পাতাঝরার শেষে……পর্ব ১১

0
1401

পাতাঝরার শেষে……
©মৌপর্ণা

পর্ব ১১) তোমায় আমি আমার কথা বলতে চাই!

লাল গাড়ি ছোটরাস্তা পেরিয়ে দাঁড়িয়েছে সিগন্যালে….

অন্বেষা চুপচাপ বসে ড্রাইভিং সিটের পাশে!

আবার মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে…..
তুমুল বৃষ্টির জল বিভীৎস্য এক
শব্দ তৈরী করছে লাল গাড়ির ছাদে…..
রাস্তার এক ধারে সেঁটে থাকা কাঁঠাল, নারকেল গাছের পাতায় আছড়ে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা……
প্রকান্ড ঝরে দুলে উঠছে গাছের ডালপালা!

অন্বেষা গাড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে চেষ্টা করছিলো বাইরেটা দেখার…..
বিভৎস্য বৃষ্টির কারণে চারিপাশের রাস্তা বড্ডো অস্পষ্ট হয়ে আসছিলো ক্রমশঃ….
গাড়ির ওয়াইপার টা পরিষ্কার করে চলেছে গাড়ির সামনের কাঁচটা সমানে, তবু বৃষ্টির জল ঝাপসা করে দিচ্ছে সেটাকে বারবার!

গাড়িতে ওঠার পর থেকে একবারও চোখে চোখ রাখেনি অন্বেষা মিস্টার রায়ের! কোনো কথা হয়নি দুজনের!
যবুথবু হয়ে বসে, মোবাইলের ওপরের ফেটে যাওয়া স্ক্রিনগার্ড টা নখ দিয়ে খুঁটে চলেছে সমানে…..

“আর একটা নতুন স্ক্রিনগার্ড কেনা থাকলেও ওরকম করোনা! নখে লেগে যাবে……”
সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে খুব মৃদু স্বরে বললো মিস্টার রায়….

“Sorry….!” বলে একটু চুপ করে যায় অন্বেষা…..তারপর আবার খুব মৃদু স্বরে বলে ওঠে….
মিস্টার রায় ….”
কথাগুলো আবার জড়িয়ে যায়…..

“বলো..যেটা মনে আসছে সবটা বলো!”

“আজ জানিনা কি হয়ে গিয়েছিলো আমার! একটু আগে আমি কেন যে ওরম বিহেভ করলাম, আমি জানিনা……
I am so sorry মিস্টার রায়………আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা আমি কি ভাবে….”

“ইটস ওকে! যেটা হওয়ার হয়ে গিয়েছে…..
ভালো করেছো…… মনে যা ছিল বলে দিয়েছো….
মনে জমিয়ে রাখা কথার ওজন ভীষণ ভারী অন্বেষা!
আর কেউ বুঝুক বা না বুঝুক আমি এটা বুঝি…..
ভুলে যাও যা বলেছো…..
আমি কিচ্ছু মনে করিনি….”

“একটা কথা বলবো?”

“বলো….”

“আপনার হাতে জাদু আছে মিস্টার রায়!
একটা সেতার যেটাকে আমি রোজ তানপুরা ভাবতাম সেটা যে মানুষের মনে জমে থাকা ব্যাথা গুলোকে এভাবে বোঝাতে পারে, সেটা আমার আগে জানা ছিলোনা!
আপনার সুরে প্রাণ আছে মিস্টার রায়! একটা ব্যাথা আছে! একটা নিছক সরলতা, পবিত্রতা আছে! একটা পিওরিটি আছে!
আমি সত্যি বলছি মিস্টার রায় কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিলো আপনার সুরটা শুনে! খুব কষ্ট হচ্ছিলো!
জানিনা হয়তো সেই জন্যেই আজ এতগুলো কথা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো!”

“ইটস! ওকে! অন্বেষা! প্লিজ ডোন্ট ফিল গিলটি ফর দিস……..
ইটস ওকে! কমপ্লিটলি ওকে! অন্বেষা আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

“বলুন না….”

“তার আগে গাড়িটা সাইড করবো? কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা সামনেটা! একটু রিস্ক হয়ে যাচ্ছে অন্বেষা…..”

অন্বেষা দেখলো গাড়ির কাঁচের সামনে সত্যি একটা সাদা আস্তরণ! সামনের দশফিটের পর সবটাই পুরো ধোঁয়া!
“শিওর! আপনি প্লিজ সাইড করুন আগে….যখন তখন একটা Accident হয়ে যেতে পারে!”

“ছ বছর আগে ঠিক আজকের দিনটাই একটা গাড়ি Accident করেছিল! এরকমই একটা ঝড়বৃষ্টির রাতে….
মা মারা যায় এক্সিডেন্ট টাতে……
রিরি কিভাবে বেঁচে গিয়েছিলো সে শুধু ভগবানই জানে!”

“আপনিই ড্রাইভ করছিলেন সেদিন?”

“না! আমি অফিসে ছিলাম যখন Accident টা হয়!
ড্রাইভার ছিল সেদিন! ড্রাইভার স্পটেই শেষ! মা লড়াই করেছিল বেশ কিছুদিন! তারপর মাস দুয়েক পর যুদ্ধ শেষ করে চলে গেলো অন্য পারে!
কার ভরসায় যে আমাকে আর রিরি কে রেখে গেলো কে জানে?”
গলাটা ভেঙে এলো মিস্টার রায়ের!

