পাতাঝরার শেষে……পর্ব ১৬

0
1542

পাতাঝরার শেষে……
©মৌপর্ণা

পর্ব ১৬) পুরো সত্যি!

“মিস্টার রায়! এখানে সব কিছু এতো দাম কেন?”
মেনু কার্ডের দিকে ইশারা করে ফিসফিস করে বললো অন্বেষা!

মিস্টার রায় কোনো উত্তর দিলোনা, একটু অন্যমনস্ক হয়ে তখনও সে একমনে
তাকিয়ে রইলো টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটার দিকে…

“মিস্টার রায়….”

“হ্যাঁ! কিছু বললে, না না দাম তো স্ট্যান্ডার্ড, শোনোনা এতো ভেবোনা যেটা ভালো লাগে তোমার সেটা অর্ডার করে দাও”
একটা ফেকাসে হাসি দিয়ে কথা শেষ করলো মিস্টার রায়….

“আপনার কি হয়েছে বলুন তো?”

“কই কিছু না তো!”

“তাই? ওপেন টেরাসে বসে ঘামছেন, তখন থেকে দেখছি অন্যমনস্ক! ব্যাপারটা কি বলুন তো? একটু আগে তো সব ঠিকিই ছিল!”

মিস্টার রায় এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো অন্বেষার দিকে, একটু ইতস্তত স্বরে বললো –
“একটা কথা কনফেস করার ছিল!”

“Really! বলুন বলুন! প্লিজ এবারে এটা বলবেন না আমার আগে একজন গার্লফ্রেন্ড ছিল!”

“অন্বেষা, আমি তোমার কনসেন্ট ছাড়া তোমার ফোনে হাত দিয়েছিলাম!”

“তো! মিস্টার রায় এটা আপনার কনফেশন! আপনি সিরিয়াসলি….”

“অন্বেষা, শুভ্রনীল রায় বলে তোমার কোনো বন্ধু আছে আগে বলোনি তো!
আসলে উনি তোমায় পাঁচবার ফোন করেছিলেন, যখন তুমি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিল….
Sorry অন্বেষা! আমি ……তখন আমি ……
তখন পুরো কনফিউস হয়ে গিয়েছিলাম, বারবার মনে হচ্ছিলো আমাদের বাড়ির শুভ্র, তারপর আমি শুভ্রর ফোন নম্বরটা আমার ফোনে সেভ করা নম্বরের সাথে মেলালাম তারপর মনটা কিছুক্ষণ
শান্ত হলো…..
তবে এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি!
এতকিছুর মধ্যে আমি দুটো বড়ো কথা বলতে ভুলে গেলাম – এক যে মানুষটা খুব প্রয়োজনে ফোন করেছিল তোমাকে একবার তাকে তুমি ব্যাক করে নাও আর দুই …..
…….আমি তোমায় বিশ্বাস করি খুব অন্বেষা, বিশ্বাস করো ইচ্ছে করে তোমার ফোনে আমি হাত দীনি…আসলে…..তুমি ঘুমোচ্ছিলে, তাই…..”

মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার রায়ের হাতের তালুটা নিজের দুটো হাতের তালুর মধ্যে জড়িয়ে নিলো অন্বেষা, গলাটা বুজে এসেছিলো এরিই মধ্যে!
ভাঙা গলায় বলে চললো সে –
“প্লিজ কিছু এক্সপ্লেন করবেন না! যেটা করেছেন, ভালো করেছেন! আমায় দুটো মিনিট দেবেন মিস্টার রায়? আমি একটা ফোন করে আসি কেমন?”

“হ্যাঁ যাও…..থ্যাংক ইউ অন্বেষা ফর …….

“ইটস ওকে!”
ছোট একটা উত্তর দিয়েই উঠে দাঁড়ালো অন্বেষা, একটা ফেকাসে হাসি হেসে এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে…….

মিস্টার রায় একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রেস্তোরার সোফায় বসে রইলেন
হেলান দিয়ে, চেয়ে রইলো দীর্ঘ আকাশের দিকে!
আজ আকাশটা বেশ ঝকঝকে, এক ফালি চাঁদ উঠেছে আজ! চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারিপাশটা!
রেস্তোরাটাও বেশ সুন্দর, ছাদের চারিপাশটা সুন্দর করে ফেন্স করে টাঙানো হয়েছে
ছোট্ট ছোট্ট কাঁচের, প্লাস্টিকের ডেকোরেটিভ টব, টবে ফুটে আছে নানান রঙের নাম না জানা ফুল! কোথাও আবার বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন আকারের পাতা!
সব কটা টব ঝোলানো হয়েছে সাদা হ্যাঙ্গিং রোপে, মাথা ঘুরিয়ে ছাদের চারিপাশটা দেখতেই একটা টবে নজর আটকে যায় মিস্টার রায়ের!
সোফা থেকে উঠে একটু একটু করে সে এগিয়ে যান সেই ঝোলানো টবের দিকে, তারপর খানিকক্ষণ একমনে চেয়ে থাকে সে – গাছ টার দিকে, গাছটার কোনো পাতা নেই, ছোট ছোট গোল গোল থোকথোক
– মুক্তোর মতন বল ভোরে আছে টব জুড়ে, সরুসরু ডালে গোছাগোছা মুক্তোর বল! কোথাও বা আবার সেই গোছা
মুক্তোর বল নেমে এসেছে টবের বাইরে! ঢেকে ফেলেছে সে টবের বাইরের অনেকটা অংশ!

“স্যার! এগুলো সাক্যুলেন্ট প্ল্যান্ট! নাম
সেনিশিও রৌলিয়ানো
এদের কে String-of-Pearls or String-of-Beads
বলেও ডাকা হয়, এই যে দেখছেন স্যার পার্লের মতন ছোটছোট পাতা আটকে সরুসরু গাছের ডালে, সেই জন্যেই এগুলোকে String-of-Pearls
বলা হয়! স্যার ওদিকে দেখুন! ওদিকে আরও দুটো কালার আছে, ঐদিকে একটা ব্লু কালারের আছে, ব্লুটা আবার এখানে পাওয়া যায়না স্যার, আসলে…………..
…………………………………………………”

রেস্তোরার স্টাফ না ম্যানেজার সে –
বুঝলো না মিস্টার রায়, তখনও সে নানান ধরণের
সাক্যুলেন্ট চারাদের কথা বলে চলেছেন!

মিস্টার রায়ের তখন বিশেষ মন নেই কথাগুলো শোনার!

