পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ।৪।

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
।৪।

সুলাইমানের কথা শুনে পদ্ম আরো বেশি ভয়ে কুকরে উঠে। সে বেডের এক কোণে গিয়ে জড়সড় হয়ে বসে। তার মামি হেসে বেডের এক পাশে বসে বলে,

‘কী সুলাইমান, ভেতরে আসো।’

মোটাকাটা এক মধ্য বয়স্ক লোক তখন কেবিনের ভেতর ঢুকল। মুখে একগাদা কালো কালো দাড়ি। চোখ মুখ যেন কেমন অদ্ভুত লোকটার। লোকটা এসেই পদ্ম’র খুব কাছে গেল, তার হাতে স্পর্শ করে বললো,

‘তুমি ঠিক আছো, পদ্ম?’

পদ্ম এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নিল। তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,

‘ক-কে আপনি?’

‘ওমা! তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? আমি সুলাইমান, তোমার হবু বর।’

পদ্ম আরো কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললো,

‘আমি কোনো সুলাইমান-কে চিনি না। কাউকে চিনি না আমি। আপনারা চলে যান এখান থেকে।’

‘যাবো তো অবশ্যই। তবে তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো।’

সুলাইমান লোকটা তার পান খাওয়া দাঁত বের করে বিকট ভঙ্গিতে হাসল। পদ্ম’র গা যেন শিউরে উঠল সেই হাসি দেখে। মামি তখন বললো,

‘হুম, তা তো নিয়া যাবোই। তার আগে ঐ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হইব। চলো সুলাইমান, আমরা বরং ঐ ডাক্তারের কেবিনে গিইয়া ওর সাথে কথা বইলা আসি।’

‘আচ্ছা, চলুন। তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো, আমরা এক্ষুণি আসছি।(পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে)’

ওরা কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই পদ্ম ছটফট করতে লাগল। যদি ডাক্তারবাবু-কে তারা মানিয়ে নেয়? ডাক্তারবাবু যদি তাদের কথায় রাজি হয়ে যায়? তাহলে তার কী হবে? কী করবে সে? পালিয়ে যাবে? হ্যাঁ, পালাতে হবে। এক্ষুণি পালাতে হবে।

পদ্ম আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। বুক ধরফর করছে তার। নার্স কেবিনে আসার আগেই তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। পদ্ম ধীর পায়ে দরজার সামনে গেল। তারপর এদিক সেদিক দেখে দরজার বাইরে পা রাখতেই সেখানে তার নার্স চলে এলো। সে পদ্ম’র হাত ধরে বললো,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

পদ্ম তখন কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বললো,

‘প্লীজ, আমাকে যেতে দিন। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি। প্লীজ।’

পদ্ম’র চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। নার্সের মায়া হলো খুব। কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে বললো,

‘আপনার কথা শুনলে যে আমার চাকরি থাকবে না। আদিদ স্যার আমাকে সাসপেন্ড করে দিবে। ক্ষমা করবেন আমায়। চলুন, ভেতরে চলুন।’

পদ্ম থমকে যায়। কী করবে সে? তার জন্য কারো চাকরি যাক সেটা সে কখনোই চায় না। কিন্তু, এছাড়া আর বাঁচার উপায় কী?

নার্স পদ্ম-কে ধরে এনে বেডে বসালো। পদ্ম এখনো কাঁদছে। নার্স কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল তার দিকে। তারপর তার পাশে বসে কোমল গলায় বললো,

‘স্যার যখন বলেছে আপনাকে আজকে এখান থেকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না, তার মানে সত্যিই সেটা কেউ পারবে না। স্যারের উপর ভরসা রাখুন। আপনার মামি-কে উনি ঠিক ম্যানেজ করে নিবেন।’

পদ্ম ভেজা অক্ষিপল্লব মেলে তাকাল নার্সের দিকে। ধরা গলায় বললো,

‘আজকে না নিয়ে যেতে পারলে, কাল আবার আসবে। কালকে না পারলে, পরশু আসবে। কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবেই। এখানে থাকলে আমি মামির হাত থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাবো না। তাই আমি পালিয়ে যেতে চাই। মামির হাতের নাগাল থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে চাই।’

