নীল চিরকুট পাঠ-৩৫

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৩৫.

রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীন হেঁটে চলেছে নাদিম। দুপুরের তীব্র গরমে ভিজে উঠেছে শার্ট। আজকাল ভার্সিটি চত্তরটা বড় পানসে লাগে তার। কোনো কিছুতেই স্বস্তি নেই। এই পরিচিত শহরটাতে আজকাল খুব দমবন্ধ ভাব। বিষাক্ত আলো-বাতাসে নাদিম বড় বিরক্ত। মাঝেমাঝেই এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার। হারাবেও একদিন। কিন্তু সেই একদিনটা কবে জানা নেই নাদিমের। নাদিম রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। রাস্তায় চা ফেরি করে বেড়ানো ছেলেটাকে ডেকে এক কাপ চা খায়। কপাল কুঁচকে ঝলমলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই জ্বলাপোড়া করে উঠে চোখ। তবুও চোখ ফেরায় না নাদিম। জ্বালাপোড়া অনুভূতি গাঁয়ে লাগে না তার। নাদিম জানে তার অনুভূতি নেই। ভেতরের মনটা আস্ত পাথর। আজ হঠাৎ সেই পাথরে ফাটল খুঁজে পায় নাদিম। খেয়াল করে, এই পৃথিবীতে তার নিজের কেউ নেই। বন্ধুরা ছিল। এখন নেই। ‘নেই’ শব্দটা মনে পড়তেই বুক জ্বালা করে নাদিমের। সব ঠিক করে আবারও আড্ডায় বসতে ইচ্ছে করে। অন্তু, রঞ্জনের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বড্ড অস্বস্তি হয়। বুকের ভেতর থেতিয়ে থাকা ইগোটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বলে, ‘ তোমার কী অভিমান নেই? আত্মসম্মান নেই?’

নাদিম অবাক হয়, ‘ আত্মসম্মান? বন্ধুদের সামনে আবার আত্মসম্মান কিসের? ওরা তো আমার নিজের।’

ভেতর থেকে উত্তর আসে, ‘ সত্যিই ওরা নিজের?’

‘ কেন? নয়?’

‘ কখনো নয়। হলে কী সে তোমায় ওভাবে অপমান করতে পারে?’

নিজের ভেতরকার পুরুষটির সাথে শান্ত বাক্য বিনিময় করতে করতেই এগিয়ে যায় নাদিম,

‘ আমিই কী আগে শুরু করিনি? কি দরকার ছিল আগ বাড়িয়ে কথা বলার? ও যে রেগে ছিল!’

‘ ছিঃ নাদিম! এ তোমার কেমন অধঃপতন? ভীষণ সাহেবী হয়ে যাচ্ছ আজকাল। বন্ধুরা যদি তোমার নিজেরই হয় তবে বন্ধুত্বের স্বার্থে করা তোমার কাজটা কী খুব অন্যায় ছিল? এতো বাছ-বিচার করেই যদি কথা বলতে হয় তাহলে বন্ধু আর রাস্তার মানুষের মাঝে পার্থক্য কী?’

নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অসহায়ভাবে বলল,

‘ রেগে থাকলে কী কারো হুশ থাকে? কখন কী বলে ফেলে! আমি কী বলি না?’

‘ না। বলো না। আর যায় হোক বন্ধুর গোপন কষ্টগুলো দিনের আলোয় গলা চিরিয়ে প্রকাশ করো না। এ কী কোনো বন্ধুর মতো কাজ হলো? যে ব্যক্তি বন্ধুর গোপনীয়তা ঢাকতে জানে না সে কখনও বন্ধু হতে পারে না।’

‘ আমার কী আদৌ গোপন কিছু আছে?’

