নীল চিরকুট পাঠ-৯

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

০৯.

ছাই রঙা বিশাল আকাশে রুটির মতো গোলকার এক চাঁদ। জ্যোৎস্না যেন ঠিকরে পড়ছে। সমুদ্রের হিংস্র ঢেউগুলোর গাঁ চিকচিক করে উঠছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয়। বিশাল ঢেউগুলো শুভ্র ফ্যানা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বালিময় তীরে। নগ্ন পায়ে অগোছালো পদক্ষেপগুলো জলের তোড়ে মিশিয়ে দিয়ে মহমান্বিত গর্জনে কাঁপিয়ে তুলছে চারপাশ। অন্ধকার মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছগুলো প্রচন্ড বাতাসে তির তির করে কাঁপছে। কাঁপছে নম্রতার লম্বা চুল, ওড়নার আঁচল। মুগ্ধ চোখদুটো তাকিয়ে আছে বহুদূরে। বিশাল আকাশ আর সমুদ্র, পরম ভালোবাসায় যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়েছে ঠিক সেখানটাতে। কী আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী! কী আশ্চর্য সুন্দর আকাশ আর সমুদ্রের এই স্বর্গীয় মিলন! নম্রতা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত রঞ্জন। চোখে-মুখে চাপা তৃপ্তির আভাস।

‘ কী করছ?’

‘ বিচে আছি। বালির ওপর খালি পায়ে হাঁটছি। যখনই ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই তোমাকে প্রচন্ড মিস করছি।’

ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠী অভিমানী কন্ঠে বলল,

‘ চাপা! মিস করছ না ছাই।’

‘ আরে! সিরিয়াসলি খুব মিস করছি। এই মুহূর্তে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি জানো, তোমার রঞ্জন মিথ্যা বলে না।’

ওপাশের কন্ঠস্বরটা এবার খানিক নরম হলো। আবেগী কন্ঠে বলল,

‘ আমিও।’

রঞ্জন মন খারাপ ভাব নিয়ে বলল,

‘ তোমাকে বললাম সাথে এসো। রাজি হলে না। কী হতো এলে?’

ওপাশ থেকে মৃদু হাসির শব্দ পাওয়া গেল। মিষ্টি কন্ঠে বলল,

‘ বন্ধুরা মিলে ট্যুরে গিয়েছ সেখানে গার্লফ্রেন্ডের কী কাজ? সবারই একটা পার্সোনাল স্পেস দরকার। আমি তোমায় ভালোবাসি বলে যে তোমাকে সবসময় আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখব তা ঠিক নয়। আমার বাইরেও তোমার একটা জগৎ আছে। বন্ধুমহল আছে। আমার সাথে কাটানো সময়গুলোতে যেমন তুমি শুধু আমার থাকো। আমাকেই ভাবো। তেমনই ফ্রেন্ডদের সাথে সময় কাটানোর সময় শুধু এই তুমিটা শুধু ওদের হয়েই থাকা উচিত। আমি সাথে থাকলে তুমি কাকে রেখে কাকে সময় দিতে?’

রঞ্জন হাসল। চাঁদের আলোয় ফর্সা মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। মুগ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ তুমি এখন সামনে থাকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে চুমু খেতাম তোমার গালে। এইজন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি পূজা। পরিস্থিতিগুলোকে এতো ভালোভাবে বুঝো কিভাবে বল তো?’

পূজা লাজুক হেসে বলল,

‘ কই বুঝি? তুমি আমায় যতটা বুঝো ততটা তো বুঝে উঠতে পারি না। আচ্ছা? তোমার বন্ধুরা নেই পাশে?’

‘ আরে নাহ। সব কটা নাক ঢেকে ঘুমাচ্ছে। বিচে শুধু আমি আর নমু। ওর নাকি ঘরে দম আটকে আসছিল। মেয়েটা ঠিকঠাক ঘুমায় বলেও মনে হয় না আমার। কতটা পাগল হলে কিছু চিঠিকে পুঁজি করে বছরের পর বছর অপেক্ষা করা যায় ভাবো!’

পূজা দুঃখী কন্ঠে বলল,

‘ ওর ডায়েরিটার জন্য খুব খারাপ লাগছে আমার। সেদিন সব শোনার পর কী মনে হয়েছিল জানো?’

‘ কী?’

‘ আমার কাছে ম্যাজিক থাকলে। চোখের পলকে ডায়েরিটাকে নদী থেকে তুলে হাতে ধরিয়ে দিতাম তার। খুব খুশি হতো না?’

