নীল চিরকুট পাঠ-৩৬

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৩৬.

বিকেল তিনটা। দুপুরের ঝাঁঝ ধরা উত্তাপটা খানিক মিইয়ে এসেছে। ডিপার্টমেন্টের পাশে লম্বা অশ্বত্থ গাছের মাথায় ঝলমল করছে পড়ন্ত সূর্য। ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েদের পাশ কাটিয়ে মাঠে নেমে এলো নীরা। দিনের শেষ ক্লাসটা মাত্রই শেষ হয়েছে। নীরার দৃষ্টি স্থির। চাহনী গম্ভীর। টুলটুলে মুখটা কয়েকদিনের অবহেলায় কিছুটা শীর্ণ। এই শীর্ণতাও যেন বেশ মানিয়ে গিয়েছে তার মুখে। কাটা কাটা চেহারাটা বড্ড চোখে লাগে। নীরা কাঁধের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা সকাল থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। কেন দিচ্ছে তাও নীরার জানা। নীরা হাঁটতে হাঁটতেই মাকে ফোন লাগাল। বড় ক্লান্ত লাগছে তার। শরীরের সাথে মনটাও কেমন মুড়িয়ে গিয়েছে। এভাবে কী বাঁচা যায়? নীরার মা ফোন তুলেই বললেন,

‘ তোর সমস্যাটা কী?’

নীরা শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমার কোনো সমস্যা নেই মা।’

‘ সমস্যা নেই তো বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না কেন?’

অবুঝ মায়ের খুব সাধারণ প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীরা।

‘ আমি ওকে বিয়ে করতে চাই না মা।’

‘ চাস না! কিন্তু কেন? ছেলের চরিত্র খারাপ? মদ,গাঞ্জা খায়? মেয়েমানুষের নেশা আছে? ভদ্রতা জানে না? দেখতে খারাপ?’

নীরা শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এগুলোর কোনোটাই আমার সমস্যা নয় মা। অন্তু খুবই লয়্যাল একটা ছেলে, আমি জানি।’

নীরার মা এবার তেতে উঠলেন। ভীষণ রাগ নিয়ে বললেন,

‘ নিজেই বলছিস লয়্যাল তাহলে বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না কেন? ছেলে যেহেতু পড়াশোনা করছে চাকরি তো একদিন করবেই। ধানমন্ডিতে নিজস্ব বাসা আছে। এই যুগে ঢাকা শহরে বাসা থাকার মানে বুঝিস? ছেলের বাপ সরকারি চাকরী করেন। আহামরি টাকা পয়সা না থাকলেও ছেলের জন্য চাকরীর ব্যবস্থা ঠিকই করবেন। মেয়েটেয়ে নেই, দুটো ছেলেই। অযথা টাকা খরচের বালাও নেই। আমাদের যা অবস্থা সেই হিসেবে সম্বন্ধটা খুব খারাপ না। ছেলের চাকরী নিয়ে একটু অনিশ্চয়তা আছে ঠিক কিন্তু এদিকেও যে আর পারা যাচ্ছে না। তোর বড় চাচা জমি নিয়ে নতুন করে ঝামেলা শুরু করেছে। তোর বিয়ে ভাঙা নিয়েও বিশ্রী বিশ্রী কথা বলে বেড়াচ্ছে। সম্বন্ধ আসার আগেই পাত্রপক্ষকে কানপড়া দিয়ে বিয়ে ভাঙাচ্ছে। এই সম্বন্ধটাও কখন বেঁকে বসে তার কোনো ঠিক আছে? ইরারও ভার্সিটিতে দুই বছর চলে গেল। ওকেও বিয়ে দিতে হবে। আর তোর ভাইয়ের কথাও ভাব। ছেলেটা তো খেঁটেই আসছে আজীবন। আপাতত ঠিক বয়সে বিয়েটা করুক। তু…’

