নীল চিরকুট
লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৪২.
বেলী আর গোলাপের শোভামন্ডিত ঘরটিতে হালকা নীল আলো জ্বলছে। দরজার পাশে ছোট্ট টেবিলটিতে ভিন্ন রঙের মোমও জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। নিশুতি রাত দ্বিতীয় প্রহরে গা ভাসাতেই রাতের শান্ত ঝিমঝিম শব্দে ধরফর করে উঠছে বুক। চারদিকে অস্বস্তিকর নীরবতা। সেই নীরবতাকে আরও বেশি গা ছমছমে করে দেওয়ার জন্যই হয়ত ঘরজুড়ে বেলীফুলের তীব্র সুগন্ধ। হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসছে বেশ কিছু উৎসুক মানুষের আনন্দিত কন্ঠস্বর। ক্ষীণ হাসির শব্দ। ওগুলো কী তবে নাদিম-রঞ্জন? হতে পারে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্লান্তিতে চোখদুটো বোজে আসছে তার। ভারী শাড়ি আর অনেকক্ষণ টানা বসে থাকার জন্য ঝিমঝিম করছে পা। ভ্যাপসা গরমে চুলকাচ্ছে শরীর। নীরা অসহায় চোখে ঘড়ির দিকে তাকাল, একটা বিশ। অন্তু কি তবে ঘরে আসবে না? একটি চিন্তার রেশ ধরে ধীরে ধীরে অসংখ্য চিন্তা উঁকি দিয়ে গেল মস্তিষ্কে। অন্তুর মনোভাব জানার ইচ্ছেয় ছটফট করে উঠল ভেতরটা। চিরায়ত স্বামীদের মতো অন্তুও কী খুব ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে আজ? নাকি দূর্ব্যবহার করবে তার সাথে? বন্ধু অন্তুকে নীরা চিনে। বন্ধু অন্তুর আগাগোড়া পড়ে ফেলার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু স্বামী হিসেবে অন্তু কী রকম হতে পারে তার বিন্দু বিসর্গও ধারণা করা যাচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণে ভয় আর অনিশ্চয়তায় গলা শুকিয়ে আসছে। এক চুমুক জলের জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে হৃদপিণ্ড।
নীরার হাজারও জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঘরে এলো অন্তু। ঘড়ির কাটা তখন দেড়টা ছুঁই ছুঁই। অন্তু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ফ্যানের সুইচ চাপল। কয়েক সেকেন্ড বিলম্ব করে ভো ভো শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল বৈদুত্যিক পাখা। অন্তু শেরওয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে ফ্যানের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। টি-টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলা ভেজাল। প্রতিটি কাজই সে করল অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। নীরার দিকে তাকাল না। অন্তুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিল নীরা। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে অন্তুর দিকে এক পলক তাকাতেই দৃষ্টি থমকে গেল তার। চোখের পলকে বিশ্বাস করে নিল, সাদা শেরওয়ানি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি পৃথিবীর সবথেকে সুপুরুষদের একজন। অন্তুর শ্যাম কালো মুখের বিগলিত মায়ায় নারী অহংকারের সবটায় যেন ভেসে গেল নীরার। বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল গুচ্ছ গুচ্ছ অনুভূতির বহর। বন্ধু থেকে স্বামীত্ব বরণ করা মানুষটির দিকে অপলক চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎই উপলব্ধি করল, এই মানুষটিকে প্রচন্ড ভালোবাসে নীরা। তাকে দেখা মাত্রই তীব্র অনুভূতিতে ঝাপসা হয়ে আসে সব। অন্তু শেরওয়ানিটা খুলে রেখে আলমারি থেকে টি-শার্ট, টাউজার বের করল। নীরার সামনে বিছানায় একটি সুতি শাড়ি রেখে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। পুরোটা সময় অন্তুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করল নীরা। অন্তুর বেখেয়ালি চাহনী। প্রশস্ত কাঁধ। অনাবৃত রোমশ বুক। কপালের কুঞ্চন