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে কে বোঝায় যে মিস্টার রায় গাছটাকে দেখছিলো শুধুই, কারণ এমন ধরণের নানান রঙের গাছ ইদানিং সাজানো হয়েছে রয় ম্যানশনের ডাইনিংয়ে!

সেগুলো যদিও ঝোলানো হয়নি হ্যাঙ্গিং রোপে, তবে জায়গায় জায়গায় সেগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা!

কিন্তু এতো কথার মধ্যে লোকটা হয়তো ঠিকিই বলেছেন একটা কথা –
যে এই ধরণের অন্য রঙের গাছ পাওয়া বড়োই দুষ্কর! তাইতো রয় ম্যানশনের সাজানো বেশিরভাগ গাছগুলোই সবুজ!

লোকটা আরও মিনিট দশেক বকবক করে একটু থামলেন! মিস্টার রায় একটা ছোট্ট থ্যাংক ইউ দিয়ে এগিয়ে গেলেন নিজের বসবার জায়গায়!
“একিই অন্বেষা কোথায়? এখনো সে ফেরেনি ওয়াশরুম থেকে!”

কথাটা ভাবতে ভাবতে মিস্টার রায় চেয়ে দেখলেন হাত ঘড়ির দিকে, ৮:৪০!
কুড়ি মিনিট ধরে অন্বেষা নেই!

দ্রুত মিস্টার রায় ফোনটা পকেট থেকে বের করে, ডায়াল করলেন অন্বেষার নম্বর!
অন্বেষার নম্বর তখনও Busy!

বুকের ভেতর টা কেমন ঢিপঢিপ করছিলো মিস্টার রায়ের! এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছে অন্বেষা! তাও আজকের দিনে!
তাদের দিনটায় তো অন্য কারোর থাকার কথা নয় আজ!
কাঁপা হাতে আরও একবার ডায়াল করলো অন্বেষার নম্বর, নম্বর তখনও Busy!

ফেকাসে মুখে মিস্টার রায় বসে রইলো আরও মিনিট দশেক!
তারপরেই দেখলো অন্বেষা দ্রুত এগিয়ে আসছে টেবিলের দিকে, কপালে একটা ভাঁজ, চোখদুটো ভিজে, ভাঙা গলায় অন্বেষা বললো
“মিস্টার রায়! আমাদের এক্ষুণি বেরোতে হবে!”

“কি হয়েছে অন্বেষা?”

“আপনি চলুন মিস্টার রায়!”

মিস্টার রায়ের হাত টা বাঁ হাতে
শক্ত করে ধরে,
নিজের ডান কাঁধে, হাত ব্যাগটা তুলে নিলো অন্বেষা,
তারপর হনহন করে টেনে নিয়ে চললো মিস্টার রায়কে…..
মিস্টার রায় অবাক হয়ে অন্বেষার পায়ের তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চললেন অন্বেষার পেছন পেছন!

হোটেলের ম্যানেজার বা স্টাফ যে এতক্ষণ ধরে গাছেদের গল্প বলছিলেন সে খুব অদ্ভুত ভাবে চোখ পাকালো ওদের দেখে,
দশ বারোটা মিনিট সে আজ বৃথাই নষ্ট করলো তাদের ওপর!
এতক্ষণ কথা খরচের পরও একটাও অর্ডার না দিয়েই কি ভাবে বেরিয়ে গেলো ওরা!

*************************************************

“অন্বেষা! কি হয়েছে? এরকম পাগলের মতন আমায় টেনে আনলে কেন? কি হয়েছে অন্বেষা? তোমাকে এতো টেন্সড দেখাচ্ছে কেন? কি দেখছো এদিক ওদিক! অন্বেষা আমার দিকে তাকাও….”
লাল গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে দ্রুত কথা গুলো বলে চললেন মিস্টার রায়!

“মিস্টার রায়! ড্রাইভ করে কোনো ফাঁকা জায়গাতে চলুন! প্লিজ! উউউফ এদিকে প্রায় নটা!”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে চললো অন্বেষা!

“অন্বেষা কি হয়েছে? আমায় যদি তুমি না বলো তাহলে আমি……”

“মিস্টার রায়! সবটা বলবো বলেই তো বলছি – আপনি প্লিজ সময় নষ্ট করবেন না দয়া করে! আজই আমায় সবটা বলতে হবে আপনাকে……হ্যাঁ আজই……”

“কিন্তু! অন্বেষা….”

“মিস্টার রায় প্লিজ! প্লিজ!”
বেশ চিৎকার করে কথাটা শেষ করলো অন্বেষা!

***************************************************

“মিস্টার রায়! আপনি কি করছেন? এদিক ওদিক গলিতে কেন ঢুকছেন বারবার! কোনো একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে চলুন!”

“অন্বেষা! আমরা শহরের একদম ভেতরে! এরম জায়গাতে সেরকম জনশূন্য এলাকা পাওয়া যাবেনা ….
এক সেকেন্ড! এক সেকেন্ড!”
বলেই মিস্টার রায় গাড়িটা সাইড করলেন
….

“মিস্টার রায় আপনি গাড়িটা দাঁড় করালেন কেন?”
কথাটা বলতে বলতেই অন্বেষা দেখলো গাড়িটা দাঁড়িয়ে একটা চৌরা রাস্তার ফুটপাথের ডান দিকে ঘেঁষে!
ডান দিকের ফুটপাথের সমস্ত দোকান বন্ধ!

রাস্তার উল্টো পাশে বিশাল এরিয়া নিয়ে একটা বহু পুরোনো বিল্ডিং কমপ্লেক্স!
ঝরঝরে ভাঙা দরজা জানালা!
বহুদিন বোধহয় কেউ থাকেনা এই কমপ্লেক্সে!
সেই জন্যই জায়গাটা শহরতলীর তুলনায় বেশ নির্জন……

“অন্বেষা এর চেয়ে বেশি ফাঁকা জায়গা এই চত্বরে পাওয়া একটু মুশকিল! অন্বেষা এবার তো বলো কি হয়েছে?

অন্বেষা ভালো করে এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো গাড়ির ভেতর থেকেই,
তারপর একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে –
“সব বলবো আমি তোমায়! সব!”

