নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব_২৩

0
869

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২১

জাফর সাহেব জর্ডান যাওয়ায় বাসা পুরু ফাঁকফাঁকা হয়ে গেল। অন্যত্রে শ্রেয়া রোগীর ন্যায় বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে আছে। তার চোখ হতে জল উপচে পড়ছে। আজকের নিশিরাত্রিটি তার জন্য কাল হবে বুঝতে পেরেছে সে!
পরণে তার পরীবৎ সবুজ রঙের জামদানি শাড়ি। কিঞ্চিৎ পূর্বে সে তিন কবুলের অপরিস্ফুট কণ্ঠের দ্বারা মনের থেকে হাতে কলমে সাক্ষর করে সদ্য স্ত্রী হয়েছে রাজিবের। জাফর সাহেব যাওয়ার পর সময় বিলম্ব করেনি সে। কোনো রুপ বনিতা,ক্রোধহীন কাজ সেরেছে! তার পরিচিত বন্ধু ও বান্ধবীকে নিয়ে এসেছিল বিয়ের সাক্ষীস্বরুপ। কাবিননামায় শ্রেয়ার হাতের উপর হাত রেখে কলম দিয়ে সাক্ষর নিয়েছে। বিনিময়ে প্রতিবাদ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ পায়নি শ্রেয়া। অসহায়,নিরব নড়বড়ে মন নিয়ে চেয়ে ছিল রাজিবের দিকে। আজ থেকে সে রাজিবের স্ত্রী হিসেবে পরিচিত হবে! আরভীককে চাওয়া মানে পরপুরুষের পিছনে কুকুরের মত ধুলচাটা। নেহাৎ সে অসুস্থ! নতুবা রাজিবকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়তো। গটগট করে কারো সচল পায়ের শব্দ শুনে কেঁপে উঠে শ্রেয়ার শরীর। মন যেন তার নিয়ন্ত্রণহীন হলো! রাজিব হাস্যমুখশ্রী নিয়ে শ্রেয়ার রুমে ঢুকে দরজা শুদ্ধভাবে আঁটকে দেয়। তার পাশ ঘেঁষে শায়িত করে নিজ দেহকে। ঢোক গিলে শ্রেয়া। চোখ দিয়ে সে বহু কথা বুঝিয়ে দিতে চাইছে। তবুও রাজিবের নয়নে কোনো রুপ কথন বাক্যের ধারা দৃষ্টপাত হচ্ছে না। বরঞ্চ সে নেশার ঘোরে চেয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে। পুরু রমণীকে আগুনের ন্যায় উজ্জ্বল আবেদনময়ী লাগছে!
তাকে ধরে হেলান দেওয়ায় কাঠের সঙ্গে। গাল বাকাঁ হলে কি হবে শরীরটাও অবশ তার। রাজিব তার হাত ধরে হাতের পিঠে গভীর চু’মু একেঁ নেশামগ্ন কণ্ঠে শুধায়।

‘তুমি এখন থেকে আমার বউ। আরভীকের নামও যেন তোমার মুখে না শুনি। তাহলে কিন্তু তুমি আমার ভয়ানক রুপ দেখতে পাবে। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি কত খেলা খেলেছি সেটা শুধু আমিই জানি। চিন্তে করো না তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর তুমি সুস্থবল হয়ে উঠবে। ততদিন তুমি আমার কাছে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকবে। তোমাকে সেই মেডিসিন দেব যেটা খেলে তোমার শরীর অবশ থাকবে কিন্তু তোমার ক্ষতি হবে না। লাভ ইউ ডেয়ার।’

রাজিবের কথা শুনে শ্রেয়ার চোখ কপালে উঠার মত উপক্রম। ঠোঁট কামড়ে কিছু বলার অবকাশ প্রকাশ করছে। কিন্তু রাজিব তার মনের উৎফুল্লতায় বিরাজিত। ফলে পাত্তা দিল না শ্রেয়ার মনের কথা। সে জড়তাহীন, বৈধতার সাপেক্ষে শ্রেয়ার ওষ্ঠদ্বয়ে তার পরম প্রণয়স্পর্শী ওষ্ঠ মিলিয়ে দেয়। শ্রেয়া চোখ বুজে নেয়। সে ব্যর্থ মনের প্রচেষ্টায় নেতিয়ে রইল রাজিবের সম্মুখে। অন্যথায় রাজিব স্বেচ্ছায় শ্রেয়ার সন্নিকটে গিয়ে পরণের শার্ট খুলে উম্মুক্ত করে দেয় তার লোমশ বুক। শ্রেয়ার সবুজ শাড়ির আঁচল সরিয়ে দেয়। রাজিব তার নিজের বুকের মধ্যিখানে শ্রেয়াকে আগলে বিয়ের প্রথম মধুররাত্রিতে আদিম খেলায় মেতেঁ উঠে। অনিচ্ছার সত্ত্বেও শ্রেয়া চোখ বুজে বাড়ন্ত রাত্রির মাঝে তার সতিত্ব বিসর্জন দেয় স্বামীর নিকট। রাজিব তার স্ত্রীর নেশায় উম্মাদের মত মগ্ন রইল।

