নীল চিরকুট পাঠ-৪১

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৪১.

খাওয়া শেষে দীর্ঘ এক ভাত ঘুমের পর বড় মামার সাথে দেখা করল নাদিম। বড় মামা মাত্রই পরিষদ থেকে ফিরেছেন। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বৈঠক ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। চোখে-মুখে আগের সেই জৌলুশ নেই। বার্ধক্য হানা দিয়েছে শরীরে। শক্তপোক্ত শরীরটা ঢিলেঢালা, থলথলে হয়ে গিয়েছে। মামার সামনে বেতের মোড়ায় বসে কৌতূহলী চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করল নাদিম।

‘ আপনার শরীরটা বোধহয় খুব একটা ভালো যাচ্ছে না মামা।’

বড় মামা চোখ মেলে তাকালেন। ম্লান হেসে বললেন,

‘ বয়স হচ্ছে।’

‘ ততটাও বয়স হয়নি। ডাক্তার দেখান।’

বড় মামা মাথা নেড়ে চুপ করে রইলেন। বড় বড় দম নিয়ে গ্লাসের বাকি শরবতটুকু এক চুমুকে শেষ করলেন। নাদিম উৎসুক কন্ঠে বলল,

‘ মিষ্টিকে নিয়ে কী বলছিলেন ফোনে?’

বড় মামা জবাব না দিয়ে বললেন,

‘ তোমার চেহারার দশা দেখে তো আমাদের বংশের ছেলে বলে মনে হচ্ছে না বাবা। মাথায় পাখির বাসা। গালেও দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল। ঢাকা শহরে গুন্ডামী করে বেড়াও নাকি হে?’

নাদিম হাসল। বড় মামা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন নাদিমের পুরু ঠোঁট জোড়ার দিকে। পরিচিত! খুব পরিচিত সেই হাসি। নাদিম হেসে বলল,

‘ আমি তো আপনাদের বংশের ছেলে নই বড় মামা। আমার বংশ ভিন্ন।’

বড় মামা কিছুক্ষণ চুপ করে নাদিমকে লক্ষ্য করলেন। তারপর মৃদু কন্ঠে বললেন,

‘ মায়ের বংশ কী নিজের বংশ নয়?’

‘ হওয়ার তো কথা নয়।’

বড় মামা বিড়বিড় করে বললেন,

‘ আমি মতিনকে বলে দিচ্ছি। বাড়ি এসে চুল,দাড়ি ছেঁটে দিয়ে যাবে তোমার। ভদ্রলোকদের এভাবে থাকতে নেই।’

নাদিম মাথার ঘন চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ সে দেখা যাবে। আপনি বরং মিষ্টির কথা বলুন। ওর জন্যই তো এতো জরুরি তলব। কেন ডেকেছেন?’

বড় মামা চওড়া চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজলেন।

‘ অতো তাড়া কীসের? আজই এলে, বিশ্রাম নাও। কাল সকালে নাহয় কথা হবে।’

‘ কাল সকাল পর্যন্ত তো থাকতে পারছি না মামা। আসার সময় ফেরার টিকেট করেই এসেছি। সন্ধ্যায় ট্রেন। রাতের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে হবে।’

বড় মামা অবাক হয়ে বললেন,

‘ সে কি! এতোদিন পর এসে আজই ফিরে যাবে? কিছুদিন থাকো। টিকেটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।’

‘ টিকেটটা কোনো ব্যাপার না বড় মামা। ব্যাপারটা আমার ঢাকা ফেরা নিয়ে। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।’

নাদিমের উত্তরটা বড় মামার ঠিক পছন্দ হলো না। বিস্বাদ মুখে বললেন,

‘ বন্ধু অপেক্ষা করলেই ছুটতে হবে নাকি? থাকো ক’দিন। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াও। তোমার মামিও বোধহয় এতো তাড়াতাড়ি ছাড়বে না। ভেতর বাড়িতে রান্নার বিশাল আয়োজন চলছে।’

নাদিম জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। ধীর কন্ঠে বলল,

‘ মিষ্টির কি হয়েছে? কেন ডেকেছেন?’

বড় মামা এবার যেন হঠাৎই আগের রূপে ফিরে এলেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খেলে গেল চোখে মুখে। মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে বললেন,

‘ তোমার বোন যে এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে জানো?’

কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা করলেন তিনি। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,

‘ জানো না, জানি। জানার প্রয়োজনও বিশেষ ছিল না। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভিন্ন। মিষ্টি বড় হয়েছে। ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।’

নাদিম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। মিষ্টির বিয়ে? ওই ছোট্ট পুচকো মেয়েটার বিয়ে? ওর কী আদৌ বিয়ের বয়স হয়েছে? এই সেদিনও না লাল ফ্রক পরে বোকা বোকা চোখে চেয়ে থাকত মেয়েটা? নাদিম মিষ্টির মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়ছে না। শেষ কবে দেখেছিল সেটাও মনে পড়ছে না। নাদিম চিন্তিত চোখদুটো বড় মামার মুখের উপর স্থির করল। বড় মামা উত্তরের অপেক্ষায় বসে থাকায় খানিক নড়ে চড়ে উঠল নাদিম। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ কোন ক্লাসে পড়ে মিষ্টি? এখনই বিয়ে কেন? পড়াশোনা করুক।’

বড় মামা অসন্তুষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ রক্ত কথা বলে বাবা। ওই মেয়ের বিশ্বাস আছে? কখন কী কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারলে আপদ বিদেয় হয়।’

নাদিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, সে রেগে যাচ্ছে। বড় মামাকে ধরে বেধরাম পেটাতে ইচ্ছে করছে। শালা, পিশাচ! নাদিমকে বিরক্ত মুখে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসলেন বড় মামা। ভারি বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকালেন।সেই কুটিল চোখ দুটোর দিকে চেয়ে নাদিমের কী ঘেন্না হলো? হওয়ার কথা না। নাদিম মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে মজা পায়। প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে গালি দেয়। বেধরাম পেটায়ও। কিন্তু ঘেন্না করে না। নাদিম সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে বড় মামার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল। বড় মামা চাকর শ্রেণীর কাউকে ডেকে কিছু একটা আনতে বললেন। তারপর চিন্তিত হওয়ার ভান করে বললেন,

‘ আজকাল বিয়ের বাজার খুব সোজা নয় বাবা। তারওপর মেয়ে হলো জারজ। জেনে-শুনে জারজ মেয়েকে ঘরের বউ কে করবে শুনি? টাকা-পয়সা দিয়ে পাড় করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখি না বাপ।’

নাদিমকে বিরক্ত মুখে বসে থাকতে দেখে বড় মামা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,

‘ তোমায় ওসব ঝামেলায় জড়াতে হবে না বাবা। যেমন আছো তেমনই থাকো। ব্যবস্থা যা করার সব আমিই করব। কিন্তু টাকা-পয়সার ব্যাপারটা তো তোমাকেই দেখতে হবে বাবা। মেয়ের ভাই যেহেতু তুমি সে হিসেবে দায়িত্ব তো তোমারই বলো?এই মেয়ের সাত-পাঁচে না থেকেও বহুত টেনেছি আমি। আর কত? আমারও দু-দুটো মেয়ে আছে। অত টাকা-পয়সায় আমিই বা কোথায় পাব বাবা?’

বড় মামার উদ্দেশ্য এবার স্পষ্ট বুঝল নাদিম। চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ চেয়ে রইল বড় মামার থলথলে মুখটার দিকে। চাকরটা এসে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ দিয়ে যেতেই ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে নাদিমের দিকে এগিয়ে দিলেন। নাদিম ভ্রু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিতেই বড় মামা বিগলিত কন্ঠে বললেন,

‘ তুমি তো বাবা বছরেও এদিকে মাড়াও না। কোথায়, কী করো আল্লাহ মালুম। তাই বলছিলাম কী? তোমার নামে বাবা যে চার একর জমি রেখে গিয়েছেন। সেই জমিটা বরং ছেড়ে দাও। অযথা পড়ে আছে। ওগুলো বিক্রি করে মিষ্টির বিয়েটা….’