একটু ঢোক গিলে ব্যাগ থেকে মুহূর্তেই জলের বোতল বের করে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিলো অন্বেষা, ওড়নাটা দিয়ে
কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামটা মুছতে মুছতে বলে –
“ওরা এবারে রুম ফ্রেশনারে মেশাচ্ছে ওই কেমিক্যাল……
সেই রুম ফ্রেশনার ইউস করার প্ল্যান করা হচ্ছে তোমার অফিসের ক্যাবিনে!
ওরা তোমাকে একই ভাবে শেষ করে দিতে চাইছে যেভাবে ওরা শেষ করেছিল তোমার বাবা – মিস্টার অর্ঘজিৎ রায় কে!”

“মানে? কি বলছো এসব তুমি? অন্বেষা আমি….”
আঁতকে ওঠে মিস্টার রায়!
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে আসে তার!

অন্বেষা আবার দুটো হাতের তালুর মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে মিস্টার রায়ের হাতের তালু……..
তারপর খুব দৃঢ় গলায় বলে চলে –
“তোমায় শক্ত হতে হবে অনেক! তুমি শক্ত না হলে আমি তোমায় সবটা খুলে বলতে পারবো না! তোমায় অনেক কথা বলার আছে, গত পনেরো ষোলো
দিন থেকে যে কথাগুলো আমি লুকিয়েছি তোমার কাছে, আজ সবটা বলতেই হবে আমায়! তুমি এরম ভেঙে যেওনা প্লিজ! আমি আছি তো তোমার সাথে!”

“আমায় সবটা খুলে বলো অন্বেষা!”

****************************************************

দিন পনেরো আগের কথা –

অফিস থেকে ফিরে ব্যাগ পত্র একটু একটু করে গোছগাছ শুরু করেছি তখন!

তুমি বিশ্বাস করো তখনও অবধি ঠিক ছিল দুর্গাপুর যাওয়ার আগে তোমার আর রিরির সাথে বেরোবো একদিন ঠাকুর দেখতে……

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নতুন কেনা জামাটা ট্রায়াল দিচ্ছিলাম তখন!
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো – একটা আননোন নম্বর……

ফোনটা ধরতেই শুনলাম ফোনের ওপাশের একটা মেয়ের কণ্ঠ, উনি বললেন –

“ম্যাডাম! আমাকে আপনি চিনবেন না, তবে আমি আপনাকে চিনি…..
কোনো…..প্রশ্ন করবেন না ম্যাডাম, আপনি মন দিয়ে শুনুন আমার সমস্ত কথা……..
আপনি যদি ভেবে থাকেন মিস্টার রায়ের ঘর তালায় আটকানো থাকলেই সব বিপদ কেটে যাবে তাহলে আপনি জিনিস টা পুরো ভুল প্রেডিক্ট করছেন!”

আমি আঁতকে উঠি মিস্টার রায়!

মেয়েটির কণ্ঠ আমার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে বলে চলেন –
“আপনার মিস্টার রায় কে বাঁচাতে চাইলে এই শনিবার দেখা করুন! ঠিকানা এই মুহূর্তে আপনার না জানলেও চলবে! আপনি ডিসাইড করুন কি করবেন, আপনার পিজির নীচে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে! আপনাকে আমি জোর করতে পারিনা, তবে এটুকু বলবো যে না এলে আমরা আপনাদের ভালো চেয়েও কিচ্ছু করতে পারবোনা, শুধু বসে থাকবো ধ্বংসের শেষটা দেখার জন্যে!
আর একটা কথা ম্যাডাম, এই ব্যাপারটা যেন ও বাড়ির কেউ না জানতে পারে এক্ষুণি, এমন কি
মিস্টার অরুণজিৎ রায়ও নয়, মনে রাখবেন অরুণজিৎ রায়ের ওভার কনসার্ন টা ওনার জন্যে আরও বড়ো একটা বিপদ ডেকে আনবে!
সময় আসলে ওনাকে সবটা জানাবেন, তবে এক্ষুণি কিচ্ছু নয়!”

তারপর মুহূর্তেই কেটে গেলো সে ফোন!

সেদিন আমি একটা বড়ো অন্যায় করে ফেলি মিস্টার রায়!
সেদিন আমি আপনার বলা সব কথা, আমাদের সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলি রিয়া দি কে! কি করতাম মিস্টার রায়? কি করতাম?
আপনার জীবন সংশয় জেনেও আমি কি ভাবে চুপচাপ বসে থাকতাম, এদিকে একা একা কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না যে কি করবো!
রিয়া দি কে সবটা খুলে না বললে সে কিছুতেই আমাকে সাহায্য করতো না!
সে এমনি শুরু থেকেই চায়নি আমাদের সম্পর্কটা এগোক, অবশ্য সেটা আপনাকে না জেনে!
তাই সম্পূর্ণ কথাটা না বললে রিয়া দি কখনো সাপর্ট করতো না, উল্টে হয়তো আমার বাবাকে ফোন করে আরও জটিল করতো পুরো ব্যাপার টা…..”

“ইটস ওকে! অন্বেষা! তারপর বলো…..

“সেদিন পুরো রাত ধরে চিন্তা ভাবনা করে, রিয়া দি পুরো ব্যাপার টা আলোচনা করে পলাশ দার সাথে,
ঠিক হয় শনিবার আমি আর রিয়া দি যাবো ফোনের ওপাশের মেয়েটির সাথে দেখা করতে!
আমি ফোন করে তাকে জিজ্ঞেস করি আমার সঙ্গে আমার একজন বান্ধবী গেলে কোনো অসুবিধে আছে কি না?
মেয়েটি বলে কোনো অসুবিধে নেই!
মিস্টার রায় তারপর সত্যি সত্যি একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় শনিবার সকাল সাতটায়! পিজির সামনে!
আমি আর রিয়া দি উঠে যায় গাড়িতে!”

রিয়া দির বয়ফ্রেন্ড পলাশ দা ও তার একজন বন্ধু ফলো করে আমাদের গাড়িটাকে দীর্ঘ দু ঘন্টা!

পলাশ দা, রিয়া দি কে একটা লকেট দিয়েছিলো, যেটার মধ্যে একটা ছোট্ট হিডেন
ক্যামেরা লাগানো ছিল!
আমাদের ঘরে হওয়া সব কথা যাতে
ট্রান্সমিট হয় পলাশ দার ফোনে এসব ছিল তারই ব্যবস্থা!

দীর্ঘ দুঘন্টা পর গাড়ি গিয়ে থামে একটা ভীষণ সুন্দর ফার্মহাউসে!
পলাশ দা রা তখন ৮০০ মিটারের তফাতে আমাদের!

আমরা ঢুকে যাই ফার্মহাউসে!
বছর কুড়ির একটি মেয়ে দাঁড়ায় আমাদের সামনে!