‘ অবশ্যই আছে। আলবাত আছে।’

‘ থাকলে থাকুক। ও না হোক, আমি তো ওর বন্ধু।’

‘ একে বন্ধুত্ব বলে না। তুমি বোকা। তুমি মেরুদণ্ডহীন বলেই তোমার আত্মসম্মান জন্মায় না।’

কথোপকথন বিশেষ এগুলো না। তার আগেই বিশাল সাদা এক মার্সিডিস গাড়ি পথ এলিয়ে দাঁড়াল। নাদিম চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল। ভ্রু জোড়া বাঁকিয়ে সচেতন দৃষ্টি ফেলল বিলাসবহুল গাড়িটির ওপর। গাড়ি থেকে সাদা ঝকঝকে পোশাক গায়ে নেমে এলো একজন ড্রাইভার।

‘ আপনারে স্যার ডাকতেছে।’

নাদিমের ভ্রু জোড়া আরও একটু কুঁচকে এলো,

‘ তোমার স্যারকে কী আমি চিনি?’

ড্রাইভার জবাব দেওয়ার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিল একটি মুখ, ইয়ামেত সাহেব। নাদিম অবাক হলো। ইয়ামেত সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ গাড়িতে উঠো। কথা আছে।’

নাদিম কয়েক সেকেন্ড দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে গাড়িতে গিয়ে উঠল। এই দামী বন্ধী গাড়িতে ইয়ামেত সাহেবের পাশে বসে তেমন অস্বস্তি না হলেও খুব একটা ভালোও লাগছে না নাদিমের। মাথার ভেতরে বিরক্তটা তরতর করে বাড়ছে। ইয়ামেত সাহেব বেশ রয়ে সয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘ কেমন আছ?’

‘ বেশ ভালো। আপনি?’

ইয়ামেত সাহেব জবাব না দিয়ে মাথা নাড়লেন। মুখের উপর একটি ইংরেজি জার্নাল ধরে বসে রইলেন। নাদিমের মেজাজটা অকারণেই খারাপ হয়ে গেল। এই বয়স্ক জাজকে কিছু নিকৃষ্টতম গালি দিতে পারলে শান্তি পাওয়া যেত। সব শালারই এক ঢং! ইয়ামেত সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

‘ তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করো?’

‘ খুব বোকা মনে করি না।’

ইমায়েত সাহেব জার্নালটা পাশে নামিয়ে রেখে নাদিমের দিকে তাকালেন। নাদিম আগের মতোই নিঃসংকোচ ভঙ্গিতে বসে আছে। ইমায়েত সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ আমি তোমার সাথে কী বিষয়ে কথা বলতে চাইছি, তা কী তুমি বুঝতে পারছ?’

নাদিম মাথা নেড়ে বলল,

‘ আংশিক পারছি। তবে, পুরোপুরি ধরতে পারছি না।’

‘ রিসেন্টলি মৌশির মাঝে কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তুমি লক্ষ্য করেছ?’

‘ জি না।’

ইমায়েত সাহেব চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

‘ মৌশি আজকাল রান্নাবান্না শেখায় মনোযোগী হয়েছে।’

‘ এই বয়সে মেয়েরা রান্নাবান্না শেখে। অস্বাভাবিক কিছু তো দেখছি না।’

ইমায়েত সাহেব শক্ত চোখে তাকালেন।

‘ অবশ্যই অস্বাভাবিক। মৌশি সব ধরনের রান্না শিখতে আগ্রহী হলে তা হয়তো অস্বাভাবিক কিছু হতো না। কিন্তু তা তো ঘটছে না। মৌশির রান্নার তালিকায় শুধু সেই সব খাবারই দেখা যাচ্ছে যেগুলো তুমি পছন্দ করো।’

নাদিম ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট গোল করে বলল,

‘ ওহ!’

‘ মৌশির ড্রয়ারে আজকাল সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। বারান্দায় মাঝে মাঝেই ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ইট’স আ বিগ চেঞ্জ ফর হার। মৌশি সিগারেট ভীষণ অপছন্দ করত।’

নাদিম কিছু বলল না। মৌশি সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে বসে থাকছে এই খবর শোনার পর কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না।

‘ তুমি কী বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?’

