নীড় পর্ব-১

0
4990

নীড়
রেশমী রফিক
১।।
ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র ছুটল তুবা। পেছনে ওর বান্ধবীরা হতবাক ওর এই কান্ড দেখে। দু’দিন যাবত কী যেন হয়েছে তুবার। সবাইকে এড়িয়ে চলছে। আগে এরকম ছিল না। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশতে, তাদের সাথে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে তারই সবথেকে বেশি আগ্রহ ছিল। সহজে বাসায় ফিরতে চাইত না। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, তুবার আম্মা। শেফালি আক্তার। তিনি জাঁদরেল স্বভাবের। ছেলেমেয়েদেরকে কঠিন শাসনে বড় করেছেন। এখন তুবা বাদে সবাই সাবালক। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিতও বলা যায়। তবু তার শাসনের বহর এতটুকু কমেনি। ছেলেমেয়েরা তাকে যমের মতো ভয় পায়। এখন অবশ্য তুবার ভাইবোনদের উপর দিয়ে তুফান কম যায়। তাদেরকে খুব একটা সামনাসামনি পান না তুবার আম্মা। তাই ইদানীংকালে তুবা হয়েছে তার টার্গেট। সারাক্ষণ ওকে ঝাড়ির উপর রাখাটাই তার একমাত্র কাজ যেন। মায়ের কড়া শাসনে তুবার জান ওষ্ঠাগত প্রায়। এখনও আঠারো হয়নি ওর। তবে শারীরিক গঠন বাড়ন্ত হবার কারণে দেখে মনেই হয় না, নাবালিকা। তাছাড়া, আঠারো পার হলেই যে মুক্তি পাওয়া যাবে, তার কোনো সম্ভাবনা নেই। এতকাল শাসনের বেলায় তুবার ভাইবোনদের সিরিয়াল থাকত আগে। তুবা ছোট মেয়ে বলে ওর দিকে অতটা মনোযোগ দিতেন না শেফালি। অন্য ছেলেমেয়েদের দিকেই কড়া নজর ছিল। তারা এক এক করে শাসনের পুলসিরাত পার করে গেছে।
ভাই পড়াশুনার পাট চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করেছে। মাসকয়েক পর বাবা হবে। তুবার বড় বোনের অনার্সে পড়াকালীন সময়ে বিয়ে হয়েছে। ডিপার্টমেন্টেরই এক বড় ভাইয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার। দুই পরিবার থেকে কেউ ওদের পছন্দ মেনে নেয়নি বলে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। সে অনেক আগের কথা। এখন ঝামেলা সব মিটে গেছে। দুই পরিবার বহুদিন যাবত রাগ করে থাকলেও ওদের প্রথম সন্তানের দুনিয়াতে আসার খবর পেয়েই ছুটে গেছে দুই হাত বাড়িয়ে। এরপর তুবার মেজ বোন দিবা, সেও কিছুদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছে। তার নিজের পছন্দ ছিল না, আবার বলা যায় পছন্দের বিয়েই এটা।
বড় বোন দিনার ওই ঘটনার সময় বাবা-মা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। মেয়েকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন ছিল অনেক। আর দশটা বাবামায়ের মতো মেয়েদেরকে কেবল শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সংসারের ঘানি টানতেই লালনপালন করানোর মানসিকতা তাদের নেই। ছেলে দিনার আর তিন মেয়ে দিনা, দিবা আর তুবাকে তারা কারও থেকে কোনো অংশে কম চোখে দেখে না। আজকালকার দিনে বাবামায়েদের মনে ছেলে আর মেয়েকে ঘিরে বৈষম্যমুলক মানসিকতা না থাকার ব্যাপারটা দুর্লভ। তুবার বাবা-মা সবসময়ই ছেলেমেয়েদেরকে সমান অধিকার দিয়েছেন, সমানভাবে বড় করেছেন। কখনো ছেলেকে আস্কারা দেননি, সে ছেলে বলেই এমনটা করতে পারবে। আবার কখনো মেয়েকে বাধা দেননি, সে মেয়ে তাই এমন করতে পারবে না। এমন মানসিকতার অধিকারী হবার পরেও দিনার এই ঘটনা তাদের মনে যথেষ্ট আঘাত দিয়েছে। সেসময়কার মুহূর্তগুলো দিনা দেখেনি। কিন্তু দিবা আর তুবা দেখেছে। ছেলেমেয়েদের সাথে সদা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা বাবা যেন হুট করেই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। আর মায়ের দুনিয়া থমকে গিয়েছিল। তাকে দেখে মনে হতো, পাজর ভাঙ্গা আহত একজন। দিবা সেসময় বেশ বড়। সে আর দিনারই তখন বাবামাকে আগলে রেখেছিল পরম মমতায়। সম্ভবত তাদের কথা ভেবেই দিবা কারও ভালো লাগার আহবানে সাড়া দেয়নি। মাথা নিচু করে কলেজ-ইউনিভার্সিটি পার করেছে। ভালো ছাত্রী হিসেবে সুনাম অনেক। গানও গাইতে পারে সুন্দর। কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে অনেকবারই পারফর্ম করেছে। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী আর শান্ত কোমল স্বভাবের এই মেয়েটা স্বাভাবিকভাবেই বহু ছেলের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। কিন্তু সে কখনোই কারও আহবানে সাড়া দেয়নি। একবার এক ছেলে তার জন্য এতই পাগল হলো যে, প্রত্যাখ্যাত হবার পর বাসায় হাজির হয়েছিল আচমকা। বুক ফুলিয়ে দিবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, কেন তাকে প্রত্যাখ্যান করা হলো। কোনদিক থেকে কমতি আছে তার? কেন সে সুপাত্র হতে পারল না দিবার চোখে?
দিবা তখন ভয়ে কাঁপছে নিজের ঘরে। ছেলের নাম সাইফুল। ওর বান্ধবী সায়রার বড় ভাই। একদিন ওদের বাসায় গিয়েছিল একটা দাওয়াতে। সেই যাওয়াটাই মরণকাল হয়েছিল। বাড়িভর্তি অপরিচিত মানুষ। তাই বান্ধবীরা সায়রার শোবার ঘরে আসর জমিয়েছিল। এক ফাঁকে ওয়াশরুমে যাবার দরকার হলো ওর। সায়রা ওকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে বের হবার পর আচমকা সব গুবলেট হয়ে গিয়েছিল। সায়রার ঘরে ঢুকতে গিয়ে পাশের ঘরটায় ঢুকে পড়েছিল। ওটাই সাইফুলের ঘর। দুপুরের খাওয়া শেষে সাইফুল প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাইরে বের হবার। বন্ধুদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। পেছনে বেগুনি জামা পরিহিত এক পরীকে দেখে তার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল।
দিবা তখনই চলে যাবার উদ্যোগ নিল। অস্ফুট সুরে ‘স্যরি’ বলল। কিন্তু তার আগেই সাইফুল এক লাফে পৌঁছে গেছে দরজার কাছে। দিবার পথ আটকে বলল,
– কে তুমি? চিনতে পারছি না।
দিবা মিনমিন করে উত্তর দিল,
– জি, আমি দিবা। সায়রার ফ্রেন্ড। আসলে ভুল করে এই ঘরে ঢুকে পড়েছি। সায়রার ঘর চিনতে পারিনি। প্রথম এসেছি তো এই বাসায়।
সাইফুল হেসে উত্তর দিল,
– ভুলটা হবার দরকার ছিল। নয়তো তোমাকে খেয়ালই করতাম না।
– মানে?