হঠাৎ একটা নীরবতা গ্রাস করলো ওদের!
গাড়ি খানিকক্ষণ হলো এসে দাঁড়িয়েছে এক চৌমাথার ডানদিকের গলিতে…..

“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো মিস্টার রায়?”

“বলো…”

“আপনার বাবা কে দেখেনি কোনোদিন….”

“উনি আমি এ বাড়ি আসার আগেই মারা গিয়েছেন!”

“মানে? আপনার জন্মের আগেই! না না আপনার জন্মের আগে মারা গেলে রিরি কি ভাবে আপনার বোন হয়….”

“আমি এ বাড়ি আসার আগে, মানে আমি Adopted……তুমি এটা জানো তো?…”

“হোয়াট?” অন্বেষা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মিস্টার রায়ের দিকে….

“অফিসে তো অলমোস্ট সবাই জানে! তুমি জানতে না?”

“না আমি আজকে জানলাম….Sorry
……”

গলাটা আবার শুকিয়ে আসে অন্বেষার, গলাটা পরিষ্কার করে সে আবার বলে –
“মিস্টার রায় আজ জানিনা কেন না চেয়েও আমি বারবার আপনাকে হার্ট করে ফেলছি
…”

“এতটুকু কথায় আমি হার্ট হইনা অন্বেষা! আমার জীবনের গল্পটা অনেকটা আলাদা! আর দশটা জীবনের মতন নয় আমার জীবন টা….
ছাড়ো! এসব কথা শুনে কি হবে?
বাদ দাও!”

“মনের জমিয়ে থাকা কথাগুলো যে ভীষণ ভারী মিস্টার রায়! কতদিন এই ভারী মন নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন?”

মিস্টার রায় খুব অদ্ভুত ভাবে চেয়ে দেখলেন অন্বেষার দিকে!
হঠাৎ মোড়ের মাথায় স্ট্রিট লাইটটা নিভে গেলো!
প্রকান্ড ঝড়ের কারণেই বোধহয় এই powercut
……
ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো গাড়ির ভেতর!

“ওঃ! I’m So Sorry অন্বেষা, So Sorry
……ওহ গড! Shit
কবে খারাপ হলো এটা আবার! ”
মিস্টার রায় কথাগুলো বলতে বলতে মাথার ওপরে লাগানো সুইচটাকে বারবার ডানদিক – বাঁদিক করতে থাকলেন……
গাড়ির ভেতরে লাইট কিছুতেই জললোনা!
“অন্বেষা রিলাক্স….আমি দেখছি…..”

“ইটস ওকে! মিস্টার রায়! নো প্রব্লেম! আমি রিলাক্সড ই আছি!”
ভীষণ একটা ঠান্ডা গলায় উত্তর এলো অন্বেষার….

তৎক্ষণাৎ মিস্টার রায় পকেট থেকে ফোনটা বেরকরে জ্বেলে দিলো মোবাইলের টর্চটা!

মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে দিতেই দেখলো
অন্বেষা নির্বিকার মুখে গাড়ির কাঁচ দিয়ে চেয়ে আছে বাইরের রাস্তার দিকে!
আজ মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই, অথচ সে এরকম একটা ঝড়বৃষ্টির রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একলা বসে আছে মিস্টার রায়ের গাড়িতে!

“অন্বেষা!” খুব আলতো গলায় ডাকলো মিস্টার রায়….

অন্বেষা চেয়ে দেখলো মিস্টার রায়ের দিকে, মোবাইলের ক্ষীণ আলোয় মিস্টার রায় দেখলো অন্বেষার ভেজা দুটো চোখ!
“আপনি কিছু একটা বলবেন বলছিলেন মিস্টার রায়!”

“আজকে ভয় করলোনা তোমার? মানে এভাবে এমন এক অন্ধকার রাতে আমার সাথে এই ভাবে এক নির্জন রাস্তায়….”

“না!” মিস্টার রায়ের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দিলো অন্বেষা!

বাইরে ভীষণ জোরেজোরে বাজ পড়তে শুরু করছে!
বিদ্যুতের আলোয় মাঝেমাঝে অন্বেষার মুখটা স্পষ্ট হয়ে আসছে ….

অন্বেষা মিস্টার রায়ের দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে বললো –
“আপনি ঠিক বলেছিলেন মিস্টার রায়! আপনি অনেকটা আলাদা, তবে আপনি হার্মফুল নয়….
আপনার হাত দুটো শুধু মানুষকে আগলে রাখতে জানে মিস্টার রায়!
তাদের বাঁচাতে পারে কখনো কোনো ভিড় ঠাঁসা ট্রেনে লোকজনের নোংরা স্পর্শ থেকে,
কখনো আবার পৌঁছে দেয় অসহায় একটা মেয়েকে তার গন্তব্যে!
এই গন্তব্য জিনিস টা ভারী অদ্ভুত মিস্টার রায় জানেন তো! এই গন্তব্য জিনিষটা পাল্টে যায় রোজ আমার কাছে – রোজ!
তবু আপনি কিরকম অনায়েসে সবসময় বুঝতে পারেন সেই গন্তব্য!
প্রথমদিন প্রজেক্ট Synopsis, পরের দিন প্রজেক্ট থিসিস, তারপর চাকরি ইন্টারভিউ, তারপর বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো….

আমার হারিয়ে ফেলা গন্তব্যের খোঁজ সব সময় আপনি কি ভাবে রাখেন মিস্টার রায়! কি ভাবে?

