নীড় পর্ব-৩

0
2616

নীড়
রেশমী রফিক
৩।।
কলেজ গেট থেকেই রিকশা নিল তুবা। এখান থেকে কর্ণফুলী গার্ডেন শপিং সেন্টার খুব দূরে না। হেঁটেই যাওয়া যায়। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটলে বড়জোর পনেরো বিশ মিনিট লাগবে। আধঘন্টাই ধরে নেয়া যায়, ব্যাপার না। তবু সে রিকশায় চড়ল। এই সময়ে রিকশা ভাড়া বাঁচানোর চাইতে নিজেকে আড়াল করাটা বেশি ফরজ। রাস্তাঘাটে কখন কে দেখে ফেলবে, আল্লাহ মালুম। যদিও এই ভরদুপুরে এদিকে ওর পরিচিত কারও আসার কথা নয়। সেদিকে ও তবু সাবধানের মার নেই।
চৈত্রের কাঠফাঁটা রোদে চারদিক পুড়ে যাবার জোগাড়। সুর্যটা যেন মাথার ঠিক উপরেই তাতাচ্ছে। গরমে প্রাণ আইঢাই করছে। তবু রিকশার হুড তুলে দিল সে। ব্যাগ থেকে সাদা ওড়না বের করে মাথায় জড়াল। এই ওড়নাটা হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। বলা যায় না, কেউ যদি হুট করে ওকে রিকশায় দেখে ফেলে, তাহলেও চিনতে পারবে না। কারণ সবাই জানে ওর কলেজ ইউনিফর্মের সাথে সাদা ওড়না নেই। যদিও কলেজের অনেকেই ওড়না পরে। কিন্তু সে পরে না। বাসায়ও এই নিয়ে তাকে কেউ কিছু বলেনি।
কর্ণফুলী গার্ডেন শপিং সেন্টারে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগল না। রিকশা থেকে নামার আগেই চকিতে কবজি উল্টিয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখল তুবা। একটা পনেরো বাজে। এখনো পনেরো মিনিট বাকি আছে। যাক, শারার ভাই আসার আগেই তিনতলায় গিয়ে সুস্থির হয়ে বসতে পারবে কোনো টেবিলে। ভাড়া মিটিয়ে মাথার উপর ওড়নাটা আরেকটু টেনে নেমে পড়ল সে। এদিক-ওদিক এক ঝলক তাকিয়েই সোজা শপিং সেন্টারের ভেতর ঢুকে গেল।
শারার হচ্ছে তুবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আরেকটু ভালো করে বললে, ওর মেজ বোনের শ্বশুরবাড়ির দিকের। সাইফুল ভাইয়ের ফুপাতো ভাই। দিবার বিয়ের সময় তাদের প্রথম দেখা। এর আগেও তুবাদের বাসায় এসেছিল শারার, দিবার পানচিনির দিনে। এরপর কালেভদ্রে মামাতো ভাইয়ের সাথে হবু ভাবির বাড়ির সামনে এসেছে। কিন্তু তুবার সাথে অত ভালোভাবে দেখা হয়নি। দেখা হলেও ভীড়ের মধ্যে আলাদা করে পরিচয় ছিল না। অবশ্য দিবার বিয়ের আগে তুবাকে আলাদা করে লক্ষ করার মতো কোনোকিছু ছিলও না। সাধারণ এক স্কুল ছাত্রী। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী বলা যায়। তবে আহামরি কিছু না। বাড়ন্ত শরীরের কারণে তাকে কমবেশি সবাই ভুটকি, মুটকি নামে ডাকে। দিবা নিজেই ডাকে, অ্যাই মুটকি শোন! তুবা ছোটবেলা থেকে তার শরীর নিয়ে অনেক খোঁচামারা কথা শুনেছে। এসব শুনে অভ্যস্ত সে। তাই অন্যসব মোটা মেয়েদের মতো তার আঁতে ঘা লাগে না। এক কান দিয়ে ঢুকায়, অন্য কান দিয়ে বের করে। শেফালি মাঝেমধ্যে ওকে বলেন ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে। তাও খুব একটা জোর দেন না। মেয়ে এমনিতেই পড়াশুনা নিয়ে সারাদিন দৌঁড়ঝাঁপ করে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া হয় না। বাইরের ছাইপাশ খেয়েও যে পেট ভরে, তা নয়। এরপরও যদি ওজন বাড়তি থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে ওটাই শরীরের গড়ন। তবে ঘরের মধ্যে তিনি তুবাকে একটু-আধটু বললেও বাইরের কেউ যদি তুবার স্বাস্থ্য নিয়ে টু শব্দ করে, পালটা শুনিয়ে দেন মেয়ে মোটা হয়েছে ভাগ্যগুণে। চাইলেই যেমন কেউ চিকন হতে পারে না হুট করে, তেমনি ইচ্ছে থাকলেও তুবার মতো মোটা হবার সাধ্য কারও নেই। আল্লাহ পৃথিবীতে যাকে যেমন করে পাঠিয়েছেন, তার উপর তো কারও হাত নেই। তাই মেয়ে মোটা নাকি চিকন তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। রইল বাকি মেয়ের বিয়েশাদি। ভাগ্যে থাকলে তার মোটা মেয়েকেই রাজপুত্র বিয়ে করবে। ভাগ্যে না থাকলে করবে না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটা জিনিস আল্লাহর হাতে। মানুষ কোনোভাবেই এগুলো পরিবর্তন করতে পারবে না। অতএব, মেয়েকে যতই ঘষেমেজে পরিপাটি আর হুরপরী বানিয়ে ফেলেন না কেন, কপালে যেখানে জোড়া লেখা আছে, সেখানেই বিয়ে হবে। বাইরে গলাবাজি করলেও মায়ের মন। একটু খুঁতখুঁত তো করবেই। তাই বলে মেয়ের উপর চাপ দেবার মতো মানুষ তিনি নন।
সম্ভবত একারণেই শারার আগে লক্ষ করেনি তুবাকে। কিংবা লক্ষ করলেও পাত্তা দেয়নি। এখানে এই বেচারাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। তুবার নিজ বংশেই কেউ চোখ তুলে তাকায়নি। আর শারার তো পরের বংশের ছেলে। মূলত দিবার বিয়ের অনুষ্ঠানেই তুবা সবার নজরে এসেছে। বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে শাড়ি পরেছিল। পারলার থেকেও সাজতে চেয়েছিল। শেফালি নিষেধ করেছেন। দিবার গায়ের রং একটু চাপা। চেহারাও আছে মোটামুটি। সেই তুলনায় তুবা ধবধবে ফর্সা। হোক না বহু আগের বিয়ে ঠিকঠাক, তবু বিয়ের আসরে কোনোরকম অঘটন যাতে না ঘটে, সেজন্য তুবাকে পারলারে যেতে দেননি।
আসলে এই ভাবনা শেফালির ছিল না। বিয়েবাড়িতে আগত আত্মীয়স্বজনদের আলোচনার মূল প্রসঙ্গ ছিল, দিবার চাইতে তুবা দেখতে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে দিনকে দিন। বলা ভালো, তিন বোনের মধ্যে তুবাই সবথেকে বেশি সুন্দরী। শরীরের ওজন যদি একটু কম হতো, তাহলে অনায়াসেই তাকে বলিউড নায়িকাদের সাথে এক কাতারে দাঁড় করানো যেত। তারাই মুলত শেফালির কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেছে যাতে বিয়ের আসরে তুবাকে কোনো অবস্থাতেই দিবার চাইতে বেশি সুন্দর না লাগে। তার উপর দিবা পণ করে বসেছিল, পারলারে সাজবে না। সাইফুল নাকি নিষেধ করেছে। দিবার আসল রুপটাই তার বেশি ভালো লাগে। তা লাগুক। তাই বলে বিয়ের অনুষ্ঠানে কনে সাজবে না এটা কোনো কথা? কনে নিজে সাজগোজ না করলে তো মেহমানদেরও সাজগোজ করা হবে না। আর বিয়েবাড়ি মানেই সাজসজ্জার পশরা। শেষমেশ দিবাকে রাজি করানো হয়েছে, পারলার থেকে পার্টি মেকআপ করবে। যাকে বলে হালকা সাজ। আর চুলটা সুন্দর করে বাঁধবে। সাইফুল চুলের ব্যাপারে কিছুই বলেনি হবু স্ত্রীকে। হয়তো সেটাও বলত। কিন্তু তার আগেই শাশুড়ির কঠিন ধমক খেয়ে ঠান্ডা মেরে গেছে। বলা বাহুল্য, হবু শাশুড়িকে যমদূতের চাইতেও বেশি ভয় পায় সে। কবে কোনকালে জীবনমরণ পণ করে দিবার বাসায় গিয়েছিল। সেদিন অত সাহস কোথা থেকে পেয়েছিল, নিজেও জানে না। হয়তো প্রেমে পড়লে সাহসের লেভেল এমনিতেই ধাই ধাই করে বাড়ে, অথবা সেদিন তার উপর প্রেমদেবতা বা জ্বিন জাতীয় কিছু ভর করেছিল। সেদিনের পর সাহসের পারদ আবার ধুপ করে নেমে গেছে। এরপর ওর বাবা-মাই যা করার করেছেন। ওকে আর দজ্জাল শাশুড়ির মুখোমুখি হতে হয়নি। পানচিনির দিন সে একবারও চোখ তুলে শাশুড়ির দিকে তাকায়নি। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে রেখেছিল। পানচিনি হবার পরও সবসময় চেষ্টা করেছে শেফালির মুখোমুখি না হবার। দিবার সাথে দেখা করতে হলে বাসার সামনে এসে কল করেছে, অথবা চুপিচুপি বাড়ির ছাদে চলে গেছে। খুব বেশি দরকার না পড়লে বাসার ভেতর পা দেয়নি। তবে শেফালি বিভিন্ন উপলক্ষ্যে হবু জামাতাকে দাওয়াত করতেন। কখনো একাকি, কখনো সপরিবারে। সাইফুল সবসময় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে।
যাকগে, শেষ অবধি দিবা পারলার থেকে পার্টি মেকআপ করেছিল। আর তুবাকে পারলারেই যেতে দেয়া হয়নি। ওর মন খারাপ হয়েছিল খুব। দুনিয়াতে বোধহয় সে-ই একমাত্র পোড়াকপালী, আপন বোনের বিয়েতে পারলারে সাজার ভাগ্য তার হয়নি। মামাত বোন, স্বর্ণা সাজিয়ে দিয়েছিল কোনোরকম। বাসাভর্তি মানুষজনের সামনে মায়ের ঝাড়ি খাবার ভয়ে ওতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। হাজার হলেও এখন আর ছোট নয় সে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ছে। এখন কি বাইরের মানুষের সামনে মুখ ঝামটা খেলে ইজ্জত থাকবে? উহু, অবশ্যই না।
তবে আত্মীয়স্বজন যে যাই বলুক, তুবাকে যাকে দিবার চাইতে বেশি আকর্ষণীয় না দেখায়, সেজন্য যত রকমের চেষ্টাই করা হোক না কেন, সব বিফলে গেছে। ঘরোয়া সাজেও তাকে যথেষ্ট সুন্দরী লাগছিল। শাড়ি পরাতে রীতিমতো বিয়েবাড়িতে আগত মেহমানদের সুনজরে পড়ে গিয়েছিল। সবারই চোখ ঘুরে ঘুরে ওকে দেখেছে। সবার মনেই এক প্রশ্ন, এই পিচ্চি হুট করে এত বড় হয়ে গেল কীভাবে? শেফালির গর্ব হচ্ছিল মেয়েকে নিয়ে। ফাঁকতালে দিবার জন্যও টেনশন হচ্ছিল। দিদারুল সাহেব অবশ্য কাছের আত্মীয়দের এসব ফালতু কানপড়া তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। শেফালিকে বারবার আশ্বস্ত করছিলেন, বিয়েতে কোনো অঘটন ঘটবে না। ঘটলেও তার জন্য তুবা দায়ী থাকবে না। কারণ আল্লাহ যার সাথে যার জোড়া লিখে রেখেছিলেন, তার সাথেই তার বিয়ে হবে। এখানে মানুষের কিছুই করার নেই। তবু মায়ের মন বলে কথা।
(চলবে)
পরের পর্ব রাত নয়টায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here