‘ জি। বুঝতে পারছি।’

অনেকটা প্রাণহীন কন্ঠে উত্তর দিল নাদিম। ইমায়েত সাহেব আবারও চুপ হয়ে গেলেন। উদাস দৃষ্টিতে জানালার বাইরে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। সেদিক দৃষ্টি রেখেই বললেন,

‘ মৌশির বইয়ের মাঝে, ড্রয়ারে তোমার অসংখ্য ছবি পাওয়া গিয়েছে। ছবিগুলো খুব সাবধানে, লুকিয়ে তোলা হয়েছে। আমার ধারণা, মৌশি তোমাকে প্রায়ই ফলো করে। ব্যাপারটা কী সত্য?’

নাদিম ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ এই ব্যাপারে মৌশিই বোধহয় ভালো তথ্য দিতে পারবে। আপনার ওর সাথে সরাসরি কথা বলা উচিত।’

ইমায়েত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘ মৌশির সাথে আমার কথা হয়েছে। শী ওয়ান্টস টু বি উইদ ইউ। তোমার সঙ্গ ওর ভালো লাগে।’

নাদিম কিছু বলল না। অবাকও হলো না। খবরটা নতুন নয়। মৌশি যে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তা সে তিন-চার মাস আগে থেকেই জানে। ইমায়েত সাহেব স্বগোতক্তির মতো বিরবির করে বললেন,

‘ শী ইজ গোয়িং ক্রেজি। আমার মনে হয়, ও রাতে ঘুমায় না।’

নাদিম আগের মতোই নিশ্চুপ বসে রইলো। ইমায়েত সাহেব হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে বললেন,

‘ ডু ইউ লাইক মৌশি?’

‘ এজ আ হিউম্যান বিয়িং আই লাইক হার। বাট নট লাইক আ ওমেন।’

ইয়ামেত সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন।

‘ পার্সোনালি আমি তোমাকে পছন্দ করি না। তোমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যতটুকু জেনেছি তাতে ভালো রেজাল্ট ব্যতীত পছন্দ করার মতো দ্বিতীয় কিছু তোমার আছে বলেও মনে হয়নি। ইউ আর আ ইউসলেস ফেলো অলওয়েজ। স্টিল ইউ হ্যাভ আ এট্রাকশন। দূর্ভাগ্যবশত মৌশির সাথে তোমার ইনভলভ হওয়াটা আমায় বাধ্য হয়েই চাইতে হচ্ছে। আই ক্যান চেঞ্জ ইউর লাইফ ওভারনাইট।’

নাদিম হাসল। খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটা দাঁতে দাঁত চেপে সামলে নিয়ে বলল,

‘ আমিও আপনাকে পছন্দ করি না। ফ্রাঙ্কলি স্পিকিং, বিশাল অঙ্কের মালিকানা ছাড়া পছন্দ করার মতো কিছু খুঁজেও পাইনি। দূর্ভাগ্যবশত টাকা কখনোই আমার কাছে পছন্দনীয় বিষয় নয়। তাই লাইফ চেঞ্জ করে নেওয়ার এমন দূর্দান্ত সুযোগটা নিতে পারছি না বলে দুঃখ হলো। ড্রাইভার সাহেব? ডানপাশের রাস্তাটায় গাড়ি থামান। আমার যাত্রা এখানেই শেষ।’

ইমায়েত সাহেব বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। অপমানটা সচল মস্তিষ্ক টের পেলেও বিস্ময়ভাবটা কাটল না। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থেকে খুঁজতে লাগলেন অচেনা কোনো বিশেষত্ব। কী আছে এই ছেলের মাঝে? কিসের বলে এমন অকপট, নাকউঁচু আত্মবিশ্বাসে কথা বলে এই ছেলে? বিন্দুমাত্র মাথা নোয়ায় না।

খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে নম্রতা। খাবার মুখে নেওয়ার কোনোরূপ লক্ষ্মণও দেখা যাচ্ছে না। আরফান খেতে খেতেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ কি ব্যাপার?’