বলতে বলতে থেমে গেলেন বড় মামা। সামনে বসে থাকা ছেলেটির শক্ত চোয়াল। অকপট চাহনি দেখে হঠাৎই চমকে উঠলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আদিবকে বিভ্রম হলো তার। নাদিম কাগজটা বড় মামার কোলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ মিষ্টির বিয়ের কথা ভুলে যান মামা। ওর বিয়ের বয়স হয়নি।’

নাদিমের কন্ঠে আদিবের সেই অকপট, ভয়হীন কন্ঠের আভাস পেয়ে কিছুক্ষণ কথা খুঁজে পেল না বড় মামা। সম্মোহনের মতো নাদিমের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘ বয়স হয়নি, বিয়ের পর বয়স হয়ে যাবে। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। তবুও অযথা বোঝা বইতে যাব কেন? তোমারই বা কী প্রয়োজন? তুমি টাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাও৷ বাকিটা আমি দেখব।’

নাদিম দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ মিষ্টির বিয়ে নিয়ে আর কোনো আলোচনা না হওয়ায় ভালো বড় মামা। ওর বিয়ের বয়স হয়নি।’

বড় মামা চাপা রাগ নিয়ে বললেন,

‘ ওর বিয়ের বয়স হয়েছে কিনা তা তুমি শেখাবে আমায়? কখনও খোঁজ নিয়েছ ওর? আজ হঠাৎ বোনের প্রতি এত দরদ, হ্যাঁ?’

নাদিম শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আপনি ক’দিন খোঁজ নিয়েছেন ওর? আপনার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো বলে মনে হচ্ছে না। খুব বেশিদিন বাঁচবেন বলেও মনে হয় না। শেষ বয়সে এসে আপাতত হিসেবী চিন্তা-ভাবনা বাদ দিন। বিশ্রী কুটিলতা থেকে বেরিয়ে একটু মানুষ হোন।’

বড় মামা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার গ্রাম, তার বাড়িতে বসে কেমন অকপট কথা বলছে ছেলেটা। অপমান করছে। ভয় নেই? আদিবেরও ছিল না। বড় মামা চাপা গর্জন করে বললেন,

‘ কি বলতে চাইছ তুমি? আমি অমানুষ? আমি অমানুষ হলে তোমার ওই জারজ বোনকে এতোদিন দেখেছে কে?’

‘ সেটা তো আমারও প্রশ্ন। কে দেখেছে ওকে? আপনি তো দেখেননি।’

এটুকু বলে থামল নাদিম। হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ মিষ্টি কোনো চাইল্ড হাউজে থাকে না, তাই না মামা? আপনি ওকে সরিয়ে দিয়েছেন। কোথায় থাকে ও?’

বড় মামা থতমত খেয়ে গেলেন। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল মুখ। অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, এই দুইদিনের বাচ্চা ছেলেটাকে খানিক সমীহ করছে তার মন। নাদিম শক্ত চোখে চেয়ে রইল। বোনের প্রতি প্রগাঢ় কোনো টান কোনো কালেই উপলব্ধি করেনি সে। সংগত কারণেই তার সুখ-দুঃখের কথাও কখনও চিন্তা করা হয়নি। তবুও আজ হঠাৎ ভীষণ রাগ লাগছে তার। সামনে বসে থাকা লোকটিকে রড দিয়ে পিটিয়ে চমড়া ফাটিয়ে দেওয়ার এক দূর্দমনীয় ইচ্ছে জাগছে।

_

বিষণ্ন সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত নেমেছে শহরে। শরতের ঝিরিঝিরি বাতাসে উড়ছে পূজার খয়েরী শাড়ির আঁচল। গোছালো চুলগুলো ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে পড়ছে ক্লান্ত, সুন্দর মুখটিতে। চাঁদের আলোয় মোমের পুতুলের মতোই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তার নিখুঁত মুখশ্রী। তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে, তার দিকেই মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপুরুষ এক যুবক। প্রিয়তমার মুখের প্রতিটি ভাঁজ যেন গুণে গুণে মুখস্থ করছে সে। পূজা কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিল। বেখেয়ালি হাতে অগোছালো চুলগুলো গোছাতে গোছাতে বলল,

‘ অন্তদাদের ছাঁদটা বেশ খোলামেলা। বাতাস হয় খুব। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

রঞ্জন রেলিঙে ঠেস দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল,

‘ আমারও খুব পছন্দ হয়েছে।’

পূজা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকাল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘ কী?’

‘ তোমাকে।’

রঞ্জনের ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি। পূজা হেসে অন্যদিকে তাকাল। রঞ্জন বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে পূজার সামনে এসে দাঁড়াল। রঞ্জনকে কাছাকাছি দাঁড়াতে দেখে চোখ তুলে তাকাল পূজা। চোখে তার হাজারখানেক প্রশ্ন। দমকা বাতাসে এক গাছি চুল আছড়ে পড়ল পূজার কপালে। আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সম্মোহিত,মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল রঞ্জন। হাত বাড়িয়ে রঞ্জনের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে কপাল কুঁচকাল পূজা। আদুরে কন্ঠে বলল,

‘ কি দেখছ? কি হয়েছে?’

