পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ।৩।

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৩।

‘কোথাও একটা ঠিক চলে যাবো। কিন্তু এইখানে থাকবো না। মামি এসে কালই আমায় এখান থেকে নিয়ে যাবে। তারপর ঐ খারাপ লোকটার সাথে আমায় বিয়ে দিয়ে দিবে। কাল মামি আসার আগেই আমি এখান থেকে চলে যাবো।’

‘কাল তো এমনিতেও আপনাকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে না। চিন্তা করবেন না আপনার মামিও আপনাকে কাল নিয়ে যেতে পারবেন না। নিশ্চিন্তে থাকুন। অযথা দুশ্চিন্তা করলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। রেস্ট নিন, আর কোনো অসুবিধা হলে নার্সকে বলবেন।’

পদ্ম আস্তে করে বললো,

‘আচ্ছা।’

আদিদ তার কেবিনে চলে গেল। নার্স পদ্ম-কে রাতের খাবারে একটা স্যুপ খাইয়ে ঔষধ দিল। তারপর ওর স্যালাইন’টা চেক করে বললো,

‘এবার আপনি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি এখানেই আছি, ভয় পাবেন না।’

পদ্ম আলতো হাসল। এই মানুষগুলো তাকে চেনে না, হোক না পেশার খাতিরে কিন্তু কী নিখুঁত ভাবে তার সেবা যত্ন করছে। তাদের মনে অঢেল মায়া। নয়তো এমন অচেনা অজানা মানুষকে কখনোই তারা এতটা গভীর ভাবে সেবা যত্ন করতে পারতো না। এই একটু মায়া যদি তার মামা মামিরও থাকতো। তাহলে সেও আর পাঁচটা মানুষের মতো একটু প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারতো।

পদ্ম কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল। বাবা মা’র কথা ভীষণ মনে পড়ছে তার। তার মনে আছে ছোট্ট বেলায় গ্রামে খেলতে গিয়ে একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় খুব ব্যথা পেয়েছিল সে। সেই নিয়ে তার মা বাবা সেকি হুলস্থুল বাধিয়েছিল! মেয়ের জন্য জীবন যেত তাদের। আজকে তাদের সেই মেয়ে কতটা অসহায় হয়ে হসপিটালের বিছানায় একা পড়ে আছে। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। একটু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতোও কেউ নেই। কী হতো মা বাবা বেঁচে থাকলে?

এই এক প্রশ্ন যে সে কতবার সৃষ্টিকর্তাকে করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কষ্টে যখন তার দম বন্ধ হয়ে আসে তখন আবার তার হঠাৎ মনে পড়ে, সে শুনেছিল সৃষ্টিকর্তা যাকে বেশি ভালোবাসেন তাকে তিনি তাড়াতাড়ি উনার কাছে ডেকে নেন। হয়তো তার মা বাবাকেও সৃষ্টিকর্তা খুব ভালোবাসতেন তাই হয়তো তিনি উনাদের এত তাড়াতাড়ি উনার কাছে নিয়ে গেছেন। এই কথাটা ভাবলে একটু হলেও শান্তি পায় সে। তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব পায় তখন।

পদ্ম ঘুমিয়ে পড়ে। নার্স লাইট অফ করে সোফায় গিয়ে বসে। তারও খুব ক্লান্ত লাগছে। তাই হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতেই সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

.

জানলার ফাঁক গলিয়ে রোদের কিছু অংশ পদ্ম’র চোখে মুখে এসে পড়ছে। পদ্ম’র ঘুমটা তখন হালকা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় সে। চোখের সামনে দৃশ্যপট পরিষ্কার হতেই দেখল তার পুরো রুম রোদের আলোয় ঝলমল করছে। পাশে তাকিয়ে দেখল নার্স যেন কী একটা ফাইল দেখছে। পদ্ম আস্তে আস্তে বসার চেষ্টা করলো। কিন্তু বসার শক্তি পেল না সে। নার্স সেটা দেখে তাকে সাহায্য করলো, উঠে বসতে। পদ্ম আস্তে করে বললো,

‘আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।’

নার্স পদ্ম’র হাত থেকে ক্যানোলা’টা খুলে তাকে ধরে ওয়াশরুমের কাছে নিয়ে গেল। পদ্ম’র শরীর যেন ভার হয়ে আছে। হাঁটতে চলতেও যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে ফের হলো। নার্স তাকে আবার বেডে নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর বললো,

‘আপনি রেস্ট নিন। আমি স্যারকে ডেকে আনছি।’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।

কিছুক্ষণ পর আদিদ কেবিনে এসে পদ্ম’র পালস্ চেক করলো। তারপর জিগ্যেস করলো,

‘এখন কিছুটা সুস্থ লাগছে?’