নম্রতা মুখ মেরে উত্তর দিল,

‘ কোনো ব্যাপার না।’

‘ তাহলে খাচ্ছেন না কেন?’

নম্রতা এবার চোখ তুলে তাকাল। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ পুরো ব্যাপারটা না শুনলে খাবার টাবার গলা দিয়ে নামবে না আমার। আপনি প্লিজ তাড়াতাড়ি খান। খাওয়া শেষ করে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন। দ্রুত করুন।’

আরফান এক গাল হেসে বলল,

‘ আপনি এত অধৈর্য্য কেন বলুন তো? একটুও পেশেন্স নেই। আগেও অবশ্য ছিল না।’

নম্রতা কাটা চামিচটা তুলে নিয়ে আরফানের দিকে তাক করে বলল,

‘ আপনি কথা না বলে তাড়াতাড়ি খাবেন?’

নম্রতার অস্থিরতা দেখে হাসে আরফান। এক চুমুক পানি খেয়ে নিয়ে বলল,

‘ আপনি খাওয়া শুরু করুন। আমি খেতে খেতেই বলছি।’

নম্রতা নড়েচড়ে বসল। উৎসাহী চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আচ্ছা বলুন।’

আরফান ভ্রু’কুটি করে বলল,

‘ উহু। না খেলে বলব না।’

বাধ্য হয়েই খাবারে হাত দেয় নম্রতা। দুই তিন গ্রাস মুখে তুলে নিয়ে বলে,

‘ এবার তো বলুন।’

আরফান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। দাঁড়ান আমি একটু গুছিয়ে নিই।’

নম্রতা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জোড়াল শ্বাস ফেলল আরফান।

‘ আমি ছোট থেকেই খুব পড়াকু ছিলাম। আর ভাইয়া ছিল ডানপিটে, চঞ্চল। ভাইয়া তত পড়াকু না হলেও তার বিজনেস আইডিয়া ছিল অসাধারণ। আমার আর নিদ্রার ছোট থেকে ছোট বিষয়ও খুব গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল রাখতো ভাইয়া। ভাইয়ার দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ, সজাগ। গাছ থেকে একটা পাতা খসে পড়লেও নজর এড়াত না তার। নজর এড়ানোর উপায়ও ছিল না হয়তো। আমার আর আপনার চিঠি প্রেমের ব্যাপারটা ভাইয়াই ধরে ফেলেছিল প্রথম। আমার বাবা সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। পারিবারিক অবস্থা খারাপ না হলেও আহামরি কিছুও ছিল না। সেই পরিবারকে একা হাতেই এতোদূর টেনে আনলেন ভাইয়া। আমার স্কলারশিপের ব্যাপারটা আমার আগে ভাইয়ারই কানে এসে পৌঁছেছিল। কিভাবে পৌঁছেছিল সেটা আজও একটা রহস্য। আমার ধারণা, ভাইয়াই কোনো কলকাঠি নেড়ে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।’

এটুকু বলে থামল আরফান। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবারও বলল,