মায়ের কথার মাঝেই ফোন কাটে নীরা। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। দিশেহারা দৃষ্টিটা খনিকের জন্য টলমল করে উঠে। হঠাৎ করেই একটা বুঝদার কাঁধের খুব অভাববোধ করে। মনটা ছলকে উঠে বলে, ‘ আজ যদি বাবা থাকত!’ নীরার পাতলা ঠোঁটজোড়া ভেঙে আসে কান্নায়। মা আজ বলছে, সম্বন্ধটা ভালো। নীরার বিয়ে ভেঙেছে, বিপদে পড়েছে বলেই আজ চাকরীহীন ছেলের হাতে মেয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হচ্ছে না মায়ের। অথচ আজ যদি অন্তুকে সে প্রকাশ্যেই ভালোবাসত। মায়ের কাছে অন্তুকে বিয়ে করার জন্য বায়না ধরত তাহলেই প্রাচীন সব সংস্কারে ভরে উঠত মায়ের মন। অন্তুর অপূর্ণতাগুলো নিয়ে হাজার হাজার প্রশ্ন উঠত। চাকরীটা হয়ে উঠত সবচেয়ে মূল্যবান আর ভালোবাসাটা ঠুনকো। তারপরই টেনে দেওয়া হতো নিষেধাজ্ঞার বেড়ি। আর আজ যখন… নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শরতের স্বচ্ছ আকাশের দিকে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। আজ বাবা থাকলে এমন দ্বিধাভরা জীবন টানতে হতো না নীরার। বাবা নীরাকে বুঝত। নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, পথ দেখাত।

ধানমন্ডির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটিতে বসে আছে ছোঁয়া। সাদা বেড কাভারে ঢাকা বিশাল বিছানাটিতে বইয়ের স্তুপ। মেঝের উপর কফি কাপ, মার্কার, ডট পেইন আরও কতো কি! বিছানার মুখোমুখি বিশাল জানালাটার পর্দা সরানো। বৃষ্টির পানি ঝাপটে পড়ছে গ্লাসে। বাইরের অন্ধকারে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো লাগছে মুক্তোর মতো। বিশাল চাদরে ছোট ছোট মুক্তো ছুঁড়ে ফেললে যেমন লাগে, ঠিক তেমন। ছোঁয়া বিছানার গদিতে ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে ছিল। হাতে ‘দ্য সাইকোলজি অব দ্য সিম্পসনস’ নামে একটি ইংরেজি বই। বইটা এর আগেও দুইবার পড়েছে কিন্তু আজ মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। ছোঁয়া বরাবরই পড়াকু মেয়ে। পড়াশোনায় মন বসছে না এমন অভিজ্ঞতা তার নতুন। ছোঁয়া হাতের বইটা উল্টে রেখে জোড়াল শ্বাস ছাড়ল। কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দ বৃষ্টি দেখে নিয়ে দামী ফোনটা তুলে নিল হাতে৷ একবার, দুইবার, তিনবারের সময় ফোনটা রিসিভ করল নাদিম। ফোন রিসিভ করেই ধমকে উঠে বলল,

‘ তোর সমস্যা কি বাপ? জ্বালাইতাছিস কেন? মাঝরাতে ঘুম ভাঙাইয়া কানের কাছে কিরিংকিরিং লাগাইছত। বড়লোকি বিছানায় ঘুম আহে না? ফোন রাখ, বাল।’

ছোঁয়া নাক ছিটকে বলল,

‘ তুই আবারও এভাবে কথা বলছিস? ট্রাই টু মেইক আ পার্সোনালিটি। তোর কথা শুনে যে কেউ বমি করে ফেলবে।’

‘ এক থাপ্পড়ে দশবার বমি করাই ফেলমু তোরে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙাইয়া পার্সোনালিটি মেইক করার গল্প শোনাস তুই?তোর এই ইংরেজি আলাপ তোর ইংরেজ বাপের লগে কর গা। আমার সাথে ইংরেজি মারাইতে আসবি তো তোর খবর আছে ছোঁয়াইয়া।’

ছোঁয়া নিজেকে সামলে নিল। আজকাল তার বুদ্ধি হয়েছে। কাজের সময় নাদিমকে রাগিয়ে দেওয়া যে বোকামো তা সে বোঝে। ছোঁয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে রয়ে সয়ে বলল,

‘ আচ্ছা যা ইংরেজি আর বলব না। এখন বল সবাই এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করছে? কি হয়েছে?’