‘কিন্তু, আপনি এখন অনেক দূর্বল। এই অবস্থায় একা চলাচল করতে পারবেন না। আপনাকে এখন রেস্টে থাকতে হবে। এই অবস্থায় কোনোভাবেই আপনাকে আমরা ছাড়তে পারবো না।’

পদ্ম নার্সের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সে চুপচাপ বেডে শুয়ে পড়ে। আর পারছে না। এই একটা শরীর আর কত ধকল সহ্য করবে। এই মন আর কত আঘাত সহ্য করবে। সে তো রোবট নয়, একটা র/ক্তে মাংসে গড়া মানুষ। একটা মানুষ ঠিক কতটা কষ্ট, কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে? তার যে বড্ড মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে মা বাবার কাছে চলে যেতে। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া’টা কি ভালো সিদ্ধান্ত নয়?

.

‘বললাম তো আজ কোনোভাবেই উনাকে ডিসচার্জ করা যাবে না। উনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। উনাকে আরো দুদিন হসপিটারে থাকতে হবে। তারপর উনার শারীরিক কান্ডিশন দেখে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিব।’

‘আহ, ডাক্তার! আপনাকে কী করে বোঝায়? আমার বিয়েটা যে আটকে আছে। আর কতদিন আমি অপেক্ষা করবো? আপনি একদম নিশ্চিন্তে থাকুন ডাক্তার। ওকে বাড়িতে খুব যত্নে রাখা হবে। কোনো চিন্তা করবেন না, ও খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।’

আদিদ কপালে চওড়া ভাজ ফেলে লোকটার দিকে তাকাল। এই লোকটার সাথে মেয়েটার বিয়ে হবে? লোকটা-কে আদিদের মোটেও ভালো মানুষ মনে হলো না। আর তাছাড়া এই লোকটা বয়সে মেয়েটা থেকে অনেক বড়ো হবে। মেয়েটার সাথে তার মামা মামি সত্যিই খুব অন্যায় করছে।

আদিদ চাপা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘উনার সুস্থতার চেয়ে আপনার কাছে বিয়েটা ইম্পোরটেন্ট? আর তাছাড়া আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি বিবাহিত। এই বয়সে ঐটুকু একটা মেয়েকে বিয়ে কেন করতে চাইছেন? বিয়েতে মেয়েটার মত আছে তো? নাকি জোর করছেন? জানেন তো আজ কাল এসব ব্যাপার নিয়ে প্রশাসন খুব সতর্ক? তাই যা করবেন ভেবে চিন্তে করবেন, নয়তো জেলে ঢুকতে দু মিনিট সময়ও লাগবে না।’

‘এই ডাক্তার, আপনারে এত কথা কইতে কেউ কইছে? খালি আজাইরা কথা। আমাদের মাইয়া বিয়েতে রাজি। এটা নিয়া আপনার ভাবতে হইত না। আপনার যা কাজ আপনি তাই করেন। পদ্মরে আজকেই আমাদের সাথে যাইতে দেন। ও আমাদের কাছে থাকতে ভালো থাকব, বুঝছেন?’

মামির কথায় চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আদিদের। সে দারাজ গলায় বললো,

‘ভদ্রতার বিন্দু মাত্র ছিটে ফোটাও দেখছি আপনার মাঝে নেই। আমি কি বলেছি আপনি বুঝতে পারেননি? পদ্ম-কে আজ ডিসচার্জ করা হচ্ছে না। অযথা ঝামেলা করবেন না, নয়তো আমি অন্য স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।’

সুলাইমান তখন টেবিলে চাপড় মেরে উঠে দাঁড়াল। উঁচু স্বরে বলতে লাগল,

‘মগের মুল্লুক নাকি? আমাদের মেয়েকে আমরা নিতে পারবো না, এটা আবার কেমন কথা? একদম বাড়াবাড়ি করবেন না ডাক্তার। চুপচাপ যা বলছি তাই করেন।’

আদিদ তার চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

‘না করলে কী করবেন?’