– মানেটা কি এখনই শুনতে চাও? তাহলে তো তোমাকে বসতে হবে এই ঘরে। কারণ মানেটা বলতে সময় লাগবে। এক কথায় বলা যাবে না।
– না না, ঠিক আছে। পরে শুনব একদিন। এখন যাই। আমার ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছে।
সাইফুল সেদিন আর কিছু না বলে পথ ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই প্রতিদিন সায়রাকে কলেজে পৌঁছে দেবার আর আনতে যাবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল। উদ্দেশ্য, দিবার সাথে দেখা করা। তখন হাই-হ্যালো বলা হতো বান্ধবীর বড় ভাইকে। মিষ্টি হেসে কুশল বিনিময় করত। একদিন কানাঘুষা শুনল বান্ধবীদের মধ্যে। সায়রা তাদেরকে বলেছে, দিবাকে নাকি ভাইয়ের বউ করবে। ওর ভাই দিবাকে পছন্দ করে অনেক। সেদিন থেকেই সে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে সায়রা আর ওর ভাইকে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সাইফুল যখন টের পেল এড়িয়ে যাওয়াটা, তখন সরাসরি পেছনে লেগে গেল। প্রায়ই কলেজ থেকে ফেরার সময় রাস্তা আটকাত। তখনই একদিন ওর বাড়ির ঠিকানা চেয়েছিল। সে ঘুরিয়ে কেবল বাসার লোকেশন বলেছে। বাড়ির হোল্ডিং নাম্বার দেয়নি। তবু এলাকার নাম জেনেই কীভাবে যেন ছেলেটা ঠিকানা অবধি চলে গেছে। আগে জানলে বলতই না বাসার কথা। এখন সে হুট করে বাসায় চলে আসায় শেফালি আক্তার ক্ষেপে গেছেন। মেয়েকে একদফা ঝেড়েছেন। দিবা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলেছে,
– আমার কথা বিশ্বাস করো, আম্মা। ওই ছেলের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। ওই ছেলে আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছে কয়দিন। আমি তাকে মানা করছি। বলছি, প্রেমটেমের মধ্যে আমি নাই। ফ্যামিলির পছন্দের বিয়ে করব।
– তাইলে ওই ছেলে বাসায় আসলো কেমনে? তুই ওরে ঠিকানা না দিলে কই থেকে পাইছে? আকাশ থেকে তো টুপ করে পড়ে নাই।
– আম্মা, আল্লাহর কসম করে বলতেছি আমি ওই ছেলেকে বাসায় আসতে বলি নাই। ঠিকানাও দেই নাই। শুধু একদিন বলছিলাম, আমাদের বাসা মধুবাগ, খেজুর গাছের গলিতে। তারপর কেমনে কী বের করছে, আমি জানি না।
শেফালি অত সহজেই ক্ষান্ত হবার নন। মেয়েকে একচোট থাপ্পড় মেরে, আচ্ছামতো শাঁসিয়ে এরপর বসার ঘরে গেছেন। সেখানে দিবার বাবাকে নিজের আর নিজ পরিবারের বৃত্তান্ত শোনাচ্ছিল সাইফুল। শেফালি ওখানে গিয়েই তাকে দিলেন এক ধমক,
– অ্যাই ছেলে, তুমি এইখানে বসে কী করতেছ? কে সাহস দিছে তোমাকে এই বাসায় আসার? কতদিন ধরে দিবার সাথে সম্পর্ক চালাইতেছ? দিবা তো বলল, সে নাকি তোমাকে চিনেই না।
সাইফুল পালটা জবাব দিল,
– আন্টি আপনার মেয়ে ভীতুর ডিম। আমার সাথে কথাই বলে না ঠিকমতো। আমাকে দেখলেই দৌড়ে পালায় জানি আমি ওকে কামড় দিব। আমাকে চিনতে হলে তো আমার সাথে কথা বলতে হবে, তাই না? তাকে আজ পর্যন্ত একটা কফিশপেই ডেকে বসাইতে পারি নাই।
– ভালো করছে। কেন যাবে দিবা তোমার সাথে কফিশপে? কান খুলে শুনে রাখো। আমরা ভদ্রলোক। আর ভদ্রলোকের মেয়েরা কখনো কোনো ছেলের সাথে কফিশপে যায় না। প্রেমও করে না। তুমি দিবার পিছনে ঘুরাঘুরি ছাড়ো। আর যদি কোনোদিন দেখছি দিবার আশপাশে ঘুরঘুর করতেছ, ঠ্যাং বাড়ি দিয়া ভাইঙ্গা ফেলব। আমাকে চিনো নাই এখনো!
– কিন্তু আন্টি, আমি দিবাকে ভালোবাসি। (চলবে)
পরের পর্ব রাত নয়টায় পোস্ট করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here