রঞ্জন শব্দ করে হেসে উঠল। আদুরে কন্ঠে বলল,

‘ পাগলী।’

‘ আচ্ছা? ওই লোকটাকে কী কোনোভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না? আমি কালই পূজো দেব। প্রার্থনা করব নম্রতা যেন খুব শীঘ্রই তার পত্রপ্রেমিককে পেয়ে যায়। ভগবান আমার কথা না রেখে পারবেই না।’

‘ এইতো শুরু হলো তোমার অন্ধ বিশ্বাস।’

‘ আচ্ছা? তুমি কী নাস্তিক?’

‘ নাস্তিক কেন হব?’

‘ তাহলে সবসময় ধর্মের কথায় নাক সিটকাও কেন? জীবনেও তো মন্দিরে যেতে দেখলাম না।’

‘ নাস্তিক না হলেই তোমাদের মন্দিরে গিয়ে মাথা কুটতে হবে? কী আশ্চর্য! শুনো, আমি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি, একজন আছেন যিনি আমায়, এই পুরো সৃষ্টিজগৎকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু…. ‘

পূজা অধৈর্য্য হয়ে বলল,

‘ হয়েছে। আপনার এই যুক্তি বহুত শুনেছি। একদম মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দয়া করে, আমার বাবার সামনে এসব কথা বলো না। আমার বাবা কিন্তু গোঁড়া হিন্দু। তোমার এসব কথায় চেঁতে যেতে দু-মিনিটও লাগবে না।’

রঞ্জন প্রত্তিত্যুরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে নম্রতাকে দেখতে না পেয়ে আৎকে উঠে বলল,

‘ নমুকে আশেপাশে দেখছি না পূজা। আমি তোমাকে পরে কল করি?’

পূজা বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ সে-কি! আচ্ছা, ঠিক আছে। খুঁজে পেলে ইনফর্ম করো।’

‘ আচ্ছা।’

কথাটা বলেই তাড়াহুড়ো করে ফোন কাটল রঞ্জন। ভয়ার্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। যতদূর চোখ যাচ্ছে জনমানবহীন বালুকাময় তীর। মুহূর্তেই কোথায় চলে গেল মেয়েটা?

সমুদ্র তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর পৌঁছে গিয়েছে নিজেও জানে না নম্রতা। শুধু জানে সমুদ্র তাকে টানছে। অদ্ভুত সুন্দর এই জলরাশি জ্যোৎস্না স্নান করতে করতে নিবিড়ভাবে হাতছানি দিচ্ছে তাকে। পরনের লাল ওড়না আর লম্বা চুলগুলো উচ্ছল কিশোরীর মতো লাফালাফি করছে। শরীর থেকে ছিঁটকে হাওয়ায় হাওয়ায় মাতোয়ারা হতে চায়ছে। নম্রতা সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ উদাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই পানিতে গিয়ে দাঁড়াল। সমুদ্রের শীতল বাতাস ঝাপটে পড়ছে নম্রতার গায়ে। নম্রতা চোখ বোজলো। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে দু’পাশে দু-হাত প্রসারিত করল। নম্রতার মোমের মতো ফর্সা মুখটা চাঁদের আলোয় ঝলক দিয়ে উঠল। নম্রতার হঠাৎ করেই মনে হলো, সে উড়ছে। বাতাস, চুল, উড়নার আঁচলের সাথে তার হালকা পাতলা শরীরটাও যেন ভাসছে। চারপাশে সমুদ্ররাজ ভয়ানক গর্জন তুলে হাসছে। নম্রতার চোখের পাতায় ভেসে উঠল সে-ই আশ্চর্য সুন্দর দিনটি। নম্রতার ‘সে’ নম্রতাকে প্রেম নিবেদন করার পর পরই শুরু হয়েছিল তাদের সুখময় প্রেম। কী সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি। নম্রতা একবার খুব আবেগ নিয়ে লিখেছিল,