নাদিম অকপটে বলে,

‘ আমার বউয়ের ছাবাল হইছে। ইন শর্ট ক্যানা হইছে। তোর কোনো সমস্যা?’

নাদিমের বলা বাক্যটা ঠিক ক্যাচ করতে পারল না ছোঁয়া। কিছুক্ষণ গাড়লের মতো বসে রইল। নাদিমের বলা বাক্যটা বার দুই আওড়ানোর চেষ্টা করল। হচ্ছে না। ‘ক্যানা হইছে’ মানে কী? এটা কী কোনো বৈজ্ঞানিক নাম? নতুন কোনোও রোগও হতে পারে। ছোঁয়া বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,

‘ সমস্যা? না, কোনো সমস্যা নাই। তুই চিন্তা করিস না দোস্ত। মেডিকেল সাইন্স এখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। ক্যানার প্রতিষেধকও জলদি পেয়ে যাবি।’

ছোঁয়ার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল নাদিম। বেশ কিছুক্ষণ মুখে কোনো কথা খুঁজে পেল না সে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলল,

‘ তোরে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বাইরে ফালাই দিয়া আসতে মন চাইতাছে। ”ক্যানা’ একটা রোগ? বলদের বলদ।’

ছোঁয়া নিভে গেল। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ রোগ নয়?’

‘ তুই আমার সামনে থাকলে নির্ঘাত থাপড়া খাইতি আজ। ভোলাভালা মেজাজটাই বিগড়ে দিলি শালী।’

‘ দেন হোয়াট ইজ ক্যানা? এটা বাংলা শব্দ? তোর বলা বাংলা শব্দ আমি কেন কখনও শুনি না?’

নাদিমের রাগের মাঝেও হাসি পেয়ে গেল। মনের গোমট ভাব বেশ খানিকটা কেটে যাওয়ায় ধমকা-ধমকি না করে ফুরফুরে মেজাজে বলল,

‘ তুমি বাঙালী হলে শুনতি। তুই ইংরেজ। তোর উচিত ব্রিটেন বা আমেরিকা চলে যাওয়া। এখন ফোন রেখে ক্যানার অর্থোদ্বার কর। অর্থ বের করতে পারলে আমায় কল করবি নয়তো নয়। বেহুদা জ্বালাইছিস তো খবর আছে।’

ছোঁয়া বোকা বোকা কন্ঠে বলে,

‘ আচ্ছা।’

নাদিমের ফোন কেটে ডান হাতে চশমা ঠিক করে ছোঁয়া। মাথায় ঘুরতে থাকে একটায় শব্দ ‘ক্যানা’। ছোঁয়া গুগলে সার্চ দেয়। বানানটা ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বিভিন্নভাবে লেখে। কিন্তু প্রত্যেকবারই একই লেখা ভেসে উঠে, ‘ ইউর সার্চ ক্যানা ডিড নট ম্যাচ এনি ডকুমেন্টস।’ ছোঁয়া বেশ কিছুক্ষণ অসহায় মুখে বসে থেকে বাবার লাইব্রেরিতে যায়। পুরো লাইব্রেরি গেঁটে পুরনো-নতুন তিনটা বাংলা অভিধান খুঁজে পায় সে। ডানহাতের আঙ্গুল দিয়ে চশমাটা ঠিক করে চেয়ার টেনে বসে। অভিধানের প্রতিটি পাতা মনোযোগ দিয়ে দেখে, হয়ার ইজ ক্যানা? ঘন্টা দুয়েক পর লাইব্রেরির দরজায় হালকা টোকা পড়তেই চোখ তুলে তাকাল ছোঁয়া। বাবাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হালকা হাসল,

‘ হেই বাবা৷ হোয়াটস আপ?’

