পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |১৫|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৫|

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে পদ্ম বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কুচকুচে কালো আকাশ। তার একপাশে আবছা রূপালি আলো। পদ্ম সেদিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে ঠান্ডা বাতাস, পদ্ম’র শরীরে এসে ঠেকছে। পদ্ম চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানল। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পেল সে। গেইটের কাছে একটা বেলী ফুলের গাছ আছে। সুবাস’টা সেখান থেকেই আসছে। পদ্ম’র ভীষণ আরাম লাগছে। সে চোখ বুজে সেই আরাম অনুভব করছে। হঠাৎ সে তার কাঁধে ঠান্ডা কিছু একটার স্পর্শ অনুভব করলো। চট করে চোখ মেলে তাকাল সে। কিছু একটা আঁচ করতে পেরে পেছন ফিরে তাকাল। পেছনের মানুষ’টাকে দেখে বরাবরের মতোই সে রাগে আর বিদ্বেষে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেই মানুষ’টা দাঁত কেলিয়ে বিচ্ছিরি ভাবে হাসলো। বললো,

‘একা একা বারান্দায় কী করছো মা?’

পদ্ম’র গাঁ যেন জ্বলে উঠলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘আপনার মুখে “মা” ডাক’টা শুনলে আমার গাঁ জ্বলে উঠে। দয়া করে আমাকে আর মা বলে ডাকবেন না।’

আকবর সাহেব অসহায়ের মতো মুখ করে বললেন,

‘কেন মা, কী হয়েছে?’

‘উফ, বন্ধ করুন আপনার এই নাটক। আপনার এই অভিনয় আপনি অন্য কাউকে গিয়ে দেখান। আপনার উদ্দেশ্য আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। দয়া করে আপনি এখান থেকে চলে যান, নয়তো আমি কিন্তু বড়ো মা ডাকবো।’

‘আহা মা, এত হাইপার হচ্ছো কেন? আমি তো তোমার সাথে একটু গল্প করতে এসেছি। তা মা, আরাফাত-কে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?’

পদ্ম’র ভীষণ রাগ হচ্ছে। সে কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘আপনাকে এত কিছু জানতে হবে না। আপনি দয়া করে এখান থেকে যান।’

আকবর সাহেব হাসলেন। বললেন,

‘সুন্দরীদের রাগ দেখতেও ভালো লাগে।’

বলেই তিনি হেসে হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্ম’র ইচ্ছে করছে লোকটাকে খু*ন করে ফেলতে। একটা মানুষ এত খারাপ কী করে হয়?

বিছানায় বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে পদ্ম। তার এখন ভীষণ ভাবে ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ছে। এই মানুষটাকে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করা যায়। আচ্ছা, তার কাছে কি একবার সাহায্য চাইবে সে? ব্যাপারটা কি ঠিক দেখায়? মানুষটা তো এমনিতেই তাকে এত সাহায্য করেছে, দয়া করে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে এখন আবার তাকে কিছু বলে বিরক্ত করা’টা কি ঠিক হবে? আর তার উপর উনার নিজের ও তো মন মেজাজ ভালো নেই। প্রিয় মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত কত কষ্ট পাচ্ছন। না জানি কোথায় আছে মেয়ে’টা? আদৌ বেঁচে আছে তো? না না, বেঁচে অবশ্যই আছে। আর ডাক্তারবাবুও ঠিক উনার প্রিয় মানুষকে খুঁজে বের করতে পারবে।

.
.

রোদ ঝলমলে সকাল। বারান্দা টপকিয়ে রোদের আবছা আলো এসে পড়ছে পদ্ম’র রুমের ফ্লোরে। কিছু আলো তীর্যক ভাবে এসে পড়ছে পদ্ম’র টেবিলে। সেখানে রাখা ছোট্ট পাতাবাহার গাছ’টা সেই আলোয় ঝলমল করছে।

দরজার ঠকঠক আওয়াজে পদ্ম’র ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ ডলে উঠে বসলো সে। ঘুম ঘুম চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কয়টা বাজে। নয়’টা ত্রিশ। পদ্ম জোরে হাই তুললো। তারপর গিয়ে দরজাটা হালকা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে এসেছে। কেউ নেই? আশ্চর্য! তাহলে দরজায় নক করলো কে? সে তো স্পষ্ট শুনেছে দরজায় কারোর ঠকঠক শব্দ। তবে কি ভুল শুনলো সে? হতে পারে। পদ্ম দরজা’টা চাপিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো, ফ্রেশ হতে।

পদ্ম ফ্রেশ হয়ে এসে নিচে নামল। নিচে গিয়ে দেখল কেউ নেই। পদ্ম অবাক হলো। কী ব্যাপার! কেউ কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি? কিন্তু, এতক্ষণে তো উঠে পড়ার কথা! পদ্ম রান্নাঘরে গেল। খালা কাজ করছেন। সে তখন খালা-কে জিগ্যেস করলো,

‘খালা, কেউ কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি?’