‘ শুনো,

আমরা একটা ঘর বাঁধব। ছোট্ট একটা ঘর। ছনের বনের চাল থাকবে। আধভাঙ্গা দেয়াল থাকবে। ভাঙা দেয়ালের ফাঁক গেলে এক পশলা জ্যোস্না আসবে। ছোট্ট ঘরের এক কোণায় পুরানো এক লন্ঠন থাকবে। হাতের তৈরি শিকা থাকবে। সেগুলোতে হরেক রকম রঙ থাকবে। আর শোন? পোষা একটা টিয়া থাকবে। আমাদের এই ছোট্ট ঘরে তারও ছোট্ট ঘর থাকবে। তুমি প্রতিদিন গঞ্জে যাবে…..আমার জন্য মুঠো ভরা লাল ফিতে আর আলতা আনবে। চাঁদের আলোয় গা ভিজিয়ে নদীর পানি ঝলমলাবে। সেই আলোতে মত্ত হয়ে আমার পায়ে আলতা আঁকবে। বৃষ্টি ভেজা রাতগুলোতে তোমার বুকে সিঁটিয়ে রাখবে। আর শোন? যখন ছোট্ট ঘরের পাঁচিল বেয়ে ঝরঝরিয়ে জল গড়াবে আমরা তখন ছোট্ট পাত্রে মিষ্টি সেই জল কুঁড়াব। আমাদের আধভাঙ্গা এক চৌকি থাকবে। নড়তে চড়তেই আনন্দে সে খিলখিলাবে। শক্ত একটা তোশক আর শিমুল তুলোর বালিশ থাকবে। সেই বালিশে মাথা রেখেই তুমি আমার মন ভুলাবে। ছোট্ট ছোট্ট হাঁড়ি-পাতিল আর ছোট্ট কিছু বাসন থাকবে। ছনের বেড়ায় গুঁজে রাখা ছোট্ট একটা আরশি থাকবে। মাঝ দুপুরে, তপ্ত সময় ফুঁড়ে দিয়ে প্রাণখোলে গান গাইবে। দুষ্টুমিতে মত্ত হয়ে ভালোবাসায় মাতাল হবে। আমি লজ্জা পাব, এত্ত এত্ত গাল ফুলাব। এই শুনছ তুমি? আমরা কিন্তু ছোট্ট একটা ঘর বাঁধব!

ইতি
শ্যামলতা’

চিঠিটা লিখে নম্রতার সে-কি লজ্জা। পাঠাবে কী পাঠাবে না সে নিয়ে কতো যে দুর্ভাবনা। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পাঠিয়েছিল নম্রতা। দু’দিনের মাথায় কাঙ্ক্ষিত উত্তরও পেয়েছিল। নীল কাগজের পরিবর্তে সাদা কাগজের জমিনে লাল আলতা দিয়ে লেখা হয়েছিল সেই উত্তর। চিঠির ওপর পেঁচানো হয়েছিল লাল ফিতা। লাল আলতায় গুটি গুটি অক্ষরে লিখেছিল,

‘ শ্যামলতা!

তুমি কী জানো? তুমি আমায় আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছ। আমি ঠিকঠাক পড়তে পারছি না। হুটহাট মন জুড়ে বর্ষা হয়ে ঝড়ে পড়ছ। সেদিন কী হয়েছিল জানো? গভীর রাতে আমি পড়ছি। ঘড়িতে একটা কী দুইটা বাজে। হঠাৎ দরজায় কড়া নেড়ে ঘুম ঘুম চোখে ডাকাডাকি করছে নিদ্রা। আমি বিস্ময় নিয়ে দরজা খুলতেই সে বলল, ‘ভাইয়া?তোর কী অসুখ করেছে? কখন থেকে পড়ার মতো সুর করে বলছিস “শ্যামলতা, শ্যামলতা”। কাহিনী কী?’ ওর কথায় আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। তুমি ভাবতে পারছ? আমি নাকি আধাঘন্টা যাবৎ পড়ার বদলে শ্যামলতা শ্যামলতা বলে জপ করছি অথচ আমি নিজেই জানি না। তারপর আবারও এক কান্ড ঘটালাম। কাল তোমার চিঠিটা পেয়েই ইচ্ছে জাগল তোমার পায়ে আলতা আর চুলে লাল ফিতা জড়াব। কিন্তু আমাদের এই অসম দূরত্বের প্রেমে সে এক প্রকার অসম্ভবই বলা চলে। কিন্তু মন বাবাজি সম্ভব-অসম্ভবের ব্যাখা শুনতে নারাজ। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আলতার রঙে চিঠি লিখব। সাথে থাকবে লাল ফিতে। এই আলতা জোগাড় করতে কত পেরেশানি করতে হয়েছে জানো? নিদ্রার যন্ত্রণায় ধরা খেয়ে গিয়েছি বাসায়। ছেলে পকেটে আলতা আর লাল ফিতা না ঘুরে বেড়াচ্ছে, মায়ের জন্য এ-যেন এক ভয়ানক কান্ড। বাসায় হুলস্থুল বাঁধিয়ে মান-সম্মান শেষ। কী লজ্জায় পড়তে হয়েছিল বুঝতে পারছ? দু’দিন ধরে সবাই কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। আমি তাকাতেই মিটমিট করে হাসছে। তুমি আমার কী ভীষণ সর্বনাশ করলে বলো তো? এই সর্বনাশটা কী করে ঢাকব আমি? আচ্ছা শ্যামলতা? এই সর্বনাশা সর্বনাশ ঢাকার পরিবর্তে সমান তালে আরও কিছু সর্বনাশ করে ফেললে কেমন হয়? শ্যামলতার সর্বনাশের দায় নিয়ে সর্বনাশা, সর্বগ্রাসী হওয়ার মতো প্রাপ্তি কী আর কিছুতে আছে?