‘ ভাইয়া স্কলারশিপের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে আমার পার্সপোর্ট আর ভিসার ব্যবস্থাও করে ফেললেন। আমি তখন হসপিটালে প্রেকটিস করি। সারাদিন গাঁধার মতো খেঁটে রাতভর পড়াশোনা করি। ভাইয়ার মতো অতো সজাগ দৃষ্টি আমার কোনোকালেই ছিল না। তাই পিঠ পিছে ঘটে যাওয়া এতো কাহিনীর টিকিটুকুও ধরতে পারিনি। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু হঠাৎই একটা এক্সিডেন্টে উলোটপালোট হয়ে গেল সব। চট্টগ্রামগামী একটা ট্রাকে থেতলে গেলেন ভাইয়া। ভাইয়াকে যখন হসপিটালে আনা হলো তখন আমি ডিউটিতে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ার শেষ হয়ে যাওয়াটা দেখলাম। সেই দিনটি যে কী ভয়ানক ছিল নম্রতা! নিজের ডাক্তারী পড়াটা বেকার মনে হচ্ছিল। আমার চোখের সামনে পুরো পরিবারটাতে নেমে এলো বিশাল ধস। ভাইয়া মারা যাওয়ার পরের দিন বাবার থেকে স্কলারশিপ সম্পর্কে জেনেছিলাম আমি।
একদিকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলাম অন্যদিকে ফিন্যানশিয়াল চাপ। সব মিলিয়ে ইউএস যাওয়াটা বাতিলই করতে চেয়েছিলাম। পড়াশোনাতেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আমার ছোট বোন নিদ্রা ভাইয়ার প্রতি প্রচন্ড উইক ছিল। ভাইয়া ব্যবসায়িক কাজ শেষ করে রাতে এসে তাকে খাইয়ে দিলে সে খেত নয়তো খেত না। সারাদিন উপোস বসে থাকত। ভাইয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে নিদ্রাও অসুস্থ হয়ে পড়ল। নিদ্রা এমন একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যে ওর বেঁচে থাকা নিয়েই আশঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলাম আমরা। আমি কী করব, কোথায় যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ‘ভাইয়া আছে মানে সব ঠিক’ এমনটা জেনেই ছোট থেকে বড় হয়েছিলাম আমরা। কখনও কোনো কিছু নিয়ে ভাবতেই হয়নি। ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে পৃথিবীর চেনা আদল বদলে গেল। পরিবারকে এমন একটা অবস্থায় রেখে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ইউএস যাওয়ার কথা তখন চিন্তাও করতে পারছিলাম না। যেতামও না হয়তো যদি-না ভাইয়া মৃত্যুর আগে এডভান্স টিকেট কেটে রাখতেন। বাবাও জোর দিলেন। ভাইয়ার এতো চেষ্টা মাঠে মারা যাবে এমনটা ভাবতেও খারাপ লাগছিল। দুই দিন দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে। একরকম বাবার চাপে পড়েই ভাইয়ার মৃত্যুর পাঁচদিনের মাথায় , নিদ্রাকে হসপিটালে ফেলেই মার্কিন মুলুকে উড়াল দিতে হলো। ইউএস গিয়েও শুরু হলো টিকে থাকার আরেক যুদ্ধ।’

নম্রতা কিছুক্ষণ শান্ত থেকে বলল,

‘ চিঠি! তবে চিঠি দিয়েছিলেন কখন? এমন একটা পরিস্থিতিতে লাইব্রেরি গিয়েছিলেন আপনি?’

বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করল নম্রতা। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ লাইব্রেরি যাইনি। যাওয়া সম্ভবও ছিল না। তবে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। ফ্লাইটে উঠার আগে তাড়াহুড়ো করে চিঠি লিখেছিলাম। তাতে আমার স্কলারশিপ নিয়ে ইউএস যাওয়া, ভাইয়ার মৃত্যু আর আমার নাম্বারটা ছিল। যোগাযোগ করতে বলেছিলাম। সেই চিঠি পাঠিয়েছিলাম আমার এক ছোট ভাইয়ের হাতে। ছোট ভাই বলতে ভার্সিটি জুনিয়র। কোথায় রাখতে হবে সেটাও বলে দিয়েছিলাম। ওর মতে চিঠিটা সে সঠিক জায়গাতেই রেখেছিল। এক সপ্তাহেও আপনার কোনো খবর না পেয়ে ওকে কল করেছিলাম আমি। ও ফিলোসোফির বইটির একটা ছবিও পাঠিয়েছিল। বই চেইক করে জানিয়েছিল, বইয়ে চিঠি নেই। আমি ভেবেছিলাম চিঠিটা হয়তো আপনিই নিয়েছেন।’

নম্রতা বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এতোকিছু ঘটে গিয়েছে তার অগোচরে? নম্রতা শুকনো গলায় ঢোক গিলল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ আপনার সেই জুনিয়রই চিঠিটা সরিয়ে ফেলেছে এমন কিছু কী হতে পারে?’