আপনি যা করেছেন আমার জন্যে, তার বদলে অপমান ছাড়া আর আপনাকে আমি কিছুই ফেরত দিতে পারিনি মিস্টার রায়!
আজ যদি আপনাকে আমি না বিশ্বাস করতে পারি, তবে আমার থেকে বড়ো বিশ্বাসঘাতক আর বোধহয় কেউ হবেনা!”
অন্বেষার গলাটা ভেঙে আসছে বারবার!
গলাটা পরিষ্কার করে অন্বেষা আবার বলতে শুরু করলো
“আপনি কিছু একটা বলবেন বলছিলেন তখন!”

“হ্যাঁ….তখন তুমি একটা ভালোলাগার কথা বলছিলে …….কিরকম ভালো লাগা অন্বেষা? মানে আই মিন ইউ লাইক মি as হোয়াট? As
ফ্রেন্ড রাইট?”

“No! I like you…… as a woman likes her man ”

“পাগল হয়ে গিয়েছে তুমি!” খুব মৃদু একটা আওয়াজ শুনতে পেলো অন্বেষা! বোধহয় এটাই বললো মিস্টার রায়!
বাইরে ঝড়, বৃষ্টি ও প্রকান্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখন! সেই আওয়াজের কারণেই আরও অস্পষ্ট ছিল মিস্টার রায়ের আওয়াজ!

অন্বেষা আবার বলতে শুরু করলো, মিস্টার রায় একদৃষ্টি তে চেয়ে রইলো স্টিয়ারিং এর দিকে, মাথা নীচু করে……

“রিলাক্স! মিস্টার রায়! আমি ভালোলাগার বদলে ভালোলাগা চাইতে আসিনি আজ! রিলাক্স….
আমার কথাগুলো কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলাম না অনেকদিন থেকে! আজ অনেকটা হালকা লাগছে জানেন!”

“কি জানো আমার ব্যাপারে? মানে কি কি জানো? কতটা জানো? তুমি না জেনেই….”

খানিকক্ষণ চুপ রইলো মিস্টার রায়…..
আবার নীরবতা নেমে এলো গাড়ির ভেতরে খানিকক্ষণের জন্যে!

একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিস্টার রায় বলা শুরু করলেন –
“আমার কথাগুলো আমি তোমায় বলতে পারি অন্বেষা?
মানে ভালোলাগার কথা নয় সেটা!
অন্য কথা – আমার জীবনের কথা!
বলতে পারি আমি সেগুলো তোমায়?
সত্যি মাঝেমাঝে ভীষণ ভারী লাগে বুকে জমানো কথাগুলো!”

“বলুন!
আজ আমি সবটা শুনতে চাই…..মিস্টার রায়….”

“বছর পঁচিশ আগের কথা…
বয়েস তখন চার…..
আসতে আসতে বড়ো হয়ে উঠছিলাম আমি গ্যাংটকের একটা বোর্ডিং স্কুল কাম অর্ফানেজে….
সবটা মনে নেই তবে এইটুকু মনে আছে রোজ ঘুম থেকে উঠে প্রেয়ার সেরে দাঁড়িয়ে থাকতাম বাগানে….
পাহাড়ের সবুজ গাছগাছালির ওপারের জগৎ টা ঠিক কিরকম হয় জানা ছিলোনা তখন……
সবসময় ভাবতাম বড়ো হলে একদিন ওই পাহাড় পেরিয়ে যাবো, দেখবো ও পাশে কি আছে!
ওরা আমাকে বলতে শেখালো –
“My name is Arunjit Ray”

তারপর ছোট্ট হাতে উঠলো পেন্সিল, নাম ঠিকানা লিখতে পারতাম তখন!
অর্ফানেজ মানেটা ঠিক বুঝতাম না!

একটু জ্ঞান হতেই বুঝলাম যাদের মা, বাবা থাকেনা, মানে যাদের মা বাবা Star হয়ে যায় আকাশের, তাদের ঠিকানা Orphanage…….
……………………………………………………….
ওরা বলতো যারা খুব ভালো মানুষ হয়, তাদের গড নিজের কাছে ডেকে নেন, তারপর তারা Star
হয়ে যায় আকাশের!
আমার বাবা মা তো খুব ভালো তাই তারা ষ্টার…..

বছর পাঁচেক যেতেনা যেতেই বুঝলাম ওখানকার টিচার, ফাদারের চোখের মধ্যমনি হয়ে উঠছিলাম আমি….আসতে আসতে…..
Exceptional IQ, High Memory Strength
…..গলায় একটা ভরাট সুর….
পুরো Orphanage টার কেন্দ্রবিন্দু তখন এই অরুণজিৎ রায়……
সকালের প্রেয়ার, দুপুরের ক্লাস, বিকেলের ফুটবল আর কখনো সেতার সেখা….রাতে আবার পড়াশোনা….
সব মিলিয়ে তখন আমি বেশ সাকসেসফুল!
মানে একটা বাচ্চার কাছে টিচারের “ব্রিলিয়ান্ট” “গুড” এগুলোই তখন সাকসেস!
সাকসেস মানে তখন পরীক্ষার খাতার প্রাপ্ত নম্বর, সাকসেস মানে তখন ফুটবলের মাঠের একটা গোল, সাকসেস মানে তখন সেতারে, মাউথপিসে বাজানো পুরো একটা গান!

সব মিলিয়ে অনাথ হলেও বেশ চলছিল সব! তখন আমি এক্সাক্টলি ১৪…..