সালাম সাহেব বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দরজা ছাঁড়লেন। ভেতরে ঢুকে সামনে থাকা অভিধানগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ নাথিং মাচ। কিন্তু এতো রাতে এসব কী? কি করছ?’

‘ একটা শব্দ খুঁজছি বাবা। ডু ইউ নো? আই এম নট মাচ ফ্লুয়েন্ট ইন ব্যাঙ্গলি।’

সালাম সাহেব চেয়ার টেনে বসলেন। বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন,

‘ বাংলায় দুর্বলতাটা আমারও আছে। ছোটবেলায় ব্যাকরণের বইগুলো না বুঝেই মুখস্ত করতাম আর বাবার কাছে বেদারম মার খেতাম। এনিওয়ে, কী শব্দ খুঁজছ?’

‘ ক্যানা। তুমি কী এই শব্দটার অর্থ জানো বাবা?’

সালাম সাহেব অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

‘ এটা কোনো বাংলা শব্দ, তুমি শিওর?’

ছোঁয়া মাথা নেড়ে বলল,

‘ হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট শিওর৷ নাদিম প্রায় সময়ই বাংলাতে কথা বলে। যদিও ওর বাংলাগুলো ভীষণ অদ্ভুত।’

সালাম সাহেব মুখ কুঁচকে ফেললেন৷ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

‘ নাদিম? দেট স্কাউনড্রেল? তুমি এখনও ওর সাথে মিশো?’

ছোঁয়া উত্তর দেয় না৷ উদাস ভঙ্গিতে একের পর এক পাতা উল্টাতে থাকে। মনটা ভালো লাগছে না তার৷ সারাদিন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে থাকলেও বন্ধু মহলের পরিবর্তনটা চোখ এড়ায়নি ছোঁয়ার। আগের মতো আড্ডা বসছে না। কেউ ঠিকঠাক ক্লাসে আসছে না। আজকাল রঞ্জনও কেমন গম্ভীর। অন্তু, নাদিমের দেখা নেই। নীরা-নম্রতাও তাই। ছোঁয়াকে কেউ কিছু না বললেও সে বুঝে, কিছু একটা ভালো হচ্ছে না৷ কোথায় একটা বড্ড গোলমাল। ভেঙে যাওয়ার পূর্বাবাস। এই বন্ধুমহল ছাড়া ছোঁয়ার জীবনে ভিন্ন স্বাদ, আনন্দ বলে কিচ্ছু নেই। ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বোকা,সরল মনটা ভীষণ টনটন করছে। অদৃশ্য একটা ভয়ে কাটা হয়ে উঠছে। এই ভয়টা কী হারানোর ভয়?নাকি হারিয়ে যাওয়ার ভয়?