থেকে শুরু করে হাঁটা-চলা সব। পনেরো মিনিটের মাথায় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো অন্তু। সারামুখে বিন্দু বিন্দু পানির ছঁটা। চুলগুলো ভেজা, অগোছালো। নীরা আবারও অপলক চোখে চেয়ে রইল অন্তুর চোখে-মুখে। তবে, অন্তুর মাঝে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। তার হাবভাব দেখে মনে হল, তার নিজস্ব বিছানায় নীরা নামক মেয়েটার বসে থাকা। তার দিকে অহর্নিশ চেয়ে থাকা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অতীতে ঘটেছে। নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটছে। ভবিষ্যতেও এমনটাই ঘটবে। অন্তু হাতের তোয়ালেটা চেয়ারের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। নীরার দিকে পিঠ ফিরিয়ে চুপচাপ বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। একটা বারের জন্যও নীরার দিকে চোখ তুলে তাকাল না। নীরার উদ্দেশ্যে একটা কথাও বলল না। নীরাও আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস পেল না। শুকনো মুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে অন্তুর দেওয়া শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। দরজা লাগানোর আগমুহূর্তেও অসহায় চোখে চেয়ে রইল সাদা টি-শার্ট গায়ে অন্তুর পিঠে।
মুখের সাজগোজ তুলে গোসল করে বেরুতে বেরুতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেল নীরার। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখল অন্তু ঘুমাচ্ছে। বিছানায় ফুলের অংশবিশেষও অবিশিষ্ট নেই। ধবধবে সাদা চাদরে, সাদা টি-শার্ট গায়ে ঘুমিয়ে আছে শ্যাম কালো এক যুবক। নীরা ধীর পায়ে বিছানার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। বামপাশে একজনের শোয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা রেখে ডানপাশ ঘেঁষে শুয়েছে অন্তু। বামহাতটা মাথার নিচে দিয়ে ডানহাতটাকে কপালের উপড় আড়াআড়িভাবে স্থান দিয়েছে সে। কপালটা হালকা কুঁচকে আছে। নীরা বুঝল, তার এই বিছানায়, অন্তুর পাশে ঘুমানোর অনুমতি আছে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসল। অভিমান ভরা চোখে অন্তুর মুখের দিকে চেয়ে রইল অল্প কিছুক্ষণ। বালিশ টেনে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়তেই টপাটপ চোখের জলে বালিশ ভিজল। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের বিছানায় এসে মনের একটা অংশ অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গেলেও অপর একটি অংশ খুব করে চাইতে লাগল, অন্তু তাকে জড়িয়ে ধরুক। বুকের খুব কাছে নিয়ে খুব যত্ন করে ঘুম পড়াক। কতদিন ঘুমায় না নীরা! অন্তু নাহয় এবার একটু ঘুম পাড়ানী ঔষধ হোক।
সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্তুকে বিছানায় পেল না নীরা। ঘড়ির কাটা তখন সাড়ে আটের ঘরে। নীরা দরফর করে উঠে বসল। হাতে-মুখে পানি দিয়ে বিছানা গোছাল। ঘড়িতে নয়টা বাজতে চললেও কেউ ডাকতে এলো না তাকে। নতুন বউ হয়ে নিজ উদ্যোগে বাইরে যাওয়া উচিত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অন্তুর দূর সম্পর্কের বোন দরজা থেকেই বাইরে আসার জন্য ডেকে গেল। নীরা অস্বস্তি আর অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘর থেকে বেরুতেই মহিলাদের ফিসফাস কানে এলো। রান্নাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল অন্তুর দুই ফুপু আর খালা। নীরাকে বেরুতে দেখেই চোখ কপালে তুলে বলল,
‘ নতুন বউয়ের কী এতো ঘুমালে চলে নাকি? আমাদের সময় ফজরের ওয়াক্ত উঠে মশলা বাটতে হয়েছে। একশো মানুষের রান্না করতে হয়েছে। নতুন বউ মশলা বাটতে পারো?’