তারপর নিয়ে গিয়ে বসায় আমাদের
বসার ঘরে……

দু-একটা গতানুগতিক কথার পর মেয়েটির নাম জানতে পারি আমরা,
মেয়েটির নাম স্বর্ণালী মুখার্জি, Phd করছে কেমিস্ট্রি তে!
আমাদের, তার নিজের কলেজের আইডি দেখায় মেয়েটি,
যদিও আমরা দেখতে চায়নি,
মেয়েটির চোখে একটা অদ্ভুত সততা ছিল সেদিন!
তখন একটু একটু করে বুকের ভেতরের ধুকপুকানি টা হালকা হয়ে আসছিলো….

************(ফ্ল্যাশব্যাক শুরু) **************

স্বর্ণালী : এবারে কাজের কথায় আসা যাক! মিস মিত্র আপনি নিশ্চয় এতদিনে জানেন অরুণজিৎ রায়ের আফটার শেভিং Gel
ও পারফিউমে একটা বিষাক্ত processed
কেমিক্যাল রয়েছে, যেটা একধরণের Slow poisoning করতে পারে!”

অন্বেষা: হ্যাঁ আমি জানি, মানে আমি নিজে হাতে ওটা টেস্ট করি! তারপর ওটা সৌগত কে দিয়ে ভ্যালিডেট করিয়েছি!

স্বর্ণালী: রাইট! মিস মিত্র আপনার একবারও মনে হয়নি ঠিকঠাক করে Slow poisoning হয়ে থাকলে মিস্টার রায়ের হয়তো এতদিন বেঁচে থাকারই কথা নয়!

অন্বেষার নিঃশ্বাসটা আটকে আসে স্বর্ণালীর কথা শুনে!
অস্ফুট স্বরে বলে –
অন্বেষা: হ্যাঁ…….মানে আমি….প্রথমে সত্যি খুব প্যানিকে ছিলাম তারপর ডাক্তার এন্ড চেকাপ শেষে দেখলাম সামান্য একটা Effect হয়েছে মিস্টার রায়ের….

স্বর্ণালী: আর তার কারণ কি হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

অন্বেষা: মিস্টার রায় বলেছেন উনি খুব বেশি হলে পারফিউম মাসে একদিন ইউস করেন….আর আফটার সেভ Gel
টাও…..

স্বর্ণালী: খানিকটা আপনি হয়তো ঠিক! আর খানিকটা ভুল! মিস্টার রায় আপনার ভয়ে বলেছেন উনি পারফিউম ইউস কম করেন!
মিস মিত্র ও বাড়িতে যেমন কেউ একটা হার্মফুল কেমিক্যাল মেশাচ্ছে মিস্টার রায়ের
জিনিসে,
কেউ সেরকম পাল্টেও দিয়েছে হার্মফুল কেমিক্যালের কসমেটিক মিস্টার রায় কে বাঁচানোর জন্যে!
এমন একজন মানুষ যে দিনের পর দিন ওই বিষাক্ত মানুষগুলোর সাথে থেকেও আগলে রেখেছে আপনার চেনা মিস্টার রায় কে!
মিস মিত্র, সেই একিই মানুষ ইচ্ছে করে সেদিন একটা অন্য হার্মলেস কেমিক্যাল ছড়িয়েছিলো মিস্টার রায়ের ঘরে, হার্মলেস হলেও সেই কেমিক্যালের গন্ধ ছিল বিভীৎস্য!
বাড়ির পরিচারক রান্না ঘরেই থাকে,
সেদিন উনি রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই,
সেই মানুষ একটা পুরো বোতল কেমিক্যাল ঢেলে দেয় মিস্টার রায়ের ঘরে – ওটা আপনার জন্যে একটা ক্লু ছিল!
সেই কেমিক্যাল ক্ষতিকর নয়! মানে ততটা নয়!
কারণ যে ভয়ানক প্রসেসড কেমিক্যাল ওরা মেশায় তাতে কিন্তু সেরকম গন্ধ থাকেনা! মানে থাকে অল্প, পারফিউমে মেশালে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা ধরা সম্ভব নেই বললেই চলে!
এর আগেও বহুবার সেই মানুষ একটু আধটু হার্মলেস গন্ধযুক্ত কেমিক্যাল ছড়িয়েছে মিস্টার রায়ের ঘরে, তবে সেটা বারবার ধরতে পারেননি আপনার চেনা মিস্টার অরুণজিৎ রায়!

তবে আপনি কেমিস্ট! আপনার বুঝতে পাড়ারই কথা! তাই সেদিন ইচ্ছে করে সেই মানুষ কেমিক্যালটা একটু বেশিই ঢেলে দেয়!
তবে অন্যদিনের মতন, সেদিন সে
পাল্টায়না মিস্টার রায়ের
আলমারির জিনিস, কারণ সে চেয়েছিলো আপনার নজর ওদিকে যাক, আপনি টেস্ট করুন কেমিক্যাল গুলো!

কিন্তু মিস মিত্র তারপর আপনি কি করলেন? সবটা জানার পরও কোনো পুলিশ কেস নেই, কোনো প্রোটেস্ট নেই? কেন? কেন আপনারা দুজনে সবটা মেনে নিলেন!
তারপর কি মনে হলো আপনাদের?
দরজা বন্ধ করে দিলেই সবটা ফিক্সড!
ও বাড়িতে সবাই ওরা একসাথে থাকে মিস মিত্র!
ওরা চাইলে যেকোনো মুহূর্তে যা ইচ্ছে করতে পারে!”

অন্বেষা: আপনি বিশ্বাস করুন! আমি অনেকবার মিস্টার রায় কে বলেছিলাম, মাঝে দুচার দিন কথাও বলিনি, তবে মিস্টার রায় বললেন উনি কম্পানি ছেড়ে দেবেন, সব শেয়ার ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন আমাদের নিয়ে অন্য কোথাও!

স্বর্ণালী: আর আপনি মেনে নিলেন! কেমন ভালোবাসা আপনার! আর আপনার কি মনে হয় লড়াইটা শুধু প্রপার্টি, শেয়ার!
না! লড়াইটা শুধু শেয়ারের নয়!
ওকে……
ওকে……
আই থিঙ্ক আই নিড টু টেল এভরিথিং টু ইউ!
আমি সবটা জানিনা কিন্তু যতটুকু শুভ্র জানে, যতটুকু শুভ্র আমায় বলেছে……”

অন্বেষা: শুভ্র মানে?

স্বর্ণালী: শুভ্রনীল রায়! রুদ্রনীল রায়ের বড়ো ছেলে! সেই মানুষ যে বারবার প্রটেক্ট করেছে অরুণজিৎ রায় কে! যে আপনাকে ক্লু দিয়েছে নিজে রিস্ক নিয়ে, যার হাত পা বাঁধা!

রিয়া: সবটা খুলে বলো! অন্বেষা কোনো প্রশ্ন করিস না এখন…..
ওনাকে বলতে দে!

স্বর্ণালী:
তাও বছর 32 আগেকার কথা জানেন,
শুভ্রর মা –
রজনী দেবী
তখন নতুন বিয়ে হয়ে এসেছে রয়
ম্যানশনে…..

কম্পানি ফাউন্ডার অর্ঘনীল বাবুর
বড়ো ছেলে রুদ্রনীল রায়ের কোনোদিনই সেরকম মন নেই ব্যবসায়!
বিয়ে দিলেই হয়তো তার মন ফিরবে ব্যবসায়, টাকা পয়সায়!
এই ভেবে খুব তড়িঘড়ি করে খানিকটা কম বয়েসেই বিয়ে দেওয়া হলো তাকে!

কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলোনা! সে তখনও নিজেকে নিয়েই মত্ত!
বাড়িতেই থাকতো সে সারাটাদিন!
সে তখন ব্যস্ত গল্প লেখা, আবৃর্তি, সংগীত চর্চায়!

হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে কিছুতেই তার বাবা ইনভল্ভ করতে পারছিলেন না ব্যবসায়!

তাকে জোর করে এক দুদিন কম্পানি তে নিয়ে গেলেও, পরের দিন যে কার সেই!

অর্ঘনীল বাবুর ছোট ছেলে অর্ঘজিৎ রায় তখন মাস্টার্স করছেন!
তাকে বিজনেসে ইনভল্ভ করলে তার পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে অনেক!

এদিকে শুভ্রর ঠাকুরদা অর্ঘনীল বাবু
তখন একা একা বিজনেস ম্যানেজ করে উঠতে পারছিলেন না কিছুতেই!

সেরকম বিশস্ত ভরসা করার মতন বুদ্ধিমান বিচ্চক্ষণ লোকও ছিলোনা কম্পানিতে!
এদিকে মার্কেটে অন্যআন্য কম্পানি তখন ভালো রকমের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে!
এতো বড়ো ব্যবসা একটু একটু করে ধসে পড়ছিলো লোকের অভাবে!

তখন থেকেই রয় এন্ড রয় –
শুধু এখনকার এই হেলথ ইমিউনিটি পিলস ও হেলথ ড্রিংক বাদে,
বাকি অলমোস্ট সব ধরণের জিনিসই বানাতেন – I mean
consumer goods including beauty and grooming supplies, household care items, soap, detergents.

একদিন একটা ছুটির দিনে বাড়িতেই শুভ্রর ঠাকুরদা – দ বিগ মিস্টার রয়…
কিছু বিজনেস ফাইল নিয়ে বসেছিলেন,
রজনী দেবী বিছানা গোছাতে এসে সেই ফাইলের একটা ছোট্ট ভুল ধরিয়ে দেয় তাকে, তিনি অবাক হয়ে যান!

হঠাৎ ওনার মাথায় আসে, রজনী দেবী তো কমার্স গ্রাডুয়েট! বিজিনেসটাও বোঝেন!
তবে বাইরের লোক খোঁজার কি প্রয়োজন?
ব্যাস! তৎক্ষণাৎ পাল্টে গেলো রজনী দেবীর ডেসিগনেশন!
বাড়ির বৌ থেকে কম্পানির ভরশা দায়ক স্টাফ, যে সবসময় থাকতো মালিকের সাথে!

বছর দুই ঘুরতে না ঘুরতেই রজনী দেবী তার শশুরমশাই এর চোখের মণি হয়ে উঠলেন!
সেটা অবশ্য হওয়ারই কথা ছিল!
রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নাওয়া খাওয়া ভুলে, ধসে যাওয়া কম্পানি আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল সোজা হয়ে শুধু মাত্র রজনী দেবীর জন্যে!

ততদিনে ছোট ছেলে অর্ঘজিৎ রায়ও বিজনেস জয়েন করেছেন, তার বাবা ও বৌদিদির হাতে শুরু হলো তার কাজের হাতেখড়ি!
বেশ দ্রুত ব্যবসা বুঝতে শুরু করেছিলেন তিনি! তবে মাসখানেক যেতেনা না যেতেই হঠাৎ তিনি কম্পানি আসা বন্ধ করে দিলেন!

হফতা খানিক ঘর লাগিয়ে শুয়ে থাকলেন, তখন নাকি শরীর ঠিক নেই তার, তারপর একদিন তার বাবা ও বৌদিদি তাকে খুব চাপাচাপি করতেই তিনি বলেন তার প্রেমিকা – সুবর্ণা চার মাসের
সন্তান সম্ভবা, সে তারই সন্তানের মা হতে চলেছে!
অর্ঘনীল রায় প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন ওই সন্তান কে নষ্ট করে দিতে, তবে ডাক্তারের মতামতে সেটা করলে সুবর্ণা দেবীর জীবনের ঝুঁকি হতে পারে অনেকটা! অবশ্য সুবর্ণা দেবীও রাজি ছিলেন না ব্যাপারটা তে একেবারে! প্রথম সন্তান কোন মা ত্যাগ করতে চায়?

সব দিক ভাবনা চিন্তা করে তিনি সুবর্ণা দেবী কে আবারো ডেকে পাঠালেন রয় ম্যানশন!
সবার মতামত নিয়েই ঠিক হলো হবু সন্তান কে রেখে আসা হবে দেশের সব চেয়ে বড়ো বোর্ডিং অরফ্যানেজে!
এই শর্ত মানলে তবেই সে সুবর্ণা ও অর্ঘজিৎ বাবুর সম্পর্কটা মেনে নেবেন!

সুবর্ণা দেবী অনেক কান্নাকাটি করেছিলেন, বারবার অর্ঘনীল বাবু কে বুঝিয়ে চলেন যখন সে তাদের সম্পর্কটা মেনেই নিচ্ছেন, তবে কেন তাদেরই বংশের প্রথম সন্তান কে মেনে নিচ্ছেন না?

অর্ঘনীল বাবু পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, এতে লোক নিন্দে হবে! বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যে কেউ কি ভাবে সন্তান প্রসব করতে পারে?
প্রাণের চেয়েও তার কাছে তার বংশ ও
কম্পানির রেপুটেশন অনেক খানি বেশি!