সুলাইমান রাগে চোয়াল শক্ত করে এসে আদিদের শার্টের কলার চেপে ধরলো। আদিদ চোখ বুজে নিশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বললো,

‘কলার ছাড়ুন।’

‘ছাড়ব না।’

আদিদ আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে লোকটার নাক বরাবর এক ঘুষি মারল। সঙ্গে সঙ্গে সে ছিটকে দূরে সরে গেল। আর তার সাথে সাথেই নাক দিয়ে বের হতে লাগল অনর্গল রক্ত। সুলাইমান নাকে হাত দিয়ে রক্ত দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সে জানে শক্তিতে সে আদিদের সাথে পেরে উঠবে না। তার বয়স হয়েছে, আর আদিদ এখন চাঙ্গা যুবক। তার শরীরে এখন বয়ে চলছে টাটকা র/ক্ত। তাই সে দমে গেল। আদিদ তার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,

‘দুঃখিত, হাত তুলতে চাইনি। আপনি বাধ্য করেছেন। বসুন এখানে আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি।’

লোকটিকে বসিয়ে আদিদ তার নাকের র/ক্ত মুছে ড্রেসিং করিয়ে দিল। তারপর নরম গলায় বললো,

‘দেখুন, আমি কোনো ঝামেলা চাই না। আমাদের হসপিটালের একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়মের বাইরে আমরা যেতে পারবো না। একজন অসুস্থ রোগী-কে আমি কোনোভাবেই রিলিজ দিতে পারবো না, এটা নিয়মের খেলাপ। আপনারা আরো দুদিন পর আসুন। আশা করছি ততদিনে উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’

‘কিন্তু..’

মামি কিছু বলতে নিলে সুলাইমান তাকে ইশারা দিয়ে থামিয়ে দেয়। তারপর সে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘আচ্ছা ডাক্তার, আপনি যা বলবেন তাই হবে। আমরা দু দিন পর এসেই ওকে নিয়ে যাবো। আজ তাহলে আমরা যাই। আর আমিও আমার খারাপ ব্যবহারের জন্য খুব দুঃখিত।’

‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আপনারা আসতে পারেন।’

মামি কেবিন থেকে বেরিয়েই ষুলাইমান-কে বললো,

‘এটা কী করলে সুলাইমান? তোমাকে আনলামই যাতে ডাক্তাররে বুঝাইয়া পদ্মরে বাসায় নিয়া যাইতে পারো। আর তুমি এখানে আইসা পল্টি মারলা। এটা কেমন হলো।’

সুলাইমান দাঁত বের করে হাসল। বললো,

‘আরে মামি ধৈর্য ধরুন। আপনার ভাগ্নী খুব চালাক। আমিও কিন্তু কম চালাক না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, ওর আর আমার বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। কেউ না।’

কথাটা বলে সুলাইমান জোরে জোরে হেসে উঠল। তার সাথে মামি ও তাল মেলালো।

_______________________

মামির চলে যাওয়ার খবর শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল পদ্ম। তবে দুশ্চিন্তা তার এখনও যায়নি। মামি তো আবার আসবে। তাকে তো একবার না একবার যেতে হবেই। পদ্ম সিদ্ধান্ত নিল। আদিদের সাথে কথা বলবে সে। এই হসপিটালে এক মুহুর্তেও সে শান্তিতে থাকতে পারছে না। তার উপর আবার ঐ সুলাইমান, ওকে দেখলেই কেন যেন পদ্ম’র গায়ে কাটা দেয়। কেমন অদ্ভুত করে তাকায় লোকটা।

পদ্ম নার্স-কে বলে,

‘একটু ডাক্তারবাবু-কে ডেকে দিন না।’

‘কোনো অসুবিধা? আমাকে বলুন..’

‘না, আসলে উনার সাথে আমার একটু কথা ছিল।’

‘ওহ আচ্ছা। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি উনাকে ডেকে আনছি..’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here