৪১.
আশফি আজ পুরুটা দিন আরভীক এর সঙ্গে কথা বলেনি। কেননা আরভীক তাকে না বলে অফিসে গিয়েছে। ফলে তার আশফির অভিমান ভাঙ্গতে বেশ কাঠখোড় পুড়াতে হয়েছে। আশফি বিনিময়ে খিলখিল করে হেসে প্রমিজ করিয়েছে যে আজ সেও অফিসে যাবে। অতঃপর অঞ্জয় আশফিকে নিয়ে তার কেবিনে খেলছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তবুও অফিসে বসে কাজ করে শান্তি পাচ্ছে না আরভীক। চোখে চোখে হারায় তার বউপাখিকে। অথচ গর্দভ বউ সাংসারিক মেয়ের মত বাসায় বসে খালি ফোন টিপে।
ফোন দিলে কড়া ভাষণ শুনায়! একটু মিষ্টিমুখ করে কথাও বলে না। এ নিয়ে ভীষণ বিরক্ত সে। ভাবনার জগৎ এ ভাবার পরিবর্তেও সে কম্পিউটারে হাত চালাচ্ছে। লেটেস্ট কারর্স ডিজাইন অঙ্কন করে সংরক্ষণ করে রেখে ছিল। এর ফাইল জরুরি ভিত্তিতে জমা দেবে সুইজারল্যান্ডের কারর্স কোম্পানির নিউ ক্লাইন্টের নিকট। তাদের ভাষ্যমতে আরভীক এর কোম্পানির সঙ্গে ডিল করার অর্থ হলো লাভবান হওয়া। বিধেয় ক্লাইন্টস হাতচ্ছাড়া করেনি। অঞ্জয়ের কোলে জড়ে আছে আশফি। ঠোঁট চেপে মুখ ফুলিয়ে চেয়ে আছে তার আরভীক বাবাইয়ের দিকে। সে আদু আদু কণ্ঠে আরভীককে ‘বাবাই’ ডাকে। শুনতে বেশ লাগে তার। তবে আনজুমাকে ‘মাম্মা’ ডেকেই অভ্যস্ত আশফি। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুষতে থাকে। যার লাভা অঞ্জয়ের শার্টের কলারে মাখামাখি হয়ে আছে। বেচারা বাচ্চা না পেলে বড় হয়েছে, এখন বাচ্চা পালতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
ভেজা জুবুথুবু মনে হচ্ছে তার নিজেকে। শার্টের কলার ভেজে পুরু গলায় আঠালো ভাব ছড়িয়েছে। আমতা আমতা কণ্ঠে তার বসের দিকে চেয়ে বলে,

‘স্যার আশফি বাবুকে সোফায় রাখি।’

‘না তোর কোলে রাখ। দেখিসনি ক্লাইন্টর্স সোফায় বসে টসে ঘষেঁ মেজে জীবাণু করে ফেলছে। আশফিকে রেখে ওর শরীরে জীবাণু ঢুকলে তোর খবর আছে।’

ব্যস অঞ্জয়ের মুখ হা থেকে বন্ধ হয়ে গেল। নিশ্চুপে দাঁড়ানো থেকে বসে যায় চেয়ারে। আশফি আঙুল চুষে চুষে তার বাবাইয়ের ডেস্ক থেকে পেন্সিল,কলম ধরে আকাঁবুকিঁ করে। অঞ্জয় টেবিলের সাইডে আশফিকে বসায়। কেননা তার ফোনে কল এসেছে। আড়চোখে কলে থাকা ব্যক্তির নাম খেয়াল করে আরভীক। ‘আনজুমা ভাবী’ লিখা দেখে নিবিড় রইল। অঞ্জয় ফোন রিসিভ করলে অপরপ্রান্ত হতে আনজুমা ফিসফিসিয়ে বলে,

‘দেবরজী আপনার খচ্চর বস কি করছে!’