‘হ্যাঁ, তবে শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।’

‘ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করলে এই দুর্বলতা কেটে যাবে। আর এই স্যালাইন’টা শেষ হলে আরেকটা স্যালাইন দিব সেটা নিলেই দেখবেন অনেকটা বেটার ফিল করছেন।’

‘স্যালাইন শেষ করতে আর কতক্ষণ লাগবে।’

‘এই দেড় থেকে দু ঘন্টা।’

পদ্ম ঘড়ির দিকে তাকাল। আট’টা বাজে। দশটার আগে সে এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে। মামি আসার আগে যেকোনো মূল্যে তাকে এখান থেকে চলে যেতেই হবে। নয়তো মামি এসে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে আর ঐ লোকটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। কথাটা ভাবতেই পদ্ম’র বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। পদ্ম নরম সুরে বলে,

‘স্যালাইন’টা শেষ হলে আমি এখান থেকে চলে যাবো। আর বিল কত এসেছে? আমার কাছে তো ক্যাশ টাকা নেই তবে এই ছোট্ট সোনার দুলগুলো আছে বাকি যা ছিল সব মামি নিয়ে গিয়েছে এইগুলো খুব কষ্ট রেখে দিয়েছি, মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে। আচ্ছা একটা দুল দিয়ে হবে? নাহলে দুটো’ই..’

‘পাগল হয়েছেন আপনি? আপনাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমাদের এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা করানো হয়। তাই এইসব না ভেবে রেস্ট নিন। আমি আপনার স্যালাইনের ব্যবস্থা করছি।’

আদিদ বেরিয়ে গেল। নার্স তাকে হালকা খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিল।

ঘড়ির কাটা দশ’টা ছুঁলো। পদ্ম’র মন জুড়ে ছুটে চলছে তখন অস্থিরতার স্রোত। সে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি মামি চলে এলো। আরেকবার তাকাচ্ছে স্যালাইনের দিকে। এটা এখনো শেষ হচ্ছে না কেন? সময়ের সাথে সাথে পদ্ম’র অস্থিরতা বেড়েই চলছে। এক পর্যায়ে সে আর না পেরে নার্সকে বলে উঠে,

‘আমার ক্যানোলা’টা খুলে দিন না প্লীজ।’

নার্স অবাক হয়ে বললো,

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘আমি এখান থেকে চলে যাবো। আমার মামি এক্ষুণি চলে আসবি। তাড়াতাড়ি আমার ক্যানোলা’টা খুলে দিন প্লীজ। মামি আসার আগে আমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। প্লীজ খুলে দিন।’

পদ্ম অনেক বেশি অস্থির হয়ে পড়ে। নার্স তার কোনো কথা শুনছে না দেখে সে নিজেই ক্যানোলা ধরে টেনে টুনে সব খুলতে থাকে। নার্স যখন অনেক চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারে না তখন সে দ্রুত গিয়ে ড. আদিদ-কে ডেকে নিয়ে আসে। সে এসে দেখে পদ্ম স্যালাইন ট্যালাইন সব ছিঁড়ে ফেলেছে। সে তখন তাড়াহুড়ো করে বেঠ থেকে নামছিল। আদিদ দ্রুত তার কাছে যায়। শরীর দুর্বল থাকায় বেড থেকে অস্থির হয়ে নামতে গেলেই পদ্ম’র মাথা ঘুরে উঠে। সে তখন ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই আদিদ তাকে ধরে বেডে বসিয়ে দেয়। তারপর সে ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘পাগলামী করছেন কেন? এক্ষুণি তো পড়ে গিয়ে আরো বিপদ বাধাতেন। আমার অনুমতি ছাড়া এখান থেকে আপনাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। তাই এসব পাগলামী বন্ধ করুন। আপনি ছাড়াও আমার আরো অনেক পেশেন্ট আছে, আপনার জন্য আমি অযথা এত প্যারা নিতে পারবো না। আপনার মামি আসলে আমি কথা বলবো উনার সাথে, আপনাকে এই নিয়ে আর ভাবতে হবে না। চুপচাপ এখানে বসে থাকুন। আর আপনি উনার দিকে খেয়াল রাখবেন। (নার্সের দিকে তাকিয়ে)’

কথাটা বলেই আদিদ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। আদিদ যে ভীষণ রেগে গিয়েছে সেটা পদ্ম তার কথা শুনেই বুঝতে পারছে। কিন্তু সেই বা কী করবে। তার বুকের ভেতরটা ভয়ে কেমন করছে সেটা কেবল সেই জানে। এই অনুভূতি তো সে কাউকে বোঝাতে পারছে না।

পদ্ম শক্ত হয়ে বিছানায় বসে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মন বলছে তার মামি মনে হয় চলে এসেছে। এই বুঝি তাকে ধরে নিয়ে যাবে। আর তারপর..

সত্যি সত্যিই মহিলাটা চলে এসেছে। মামিকে দেখা মাত্রই পদ্ম’র মনের ভয়টা হাজার গুণ বেড়ে যায়। সে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে। তার মামি তখন তার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘তোকে নিতে এসেছি মা। দেখ সাথে সুলাইমানও এসেছে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here