‘ না। মুহিব আমার বিশ্বস্ত। তাছাড়া চিঠি সরিয়ে তারই বা কী লাভ?’

নম্রতা উত্তর দিল না। চিন্তিত মুখে বসে রইল। কপালে চিন্তার ভাঁজ। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ বসে থেকে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। চারদিকে নরম আলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পার্কের দিকে হাঁটা দিল তারা। পার্কে তখন বিভিন্ন বয়সী মানুষের সমাহার। রাস্তার পায়ে বাদাম, ছোলা, ফুসকা বিভিন্ন দোকানের আসর। বেশ কিছুক্ষণ পাশাপাশি হাঁটার পর ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল আরফান। হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ জীবনটা কি অদ্ভুত তাই না? মেডিক্যাল ফাইনাল প্রুফ দেওয়ার পর কিছুটা ফ্রী ছিলাম। নিষাদের সাথেও আড্ডা হচ্ছিল অনেকদিন পর। হঠাৎ নিষাদ বলল লাইব্রেরি থেকে কিসব বই নিবে সে। আমাকেও সাথে নিল। লাইব্রেরির দুই তলায় গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। নিষাদ নিজের মতো বই খুঁজতে ব্যস্ত। অযথা বিরক্ত লাগছিল বলে উঠে গিয়ে পাশের তাক থেকে আমিও একটা বই তুলে নিলাম। পুরাতন, মোটা ফিলোসোফির বই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। ফিলোসোফি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও আমার ছিল না। কৌতূহল বশত বইটা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। তারপর কিভাবে যেন চিঠিটা হাতে পেয়ে গেলাম। অবসর বসে ছিলাম বলে নিষাদের থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে চিঠির উত্তরও লিখে ফেললাম। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে চিঠির কথাটা ভুলেও গেলাম। এই চিঠিতেই যে একদিন কপোকাত হবো কে জানত?’

নম্রতা জবাব না দিয়ে আরফানের দিকে তাকায়। লম্বাচওড়া, বলিষ্ঠ গঠনের মানুষটিকে দেখতে মাথাটা বেশ খানিকটা উঁচু করতে হয় তার। শক্ত চোয়াল আর ব্যাক ব্রাশ করা চুলগুলোতে বিকেলের সোনালী রোদ এসে পড়ছে। নম্রতা আজই প্রথম খেয়াল করল আরফানের ঘাড়ের কাছে একটা তিল আছে। কুচকুচে কালো তিল। সেই তিলের মাধুর্যেই এক পাশ থেকে আরফানকে আরো বেশি ব্যক্তিত্ববান আর বলিষ্ঠ দেখাচ্ছে। হঠাৎই তিলটাকে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে খুব খুব ইচ্ছে জাগল নম্রতার। কিন্তু প্রতিবারের মতোই ইচ্ছের ঝোপ বন্ধ করে বেহায়ার মতো চেয়ে রইল নম্রতা। ডানহাতে আচমকা আরফানের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে চোখ ফিরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল সে।পরমুহূর্তেই গম্ভীর, উদ্বেগী কন্ঠে ধ্যানভঙ্গ হলো,

‘ আরেকটু হলেই গর্তে পড়তেন। সাবধানে হাঁটুন।’

নম্রতা মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে মাথা নাড়ল। আরফান মিটিমিটি হাসছিল। বলল,

‘ মনোযোগ কোথায় ছিল? কি দেখছিলেন?’