অঞ্জয় ঢোক গিলে বাঁকা চোখে তার বসের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নুয়ে নেয়। তার ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘বস কাজ করছে এবং আশফি আমার কাছে খেলছে।’

‘গুড আশফি বাবাকে একটু বাসায় এনে দাও না দেবরজী।’

নিরবধি চাহনী নিয়ে বসের দিকে তাকায়। ততক্ষণে আরভীক এর কাজ সম্পূর্ণ হওয়ায় সে থুতনীর উপর হাত রেখে তার দিকেই চেয়ে ছিল। বসের গাম্ভীর্য চাহনী দেখে থতমত খেল অঞ্জয়। অপরপ্রান্ত থেকে বিনয়,অনুনয়ের কণ্ঠে সে ভেবে ছিল আশফিকে দিয়ে আসবে! এখন সেটাও মন থেকে জোরসরো করে মুছে ফেলল। কেননা বসের শান্ত চাহনীর মধ্যে অপরপ্রান্তের ব্যক্তির জন্য নেতিবাচক উত্তর অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে হলোও তাই আরভীক ঠেসমার্কা গলায় শুধায়।

‘চ্যাম্প তখন যাবে,যখন আমি চাইবো ইজ দ্যাট ক্লিয়ার!’

কথাটি শুনে অঞ্জয় বিতৃষ্ণর্তার নয়নে চেয়ে আশফির সঙ্গে খেলায় মেতেঁ রইল। কল কাট করে দেয় আনজুমা।
ক্ষুধার্ত হওয়ায় অঞ্জয়ের পেটে ইঁদুর দৌড়ছে। আরভীক হাতের কাজ সেরে আশফিকে কোলে উঠিয়ে নিল। অঞ্জয়কে ইশারায় খেতে যেতে বলে। ছাড়া পেয়ে ভৌ দৌড়ে চলে যায় সে। আনমনে হেসে দেয় আরভীক। আশফি মুখ ফুলিয়ে আদু বুলিতে আওড়ায়।

‘বাবাই মাম্মা যায়।’

‘না তোমার ঐ পচাঁ মাম্মা তার বাবাইয়ের কথা শুনে না।’

‘খাবো।’

‘খাবো’ শব্দটি শুনে আরভীক ফটাফট হা করে তাকায়। একদম তার মত হয়েছে আশফি। বাবা যেমন খাদক আশফিও তেমন খাদকের ছেলে আহা জিও আরভীক জিও! সে চিন্তামুক্ত টিফিন বক্স খুলে। পূর্বেই আশফির জন্য খাবার নিয়ে এসে ছিল। বাপ-ছেলে বসে আড্ডার সহিত খাবার খাচ্ছে। আশফিকে খাওয়ানো শেষ হলে হুরমুড়িয়ে কেবিনে প্রবেশ করে আনজুমা। মুখের মধ্যে ঘামের ন্যায় লালাক্ত আভা ফুটে উঠেছে, ধরধর করে শ্বাস ফেলছে সে। ‘মাম্মা’ কে দেখে আশফি হাত নাড়িয়ে ‘মাম্মা মাম্মা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে। আরভীক খেয়াল করলেও প্রথমত না দেখার ভান করে ছিল।
আশফি দেখে নেওয়ায় মজার দৃশ্যটি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল না। আনজুমা প্রশান্তির চোখে বাবা-ছেলের খাওয়ার দৃশ্য দেখে খুশি হলো। তবে ইতস্ততঃ বোধ করছে টিফিন ব্রেকে হঠাৎ চলে আসায়।
আরভীক গলা ঝেড়ে তার উপস্থিতি জানান দেয়।

‘মিসেস ফাওয়াজ কে আজ খুব হ’ট লাগছে।’

‘আপনার মুন্ড লাগছে।’

‘আমার মুন্ডর ভেতরে কিন্তু হ’ট হ’ট কথাবার্তাও থাকে। যাহার খবরও তোমার নেই রমণী।’

‘ওহ প্লিজ জানতেও চাইনা। আপনার ফাজলামি অসহনীয়।’

‘মিসেস ফাওয়াজ আই অর্ডারিং ইউ। প্লিজ টেক মাই ওয়ার্ডস ইন ইউর মাইন্ড এন্ড হার্ট। সবসময় ফাজলামি সহ্য করা শিখে নাও। না হলে আমি ফাজিল হয়ে যাব হেহেহে।’

কথাটি বলে আরভীক চওড়া হেসে টুপ করে ওষ্ঠের ছোঁয়া একেঁ দেয় আনজুমার গালে। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে জেন্টালম্যান হওয়ার ভান করে। গালে হাত রেখে আনজুমা হা করে তাকায়। রাগান্বিত রুপে চেঁচিয়ে বলে,

‘আর ডেয়ার ইউ টু কিস মি!’