তাছাড়া সে তো এখন বাচ্চা টা কে জলে ফেলে দিচ্ছেনা, শুধু বোর্ডিং অর্ফানেজে রাখার কথা বলছে!
অগত্যা ওনার কথা শুনতেই বাধ্য হলেন অর্ঘজিৎ বাবু ও সুবর্ণা দেবী!
বিয়ের পরেই তাদের দুজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দূরের এক শহরে, মাস পাঁচেক পর নিজেদের প্রথম সন্তান কে বোর্ডিং অর্ফানেজে দিয়ে অর্ঘজিৎ বাবু ও সুবর্ণা দেবী ফিরে এলেন রয় ম্যানশন!

অর্ঘজিৎ বাবু শহরে ফিরে আবার মন দিলেন ব্যবসায়, নতুন করে আবার শুরু হলো হাতেখড়ি!

রজনী দেবী কে ততদিনে কম্পানির ডাইরেক্টারের পদে পদস্থ করেছিলেন
অর্ঘনীল বাবু!
সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক ছিল, বাড়ির ছেলেরা তখন কতটাই বা বোঝে ব্যবসার? একজনের তো একেবারেই মন নেই, অন্য জন একেবারেই নতুন!
এদিকে রজনী দেবী রক্ত জল করে প্রায় একাই টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যবসার
অনেকটা!
তার বুদ্ধি ও পরিশ্রমের
দৌলতে রয় এন্ড রয় তখনকার কম্পানির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কম্পানি!

তারপর বেশ কিছুদিন সব ঠিকঠাক চলছিল!
অর্ঘনীল বাবুর সংসার ও ব্যবসা দুটোই তখন সোনায় মোড়া!
একদিকে রজনী দেবী যেমন ব্যবসার সমস্ত ভার নিয়ে দিন প্রতিদিন অর্ঘনীল বাবু কে মুগ্ধ করছিলেন,
অন্য দিকে সুবর্ণা দেবীর কাঁধে পুরো সংসারের ভার!
এতো গুছিয়ে নিপুণ ভাবে তিনি সবার আদর যত্ন করতেন, সবাই তাতেই মুগ্ধ ছিল!
অর্ঘনীল বাবুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এতো যত্নআত্তি তাকে কেউ কখনো করেনি!
তাই তখন বাকি সবাড়ির মতন তিনিও মুগ্ধ ছিলেন সুবর্ণা দেবীর ওপর!

বছর পাঁচেক যেতে না যেতেই অর্ঘনীল বাবুর মাথায় আসে এক অন্য চিন্তা!
খুব হঠাৎ করেই!
এতো বড়ো বাড়ি, ব্যবসার কোনো উত্তরাধিকারী নেই!
কেন?

সেদিন রাতেই তিনি তার বৈঠক খানায় ডেকে পাঠান সবাই কে!
অর্ঘনীল বাবুর কথা শেষ হতে না হতেই তিনি দেখতে পান সুবর্ণা দেবীর অশ্রু ভরা দুই নয়ন!
একদিন কোলে আশা শিশু কে তারা রেখে এসেছিলেন দূর কোনো পাহাড়ের ওপারে, আর তখন বহু বছর চেষ্টার পরও আর কোল আলো করে আসেনি কেউ, তারা নাকি অনেক ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ দেখিয়েছেন, তবে তাতে লাভ হয়নি কিছুই!

রজনী দেবী ভীষণ বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন!

সেদিন রাতে পুরো ব্যাপার টা শোনার পর বছর খানেকের মধ্যেই এলো রায় বাড়ির
দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম বৈধ সন্তান – রুদ্রনীল রায়ের সুপুত্র শুভ্রনীল রায়!

শুভ্র হওয়ার পরও রজনী দেবীর কোনো মন ছিলোনা সংসারে! সে তখনও উন্মত্ত ব্যবসার কাজে!

আসলে ব্যবসার কাজে সুখ্যাতি পেয়ে পেয়ে ঘরে আর মন টিকতো না তার!
না! ব্যাপারটা শুধু টাকা পয়সার নয়!
ব্যাপারটা পাওয়ারের, ক্ষমতার, খ্যাতির,
যশের!

শুভ্র এরই মধ্যে বেড়ে উঠছিলো তার কাকিমার মাতৃস্নেহে ও বাবার বন্ধুক্তের সাথে!
মায়ের প্রতি সেরকম টান ছিলোনা তার কোনোদিনই!

আরও বছর পাঁচেক আবার সব ঠিকঠাক চলে –
রজনী দেবী, অর্ঘজিৎ বাবু ও অর্ঘনীল বাবু তখন ব্যবসায় মত্ত,
ততদিনে অর্ঘজিৎ বাবু বেশ পাকা হাতে ব্যবসা সামলাচ্ছিলেন,
রুদ্রনীল বাবু তার সংগীত ও উপন্যাস চর্চায় মগ্ন,
আর সুবর্ণা দেবীর জগৎ তখন ওই রয় ম্যানশন ও ছোট্ট শুভ্র যাকে সে নিজের ছেলের মতন ভালোবাসতেন!

তারপর অর্ঘনীল বাবু আর সেরকম পেরে উঠছিলেন না,
তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অফিসিয়াল ভাবে তিনি তার কম্পানির সমস্ত ভার তার ছোট পুত্র অর্ঘজিৎ রায়ের হাতে তুলে দিয়ে অবসর নেবেন, যদিও তিনি প্রয়োজনে থাকবেন ও সাহায্যও করবেন কম্পানির কাজে!

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকে সেদিন অর্ঘনীল বাবু জানালেন কম্পানির নতুন প্রেসিডেন্ট তার ছেলে
অর্ঘজিৎ রায়,
কম্পনির ডাইরেক্টার তার বড়ো পুত্রবধূ রজনী রায়!

ঠিক এই সিদ্ধান্ত টাই ঝড় নিয়ে এলো ওই পরিবারে!

রজনী রায় কিচ্ছুতেই এই সত্য টা মেনে নিতে পারলেন না, যাকে সে নিজে হাতে তৈরী করেছিলেন,
যার ব্যবসায় হাতিখরি হয়েছে তার হাত ধরে,
সে পজিশন ওয়াইস তার বস!