নীরা মাথার কাপড় ঠিক করে নিয়ে মাথা নাড়ল। অন্তুর বড় ফুপু এক গামলা পেঁয়াজ, রসুন আর কাঁচা মরিচ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ এগুলো বেঁটে ফেলো তো। তোমাদের তো বৌভাত হচ্ছে না। আমরা আজই পত্রপাঠ বিধেয় হচ্ছি সব। যাওয়ার আগে অন্তুর বউয়ের হাতে রান্না খেয়ে যাই।হাঁসের মাংসটা মরিচ বাটা দিয়ে রাঁধবা। বড় ভাবি? দুপুরে অন্তুর বউ রাঁধব। আপনার ছুটি।’
কড়াইয়ে খুন্তি চালাতে চালাতেই মুখ ফিরিয়ে তাকালেন জাহানারা। থমথমে মুখে নীরাকে একবার পর্যবেক্ষণ করে আবারও নিজের কাজে মন দিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নীরাকে শীল-নোড়া ধরিয়ে দেওয়া হলো। নীরা টু শব্দ না করে মশলা বাটতে বসল। কাল নম্রতা-ছোঁয়া ফিরে যাওয়ার আগে জোরপূর্বক কয়েক লোকমা খাইয়ে রেখে গিয়েছিল তাকে। তখন মানসিক চাপ আর চিন্তায় খেতে পারেনি নীরা। গা গুলাচ্ছিল। মাথা ঘুরছিল। এখন ক্ষুধায় পেট জ্বালা করছে অথচ খাবার মুখে দেওয়ার উপায় নেই। অতোগুলো পেঁয়াজ,রসুন ছিলে বাটতে বাটতেই চোখ-মুখে জ্বালা ধরে গেল নীরার। এক পর্যায়ে হাতের মাংস পেশিগুলোতেও চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। হাতদুটো বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিল নীরা। কাঁচা মরিচ বাটতে গিয়ে কচি হাতদুটোতে যেন আগুন ধরে গেল। সেই সাথে ফুপু-খালা শাশুড়ীদের ঝাঁঝাল কথার তোড়ে চোখ ফেঁটে জল গড়াতে চাইল নীরার। ফুপু শাশুড়ী হৈ হৈ করে বললেন,
‘ এভাবে কেউ মশলা বাটে? সারা পাটায় ছড়িয়ে ফেলছে দেখি। কাজের মিল-মিছিল জানো না। আমাদের সময় হলে শাশুড়ী একদম মুখে গুঁজে দিত। আমাদের স্বর্ণা কি সুন্দর মশলা বাটে!’