কথাটি পছন্দ হলো না আরভীক এর। অতিষ্ঠ ভরা চোখে চেয়ে কপাল চাপড়ে বলে,

‘তোমাকে কিস না করলে কি পাশের কলিগ কাজলকে কিস করব!’

‘ছিহ্ পরকীয়া পুরুষগিরির লক্ষণ দেখাবেন আরকি।’

‘পরকীয়া কয় করলাম! আমার শখ নেই তোমাকে ছাড়া অন্য মেয়ের ধারপ্রান্তে ঘেঁষাঘেঁষি করার। তুমি হলেই হবে প্রণয়োণী।’

‘সুয়াইব।’

‘ইয়েস!’

আতঙ্কিত উত্তেজনাপ্রবণ দৃষ্টিতে তার স্বামীর দিকে তাকায় আনজুমা। সে ‘সুয়াইব’ বলে ডেকেছে যার প্রত্যত্তুরে আরভীকও সায় দিল। আরভীক নিজেই যখন খেয়াল করল। তখন আমতা আমতা করে মাথা নেড়ে বলে,

‘আই মিন হু ইজ সুয়াইব! তোমার হাজবেন্ড ঐ। সে কেনো আমি হতে যাবো। আমি তো আমিই, সে তো সেই।’

‘কেনো যেন লাগছে আপনিই সেই।’

খাবার মুখে পুরে নেয় আরভীক। তখনি তার গলায় মাছের কাটা আঁটকে যায়। কাশতে আরম্ভ করে। গলা চেপে বেসিনের সামনে গিয়ে গড়গড়ে মাছের কাটা মুখ থেকে বের করে। আনজুমা আকস্মিক কাশির ঝংকারে চিন্তিত হয়ে এগিয়ে যায় তার স্বামীর নিকট। তার পিঠে আলতো স্পর্শ দিয়ে মালিশ করে দেয়। যেন ব্যথিত না হয়। আরভীক কাটা বের করে দীর্ঘ শ্বাস নেই। খাবার আর খাবে না ভেবে নেয়। আড়চোখে তার প্রণয়োণীর দিকে অপলকে চেয়ে থাকে। তার খুব করে বলতে ইচ্ছে করে, সেই যে তার প্রণয়রাজ। তার এককালীন স্বামী ছিল,যার নতুন চেহারার বিনিময়ে নতুন রুপে হাজির হয়েছে। অন্যথায় সে বলতে পারছে না। বাধ্য সে, কেননা কার্য অসম্পূর্ণ রেখে রহস্যের সমাপ্তি ঘটাতে পারবে না। গলায় গুরুগম্ভীরতা ফুটিয়ে এনেছে সে। আনজুমার বাহু ধরে অনড় উপায়ে চেয়ারে বসায়। সে হাটুগেরে বসে হাতজোড়া আঁকড়ে কিঞ্চিৎ সময় অপরুপী শ্যার্মেরাঙা নারীর দিকে চেয়ে বলে,

‘যদি কখনো জানতে পারো আমিই সুয়াইব তখন!’

কথাটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর পরিধি আকাশসম আনজুমার কাছে। হৃদপিন্ডের ভাঙন তাজা হলো! ক্ষতবিক্ষত হওয়া সম্পর্কের ইতি টানেনি কখনো সে। অথচ মরণ টেনে নিয়ে ছিল তার স্বামীকে। বিধেয় সে অনুরাগে ভরা নয়নে বলে,

‘তাহলে আমি আপনাকে খুন করে দেব। সত্য চুপিয়ে রেখে সামনে এলে।’

‘ওহ আর যদি পুরু ঘটনার তদন্ত করে এলে, তখন কি করবে!’