সম্পর্কে, বয়েসে, ও কাজের দক্ষতায় সে সব দিক থেকে বড়ো অর্ঘজিৎ এর চেয়ে, তবে কেন তাকে দেওয়া হলোনা উচ্ছতম পদ টা!
কেন তাকে ডাইরেক্টার থেকে প্রমোট করে বানালো হলোনা প্রেসিডেন্ট?
শুরুর দিন থেকে সংসার ভুলে, নিজেকে ভুলে এই কম্পানি কে নিজের সবটুকু দিয়েছে সে! তবে কেন এই পার্শিয়ালিটি?

শুধু এই জন্যে কারণ সে বাড়ির পুত্রবধূ, বাড়ির ছেলে বা মেয়ে নয়!
তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো অর্ঘনীল ও অর্ঘজিৎ বাবুর ওপর, ভীষণ মাত্রায় অশান্তি শুরু হলো,
তারপর রজনী দেবী নিজেই কম্পানি ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলেন সংসারে,
তবে সংসারেও তার সেরকম জায়গা হলোনা তখন!

স্বামী রুদ্রনীল রায় বরাবর একই ভাবে ব্যস্ত নিজের গান বাজনা, সাহিত্যে!

নিজের ছেলে তখন মায়ের চেয়ে বেশি কাকিমা কে ভালোবাসে!

সংসার ও ব্যবসা দুটোর একটা তেও সে আর জায়গা করে নিতে পারলোনা, উল্টো
অর্ঘনীল বাবুর চোখেও সে অনেক নীচু হয়ে গিয়েছিলো নিজের অধিকার চাইতে গিয়ে!

অথচ কি করেনি সে কম্পানির জন্যে!
অর্ঘনীল বাবু কে খুশি করার জন্যে!

রাত রাত জেগে দিনের পর দিন কাজ করেছে,
অর্ঘনীল বাবুর মুখ থেকে একবার উত্তরাধিকারীর কথা শুনে সে শুভ্র কে পৃথিবীতে এনেছে নিজের সেরম ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও!
অথচ আজ একটাবার নিজের অধিকারটা চেয়েছে বলে সে নিমেষেই খারাপ হয়ে গেলো!
কম্পানি ছেড়ে দেবে শুনেও কেউ তাকে একবারও মানাতে এলোনা, কম্পানি ফিরে যেতে বললোনা!
কি স্বার্থপর! এখন তার প্রয়োজন বুঝি ফুরিয়ে এসেছে!

এই ঘটনার পর সে মনে মনে ঘৃণা করতে শুরু করে অর্ঘজিৎ ও সুবর্ণা কে!
একজন তার পজিশন কেড়ে নিয়েছে,
আর একজন তাকে ফিরতে দিচ্ছিলনা সংসারে, রান্না ঘর থেকে বাজার, সংসারের খুঁটিনাটি দায়িত্ত্ব থেকে শুভ্রর দায়িত্ত্ব – সবেতে শুধু সুবর্ণা!

মানসিক ভাবে অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়ছিলেন দিনের পর দিন!
ডাক্তার বলেছিলেন ওনার একটা বেঁচে থাকার অবলম্বন চায় ভীষণ ভাবে!

তারপর শঙ্খ এলো! শুভ্রর ভাই! তবে তাতেও পাল্টালো না কিছুই, উনি তখনও ব্যবসায় হেরে যাওয়ার ব্যাপারটা ভুলতে পারছেনা কিছুতেই!

ওনার তীব্র হিংসা নজরে আসছিলো বাকিদের নজরে, শুভ্র কেও জোর করে ঘরে আটকে রাখতে শুরু করেন উনি! তার কাকিমার সাথে তখন শুভ্রর কথা বলা বন্ধ!

বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই বুকের যন্ত্রনায় একদিন রাতে প্রাণ হারায় অর্ঘজিৎ বাবু, তার আগেও এরম বুকের যন্ত্রনা হতো মাঝে মাঝে! কেউ বোঝেনি লোকটা ঘুমের মধ্যেই চলে যাবেন এভাবে!

অর্ঘজিৎ বাবু চলে যেতেই সুবর্ণা দেবী ভীষণ একা হয়ে পরে!
দিন রাত শুয়ে থাকতেন ঘর লাগিয়ে অন্ধকার ঘরে!
জীবনে বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন নেই তখন তার কাছে!
শুভ্র – তাকেও তখন রজনী দেবী ধার ঘেঁষতে দিতেন না সুবর্ণার!

একদিকে যেমন বাড়িতে একটা শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো, অন্য দিকে কম্পানির বিশস্ত ফিনান্সিয়াল এডভাইজার কম্পানি ছেড়ে দিলেন!

অর্ঘনীল বাবু অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে একটা উপায় বের করলেন!
উনি ভেবে দেখলেন পাহাড়ের ওপারে রেখে আসা তাদেরই বংশধর কে Adopt
করলে কেমন হয়?

ফোনের মাধ্যমে উনি অনেকবার শুনেছেন বাচ্চাটার অসাধারণ মেধাবীর কথা!
সে এখন ক্লাস নাইন! এসময় গড়ে পিঠে নিলে খুব শীঘ্রই সে ব্যবসার হাল ধরতে পারবে, আর সুবর্ণা দেবীও
এই ট্রমা টা থেকে বেরিয়ে আসবে! হাজার হোক নিজের পেটের সন্তান! সে বৈধ হোক বা অবৈধ!

প্ল্যান মাফিক তিনি রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন রায় বাড়ির প্রথম বংশধর কে রয় ম্যানশনে নিয়ে আসার!
কোর্ট কাগজ, পত্র তৈরী করতে থাকলেন!

তবে এতো কিছুর পরও সে কিন্তু একটাবারের জন্যেও রজনী দেবী
কে ডাকলেন না!

নিজে আবার ব্যবসার হাল ধরলেন, সুবর্ণা দেবী কে দিয়ে সে টুকটাক কাজ করাতে থাকলেন,
তবে রজনী দেবীর
করা খারাপ ব্যবহারের কথা তিনি ভুললেন না!
তাই রজনী দেবী আবার ব্যবসায় ফিরে আসতে চাইলেও তাকে আর ঢুকতে দেওয়া হলোনা কম্পানি তে!

দিন প্রতিদিন রজনী দেবীর হিংসে বাড়তে থাকলো!

এদিকে অর্ঘজিৎ বাবু চলে যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যেই সুবর্ণা দেবী জানতে পারেন তিনি আবারও তিন মাসের সন্তান সম্ভবা!