রঞ্জন জবাব দিল না। আগের মতোই নির্নিমেষ চেয়ে থেকে হঠাৎ এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। পকেট থেকে সিঁদুর কৌটা বের করে পূজার সিঁথি রাঙাল গাঢ় সিঁদুরের রেখায়। মোমের মতো ফর্সা খাড়া নাকে উজ্জল হয়ে উঠল সিঁদুরের লাল রঙ। মুখটিতে ভর করল গাঢ় মায়া। কপালে সিঁদুর ল্যাপ্টানো প্রিয়তমাকে হঠাৎই প্রতিমা বলে বোধ হলো তার। লুকায়িত সৌন্দর্যটুকু ডানা মেলে ঝলসে দিতে চাইল তার গাঢ় দৃষ্টি, সম্মোহিত মন। পূজার হতভম্ব দৃষ্টি উপেক্ষা করে পূজার ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নিল রঞ্জন। খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের চুড়িগুলো গুণার চেষ্টা করল। প্রতিটা চুড়ি আলাদা করতে করতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলতে লাগল,

‘ ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।’

রঞ্জনের দিকে চেয়ে থাকা পূজার দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগল। হতভম্বভাব শেষে ফুটল গাঢ় কোমলতা। তারপর দীর্ঘ বিচ্ছেদের অসহনীয় সুর। এতোদিন কঠোর নিয়মে সামলে রাখা পূজা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। রঞ্জনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। রঞ্জন আলতো হাতে সামলে নিল তাকে। ভালোবাসার প্রতিমাটিকে বুকের সাথে ল্যাপ্টে নিয়ে ঘন চুলে ঠোঁট ছোঁয়াল। ভীষণ আবেগ নিয়ে বলল,

‘ ভালোবাসি!’

পূজার কান্নার আওয়াজ দৃঢ় হলো। দুইহাতে খামচে ধরল রঞ্জনের পাঞ্জাবি। যেন ছেঁড়ে দিলেই ফুরিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে অনেক দূর দেশে। রঞ্জনের ভারী পাপড়ি খানিকটা ভিজে উঠল কী? হয়তো। সিক্ত কন্ঠে বলল,

‘ তোমাকে বুক পকেটে ক্যারি করার ক্ষমতা থাকলে দূর্দান্ত হতো পূজা। বিশ্বাস করো, বুক পকেটে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখতাম তোমায়। হঠাৎ হঠাৎ বের করে মন ভরে দেখতাম। অল্প একটু দুষ্টু আদর করতাম। ইচ্ছেমতো ভালোবাসতাম। তারপর আবারও লুকিয়ে রাখতাম বুক পকেটের এক কোণায়। তোমার ঠাকুর নাকি সব পারে? দিতে বলো তো আমায় এমন ক্ষমতা। আমার খুব দরকার তোমায়। খুব বেশিই দরকার।’

পূজা মাথা তুলে তাকাল। ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ভ্রু কুঁচকাল।

‘ ঠাকুর শুধু আমার? তোমার নয়?’

‘ উহু। আমার নয়। আমার ওসবে বিশ্বাস নেই।’

‘ তাহলে সিঁদুরে বিশ্বাস কী করে এলো?’

রঞ্জন হেসে বলল,

‘ সিঁদুরটা তো তোমার বাবার জন্য। সুন্দরী বউ রেখে দেশ ছাড়ছি। সিকিউরিটির প্রয়োজন আছে না? সিঁদুর পরিয়ে সীল গালা করলাম। ছবি তুলে দলিল করব। সেই দলিল তোমার বাবাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে ট্যাগ মার্কে লিখব, “রঞ্জনের ব্যক্তিগত জিনিস”। ‘

পূজা চোখ ছোট ছোট করে বলল,

‘ সব সময় ফাজলামো না?’

রঞ্জন হেসে ফেলল। পূজাকে কাছে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আরে, আমি সিরিয়াস!’