বিঃদ্রঃ আলতা আর ফিতা কী তোমার পছন্দ হয়েছে? তোমার বাকি চাওয়াগুলো নাহয় দেখা হলেই পূরণ করব।

ইতি
শ্যামলতার ব্যক্তিগত সে’

চিঠির কথাগুলো মনে পড়তেই নম্রতার ফর্সা গালে লাল আভা ফুটল। পরমুহূর্তেই খিলখিল করে হেসে উঠল নম্রতা। সমুদ্রের গর্জনে চাপা পড়ে গেল সেই উচ্ছল হাসির শব্দ। ঠিক তখনই ডানহাতের বাহু ধরে হেঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে আনা হলো তাকে। বিস্মিত পুরাষালী কন্ঠ বলে উঠল,

‘ পাগল নাকি আপনি? তীরে লাল চিন্হ উড়ছে দেখছেন না? এখন ভাটার সময় । ঢেউয়ের টানে চোখের নিমিষেই হারিয়ে যেতে পারতেন। এই অসময়ে কেউ পানিতে নামে?’

নম্রতা চোখ তুলে তাকাল। কালো রঙের টি-শার্ট গায়ে সুঠাম দেহী এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখে মোটাফ্রেমের চশমা। চাঁদের আলোয় চেহারা ভালো বুঝা যাচ্ছে না। তবুও চিনে ফেলল নম্রতা। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

‘ আপনি!’

সামনে দাঁড়ানো মানুষটাও বোধহয় খানিক চমকাল। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ ওহ শিট্। আপনি লঞ্চের ওই পাগল মেয়েটা না?’

নম্রতা যেন আরও একটু জ্বলে উঠল এবার। তেড়ে এসে বলল,

‘ আমাকে দেখে পাগল মনে হয়?’

আরফান ভারি অবাক হয়ে বলল,

‘ মনে হয় মানে? আমি তো হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট শিওর যে আপনি পুরোদস্তুর পাগল।’

নম্রতার ডায়েরি হারানোর জ্বালাটা আবারও তীব্র রূপ ধারণ করল। আরফানের দিকে তেড়ে যেতেই দু’পা পিছিয়ে গেল আরফান। এমন সময় দূর থেকে দৌঁড়ে এলো তিনটি ছেলে। নম্রতার কাছাকাছি এসে হাঁটুতে ভর করে জোরে জোরে শ্বাস নিল। নাদিম কোমরে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল। গর্জে উঠে বলল,

‘ ওই হারামি! তোরে আজকে সমুদ্রের পানি খাওয়াইতে খাওয়াইতে মাইরা ফেলমু আমি। শালী! তোরে খুঁজতে গিয়ে জীবন শ্যাষ! রঞ্জন তো ভয় দেখায় দিছিল বাল। উফ! মাইয়া মানেই যন্ত্রণা।’

নাদিম থামতেই আরফানের পেছনে এসে দাঁড়াল একটি লোক। ফর্সাটে গোলগাল মুখ। চোখে-মুখে জ্ঞানী জ্ঞানীভাব। ফর্সা চামড়ায় লাল টকটকে ঠোঁট। লোকটি হালকা ঝুঁকে নম্রতাকে নিরক্ষণ করে বলল,

‘ আরফান? কি হয়েছে দোস্ত? এভাবে ছুটে এলি যে?’