হঠাৎ একদিন ফাদার ডেকে পাঠালেন, প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো ভিসিটর বা নামি দামি লোক! হয়তো একবার মাউথপিসটা বাজিয়ে একটা পুরোগান শোনাতে বলবে……..

ঘরের ভেতরে ঢুকে পুরো ব্যাপারটা শুনতেই মাউথপিসটা হাত থেকে পরে গেলো! ওরা বললো রয় এন্ড রয় গ্রূপ আমাকে এডপ্ট করতে চায়…..
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব….
তাই সব গুছিয়ে নিতে তৎক্ষণাৎ!
পরের দিন সকালেই ফিরে যেতে হবে সামনে টেবিলে বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোকটির সাথে …..

অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম জানো অন্বেষা, ওরা বোঝাতে থাকলো জীবন একটা অনেক বড়ো সুযোগ দিয়েছে আমায়! অনেক বড়ো একটা সুযোগ! কোনোমতেই সেটা হাতছাড়া করা যাবেনা!

কমপখ্যে পনেরো বছর না হলে Adopted child
এর মতামতের কোনো দাম থাকেনা…..
আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো জানো…….
পেছনের পাহাড়ি রাস্তা….উঁচু নীচু ঢালু, রিচার্ড – ও ছিল আমার প্রিয়বন্ধু…..সব কিছু ফেলে চলে এলাম আমি
পাহাড়ের এ পারে!

ছোটবেলার বাগানে দাঁড়িয়ে দেখা সেই স্বপ্ন পূরণ হলো!

স্বপ্নও খুব অদ্ভুত অন্বেষা জানো..
যেদিন চোখের সামনের স্বপ্নগুলো সত্যি হলো, সেদিন চোখের সামনে টা ঝাপসা হয়ে এলো – জলে….

ট্রেনে চেপে প্রথম পা রাখলাম কলকাতায়, তারপর
রয় ম্যানশন, প্রথম দিনিই জানতে পারলাম আমার বাবার নাম অর্ঘজিৎ রায়! নামের কি মিল না অন্বেষা! তবে তিনি গত! সেই একিই বছরে উনি বুকের কিছু একটা সমস্যায় মারা যান…..
ঠিক হার্ট Failure ছিল নাকি অন্য কোনো সমস্যা ছিল জানিনা আমি!

নাম সারনেম, সবটাই বেশ মেলানো!
হয়তো এটাই ছিল শেষ ঠিকানা তাই তো ভগবান কেমন যেন আগেই সবটা মিলিয়ে রেখেছিলেন! এসব ভেবে ভেবেই পুরো জিনিসটা মেনে নিলাম আমি!

বেশ কিছুদিন সব ঠিক চললো! বাংলা শিখে ফেললাম তিন চার মাসে, তবে শুধু বলতে শিখলেই হবে, মেন্ সাবজেক্ট ইংলিশ, এখানে একটা বেশ নামি দামি ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হলাম আমি!
প্রথম প্রথম ওরা খুব টেনশনে ছিল বোধহয়, extraordinary intelligent
হলেও নতুন স্কুল, নতুন জায়গার সাথে মানিয়ে নেওয়া যদি খুব ডিফিকাল্ট হয়!

খুব ডিফিকাল্ট ছিল জানো অন্বেষা! খুব ডিফিকাল্ট ছিল!

প্রথম দিনিই ক্লাসমেট জিজ্ঞেস করেছিল আগে কোথায় পড়তাম?
অর্ফানেজ টা শুনেই ওদের মুখটা কেমন যেন পাল্টে গিয়েছিলো অন্বেষা!

মাঝেমাঝে নোংরা মন্তব্য আসতো কানে!
অবাঞ্চিত সন্তান! এটার মানেও বুঝতাম না তখন! ওরা বুঝতো কিন্তু!
পরীক্ষার খাতায় আমার চেয়ে ঢের কম নম্বর পেলেও ওরা এসব বুঝতো!

তারপর ICSE তে স্টেট্ থেকে টপ করেছিলাম! পেপারে ছবি বেরোলো! সঙ্গে রয় এন্ড রয় গ্রূপের সুখ্যাতি!
এডপ্টেড, এডপ্টেড শুনতে তখন বড্ডো বাজে লাগতো! কই আর দশটা এডপ্টেড বাচ্চাকে তো এতো ফেস করতে হয়না!

ICSE রেসাল্টের পর আমার ঠাকুরদা ফাউন্ডার অফ রয় অফ রয় আমায় ডেকে পাঠালেন তার বৈঠক খানায়!
সেদিন ঘরে রাখা ওই সেতার টা কিনে দিয়েছিলেন! মুহূর্তেই আমার চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করে উঠেছিল……
কিন্তু উনি বিজনেস ম্যান আফটার অল….. আমায় উনি সেদিন পরিষ্কার করে বলে দিলেন My career is planned! The career path has been made, I just need to follow the path!
ক্লাস ইলেভেনে মোটেই নেওয়া যাবেনা সাইন্স, পড়তে হবে কমার্স, তারপর MBA (ফিনান্স)! নিজেদের কম্পানির লোক ফিনান্স না বুঝলে খুব অসুবিধে হয় কিনা! তাছাড়া আমাকে আনা হয়েছেই এই কম্পানির জন্যে! নয়তো রিরি তো ছিলই…..রিরির বয়েস তখন যদিও এক বছর কি দেড় বছর!