খালা তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো,

‘খালাম্মা আর সাহেব একটু বাইরে গেছেন, কী যেন কাজ আছে উনাদের। আপনার খাবার ডাইনিং এ আমি দিয়া রাখছি, গিয়া খান।’

পদ্ম কিছুক্ষণ খালার দিকে তাকিয়ে থেকে ডাইনিং রুমে চলে এলো। চেয়ার টেনে বসলো সে। তার কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না। মনটা অস্থির অস্থির লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে, কিছু যেন হতে চলছে। খুব খারাপ কিছু। পদ্ম খেতে পারে না। উঠে গিয়ে সোফায় বসে। টি.ভি টা ছেড়ে দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে। খবর চলছে। হঠাৎ হেড লাইনে একটা লেখা উঠলো, “প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া একটা মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে।” পদ্ম সঙ্গে সঙ্গে টি.ভি টা অফ করে দিল। তার হঠাৎ দম আটকে আসছে। দু হাত নাড়িয়ে নিজেকে বাতাস করছে সে। পদ্ম জানে, আজকাল এই ধর্ষণ জিনিসটা খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন তো ঘরে ঘরে ধর্ষীতা। মানুষ হয়তো আর ধর্ষণের খবর শুনলে আঁতকে উঠে না, হয়তো তার মতো করে কারোর আর দম বন্ধ হয়ে আসে না। ঐ যে মানুষ এখন জিনিসটাকে খুব সাধারণ চোখে দেখে। কেউ পাত্তা দেয় তো কেউ মজা নেয়। কিন্তু তার বুক এখনও কাঁপে, দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় যেন তার সাথেই ঘটেছে এত সবকিছু। পদ্ম কিছুটা সময় চোখ বুজে থাকল। তারপর সে সোজা হয়ে বসলো। মনে মনে তখন ভাবলো,

“ইশ, এই স্বাধীন বাংলাদেশে যদি মেয়েরা একটু সুরক্ষিত থাকতে পারতো…!’

_________________________________

বাড়ির ল্যান্ড লাইন’টা তখন থেকে বাজছে। পদ্ম এতক্ষণে টের পেল সেটা। পদ্ম ছুটে গিয়ে তখন ফোন’টা রিসিভ করলো,

‘হ্যালো!’

‘ডাক্তারবাবু?’

‘জ্বি।’

‘আমি পদ্ম।’

‘হু, বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, মা বাবা কোথায়? উনাদের নাম্বারে তখন থেকে কল দিচ্ছি কিন্তু ধরছেন না, বাসায় নেই?’

‘না, উনারা কাজে বেরিয়েছেন।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনি বাসায় একা তাহলে, কোনো সমস্যা নেই তো?’

‘না না, কোনো সমস্যা নেই।’

‘আচ্ছা তাহলে রাখছি।’

‘ডাক্তারবাবু..’

‘কিছু বলবেন?’

পদ্ম চুপ হয়ে যায়। বলতে তো অনেক কিছুই চায়, কিন্তু কী করে বলবে? আদিদ আবার জিগ্যেস করলো,

‘কী হলো, কথা বলছেন না কেন?’

পদ্ম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

‘আপনি আবার কখন আসবেন?’

‘সিউর বলতে পারছি না। কেন, কোনো সমস্যা? শরীর ঠিক আছে আপনার?’

‘হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। কিন্তু…’

‘কিন্তু কী? আপনার কি কোনো প্রকার অসুবিধা হচ্ছে, হলে বলতে পারেন?’

পদ্ম ভাবছে বলবে কী বলবে না। সে খানিকটা সময় নিয়ে বললো,

‘আসলে আপনার বাবা…’

‘আমার বাবা…কী?’

পদ্ম ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘আপনার বাবা আ-আমার সাথে…’

‘কার সাথে কথা বলছো, পদ্ম?’

পেছন থেকে কারোর গলার স্বর শুনে চমকে উঠল পদ্ম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব। পদ্ম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

‘ড..ড-ডাক্তারবাবু।’

আকবর সাহেব তখন ব্রু কুঁচকে বললেন,

‘তা, তুমি এত ওর সাথে কী কথা বলছো?’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here