রাতের শেষ ভাগ। ঘরজুড়ে সবুজ রঙের হালকা আলো। বিছানার এক কোণায় মাথা নিচু করে বসে আছে অন্তু। বাকি বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে অয়ন। অন্তু মাথা তুলে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। অয়নের মুখে এখনও বাচ্চাদের ছাপ। সেদিনও ‘ভাইয়া’ ‘ ভাইয়া’ করে মাথা পাগল করে দেওয়া ছেলেটা এখন ক্লাস টেনে পড়ে ভাবতেই অবাক লাগে অন্তুর। অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ সরিয়ে নেয়। মনটা বড় অস্থির। এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ দেওয়া কঠিন। অন্তু দিশেহারা চোখে চারপাশে তাকাল। সবুজ আলোয় দৃষ্টিটা ভেসে ভেসে আটকে গেল টেবিলের পাশে রাখা অয়নের গিটারটার উপর। অয়ন গান গাইতে পারে না তবুও তার গিটারের খুব শখ। দুই বছর আগে টাকা জমিয়ে অন্তুই কিনে দিয়েছিল এই গিটার। অন্তু উঠে গিয়ে গিটারটা তুলে নিল হাতে। সাথে সাথেই চোখের সামনে ভেসে উঠল নাদিমের হাস্যোজ্জল মুখ। চায়ের স্টলে বসে প্রাণখোলে গান গাওয়া বন্ধুদের আড্ডাটা। অন্তু গিটার হাতে বারান্দায় গিয়ে বসল। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া প্রকৃতির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল অনেকক্ষণ। জ্যোৎস্নায় গিটারের গা ভাসল। চিকচিক করে উঠল গিটারের মসৃন গা। অন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো বসে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধীরে ধীরে আঙ্গুলগুলো সচল হয়ে উঠল। মায়াবী জ্যোৎস্নায় বেজে উঠল এক বিরহী সুর। আনমনা অন্তু আজ অনেকদিন পর গলা ছেড়ে গাইল,

‘ এখন আমি অনেক ভালো
তোমায় ছাড়া থাকতে পারি
বলে না তো কেউ আমাকে
করো না বাড়াবাড়ি।।

আমার আকাশ, আমার সবই
আমি আমার মতো গুছিয়ে নিয়েছি।
যদি স্বপ্নটাকে আপন করে দেখতে শেখালে
তবে মাঝ পথে হাতটা ছেড়ে কী বোঝালে?

ভালোবাসি তোমায় আমি একথা জানি
তবে বলব না আর আগের মতো, এখন আমি। ‘

হঠাৎই থেমে গেল সুর। নিশ্চুপ অন্তু চুপ করে চেয়ে রইল দূরে। একসময় পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারিতে ঢুকল অন্তু। হাত চলছে যন্ত্রের মতো। প্রাণহীন, অনুভূতিহীন। কুতুবদিয়ার একটি হতশ্রী চা স্টলে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে ছয় বন্ধু। সবার মুখেই বিস্তর হাসি। নাদিমের হাতে গিটার। অন্তু দুইহাত ছড়িয়ে দিয়েছে নাদিম আর রঞ্জনের কাঁধে। ছবিটা দেখতে দেখতে চোখদুটো জ্বালা করে উঠল অন্তুর। হঠাৎই হাতের ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল ফ্লোরে। নির্জীব ফোনটা দেয়ালের সাথে লেগে ছিটকে পড়ল দূরে। অন্তু দুই হাতে মুখ চেপে বসে রইল। হাত সরিয়ে চুলগুলো খামচে ধরে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল। দীর্ঘ চারবছরের পাগলামোতে আজ সে হার মানল। নীরাকে আর চাই না তার। থাকুক সে তার মতো। শুধুমাত্র নীরাকে পাওয়ার পাগলামোতে কতকিছুই না করেছে অন্তু। পরিবার, বন্ধুমহল সবার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। নিজের জীবন থেকেও কী দূরে সরে যায়নি? নীরার অবহেলা,ঘৃণায় ভেতরের ভালোবাসাটা থিতিয়ে গিয়েছে। ভালোবাসাটা গলার কাছে আটকে থেকে দমবন্ধ করে দিতে চাইছে বরংবার। অন্তুর ভেতরটা জ্বলেপুড়ে উঠে। একের পর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকজুড়ে। নীরাকে সে ভুলতে পারবে না ঠিক। কিন্তু তাকে মনে রাখাটাও তো যন্ত্রণার। অপমান, অবহেলা সইতে সইতে অন্তু এখন ক্লান্ত। এবার তার মুক্তি চাই। যত কষ্টই হোক অন্তু লড়বে। যে তাকে চাইছে না তাকে জোরপূর্বক পাওয়ার থেকে নিজের সাথে লড়াই করাটা সহজ। সেই লড়াইয়ে আত্মসম্মান হারানোর ভয় থাকে না। মাথা নোয়াতে নোয়াতে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার ভয় থাকে না। প্রিয় বন্ধু, পরিবার হারানোর ভয় থাকে না। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অন্তু। মস্তিষ্কের পর্দায় জোর দিয়ে বলে উঠল নাদিম,