বারবার ওনাকে আমি বলি আমি সাইন্স পড়তে চাই, ফিজিক্স পড়তে চাই, তবে ততক্ষণে অলিখিত এক তরফা বিজনেস ডিল সাইন হয়ে গিয়েছে,
বাড়িতে শুধু একজন ছিল অন্বেষা যে আমার কষ্টটা বুঝতো! আমার মা!
আলতো নরম হাতে সেদিন কপালে একটা ছোট্ট ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বোঝালো সবটা মেনে নেওয়াতেই আমার ভালো!

একটা সেতার ও একটু ভালোবাসার বদলে স্বপ্নগুলো বিক্রি করে দিলাম অন্বেষা!

বছর দুয়েক পর গত হলেন ঠাকুরদা!
তখন St.Xavier’s college এ ফার্স্ট ইয়ার!
হঠাৎ বদলে গেলো বাড়ির সব লোকেদের চেহারা! সব লোক বলতে আমি মূলতঃ তিন জনকে বোঝাচ্ছি….
মা, জেঠু ও জেঠিমা!
শঙ্খরা তখন অনেকটাই ছোট!

ঠাকুরদা মারা যেতেই জেঠু ছেড়ে দিলো বাড়ি, আইনত জেঠিমা কে ডিভোর্স করেননি এখনো, তবে সেই যে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে আর ফিরলেন না!
মাঝেমাঝে হুটহাট করে আসে অফিসে আমার সাথে দেখা করতে! আজ অবধি বুঝলাম না আমি মানুষ টাকে!
অফিস বাড়ি কোনো কিছুতেই মন নেই কোনোদিনই!

মা তখন অফিসের কাজে হাত দিয়েছে, তার আগেও অফিসে যেতে দেখেছি আমি মা কে, তবে রেগুলার নয়, ঠাকুরদা চলে গেলে মা কেমন যেন সব ভুলে, আমাকে ভুলে, রিরি কে ভুলে বিভৎস্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অফিস নিয়ে!
আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, একটা মা কি ভাবে তিন কি চার বছরের শিশুর দিকে ঘুরেও তাকায়না!
রিরি তো আমার মতন Adopted নয়! আমি নিজে রিরি কে দেখতে গিয়েছিলাম হাসপাতালে!
রিরি কাঁদলে কলেজ যেতাম না জানো…..
কেন কে জানে? ওকে ও ভাবে কাঁদতে দেখলে খুব কষ্ট হতো!
ইচ্ছে করতো না জানো ওকে হারাধন দা আর মিনতি দির ভরসায় ফেলে যেতে!

জেঠিমার তখন একটা অন্য রূপ! উঠতে বসতে আমায় অপমান করতো! আমায় অনেক বাজেবাজে কথা শোনাতো! বলতো orphanage ফিরে যেতে!
সেটা কি ভাবে হয় বলতো অন্বেষা!
মা যদিও রোজ বোঝাতো আমাকে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে! ওদের জবাব দিতে গেলে যোগ্য হতে হবে! যোগ্য! সবার সেরা হয়ে উঠতে হবে!
তখন আমি একদম তোমার মতন ছিলাম জানো, হার্ডওয়ার্কিং, ইন্টেলিজেন্ট তবে রেস্পন্সিবিলিটির “R” টাও নেই!
মাঝেমাঝে খুব অদ্ভুত কথা বলতো মা – বলতো ওরা হার্মফুল! খুব খুব হার্মফুল!
আমি আজও জানিনা এই ওরা টা কারা?

বছর দুয়েক ঘুরতে না ঘুরতেই IIM থেকে MBA
করার সুযোগ এলো! ঠাকুরদা থাকলে খুব খুশি হতেন …..খুব!

মা খানিকটা জোর করেই হোস্টেলে থাকতে বলে,
রিরি তখন পাঁচ বছরের বোধহয়! ওর আধোআধো দাদা বলে ডাকটা আমার সব না পাওয়া ভালোবাসা গুলোকে মুছে দিতো! সব অপমান ভুলে যেতাম ওর ডাকটা শুনে! ওকে খায়িয়ে দিতাম নিজে হাতে!
খুব কষ্ট হয়েছিল ওকে ছেড়ে হোস্টেলে যেতে!
ততদিনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম!
পাহাড়ের এপাশের দুনিয়াটা এতো স্বার্থপর অন্বেষা!
কলেজেও সেরকম বন্ধু ছিলোনা! না থাকারই কথা, কারণ সবাই ওখানে আমার থেকে অনেকটা বড়ো ছিল! কারোর চার বছর এক্সপেরিয়েন্স, তো কারোর ছয়!

তারপর MBA শেষ হলে জয়েন করলাম রয় এন্ড রয়…..
কম্পানির কাজকর্ম হলো শুরু!
একদিন অফিসে বসে কাজ করছি হঠাৎ একটা ফোন এলো!
অর্ফানেজের ফাদার খুব অসুস্থ! একটু কথা বলতে চায়!

কতদিন পর ওনার গলা শুনবো, ধৈর্য আর রাখতে পারছিনা!
উনি সেদিন আমায় জানালেন আমি এডপ্টেড নই……
প্রথমে কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না! তারপর ব্যাপারটা আসতে আসতে পরিষ্কার হলো অন্বেষা!

আমি আমার Adopted মা ও বাবার সন্তান তবে অবৈধ! স্কুলে বলা ওদের কথাটার সাথে কেমন যেন মিলে গেলো আমার জীবনটা!