এমন হাজারও কথায় বুকটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল নীরার। হঠাৎ করেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখে। বাবা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করেই অভাব-অনটনে পড়ে গিয়েছিল তারা। কত টানাপোড়েনে জীবন কাটাতে হয়েছে। খেয়ে-না-খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এতোকিছুর পরও মেয়ে দুটোকে বুকে আগলে বড় করেছেন মা। সময়ে-অসময়ে ঝাঁঝাল, ভারী কথাও শুনিয়েছেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই পরম মমতায় আগলে নিয়েছেন বুকে। হাত জ্বলার ভয়ে মরিচ কাটতে না দেওয়া তার মেয়েটি আজ মরিচ বাটতে বসেছে দেখলে কি মা আঁতকে আঁতকে উঠত না? মেয়ের জ্বালায়, মেয়ের আগেই কি তার চোখে জল টলমল করত না? নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নিচু করে অসহ্য জ্বালা আর ব্যথা সহ্য করতে করতেই বুঝল, বাড়ির বউ আসলে বাড়ির কেউ নয়। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এই সমাজের সবচেয়ে বড় অন্যায়। পরিষ্কার, ঝকঝকে পবিত্র সমাজটা কী অতোবড় অন্যায় করতে পারে? কক্ষনও নয়।
_
চোখের উপর কড়া রোদের ঝাপটায় ঘুম ভাঙল নাদিমের। পায়ের দুই আঙ্গুল দিয়ে জানালার পাল্লাটা ঠেলে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে উল্টো হয়ে শুল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পড়ে থেকেও ঘুমের দেখা পাওয়া গেল না। মাথা ঝিমঝিম করছে। একটু আগে খুব ফালতু একটা স্বপ্ন দেখায় মেজাজটা চটে গিয়েছে। স্বপ্নে বড় মামা হাসতে হাসতে রক্ত বমি করে পৃথিবী ভরিয়ে ফেলছেন। মানুষ কখনও হেসে হেসে রক্ত বমি করে কি-না জানা নেই নাদিমের। রক্তবমি কখনোই আনন্দের কোনো ব্যাপার নয়। বমি করাও যথেষ্ট পরিশ্রমের ব্যাপার। কাঁদতে কাঁদতে বমি করলেও ঠিক ছিল। কেউ হাসতে হাসতে বমি করবে কেন? আর বমি করলেও, বমিতে বমিতে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলতে হবে কেন? নাদিম বড় মামাকে বিশ্রী কিছু গালি দিয়ে উঠে বসল। স্বপ্ন নিয়ে থিওরিটা আজ মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে তার। মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বেখেয়ালে পাশের বিছানায় তাকাতেই চমকে উঠল নাদিম। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বুকে থুতু ছিটাল। বিশাল একটা হাই তুলে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল,
‘ ডর দেখাই দিছিলি, শালা।’
অন্তুর জবাব না দিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল। পায়ের জুতোটা নাদিমের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,
‘ তোর ভাষা ভয়ানক বাজে হচ্ছে দিন দিন। এতো অশ্লীল গালি আমি মনেও আনতে পারিনি কোনোদিন।’
নাদিম দাঁত বের করে হাসল। জুতোটা লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে বলল,
‘ আরে মামা! আমি সিঙ্গেল মানুষ হয়ে ঘুম থেকে উঠতে পারলাম না৷ আর তুই বাসর-টাসর সেড়ে ধানমন্ডি থেকে শাহাবাগ চলে এলি? বাহ্! রাতে কী ঘটল?’
কথাটা বলে ভ্রু নাচিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল নাদিম।
‘ ঘড়ি দ্যাখ বলদ। অলমোস্ট দেড়টা বাজে। তুই উঠিস নাই বলে যে সূর্য উঠে নাই এমন নয়। এতোক্ষণে দশবার বাসর করে ফেলা যাবে।’
অন্তুর কথায় শব্দ করে হেসে উঠল নাদিম। অন্তু চোখ পাকিয়ে বলল,
‘ হাসছিস কেন?’
নাদিম হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। কোনরূপ হাসি চেপে বলল,
‘ রাতে তাহলে এই ঘটল? দশবার! আমাদের নীরু তোর বউ বইলা কিছু কইতেও পারতেছি না। মনোভাবটা বুইঝা নে প্লিজ।’
কথাটা বলে আবারও দৈত্যর মতো হাসতে লাগল নাদিম। অন্তু পাশ থেকে বালিশ ছুঁড়ে মেরে বাজে একটা গালি দিল। নাদিমের হাসি যেন আরও বিস্তৃত হলো। ঠিক সেই সময় রুমের ভেতরে এলো রঞ্জন। হাতে খাবারের ব্যাগ। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানার উপর বসল। নিচু হয়ে জুতো খুলতে খুলতে বলল,
‘ এভাবে হাসছিস কেন? কি হয়েছে?’
