নীড় পর্ব-৪

0
2168

নীড়
রেশমী রফিক
৪।।
আর দশটা বিয়েতে সচরাচর যা হয়, দিবার বিয়েতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সাইফুলের কাজিনরা সবাই তক্কে-তক্কে ছিল, হবু ভাবির বোন বা কাজিনদের সাথে স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি করার। সেই দলে শারারও ছিল। তবে তুবাকে কেউ টার্গেট করেনি। একে তো ছোট মেয়ে, স্কুল পেরিয়েছে মাত্র। তার উপর স্বাস্থ্যবতী। শাড়ি পরায় তাকে রীতিমতো মুরব্বি মনে হচ্ছিল। যেন দিবার বড় বোন। ওকে দেখে বরপক্ষের অবিবাহিত ছেলেরা হতাশ। কিন্তু বৌভাতের দিন কীভাবে যেন শারারের সাথে আলাদাভাবে পরিচয় হলো। কোনো এক ব্যস্ত ক্ষণে তুবা কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে শারারের কাছে এসে বলল,
– ভাইয়া, একটা কথা ছিল। একটু শুনবেন?
– হ্যাঁ, বলো।
– ইয়ে, একটু পারসোনাল।
খানিকটা অবাক হলেও শারার চেহারায় প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক সুরে বলল,
– বলো, কী পারসোনাল?
– আপনার একটু ওদিকে আসতে হবে যে!
শারারের ইচ্ছে ছিল না কোথাও যাবার। বিয়েবাড়ির হৈ-হুল্লোড়ের শেষ দিনে যারপরনাই ক্লান্ত সে। বৌভাতও প্রায় শেষ। একটু পরই নবদম্পতিকে নিয়ে রওনা হবে মেয়েপক্ষ। তবু ভদ্রতাবশত বলল,
– আচ্ছা চলো।
বিশাল কনভেনশন হলের এক কোণে বুফের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার পেছনেই খানিকটা এগোলে রেস্টরুম। তুবা ওদিকে রওনা হলো। শারার পিছু নিল ওর। একটু আড়ালে গিয়ে বলল,
– আপনি গত পরশু স্বর্ণা আপুকে চিঠি দিয়েছিলেন না?
শারার ঢোক গিলল। ঘটনা কিঞ্চিৎ সত্যি, পুরোপুরি না। ভাবির মামাত বোন দেখতে সুন্দরী আর স্মার্ট। গায়ে হলুদের দিনই তাকে দেখে বরপক্ষের ছেলেদের চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল। মেয়েটাও রহস্যময়ী সেজে চোখের সামনে ঘুরঘুর করছিল। এরপর বিভিন্ন ছুঁতোয় কথাবার্তা হয়েছে। ব্যক্তিগত কিছু না, এমনিই দুই পরিবারের নতুন আত্মীয়তার সুবাদে নিজেরা পরিচিত হওয়া। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। এরপর শারারের চোখে আটকে গেছে আরেকজন। তার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ মেলেনি বিধায় চিঠি লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেই চিঠি স্বর্ণার কাছে গেছে, এই খবর জানা ছিল না তার। কনেপক্ষের একটা ছোট্ট ছেলের হাতে দিয়েছিল চিঠিটা। নির্দিষ্ট মেয়েটাকে দেখিয়ে তার হাতে পৌঁছে দিতে বলেছিল। তখনই গড়বড় হয়েছে কোনো।
শারার মিনমিন করে বলল,
– ইয়ে, মানে চিঠিটা আসলে…
– স্বর্ণা আপুর হাত থেকে চিঠিটা মামির হাতে পড়েছে। মানে যার মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন, সে মামির সামনেই স্বর্ণা আপুকে বলেছে তার জন্য চিঠি আছে। এরপর মামি সেই চিঠি নিয়ে গেছে। ওটা পড়ার পর ক্ষেপে বোম্ব হয়েছে। ভাগ্যিস আপনি শেষে নাম লিখেননি। নইলে খবর ছিল।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল শারারের। তাড়াহুড়ো করে চিঠি লিখেছিল। ভুল করে নাম লেখা হয়নি। সেটাই শাপে বর হয়ে গেছে। যাক, আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। এটাই শুকরিয়া। কিন্তু এই মেয়ে কী করে জানল চিঠিটা সে লিখেছে? আরেকবার ঢোক গিলে বলল,
– কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে চিঠি আমি লিখেছি? মানে নাম তো ছিল না।
– নাহিনের কাছে দিয়েছিলেন না? নাহিনই আমাকে বলেছে। বেচারা ভয়েই শেষ। কারণ মামি যদি ওকে টাইট করে ধরে কে দিয়েছিল চিঠি জানতে, তাহলে সে চেপে রাখতে পারত না।
– ওহ। টাইট করে ধরেনি তাহলে?