প্রথমে ঠাকুরদা ঠিক করেন অর্ফানেজের ব্যাপারটা! নামটা যদিও উনিই ঠিক করেছিলেন তবে আমায় মেনে নেয়নি!
সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া একজন নারী ও পুরুষ এক বিছানায় রাত কাটাতে পারে তবে তাদের মিলনে নিজের গর্ভে ধরা সন্তান কে স্বীকৃতি দিতে পারেনা তারা!
তাই অপ্রয়োজনীয় বস্তু কে সেদিন তারা রেখে এসেছিলেন পাহাড়ের ওই প্রান্তে!

সময়ের সাথে সাথে আবার পাল্টে যায় সব কিছু! ফোনের মাধ্যমে উনি খবর পান আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মতন আমি নয়! IQ
, Memory, Creativity সবটাই প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটা বেশি!

কম্পানির অবস্থা আসতে আসতে ধরাশায়ী হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে, কম্পানির বিশস্ত ফিন্যান্স advisor কম্পানি ছেড়ে দিলেন, ছোট ছেলে মারা গেলেন, বড়ো ছেলে কিছুই বোঝেনা ব্যবসার!
অগত্যা পাহাড়ি রাস্তায় ফেলে
আসা কাঁচের টুকরো কে রাতারাতি তুলে আনলেন সাহেবি বাংলোয় আবার! তাকে ঘষে মেঝে তৈরী করলেন হীরে…..

সেদিন প্রথম দিন কথাটা শুনে ভীষণ কথাকাটা কাটি চলতে থাকে মায়ের সাথে!
মনের জমানো সব অভিমান ঝেড়ে ফেলেছিলাম আমি! তার আগে অত উঁচু গলায় কারোর সাথে কথা বলিনি! সেদিন মাথার ঠিক ছিলোনা!

অফিসের কাঁচের ঘরের বাইরে দিয়ে পুরো অফিসের লোকজন আমাদের ভেতরের হওয়া মান অভিমানের কথা গুলো শুনতে পায়না কিছুই, তবে সাক্ষী হয়ে থাকে সেই ঝগড়া Vertical Blind
কার্টেনের ফাঁক দিয়ে!

দিন সাতেক কথা বন্ধ হয় মা ছেলের, অফিসে একসাথে লাঞ্চ করা বন্ধ হয়ে যায় তখন!
একদিন বিকেলে মা আমায় ডেকে পাঠান কেবিনে!
মাথায় একটা আলতো স্পর্শ করে হাত দিয়ে, শেষ স্পর্শ অন্বেষা!
মায়ের বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার কষ্ট দেখে…..আমার চোখের জল দুহাত দিয়ে মুছিয়ে দেয়……
সেদিন যখন মা ছেলের ঝগড়া সব মিটে গিয়েছে আমাকে বললো রিরির ডান্স প্রোগামে যাবে সে,
আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম জানো!
মনে হলো মা জানে!

অনেকবার বলেছিলাম আমি তোমায় নিয়ে যাই ড্রাইভ করে, মা আর ছেলে দুজন পাশাপাশি বসে রিরির ডান্স দেখবো!

সেদিন মা আমায় একটা খুব অদ্ভুত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বলে – “রিরি ….রিরি বলে ওকে ডাকিস….রিরি মানে কি?”

আমি বলেছিলাম – “কোনো এক ইংরেজি গল্পের বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম, রিরি মানে গ্লোরী অফ গড!”

ভেজা চোখে মা আমায় জড়িয়ে ধরেছিলো! সেই শেষ বার!
তবু কিছুতেই নিয়ে গেলোনা আমাকে নিজের সঙ্গে!
ফাইলের গোছা হাতে ধরিয়ে মা গাড়ি নিয়ে বেরোলো ড্রাইভার কাকুর সাথে!
ফেরার পথে …….
…….একটা লরি…..এসে ধাক্কা দেয় গাড়িটাকে!
রিরির সাদা ধপধপে নাচের জামা টা তখন লাল রক্তে মাখা!

এক নিমেষেই সব শেষ হয়ে গেলো অন্বেষা!

ডাক্তার বললেন রিরি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার! তবে মা ঠিক নেই একদম! আসতে আসতে সব অর্গান গুলো ফেল হচ্ছিলো, মাল্টিওরগান ফেইলিওর, চলছিল ভেন্টিলেশন……

এরই মধ্যে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলো কাস্টডি তে! মার্ডার সাস্পেক্ট! আমি নাকি গাড়ির কিছু একটা পার্টস খারাপ করে দিয়েছি,
আমার পক্ষে কিছু অসম্ভব নয়!
ওটা কোনো Accident নয় প্ল্যানড মার্ডার কেস!
High IQ তখন নতুন নাম পেলো Abnormally
High IQ…..
তারপর মায়ের সাথে হওয়া ঝগড়াটার সাক্ষী ছিল
পুরো অফিসটা…..
কেসটা স্ট্রং করতে ওরা এটাও বলেছিলো আমি নাকি রিরি কেও মারতে চেয়েছিলাম!
কম্পানি শেয়ার আফটার অল! এতবড়ো কম্পানির লোভ সামলাতে পারে Adopted ছেলে!

টর্চার চলতে থাকলো আমার ওপর রোজ – অপোনেন্ট লইয়ার যাকে জেঠিমা Hire করেছিল রোজ বিকেলে এসে বলতো গিলটি প্লিড করে নাও!
কি প্লিড করবো অন্বেষা! গিল্ট না হয়ে গিলটি প্লিড করা যায়?
যতরকমের টর্চার করা যায় ওরা করতো!
রোজ একিই কথা – সত্যিটা বলো! সত্যি!