পূজা প্রত্যুত্তর না করে চুপ করে পড়ে রইল বুকে। রঞ্জন জোড়াল শ্বাস নিয়ে কৌতুকমাখা কন্ঠে বলল,

‘ এখন একটু কেঁদে নাও তো। কাল এয়ারপোর্টে কিন্তু কান্নাকাটি চলবে না। কান্নাকাটি চলবে না আগামী পাঁচ বছর। আমি ফিরলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাকি কান্না কাঁদবে। আজ ফার্স্ট রাউন্ড। স্টার্ট, স্টার্ট।’

পূজা হেসে ফেলল। পরমুহূর্তে, বাস্তবিকই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিল রঞ্জনের বুক। সারাদিন যে থমথমে কান্না নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তা যেন বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো এবার। রঞ্জনের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। ঠোঁটদুটো নিবদ্ধ হলো প্রেয়সীর কপালে। ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি তো আমায় সীল গালা করলে না, পূজা।’ ঠিক সেই সময় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটি লম্বাকৃতি ছায়া। ল্যাম্পপোস্টের ফিকে আলোয় ক্লান্ত দেখাল তার মুখ। রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা নেড়ি কুকুর দুটো ঘেউঘেউ করে এলাকা মাথায় তুলল। রূপালী চাঁদটা কারো ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে লাজুক মুখ লুকাল শরতের শুভ্র মেঘের ছায়ায়। কালো পাঞ্জাবি গায়ে ক্লান্ত যুবকটি বাড়িতে প্রবেশ করতেই ঝিমিয়ে থাকা আড্ডাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এগারোর ঘরে পৌঁছে যাওয়া ঘড়ির কাটাটা যেন নিমিষেই সন্ধ্যেতে নেমে এলো। উচ্ছ্বসিত, কলোরবে মুখরিত হল বন্ধুমহল।

_

মেয়েটা যখন মারা গেল তখন ঘড়িতে বারোটা কি একটা বাজে। এক্সিডেন্ট কেইস। দশদিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে এগারো দিনের মাথায় মৃত্যু। আরফান যখন শেষবার চেকআপ করল তখন মেয়েটি বেঁচে ছিল। লাইফ সাপোর্টে নিঃশ্বাস চলছে, ক্লিনিক্যালই ব্রেইন ডেথ। বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ। আরফান মৃত্যু দেখে অভ্যস্ত। নিজের পেশার খাতিরেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে সে। এই সকল মৃত্যু খুব একটা স্পর্শ করে না তাকে। মানসিক পীড়া দেয় না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম কিছু ঘটল। চেকআপ শেষে, মেয়েটির স্বামীকে যখন চেম্বার ডেকে বলল,

‘ রোগীর বাঁচার আশঙ্কা কম। আপনারা ম্যান্টালি প্রিপেয়ার থাকার চেষ্টা করুন। এক দুই ঘন্টার মাঝেই খারাপ কোনো সংবাদ শুনতে হতে পারে। আপনারা চাইলে এখনও লাইফ সাপোর্টে রাখতে পারেন। তবে, লাভ বিশেষ হবে বলে মনে হয় না।’

আরফান কথাগুলো খুব প্রফেশনালি বলেছিল। সবসময় যেমন বলে, ঠিক সেভাবেই। কিন্তু সামনে বসা ছেলেটির হতভম্ব, অসহায় দৃষ্টি যেন তার মনের কপাটে শক্ত এক আঘাত হানল। পুরোটা সময় ছেলেটি দিশেহারা চোখে আরফানের মুখের দিকে চেয়ে রইল। একটা কথাও বলল না। একসময় আরফানের সন্দেহ হলো, ছেলেটি তার কথা শুনছে তো? আরফান এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আপনি ঠিক আছেন?’

ছেলেটি একদৃষ্টে চেয়ে রইল ঝকঝকে পরিষ্কার গ্লাসটির দিকে, জবাব দিল না। আদৌ কিছু বুঝতে পারছে বলেও মনে হলো না। ছেলেটির চোখ-মুখের অসহায়ত্ব, দিশেহারা ভাব দেখে জানে না কেন হঠাৎ নম্রতার মুখটা ভেসে উঠল আরফানের চোখে। বুকে স্পষ্ট এক ব্যথা তরতর করে বাড়তে লাগল। ছেলেটি উদভ্রান্তের মতো চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও সেই ব্যথাটা রয়ে গেল। মাংস খামচে বসে রইল আরফানের বুকে। শুরু হলো অস্থিরতা। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, গোটা ডাক্তারি জীবনে এই প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যুতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার নয়। হয়নি কখনও। তবে আজ কেন? আরফান অস্থিরতায় হাসফাস করে । কাজে মন বসে না। ঘুরেফিরে মনে পড়ে যায় মৃত মেয়েটির মুখ। সেই মুখটা যদি নম্রতার হতো তবে? আরফান কেঁপে উঠে। নম্রতার প্রতি তার প্রগাঢ় দুর্বলতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে।