‘ক্ষমার মত মাফ চেয়ে নিলে, ক্ষমা করে বুকের বাঁ পাশে মধ্যে আবদ্ধ করে নেব।’

‘তাও যদি না বলি এবং তুমি অন্য কারো কাছ থেকে জানতে পারলে তবে।’

অপ্রত্যাশিত সত্যতার কারণে উত্তেজনা ভরা দৃষ্টিতে আনজুমার উত্তরের অপেক্ষায় কেঁপে উঠছে আরভীক। তার গলা ধরে এসেছে। কান্নারা কি এই হৃদয় নিঙানো পুরুষের চোখ বেয়ে পড়বে! নাকি পাখির অনু মেলে মুক্ত হয়ে অবয়বে মান্য হবে। আনজুমার প্রতি আরভীক এর অপেক্ষার মান দীর্ঘ হওয়ায় খেয়াল নেই তাদের একটি বিষয়ে। ছোট অবুঝ আশফি যার হাসিতে পুরু রুম মুখরচিত হয়। তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে আছে আলিশান রুমের মধ্যে থেকে। আনজুমা তার কাপাঁন্বিত ওষ্ঠদ্বয়ের মধ্যিখান হতে শব্দের বাক্যধার বের হবার পূর্বেই দরজায় কটকটিয়ে শব্দের কড়াঘাত হলো। ধ্যান ফেরে দুজনের মনের থেকে। আরভীক হাটু মোড়া থেকে দাঁড়িয়ে যায়। শুদ্ধি, পরিস্ফুট মনে আনজুমার দিকে চেয়ে ‘কামিং’ বলে।
ফাহাদ তার বন্ধুর অফিসের রিসেপশনিস্টের
কাছ থেকে শুনে নিয়ে ছিল। আরভীক তার রুমে স্ত্রীর সঙ্গে আছে।
ফলে গত বউরাতের অনুষ্ঠানে লজ্জাজনক ব্যাপার ঘটায় শরমের ঠেলায় বন্ধুর মুখোমুখি হতে বিবেক দিয়ে ভাবে। তবে ফাহাদ কোনো মজাঠাট্টা করতে আসেনি। সে এসেছে জরুরি তলব আদায় করার তাগিদে। ইতিমধ্যে কে যেনো ফাঁস করেছে ইনসার্চ কলিগের মৃত্যু পা পিছলে ক্রংক্রিটের উপর পড়ে হয়নি। বরঞ্চ কথাটি ছিল বিন্যস্ত এক অভিনয় মাত্র। এর মূল প্রেক্ষাপটের রচয়িতা সম্পর্কে অবগত করতে আরভীক এর সঙ্গে তলব করতে এসেছে। আনজুমা উঠে মাথার হিজাব টেনে আশফিকে কোলে নেওয়ার জন্য এগোয় টেবিলের দিকে। যেখানে বসে আশফি খেলছিল। কিন্তু টেবিলের কোণায় আশফিকে না দেখে চিৎকার করে ‘আশফি’ বলে ডেকে উঠে। সবেই পানি পান করতে গ্লাসটি হাতে নিয়ে ছিল আরভীক। আচমকা আনজুমার চিৎকারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে লেপ্টে জড়ে নেই তাকে। তার গালে হাত রেখে পুরু রুমে শঙ্কিত নয়নে দৃষ্টি বুলায়। না, নেই তার আশফি! কই গেলো সে।
আনজুমা ভাবমূর্তি হয়ে আরভীক এর গলা আকঁড়ে ধরে অনুরোধময় গলায় শুধায়।

‘আশ আশফি কোথায় দেখুন না প্লিজ!’

কথাগুলো দলা পাঁকিয়ে আসছে আনজুমার কণ্ঠনালী হতে। আরভীক তার মুখশ্রী হাতের আদলে নিয়ে আশ্বস্ত করে সে আশফিকে খোঁজে বের করবে। উচ্চস্বরে ‘অঞ্জয়’ বলে ডাক দেয়। সঙ্গেই উপস্থিত হলো সে। কেননা আশফি হারানোর খবর ছড়িয়ে গিয়েছে অফিসে। ফাহাদ এসে নিশ্চুপে বিষয়টি লক্ষ করে তৎক্ষণাৎ অফিসের ম্যানেজারকে ব্যবস্থা নিতে বলে। এ্যালার্ম বেল বেজেছে, মাইকে এনাউন্সমেন্ট করা হচ্ছে,
‘আরভীক স্যারের ছেলে নিখোঁজ। সবাই অনুগ্রহ করে খোঁজ লাগান।’

আরভীক মাইকের এনাউন্সমেন্টে কোমল,শান্ত কণ্ঠে শুনে চোখ বুজে দহনময় শ্বাস নিল। সে গিয়ে তার মাইক স্পিকার অন করে তিক্ষ্ণ কণ্ঠনালী ধারা বয়ান করে।