– না। ছোট্ট মানুষ তো। মামি শুধু জিজ্ঞেস করেছে কে দিয়েছে। ও তো আপনার নাম জানে না। তাই বলেছে, সাইফুল ভাইদের বাড়ি থেকে এসেছিল একটা ছেলে। সে দিয়েছে।
– ওহ।
– আজকে নাহিন আপনাকে দেখামাত্রই চিনেছে। স্বর্ণা আপু তো ওকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল আপনি দেখতে কেমন। গায়ে হলুদে কী কালারের পাঞ্জাবি পরেছিলেন, বিয়ের দিন কী পরেছিলেন। নাহিন স্পেসিফিক কিছু বলতে পারেনি। আপনাদের তো গায়ের হলুদ আর বিয়ের জন্য ড্রেস কোড ছিল। সবাই এক ধরনেরই পরেছিলেন।
– হ্যাঁ।
– এজন্য আজকে আপনাকে দেখেছে নাহিন। কিন্তু স্বর্ণা আপুকে গিয়ে বলবে সেই উপায় নেই।
– কেন?
– মামি তো স্বর্ণা আপুকে একটুও সরতে দিচ্ছে না। একদম বগলদাবা করে রেখেছে। তার ধারণা, আপনি মানে যে ছেলে চিঠি দিয়েছে, সে আজকে আপুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে। তখন হাতেনাতে ধরা হবে। এইজন্য আপুকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না।
– ওহ।
– নাহিন আপনাকে দেখার পর বলেছে বল্টুকে। বল্টু বলেছে স্বর্ণা আপুকে।
শারারের গলা শুঁকিয়ে যাচ্ছে। সামান্য চিঠি লেখার কারণে এভাবে প্যাঁচ লাগবে, আগে জানলে এই কাজ করতই না সে। যাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখেছে, তার নেই খবর। সবাই পড়েছে স্বর্ণাকে নিয়ে। যেন স্বর্ণা ছাড়া আর কোনো মেয়েই নেই এই দুনিয়াতে। যাকগে, আপাতত অল্পের জন্য বেঁচে গেছে এটাই রক্ষা। তাই ক্ষীণ সুরে বলল,
– এরপর? স্বর্ণা নিশ্চয়ই মামিকে বলে দিয়েছে?
– না, স্বর্ণা আপু আমাকে পাঠিয়েছে চেক করার জন্য। বল্টু আর নাহিন দূর থেকে আপনাকে দেখিয়ে দিল।
– ওহ। না আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কী, আমি চিঠি লিখেছি এই কথাটা ঠিক। কিন্তু স্বর্ণাকে লিখিনি। নাহিন ভুল মানুষকে চিঠি দিতে গেছিল।
তুবা চোখ কপালে তুলে বলল,
– স্বর্ণা আপুকে চিঠি লিখেননি? তাহলে কাকে লিখেছেন?
কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল শারার। একবার বেঁচে গেছে, তার মানে এই না আবারও বেঁচে যাবে। এই মেয়েকে সত্যিটা বললে আরেক ঝামেলা হবে কি না কে জানে! তাই বলল,
– ইয়ে, এত কিছু এভাবে বলা পসিবল না। তাও আজকের দিনে, এই পাবলিক প্লেসে। তোমার মামি বা অন্য কেউ আমাদেরকে এভাবে কথা বলতে দেখলে আবার কী না কী ভাববে। তুমি কি মোবাইল ইউজ করো? মানে তোমার মোবাইল নাম্বারটা দিবা? তাহলে ফোনে বলতে পারতাম।
তুবা আর কথা না বাড়িয়ে চটজলদি নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছিল। এরপর শারারের সাথে কথা হয়েছে দু’দিন পর। মেয়েটা কে, এখনো জানা হয়নি। তবে শারারের সাথে সাবলীল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। শারার জানিয়েছে, পছন্দের মেয়েকে প্রপোজ করতে তুবার সাহায্য দরকার। সেই সুত্র ধরেই কিছুদিন ধরে নিয়মিত দেখা করতে হচ্ছে শারারের সাথে। মোবাইলে কথা বলা খুব একটা নিরাপদ না বাসায়। শেফালি এখনো জানেন না তার ছোট মেয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। জানতে পারলে কাহিনি খতম হয়ে যাবে।