নম্রতা যেন হোঁচট খেল। একপলক আরফানকে দেখে নিয়েই বুঝতে পারল, চুরি ধরা পড়ে গিয়েছে। এই ডাক্তার খুব একটা সুবিধার নয়। চোখ-কান সজাগ, সতর্ক। তবুও নম্রতা কিচ্ছুটি স্বীকার করল না। আমতা আমতা করে বলল,

‘ আশেপাশে দেখার মতো তো অনেককিছুই আছে। রাস্তার ওপাশে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল। ওকেই দেখছিলাম।’

আরফান হেসে ফেলল। ঠাট্টা নিয়ে বলল,

‘ ও আচ্ছা আচ্ছা।’

নম্রতা খানিক রেগে গিয়ে বলল,

‘ হাসছেন কেন?’

আরফান নম্রতার মতো করেই বলল,

‘ আশেপাশে হাসার মতো তো অনেককিছুই ঘটছে। রাস্তার এপাশে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল। তার কথা শুনেই হাসছি।’

কথাটা বলে আবারও মিটিমিটি হাসতে লাগল আরফান। নম্রতা রাগ করার চেষ্টা করেও হেসে ফেলল। আরফানের বাহুতে এলোপাথাড়ি কয়েকটি আঘাত করে বলল,

‘ আপনি একদম অসহ্য।’

আরফান নিঃশব্দে হাসল। অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

‘ অসহ্য কেন? আমি কী একবারও বলেছি যে আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন? আমি আপনার কথা সরল মনে বিশ্বাস করেছি। তারপরও অসহ্য?”

নম্রতা নিভে গেল। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল মুখ। কি ফাজিল ছেলে! নম্রতা আরফানের বাহুতে বেশ জোরেই আঘাত করল এবার। কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল,

‘ আমি আপনার সাথে কথায় বলব না আর। এতো ফাজিল আপনি!’

আরফান হাসতে হাসতেই নম্রতার হাত চেপে নিজেকে রক্ষা করল। নম্রতাকে রাগিয়ে দিতেই বলল,

‘ আচ্ছা। কথা বলতে হবে না। আপনি বরং তাকিয়ে থাকুন।’

নম্রতা গর্জে উঠে বলল,

‘ আবার?’

আরফানের মুখ ভর্তি হাসি। সেই হাসি নিয়েই বাচ্চাদের মতো আবদার করল,

‘ আপনার হাতটা ধরি?’

নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে আড়চোখে তাকাল,

‘ ধরেই তো আছেন।’

আরফান মুখ ভরা হাসি নিয়ে বলল,

‘ যদি নিষেধ করেন তাই আগে থেকেই ধরে আছি। রিস্ক নিতে চাইছিলাম না। যদিও নিষেধ করলেও ধরতাম। প্রয়োজনে জোর করে।’

নম্রতা চোখ ছোট ছোট করে বলল,

‘ আমি ইভটিজিংয়ের মামলা করে দিতাম।’

‘ আমাকে সাথে নিবেন। আমিও মামলা করব। রাস্তাঘাটে মেয়েরা এমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলে তো রিস্ক। কেউ কেউ আবার গর্তেও পড়ে যায়।’

কথাটা বলে হাসে আরফান। নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আপনাকে আমি খুন করব।’

আরফান নম্রতার হাতটা চেপে ধরে রাস্তা পাড় হতে হতে বলল,

‘ আচ্ছা। তার আগে ফুল কিনে দিই চলুন। সবগুলো নিবেন?’

#চলবে…

[ কাল রাত জেগে প্রেমকথন লিখেছি। পোস্ট করার আগমুহূর্তে ডিলিট হয়ে যাওয়ায় বাকি রাতটুকু থম মেরে বসে থেকেছি। ফলাফলস্বরূপ- প্রেমকথন, নীল চিরকুট কোনোটাই দেওয়া হয়নি। অনেকে হয়তো অপেক্ষা করছিলেন। সেজন্য দুঃখিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here