‘যে আমার সন্তানকে কুড়িয়ে নিয়েছেন, ভালোই ভালোই হাতের নাগালে এনে দেন। না হলে সব কটাকে আস্ত রাখব না।’

ভয়ানক কথাগুলো আওড়ে স্পিকার বন্ধ করে দেয়। আনজুমা ঠাইঁ দাঁড়িয়ে রইল। অঞ্জয়কে নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলে,

‘তোর ভাবীকে বাসায় পৌঁছে দেয়! আপাত ড্যাডকে আশফি নিখোঁজের কথা জানাস না। বারণ করছি। নেহাৎ তিনি শ্বাসকষ্টের রোগী। না হলে আশফির খবর খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপারই না তার পক্ষেও।’

অঞ্জয় বসের কথা অনুযায়ী আনজুমাকে আলতো করে ধরে গাড়িতে বসায়। ফাহাদ শঙ্কাময়ী কণ্ঠে শুধায়।

‘ইনসার্চের মৃত্যু ক্রংক্রিটে পড়ার কারণে হয়নি ডুড! তাকে খুন করা হয়েছে। তার পোস্টমোটার্ম রিপোর্ট পেয়েছি। সেখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা আছে দিস ইজ এ মার্ডার। এক্সিডেন্টের কোনো লক্ষণ নেই। অথচ ফাস্ট ডক্টর চেক করে স্ফট এক্সিডেন্ট ডেড বলে ছিল।’

কপাল চুলকে শান্তভাবে পায়চারী করে আরভীক। আশফি নিখোঁজ , ইনসার্চ কলিগের মৃত্যু রহস্য। যার বিন্দুমাত্র আঁচটুকু নেই ফাহাদের। সে চিন্তায় দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত চিন্তার লক্ষণ হলো নখ খাওয়া। ওয়াক্ ওয়াক্ করে মুখে থাকা নখগুলো ডাস্টে ফেলে। আরভীক কি ভেবে যেন ফোনটা হাতে নিয়ে কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করে ফোনের দিকে দৃষ্টপাত রাখে।
মুহুর্তের অবিলম্বে হঠাৎ আননোন নাম্বর থেকে কল এলো। শ্লেষ্মাহীন মনে ফোনটি রিসিভ করে। দুপ্রান্তের মানব জড়ত্বে মন্থর,মৌনতা পালন করে। আরভীক আগ বাড়িয়ে বলার মত মানুষ নই। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কল কাটতে নিলে অপরপ্রান্তের ব্যক্তি বলে,

‘আশফি আমার কাছে!’

সূচালো পুরুষের কণ্ঠনালী কানে বাজতে লাগে আরভীক এর। কাঠিন্য দৃষ্টিতে ফ্রেমে বন্দি আশফির ছবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘ওহ আচ্ছা তারপর।’

‘এককোটি লাগবে !’

‘ওয়াট এককোটি জীবনে বাপের ঘরেও দেখেছিস। আমি নিজেই কোম্পানিতে চাকরী করে হাজারখানেক টাকা পাই। আর তোর কিনা বা’লের কোটি টাকা লাগবে বলিস।’

অপরপ্রান্তের ব্যক্তি হকচিয়ে উঠে। ক্ষণিক তিক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধায়।

‘টাকা না পেলে তোর ছেলেকে বেছে দেব।’

আরভীক বাঁকা হেসে ত্যাড়া দাঁতের ভাব নিয়ে চুল ধরে শক্তপোক্তভাবে টান লাগায়। ব্যথা না পেয়েও মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। ‘আউচ’ শব্দ করে বলে,

‘চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম তোকে। যদি আমার ছেলেকে বেছে দেখাতে পারিস। তবে তোকে ছাড় দেব। আর যদি আমি তোকে খুঁজে পায়। বিশ্বাস কর জ্যান্ত রেহাই পাবি না। গট ইট ইন ইউর মাইন্ড লুজার বয়।’

ফোন কেটে শয়তানি চেহারায় ফাহাদের দিকে তাকায়। সে হতবুদ্ধির ন্যায় তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে তার বন্ধুর মাথার তার ছেঁড়া। কি’ডনা’পারকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিল সে। তাও আবার আশফিকে বিক্রি করতে পারলে তাকে নাকি ছাড় দেবে! কথাগুলো বদ’হজম’শীল। সে নিজেও ধারণা করে কুল পাচ্ছে না আশফি কোথায়, কার কাছে! সেখানে আরভীক এর স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক ব্যবহার যেন চিন্তায় ফেলছে ফাহাদকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here