তুবাকে এই ফোন দিয়েছে দিনার। গত বিয়েবার্ষিকীতে সে আইফোন উপহার পেয়েছে স্ত্রীর কাছ থেকে। এর কিছুদিন পরেই তুবার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হলো। এ গ্রেড পেয়েছে সে। পরিবারের সবাই খুশি। বাবা ওকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিল। মা কিনে দিল নতুন পড়ার টেবিল। দিবার বিয়ের পর তার রুমটা ওকে নতুন আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়ে দেবে, এই কথাও বলল। দিনা বেশ দামি একটা গাউন কিনে দিয়েছে। তার বর বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে একটা সুন্দর ডিজাইনের হাতঘড়ি। দিবা তার গল্পের বইয়ের কালেকশন পুরোটাই দান করেছে। বিয়ের পর এমনিতেও এই কালেকশন তুবার হবে। তবু আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হলো আর কী। আর সাইফুল নিজ খরচে একদিন বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল নুহাশ পল্লীতে। দিনারের স্ত্রী যদিও তুবাকে একটা পারফিউম উপহার দিয়েছে, তবু বড় ভাই হিসেবে সে আলাদা কিছু দিবে ভেবেছিল, তবে সেটা তুবার নিজ পছন্দ অনুসারে। সবাই উপহার দিয়েছে যার যার সামর্থমতো। তুবার সেই উপহার পছন্দ হয়েছে কি না, কেউ জানতে চায়নি। তাই তুবাকে জিজ্ঞেস করেছিল কী চাই তার। তুবা আবদার করল, বাবা-মাকে ওর পক্ষ হয়ে ফোনসেট কিনে দেবার কথা বলতে হবে। বাবাকে বলা যায়। কিন্তু মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনের ‘ফ’ও উচ্চারণ করতে পারবে না দিনার। তার আগেই মায়ের ঝাড়ি খেয়ে কাপড় খারাপ হয়ে যাবে। এখন তো আর ছোট নয় সে। মায়ের ধমক খেয়ে কাপড় ভেজানো মানে ইজ্জতের দফারফা। আর আদৃতা আশপাশে থাকলে সাড়ে সর্বনাশ। এমনিতেই মাকে বিষম ভয় পাওয়া নিয়ে আদৃতা প্রায়ই ব্যঙ্গ করে ওকে। এদিকে তুবা এত করে অনুরোধ করেছে। এভাবে কখনোই কিছু চায়নি ছোট বোনটা। এজন্য তার কথাও ফেলতে পারছে না। অগত্যা, মা যেন জানতে না পারে এই শর্তে একটা সিমকার্ড আর নিজের পুরনো মোবাইল ফোন দিয়েছে দিনার। তুবা সেটা লুকিয়ে রাখে কলেজের ব্যাগের ভেতর। দিদারুল সাহেব অবশ্য জানেন মোবাইলের কথা। রিচার্জ করতে যে টাকার জোগান লাগে, সেটা তার পকেট থেকেই যায়। প্রতি মাসে মেয়েকে তিনশ টাকার একটা রিচার্জ কার্ড কিনে দেন তিনি। এই টাকা দিয়েই পুরো মাস পার করতে হয় তুবাকে।
তুবা শুরুতে আগ্রহী ছিল না শারারের প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কিত ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে। এমনিতেই তার পরিবারে প্রেম সম্পর্কিত অঘটনের নেতিবাচক প্রভাব আছে। বড় আপুকে আর বড় দুলাভাইকে এখন পরিবারের সবাই মেনে নিলেও কোথায় যেন সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে গেছে। কিংবা বলা যায় রঙ ফিকে হয়ে গেছে। বড় আপুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও কিছু একটা ঠিক নেই, বুঝা যায়। মেজ আপু এই ভয়ে প্রেম-ভালোবাসার আশপাশ দিয়ে যায়নি। সাইফুল ভাইয়ের কাহিনি অবশ্য আলাদা। ওই হিসেব করে লাভ নেই। বড় ভাইয়া পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছে। তুবার যদিও খুব ভালো লাগে সাইফুল ভাইকে। উনার মতো সাহসী কেউ তার জীবনে আসুক, এমনটা মনে মনে কামনা করে। কিন্তু ওই মন পর্যন্তই। মনের কথা বাইরে আসার সুযোগ দেয় না। এর উপর যদি শারারের কাহিনি কোনোভাবে টের পান শেফালি, পুরো কথা ঠিকঠাক শোনার আগেই চিৎকার দিয়ে পুরো বাংলাদেশ বয়রা বানিয়ে ফেলবেন। তারপরের কাহিনি কল্পনা করতে গেলেও শিউরে উঠে তুবা। কিন্তু শারার এতবার অনুরোধ করল, এত করুণ সুরে বলল, সে মানা করতেই পারল না। অতঃপর যা থাকে কপালে, ভেবে মাঠে নেমে গেছে। নিজের তো প্রেম করার ভাগ্য হবে না। নাহয় অন্যের প্রেম জুড়তে একটু অবদান রাখল।
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here