‘ দূর শালা! মাইয়া মানুষ নিয়া এতো ভাবুন লাগে নাকি? তুই খালি ক কেমুন মাইয়া লাগব। আমি আছি না?’

অন্তু হাসল। পরমুহূর্তেই প্রচন্ড অনুশোচনায় হাসফাস করে উঠল মন। নিজের দোষটুকু চোখের সামনে প্রকান্ড হয়ে ধরা পড়লেও নাদিমকে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। বন্ধুদের কী ঘটা করে সরি বলা যায়? সরি বললেই কী সব সমাধান হয়? অন্তুর ভাবনার মাঝেই বারান্দার দরজা থেকে ভয়ে ভয়ে ডেকে উঠে একটি কন্ঠ,

‘ ভাইয়া?’

অন্তু চোখ ফিরিয়ে তাকায়। বারান্দার দরজায় জড়োসড়ো অয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

‘ কি ব্যাপার? উঠেছিস কেন? কিছু বলবি?’

অয়ন ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,

‘ তুমি যে গিটার বাজাচ্ছিলে৷ গিটারের শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছে।’

‘ ওহ। খেয়াল ছিল না।’

অয়ন দরজার কাছেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

‘ তোমার কি মন খারাপ ভাইয়া?’

অন্তু গভীর চোখে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হেসে বলল,

‘ মন খারাপ কেন থাকবে? মন খারাপ না। তুই ঘুমো।’

অয়ন ধীর পায়ে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসল। মিনমিন করে বলল,

‘ তুমি নীরা আপুকে খুব ভালোবাসা না?’

অন্তু হাসল। ভাইয়ের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ বাসি।’

‘ নীরা আপু বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে। তুমি মন খারাপ করো না।’

অন্তু জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমি মন খারাপ করছি না অয়ু। নীরাকে আমি নিজেই বিয়ে করতে চাই না। নীরা রাজি হয়ে যাক এমন কিছুও চাইছি না।’

অয়ন অবাক চোখে চেয়ে থাকে। বিস্ময় নিয়ে বলে,

‘ তুমি নীরা আপুকে বিয়ে করবে না?’

অন্তু হাসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। পূর্ব আকাশে তখন লালাভ আভা। অন্তু সকালের সূচনালগ্নে চেয়ে থেকে বিসর্জন দেয় নীরা নামক মেয়েটিকে। বুক ভরা ভালোবাসাটুকু বন্ধী করে নেয় গোপন কালো কুঠুরে। বাবাকে খুব শীঘ্রই সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেবে অন্তু। এই অশান্তি, এই দগ্ধ- বিদগ্ধের খেলার ইতি টানবে এবার।

#চলবে…

[ বিঃদ্রঃ আজকের পর্বে নম্রতা-আরফানকে নিয়ে লেখা হয়নি। পরের পর্বে লেখা হবে ইন-শা-আল্লাহ। প্রত্যেক পর্বে সবগুলো চরিত্র নিয়ে লেখা মুশকিল। এই গল্পে শুধু আরফান-নম্রতা নয় বন্ধুমহলের প্রতিটি চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ। পারিপার্শ্বিক চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ না করে শুধু মাত্র একটি প্রেম কাহিনীর বিশ্লেষণে গল্প ফুটিয়ে তোলা যায় না বলেই আমি মনে করি। কাহিনী এগিয়ে নিতে প্রত্যেক চরিত্র বিশ্লেষণ প্রয়োজন।ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here