দিন পনেরো এরকম চলতে থাকার পর রয় এন্ড রয় কম্পানির লইয়ার বলেন উনি লড়বেন কেসটা! ওনার মনে হয়েছিল আমি গিলটি নই!
উনি আসার পর টর্চারটা বন্ধ হলো,
শুধু সাস্পেক্টের ভিত্তিতে ক্রাইম প্রুভ না হওয়া অবধি ফিসিকালি কাউকে টর্চার করা যায়না!

পুরো একটা Mechanical Engineering এর টিম সার্টিফাই করার পরেও মনে হচ্ছিলো আমি কিছু একটা গোলমাল করেছি, ওই যে বললাম Abnormally High IQ….
সপ্তাহে একদিন করে কোর্টে উঠতো কেসটা হাই প্রায়োরিটির কেস বলে…….

কম্পানির লইয়ার বারবার বলে চলেছেন গাড়িটা প্রথম দশ কিলোমিটর্স Accident
করেনি!
কোনো মেকানিকাল ফল্ট থাকলে তো কলকাতার রাস্তায় প্রথম দশ কিলোমিটর্স চলতো না! গাড়িতে ড্রাইভার, মা ও রিরির ছাড়া Active ফিঙারপ্রিন্টস নেই কারুর!

কেউ গাড়িটার ভেতরে হাত দেয়নি গাড়িটা যখন দাঁড়িয়ে ছিল রিরির স্কুলের বাইরে….

সেইটার সাক্ষী ছিল রাস্তার ওপারের একটা ATM এর বাইরে লাগানো CCTV ফুটেজ!
তবে কিভাবে এটা প্ল্যানড ? কি ভাবে?

আসতে আসতে আমি বুঝতে শুরু করেছিলাম এটা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব!
এখানে কেস চলতে চলতে হয়তো শেষ হয়ে যাবে আমার পুরো জীবনটা!

হঠাৎ একদিন ভোর বেলায় আমাকে ডেকে বলে – মায়ের জ্ঞান ফিরেছে দীর্ঘ দুমাস আর দশ দিন পর, একবার আমাকে দেখতে চাই, সব বাঁধন খুলে দেয় ওরা!

আমি সেদিন শেষ দেখেছিলাম মা কে! মুখে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক, তবে পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম, মা হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলেছিলো

“তুই রিরি কে দেখিস! তুই দাবিদার হয়েও যে ভালোবাসাটা কোনোদিন পাসনি সেই ভালোবাসাটা তুই ওকে দিস…..
কথা দে….তুই ওকে নিজের জীবন দিয়ে আগলে রাখবি….
আর বাবু তোকে অনেক বেশি রেস্পন্সিবল হতে হবে, ওরা খুব হার্মফুল….খুব হার্মফুল…..নিজের ও রিরির অধিকার তুই ছারবিনা কথা দে আমায়! কথা দে!”

তারপরেই কথাগুলো জড়িয়ে এলো মায়ের…..
চোখদুটো বন্ধ হয়ে এলো মায়ের!
মেশিনে সবুজ গ্রাফের লাইনটা সোজা হয়ে গেলো!
ভাগ্গ্যিশ সেদিন পুলিশ, ডাক্তার, রিরি সবাই ছিল ঘরে তাই ওটা আর প্ল্যান্ড ছিলোনা!

সেদিন রাতে দাহ কার্য সম্পন্ন করে ফিরে আসার পর বুঝলাম জেঠিমার করা কেসটা ডিসমিস হয়েছিল!
মা বোধহয় জ্ঞানে এসেছিলো আমায় নির্দোষ প্রমাণ করে রিরির দায়িত্ব টা আমায় দেবে বলে!
আমার সাথে কথা হওয়ার আগে উনি কিছু স্টেটমেন্ট পুলিশ কে দিয়ে যায়……
বোধহয়!

তারপর অন্য পর্ব শুরু হলো!

প্রথমে জেঠিমা এলো আমার কাছে! ক্ষমা চেয়ে বললেন উনি ভুল বুঝেছিলেন……

মানসিক ভাবে একটু ডিপ্রেসেড বলে একটু একটু করে রোজ আমায় কিছু একটা ওষুধ দিতেন, বলতেন বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার
প্যারোনিয়া হয়েছে আমার!
আমিও বিশ্বাস করতাম জানো অন্বেষা….

তারপর একদিন হারাধন দা আমায় বলে মিনতি দি মানে মিনতি মাসি একদিন নেমন্তন্ন করেছে আমায় হাবড়ার বাড়িতে…..
মিনতি মাসি কে আমি চিনতাম অনেকদিনই, মিনতি মাসিই তো রিরি কে কোলে পিঠে মানুষ করেছে! সেদিন ওদের ওখানে গিয়ে জানতে পারি আরও একটা চক্রান্ত রচনা হচ্ছে একিই বাড়িতে! হারাধন দা একদিন চা দিতে গিয়ে শুনে ফেলেছে খানিকটা!

নতুন একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কে ফলো আপ করি, উনি মন বলে একটা সেন্টারে বসেন, Haldirams এর পাশে…..
উনিই আমাকে বলেন যে আমার একটা মানসিক সমস্যা আছে,
কিন্তু সেটা বোর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা প্যারোনিয়া কোনোটাই নয়!
একজন নর্মাল সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সাথে এরকম ঘটনা ঘটলে তার মানসিক অবস্থার পতন ঘটতে বাধ্য….
তার জন্যে কোনো মেডিসিনের প্রয়োজন নেই, আর আমি এতো কিছুর পরেও ওরম একজন মানুষকে বিশ্বাস কেন করছি!”