বন্ধুর কথায় ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল আরফান। বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আর বলিস না। দু’দিন যাবৎ এক পাগলকে বাঁচাতে গিয়েই বারবার মানসম্মান খাওয়াতে হচ্ছে আমায়। ‘

‘ মানে? বুঝলাম না।’

‘ এই ভাটার সময়ে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র বিলাস করছিলেেন এই রমণী। আমি ভালো বুঝে বাঁচাতে গেলাম। সে উল্টো আমার ওপরই অখুশি। সাচ আ ফলিস গার্ল।’

নম্রতা আবারও তেড়ে গিয়ে বলল,

‘ খবরদার বাজে কথা বলবেন না। আমার অতো বড় একটা ক্ষতি করে এখন মহৎ সাজতে এসেছেন?’

আরফান দু-পা পিছিয়ে গিয়ে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

‘ দেখ নিষাদ। কেমন অসভ্য মেয়ে। কার্টেসী বলতে কিছু নেই। আমার ল্যাপটপটা ওভাবে ফেলে দিয়েও বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। ইচ্ছে করছে….’

নিষাদ হু হা করে হেসে উঠল। আরফানের কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকে শান্ত হতে বলল। নাদিম উশখুশ করে বলল,

‘ নমু? বাদ দে বইন। ঝগড়া টগড়া কইরা লাভ নাই। এই ভাই খুব একটা মিছা বলে নাই। তোর মাথায় এল্লা ওল্লা ছিট দেখা দিতাছে। এই রাইতে কেউ একলা একলা এতোদূর আহে? তারওপর পানিতে নামে?’

নম্রতা চোখ-মুখ লাল করে নাদিমের দিকে তাকাল। রঞ্জন এক পা এগিয়ে গিয়ে আরফানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ সৌভাগ্যবশত আপনাদের সাথে আবার দেখা হয়ে গেল। আর দূর্ভাগ্যবশত আবারও এমন একটা সীনক্রিয়েট হলো। সরি ভাইয়া, আসলে নমু একটু ডিপ্রেশড।’

আরফান কিছু বলার আগেই পাশ থেকে নিষাদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ ইট’স ওকে। সুন্দরী মেয়েদের টুকটাক ভুল মাফ করা যায়। আমি নিষাদ আহমেদ নিরব। বর্তমানে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার। আর ও হলো ডক্টর আরফান আলম। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে এসেছি। আর আপনারা?’

রঞ্জন ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু হাসল। বলল,

‘ আমি রঞ্জন চক্রবর্তী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি থার্ড সেমিস্টারে পড়াশোনা করছি। ওরা আমার বন্ধু। নাদিম হোসেন, অন্তু তালুকদার আর নম্রতা মাহমুদ। আমরাও ট্যুরে এসেছি।’

নিষাদ বিনয়ী হাসি দিয়ে বলল,

‘ তোমরা তো তাহলে আমাদের থেকে বেশ কয়েক বছরের জুনিয়র হবে। অলমোস্ট সাত/ আট বছর। তাই না আরফান?’

আরফান ভদ্রতার হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। দু’পক্ষের পরিচিতি পর্ব শেষ হতেই বিদায় নিয়ে যার যার হোটেলে রওনা হলো। হোটেলের পথে ফিরতে ফিরতে হঠাৎই প্রশ্ন করল নাদিম,

‘ ওই লেকচারটাকে তুই চিনিস নমু?’

নম্রতা অবাক হয়ে বলল,

‘ কোন লেকচারার?’

‘ আরে, একটু আগে কথা হইলো না? নিষাদ না বিষাদ নাম কইলো।’

নম্রতা আরেক দফা অবাক হয়ে বলল,

‘ আমি ওই ব্যাটাকে চিনব কেন?’

নাদিম কপাল কুঁচকে বলল,

‘ তাহলে ওই পোলায় তোরে চিনে কেমনে?’

নাদিমের কথায় তিনজোড়া চোখ তার উপর এসে নিবদ্ধ হলো। রঞ্জন চোখ ছোট ছোট করে বলল,

‘ ওই ব্যাটায় নমুকে চিনে তোরে কে বলল?’

‘ ফেরার সময় স্পষ্ট শুনলাম। এই লেকচারারে আরফান ভাইকে বলছে, ” রাগিস না দোস্ত। ছেড়ে দে। মেয়েটা আমার পরিচিত।” ‘

নাদিমের কথায় তিনজনই অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকাল। নম্রতার কপালে ভেসে উঠল চিন্তার ভাঁজ। এই লোক কী করে চিনবে তাকে? কই? সে তো চিনে না।

#চলবে…..

[ রি-চেইক করা হয় নি। গল্প দিতে দেরি হওয়ায় দুঃখিত। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here