অন্তুদের বাসা থেকে ফিরে মাত্রই বিছানায় গা এলিয়েছে নম্রতা। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ। ঢাকায় ফিরে বাসর ঘর সাজানো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা সব মিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে গা। দুই চোখ ভার করে আসতে চাইছে রাজ্যের ঘুম। কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছিল নম্রতা। ভাসা ভাসা কিছু স্বপ্নও বোধহয় দেখছিল। ঠিক তখনই ফোনের ঘন্টি বাজল। নম্রতা ঘুমের মাঝেই চমকে উঠল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ‘ডাক্তার’ নামটা দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল নম্রতা। তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখল, একটা বিশ। আরফান যেখানে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিনের বেশি ফোন দেয় না সেখানে এতো রাতে তার ফোন পেয়ে বোকা বনে গেল নম্রতা। ফোন রিসিভ করে সন্দিহান কন্ঠে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল আরফান,

‘ কেমন আছেন আপনি?’

বিষয়টা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল নম্রতার। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বলল,

‘ হঠাৎ এতো রাতে?’

‘ উচিত হয়নি? রেখে দেব?’

নম্রতা ব্যস্ত হয়ে বললাম,

‘ না। তা কেন? এখনও রেগে আছেন?’

‘ না।’

‘ তাহলে কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? আপনি ঠিক আছেন?’

আরফান লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,

‘ আমি হয়তো আপনাকে মিস করছি নম্রমিতা। আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। এই মুহূর্তে দেখতে ইচ্ছে করছে। এই অদ্ভুত ইচ্ছে কেন হচ্ছে আমার?’

আরফানের কন্ঠে কি ছিল জানা নেই। কিন্তু সেই কন্ঠে বলা বাক্যগুলো হঠাৎ-ই বড় সুমধুর ঠেকল নম্রতার কানে। আরফানের অকপট প্রকাশে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। আরফানের করা প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়া গেল না। খুঁজার চেষ্টায় হয়ত করল না নম্রতা। কানের মাঝে বৃষ্টির শব্দের মতো ছন্দ তুলে বাজতে লাগল আরফানের কন্ঠস্বর। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ থাকার পর মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করল আরফান,

‘ কালকের দাওয়াতটা নিচ্ছেন?’

‘ দাওয়াত?’

অবাক হয়ে প্রশ্ন করল নম্রতা।

‘ নিদ্রার পক্ষ থেকে লাঞ্চের দাওয়াত। আজ তো পারলেন না। কাল হবে?’

নম্রতাকে চুপ থাকতে দেখে কাতর স্বরে অনুরোধ করে বসল আরফান,

‘ প্লিজ!’

আরফানের কথার ধরনে বারবার অবাক হচ্ছে নম্রতা। আরফান কখনোই এতোটা দুর্বল ছিল না। তাদের সম্পর্কের শুরু থেকেই আরফানের চেয়ে নম্রতার দূর্বলতাটাই ছিল বেশি। নম্রতাই কাছে আসার চেষ্টা করত, ভালোবাসার চেষ্টা করত। পাগলামো, বাচ্চামো সবটাই ছিল নম্রতার। তবে আজ হঠাৎ এই অস্থিরতা কেন?

_

বেলী আর গোলাপে ঢাকা বিছানায় শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে নীরা। অপরিচিত এই ঘরটা বেলী ফুলের তীব্র গন্ধে মৌ মৌ করছে। বেলী ফুলের ঝাঁঝাল গন্ধে দমবন্ধ লাগছে নীরার। খুব পরিচিত একজনের অপেক্ষায় হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। বুকের ভেতর দামামা বাজাচ্ছে হৃদপিন্ড। বন্ধু থেকে স্বামী হয়ে উঠা মানুষটি তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে ভাবতেই অস্থির লাগছে। চিরায়ত স্বামী-স্ত্রীর মতই কি কাটবে তাদের রাত? অন্তু কিভাবে নিবে তাকে?

#চলবে….

[ মনোযোগ দিয়ে লিখতে পারিনি। বার বার সুর কাটছিল লেখায়। আরেকটু সময় নিয়ে লেখা উচিত ছিল হয়ত। নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। তবু দিলাম। অগোছালো লাগতে পারে, সেজন্য দুঃখিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here