেই। ভালোবাসার অধিকার নেই। নীরার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। চোখ থেকে নেমে আসে নোনা স্রোতের ধারা।

তেজস্বী সূর্য অনেকটাই মিইয়ে এসেছে। ত্যক্ত গরমটা সয়ে এসেছে শরীরে। নম্রতার নীল রঙা কামিজটা ঘামে ল্যাপ্টে আছে গায়ে। চোখের নিচে অসাবধান আদরের মতোই ল্যাপ্টে আছে কাজল কালী। হাত-পা মৃদু কাঁপছে। নিঃশ্বাস ভারী। নম্রতা ছোট ছোট পা ফেলে গ্রন্থাগারের দু-তলায় উঠল। আজ একাই এসেছে সে। আজ তার একা থাকারই পালা। না, একা তো নয়। সে এবং তার সুপ্ত, গভীর অনুভূতিগুলোর খুব একান্তে সময় কাটানোর পালা। নম্রতা ঢোক গিলে দর্শনের সেল্ফের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু একি! দর্শনের বইটা এখানে নেই। নম্রতার পরিচিত পৃথিবীটা এবার দুলতে লাগল। মাথা ঘুরছে। চিন্তা গুলিয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেল সেই বই? সারা সেল্ফ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না সেই বই। শেষ পর্যন্ত এই শেষ চিন্হটাও কী তবে হাতছাড়া হলো তার? নম্রতা কোণার এক চেয়ারে বসে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁপাতে লাগল। বুকে চাপ লাগছে। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। আচ্ছা? নম্রতা কী মারা যাচ্ছে? ওই নিষ্ঠুর লোকটিকে না দেখেই কী মরে যেতে হবে তাকে? নম্রতা টেবিলে মাথা এলিয়ে ঘন্টাময় বসে রইল। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর গ্রন্থগারের কর্মচারীদের জিজ্ঞেসাবাদ করে জানল গ্রন্থগারেরই কোনো এক পাঠক একদিন আগে বইটি বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। এখনও ফিরিয়ে দিয়ে যায়নি। নম্রতার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এতো বছর পর হঠাৎ কার প্রয়োজন পড়ল এই বই? নম্রতা উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘ যে লোকটি বই নিয়েছেন তার নাম কি? চেইক করে বলুন প্লিজ। আমার খুব প্রয়োজন।’

লোকটি খুব একটা ঝামেলা করল না। নম্রতার দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে রেজিস্ট্রার খাতা ঘাটতে লাগল। বেশ কয়েক মিনিট ঘাটাঘাটির পর গম্ভীর মুখে বলল,

‘ নিষাদ আহমেদ নীরব। গত পরশো বিকালের দিকে নিয়ে গিয়েছেন বইটা।’

নামটা শুনেই বিদ্যুৎ শক লাগার মতো চমকে উঠল নম্রতা। নিষাদ? নিষাদ নিয়ে গিয়েছে সেই বই? কিন্তু কেন? তবে কি নম্রতারা যা ভাবছে তাই? নিষাদই সেই নিষ্ঠুর পুরুষ? নাকি ব্যাপারটা পুরোপুরি কাকতালীয়? এমন কাকতালীয় ঘটনাও কি ঘটতে পারে? এতো বছর পর কাকতালীয়ভাবে সেই বইটিই কেন নিতে হবে নিষাদকে? নম্রতার ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। নম্রতা শুকনো গলায় কোনরকম ফ্যাচফ্যাচ করে বলল,

‘ উনার নাম্বারটা একটু দেওয়া যাবে? উনাকে ভীষণ দরকার আমার।’

লোকটি নম্রতার অনুরোধকে সম্পূর্ণ নাকচ করে বলল,

‘ সম্ভব নয়। নাম্বার দেওয়ার নিয়মে নেই।’

নম্রতা হাজার অনুরোধ করেও লোকটি থেকে নাম্বার উদ্ধার করতে পারল না। ধীর, দুর্বল পায়ে গ্রন্থগার থেকে বেরিয়ে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল সিঁড়ির গোড়ায়। না, আর হাঁটতে পারছে না সে। এই শরীরের ভার বহনের শক্তি আর হচ্ছে না। নিষাদের দেখা সে কিভাবে পাবে এখন? ডাক্তার আরফানকে জিগ্যেস করে দেখবে? এতোকিছুর পরও কি ওই ডাক্তার তার কথা শুনবে? সাহায্য করবে? নম্রতা সিঁড়ির রেলিং-এ ঠেস দিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। ডায়ালে প্রথমেই নাদিমের নাম্বার থাকায় তাকেই ফোন করল প্রথম। দু-বারের চেষ্টায় ফোনে পাওয়া গেল তাকে। ফোন ধরেই ওপাশ থেকে বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ টিউশনি করাইতাছি বাল। বেহুদা ফোন দিয়া ডিস্টার্ব করতাছস কেন?’

নম্রতা দুর্বল শরীরে জোরে জোরে শ্বাস নিল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

‘ সরি দোস্ত। তুই একটু রঞ্জন, অন্তু, নীরা কাউকে ফোন দিয়ে শাহবাগ গ্রন্থগারে আসতে বলবি? জলদি।’

এটুকু বলতেই কান্নায় গলা ভিজে গেল নম্রতার। নাদিম চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ রঞ্জন তো পুরাতন ঢাকায় গেছে। অন্তু কই আছে জানি না। কিন্তু হইছেটা কি? কই তুই? ঠিক আছিস?’

‘ আমি শাহবাগে। গ্রন্থগারের সিঁড়িতে বসে আছি। আমাকে নিয়ে যেতে বল। হাঁটতে পারছি না।’

নাদিম আর কোনো প্রশ্ন করল না। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

‘ তুই থাক আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতেছি।’

‘ তোর টিউশনি?’

‘ রাখ তোর টিউশন। আমি আইতাছি। চিন্তা করিস না। অন্তুকেও কল করি। শালায় আছেটা কই?’

নিজের মনে কথা বলতে বলতেই ফোন কেটে দিল নাদিম। নম্রতা সেখানে বসেই চোখ বন্ধ করল। এই চোখ খোলে রাখাটাও শরীরের আর কুলচ্ছে না।

#চলবে…..

( রি-চেইক করিনি। কাল দিতে পারিনি। আজও সময় পাইনি। তাই দ্রুত লিখেছি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here