নাদিম হাসি চেপে উঠে বসল। অন্তু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আবারও হেসে ফেলল। রঞ্জনকে পুরো ঘটনাটা রসিয়ে রসিয়ে শুনাতেই নিঃশব্দে হাসতে লাগল রঞ্জন। নাদিম বিছানা থেকে টুপ করে নেমে গিয়ে খাবারের ব্যাগটা তুলে নিল। ব্যাগের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল,
‘ কাহিনি কী?’
রঞ্জন সোজা হয়ে বসল। হেসে বলল,
‘ পূজা পাঠিয়েছে। আবার মাও প্যাক করে দিল। সব মিলিয়ে এতো খাবার হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট, ভাবলাম আজকের লাঞ্চটা আপাতত একসাথেই খাই। নমু-নীরা খায় না বলে মাংস আনিনি। রোস্ট, মাংসের ঝুল রেস্টুরেন্ট থেকে নিলেই হবে।’
নাদিম ততক্ষণে ঢাকনা খুলে ফেলেছে। আলুর একটা টুকরোও তুলে নিয়েছে হাতে। অন্তু বালিশে ঠেস দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসল। উচ্ছল হেসে বলল,
‘ ছোঁয়া থাকলে বলত, এই তুই হাত ধুয়েছিস? দাঁতও ব্রাশ করিসনি। ছিঃ কি জঘন্য! আমার তো ভাবতেই বমি পাচ্ছে।’
অন্তুর কথা বলার ঢং-এ হেসে ফেলল রঞ্জন। ফোন বের করতে করতে বলল,
‘ নমুকে ফোন লাগাই। হলে তো ঢুকতে পারবে না। ছোঁয়াকে নিয়ে লেকের পাড়ে চলে আসতে বলি। ছোটখাটো একটা পিকনিক হয়ে যাবে। খোলা আকাশের নিচে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা।’
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল রঞ্জন। অন্তুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কিন্তু নীরু?’
অন্তুর মুখটা চুপসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল,
‘ ফোন দিয়ে জিগ্যেস কর। আসতে চাইলে আমি গিয়ে নিয়ে আসব।’
নাদিম আলুর টুকরোটা চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ আসতে চাইলে মানে? অবশ্যই আসবে। আর ফোন দে মানে কী? তোর বউ তুই ফোন দিবি। রঞ্জনরে কস ক্যান?’
অন্তু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বউ টানোস ক্যান? বউ বাড়িতে, এখানে তো নয়। এই মুহূর্তে তোদেরও যা, আমারও তাই। আর দাওয়াত তো রঞ্জনের। আমার হলে নাহয় আমি ফোন দিতাম। রঞ্জনের দাওয়াত রঞ্জন দিব। তাছাড়া আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই।’
নাদিম কিছু বলতে গিয়েও বলল না। রঞ্জন দুই তিনবার ফোন দেওয়ার পরও নীরাকে ফোনে পাওয়া গেল না। নাদিম-রঞ্জন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অন্তুর দিকে তাকাতেই অস্বস্তিতে পড়ে গেল অন্তু। ঠোঁট দিয়ে জিহ্বা ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? বাড়ি ভর্তি মেহমান। নতুন বউকে এভাবে বের হতে দেবে বলে মনে হয় না। বড় ফুপু তো কেয়ামত করে ফেলবে। আমাকে কেউ কিছুই বলবে না, ঘুরেফিরে প্রশ্নের মুখোমুখি ওকেই হতে হবে।’
রঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাদিম রক্তিম চোখে চেয়ে রইল, কিছু বলল না।
_
দুপুরের খা খা রোদে, রিকশায় বসে অপেক্ষা করছে আরফান। গায়ে ঘর্মাক্ত সাদা শার্ট। আজ নম্রতা তাদের বাসায় যাবে বলে হাসপাতাল থেকে সোজা নম্রতাকে রিসিভ করতে এসেছে সে। শরীরে এক টন ক্লান্তি। নম্রতাকে সময় দিতে আজও দুপুরের দিকটায় ছুটি নিয়েছে সে। কয়েকদিন যাবৎ ঘন ঘন ছুটি নেওয়ায় হালকা ঝাঁঝাল কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। মেজাজটা খানিক চটে আছে। ব্যাপারটা তার ব্যক্তিত্বে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছে। গরমের মাঝে অপেক্ষা করতে করতে সেই রাগ, ক্ষোভ যেন তরতর করে বাড়ছে। আরফান কপাল কুঁচকে ঘড়ি দেখল। প্রায় সাথে সাথেই গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো নম্রতা। গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ। ফর্সা গায়ে রঙটা ফুটে উঠেছে। নম্রতাকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতে দেখেই বিরক্তিটা উবে গেল তার। নম্রতার শান্ত, স্নিগ্ধ মুখটা দেখে সমস্ত রাগ, মন খারাপ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নম্রতা রিক্সার পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আরফান একটু হেসে বলল,
‘ কী হলো? উঠুন।’
নম্রতা অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আরফান কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কোনো সমস্যা?’