কড়া ওষুধের এফেক্টটা কাটাতে কাটাতে বছর খানেক লেগে যায়…..

তারপর শুরু হয় কাউন্সিলিং…..মানে Dr
ধর আমাকে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার কাছে রেফার করেন Dr দেব – উনি সাইকোলজিস্ট……

তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে যাই ওখানে,
জমে থাকা সপ্তাহের সাত দিন কথা গুলো কাউকে না বলতে পারলে আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবো অন্বেষা!

জানো অন্বেষা মাঝে মাঝে বুকে ব্যাথা হয় বড্ডো, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, দমবন্ধ হয়ে আসে আমার! ওরা বলে এই মানসিক সমস্যা টা আমায় শেষ করে দিচ্ছে একটু একটু করে!

আমার লোকের সাথে মিশতে ভয় হয় অন্বেষা!
কখন কি প্ল্যান চলছে কার মনে?
এই বুঝি একটা ক্ষতি হয়ে গেলো, এই বুঝি একটা বড়ো ক্ষতি হয়ে গেলো আমার আর রিরির!

খুব ক্লান্ত লাগে আমার অন্বেষা! খুব ক্লান্ত লাগে!
একটা কথা বলবে অন্বেষা আমিই কেন?

আমার সাথেই কেন? এক অদ্ভুত যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমি আটকে, যে ময়দান আমি ছাড়তেও পারছিনা কারণ আমি কথা দিয়ে ফেলেছি আমি নিজেকে আর রিরি কে হারতে দেবোনা কোনোদিন!

আর এ যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আমি লড়তেও পারছিনা
কারণ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিজের লোকজন! ওরা হয়তো আজও জানেনা আমি সেই ছেলে, তবে আমি তো জানি ওরা আমার নিজের!

আমি কি পাপ করেছিলাম অন্বেষা, কি পাপ করেছিলাম?”

অন্বেষার ঠোঁট দুটো কাঁপছিলো থরথর করে, চোখ বেয়ে জলে গাল ভিজছিলো অনেকক্ষণ থেকে, খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো সে, তারপর নাকটা টেনে, দুহাত দিয়ে ভালো করে মুছে নিলো ভেজা গাল ও চোখের নীচ গুলো…..
ব্যাগ থেকে একটু জল বের করে দিলো মিস্টার রায়ের হাতে….
“মিস্টার রায়, গলাটা একটু ভিজিয়ে নিন…..”
খুব মৃদু স্বরে বললো অন্বেষা…..

“তুমি কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলেনা অন্বেষা….বলোনা কি পাপ করেছিলাম আমি যে দিনের পর দিন লড়তে হচ্ছে আমায় এই যুদ্ধ, নিজের সবটা থেকেও নেই! কেন? নিজের মা থেকেও ছিলোনা কোনোদিন! কেন? কেন আমার বরাদ্দ ভালোবাসা কখনো পাইনি আমি…কেন?”

“মহাভারতে কর্ণও তো কোনো পাপ করেনি মিস্টার রায়! সেও তো সূর্য পুত্র ছিল! অনেক বড়ো যোদ্ধাও ছিল, সেও নিজের ভালোবাসা, অধিকার কিচ্ছু পাইনি কোনোদিন!
বারবার অপমানিত হয়েছিল রাজসভায়! তাকেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল নিজের লোকের বিপরীতে, এটাই ধর্ম মিস্টার রায়, এটাই ধর্ম!”

অন্বেষার কথাটা শেষ হতে না হতেই স্ট্রিট লাইটের আলোটা জ্বলে ওঠে আবার!
মিস্টার রায় দেখতে পায় অন্বেষার আধভেজা গালদুটো….
ঝড়টাও কখন থেমেছে ওরা লক্ষ্য করেনি কেউ!

বৃষ্টি এখন থেমেছে…… তবে বাতাসের জোর কমেনি……থেকে থেকে দুলে উঠছে গাছের ডালপালা……পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল ঝরঝর শব্দে ঝরে পড়ছে লালগাড়িটার ছাদে….
সামনের বাড়িটার জানালা গুলো আবার খুলে দিয়েছে বাড়ির কেউ, একটু আগে অবধি ওটা বন্ধ ছিল…..
আধখোলা জানালা টা মাঝেমাঝেই দোল খেয়ে ধাক্কা দিয়ে চলেছে গ্রিলে……

একটু জলে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে মিস্টার রায় স্টার্ট দিলো গাড়িতে……
তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো –

“অন্বেষা! ওঃ! কটা বাজে বলতো? এতো দেরি কি ভাবে হয়ে গেলো?

“ইটস ওকে মিস্টার রায়
বাড়িতে সেরকম কাজ নেই আর সবে মাত্র নটা……
পিজির কাকিমার নিয়ম অনুযায়ী দশটার আগে ঢুকলেই হলো”
একটা সহজ হাসি মুখে কথাটা শেষ করলো অন্বেষা…..

মিস্টার রায়ের ঠোঁটেও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো!
গাড়ি সিগন্যাল পেরিয়ে এগিয়ে চললো অন্বেষার
পিজি কাকিমার নীল বাড়ির দিকে….

(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here