নম্রতা আমতা-আমতা করে বলল,
‘ আজ না যাই?’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে? কাল তো আপনি নিজেই রাজি হলেন। তাহলে আজ কেন?’
নম্রতা প্রচন্ড অপরাধবোধ নিয়ে বলল,
‘ আসলে আজ রঞ্জন চলে যাচ্ছে। আবার কবে দেখা হবে, কে জানে? আজকের দুপুরটা ও…’
নম্রতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরফান শীতল কন্ঠে বলল,
‘ ফাইন।’
নম্রতা বুঝল আরফান রেগে গিয়েছে। নম্রতা মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ সরি! আপনি কী রাগ করলেন?’
আরফান অত্যধিক শীতল কন্ঠে বলল,
‘ না।’
নম্রতা কি বলবে বুঝতে না পেরে অসহায় চোখে চেয়ে রইল। আরফানের থমথমে, রক্তিম মুখ দেখে বুঝল আরফান প্রচন্ড রেগে আছে। সেদিনের থেকেও বেশি। নম্রতা কথা গুছিয়ে নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই রিকশা চালককে তাড়া দিয়ে জায়গাটা ছেড়ে গেল আরফান। ভদ্রতাস্বরূপ একবার বিদায়টা পর্যন্ত নিল না। নম্রতা মুখ কালো করে চেয়ে রইল। সাথে সাথেই বেজে উঠল ফোন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগল সে। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।
একই আকাশে চড়ে বেড়ানো ছয় রঙা উচ্ছল ঘুড়ি আজ সময়ের তালগোলে ক্লান্ত। আজও তারা একই সুতোয় গাঁথা। ভিন্ন স্বাদের ঘুড়িগুলো আজও একই টানে মত্ত। তবুও কোথাও একটা ছন্নছাড়া ঢঙ্কা। প্রাণপণে কাছে টানলেও দূরত্ব বাড়ার শঙ্কা। নতুন সম্পর্ক, নতুন সময়, নতুন স্বপ্নে তাদের আকাশটা আজ ভিন্ন থেকে ভিন্নতর। কারো আকাশে পরাধীনতার ছোঁয়া, কেউবা সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্লান্ত। কারো আকাশে স্বপ্নের ছোঁয়া তো কেউ সমাজের যুদ্ধে পরিশ্রান্ত। কেউবা অতীতের ঘ্যাঁড়াক্যাচে বন্ধী। আবার কারো আকাশে নতুন ভালোবাসার সূর্যোদয়।
#চলবে…..
[ বিঃদ্রঃ কিছুদিন যাবৎ লিখতে পারছি না। রাইটার্স ব্লকে আছি হয়তো। হাত চলে না। যা লিখি তা নিজেরই পছন্দ হয় না। তাই মাঝে দুদিন দিতে পারিনি। দুঃখিত।]