আসলে সুবর্ণা দেবীর একটু গাইনোকোলোজিক্যাল সমস্যা ছিল খুব সম্ভবত, তাই উনি ব্যাপারটা ধরতে পারেননি দুবারই!
তারপর রিতিকা এলো ও বাড়িতে!
অর্ঘজিৎ বাবু দুই সন্তানের বাবা হয়েও কোনোদিনও সন্তান সুখটুকু পেলেন না!
এটাই বোধহয় নিয়তি!

আরও মাস দুয়েক পর পেপার্স সব রেডি হয়ে গেলে, অরুণজিৎ রায় পা রাখলেন রয় ম্যানশনে এবং অর্ঘনীল বাবু তাকে একটু একটু তৈরী করতে থাকলেন ব্যবসার জন্যে! তখন যদিও আপনার অরুণজিৎ রায় মাত্র ১৪ কি ১৫!

এই কথাটা জানা মাত্রই রজনী দেবীর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো অরুণজিৎ রায়ের ওপর, কারণ খুব সম্ভত দুটো –
১) অরুণজিৎ রায় কে অর্ঘনীল বাবু গড়ছিলেন বিজনেসের জন্যে, সেই কম্পানির জন্যে, যে কম্পানি তে রজনী দেবী কে উনি ঢুকতে দিচ্ছিলেন না!

২) অর্ঘনীল বাবুর শারীরিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিলোনা তখন, অনেক বয়সও হয়েছিল,
তাই অর্ঘনীল বাবু গত হলে পুরোপুরি সম্ভবনা ছিল রজনী দেবী কে
ফিরিয়ে নেওয়া হবে কম্পানি তে! মানে কম্পানি ম্যানেজমেন্ট বোর্ড নির্ঘাত তাকেই ডেকে পাঠাবে,
কিন্তু অর্ঘনীল বাবু মারা যাওয়ার আগেই রজনী দেবীর জায়গায়, যদি
অরুণজিৎ রায় কে বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো আবারও তার পজিশন ছিনিয়ে নেবে অন্য কেউ!

সব মিলিয়ে সেইদিন ওই বছর পনেরোর ছেলেটা জানতেও পারেনা তার কাকিমা তাকে মনে মনে এতো হিংসে করে,
তারপর আরও বছর দুয়েক পর অর্ঘনীল বাবু গত হলেন!

উনি গত হওয়ার আগে, একটা উইলে
তার সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি উনি ভাগ করলেন দুই ভাগে, প্রথম অর্ধেক ভাগ ছিল রুদ্রনীল রায়ের নামে ও দ্বিতীয় অর্ধেক ভাগ ছিল ছোট পুত্রবধূ সুবর্ণা দেবীর নামে….
উনি মারা যাওয়ার আগে আরও দুটো বড়ো কাজ উনি করে যান, উনি সুবর্ণা দেবী কে পুরো কম্পানির পাওয়ার অফ এটর্নি দিয়ে যান ও রজনী দেবী কে ব্ল্যাকলিস্ট করে যান!

জানেন, খুব অদ্ভুত ভাবে উনি এই রজনী দেবী কে ব্ল্যাকলিস্ট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরের দিনই গত হন! এদিকে
অর্ঘনীল বাবু মারা যাওয়ার ঠিক পরেই রুদ্রনীল রায় বাড়ি ছেড়ে চলে যান!
কারণটা আজও আমরা জানিনা!

তারপরের ঘটনা বোধহয় আপনি জানেন খুব সম্ভত!

তারপর অরুণজিৎ রয় বিজনেস জয়েন করেন,
একদিন একটা এক্সিডেন্ট হয়! Car Accident!
সুবর্ণা দেবীর এক্সিডেন্ট হওয়ার পর অকারণে কি ভাবে রজনী দেবী অরুণজিৎ রায় কে Arrest করিয়ে কম্পানি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেকথা অরুণজিৎ রয় আপনার কাছে যে লুকোননি, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস!”

অন্বেষা: হ্যাঁ উনি বলেছেন আমায়!

স্বর্ণালী:
রাইট! মিস মিত্র! এই অবধি তাও…… তাও মেনে নেওয়া যায়!
উনি অরুণজিৎ রায়কে ফাঁসিয়ে কম্পানি থেকে বের করে দিতে চাইলেও…..
……..At least ওনাকে খুন করতে চান নি ততদিন!

অন্বেষা: খুন!

স্বর্ণালী: মানে অরুণজিৎ রয় সুবর্ণা দেবীর বয়ান অনুযায়ী ছাড়া পেয়ে রয় ম্যানশনে ফিরে এলে রজনী দেবী slow poisoning করা শুরু করে! ঠিক সেদিন থেকে, যেদিন অরুণজিৎ রায় নিজের মায়ের দাহ কার্য করে পা রাখেন রায় ম্যানশনে!
প্রথম বেশ কিছুদিন একটা ওষুধ…..
তারপর অরুণজিৎ রায় ওই ওষুধ খেতে না চাইলে ওই কেমিক্যাল, যেটা আপনি ল্যাবে পেয়েছেন ওই পারফিউমে!

রিয়া: এক সেকেন্ড স্বর্ণালী, এক সেকেন্ড তার মানে এক বছর নয়, তোমার মনে হয়, অনেক বছর থেকেই ওই কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছিলো মিস্টার রায় – সরি আই মিন অরুণজিৎ রায়ের পারফিউমে!

স্বর্ণালী: হ্যাঁ রিয়া! দীর্ঘ পাঁচ বছর থেকে ওই কেমিক্যাল মেশানোর কথা ছিল রজনী দেবীর প্ল্যান অনুযায়ী!

রিয়া: প্ল্যান মানে? মানে তুমি বলতে চাইছো প্ল্যান ছিল…..
মানে তুমি বলতে চাইছো কথা ছিল…..মানে আসলে…..তার মানে……

স্বর্ণালী: হ্যাঁ! আমি বলতে চাইছি ওই কেমিক্যাল শুধুই কেনা হয়েছিল
প্রথম বছর চারেক, সেটা মেশানো হয়নি বিন্দুমাত্র মিস্টার রায়ের পারফিউমে!
শেষ এক দেড় বছরে ওই কেমিক্যাল বারবার মেশানো হয়, তবে সেটা বহুবার পাল্টেও দিতো একজন!

খুব মৃদু স্বরে কথাটা শেষ করে স্বর্ণালী, এতক্ষণে বিন্দুবিন্দু জল জমছিল স্বর্ণালীর চোখে! ভাঙা ভাঙা গলায় সে বলে চলে,

“তোমরা জানো কেন ওই কেমিক্যাল প্রথম চার বছর মেশে নি মিস্টার রায়ের পারফিউমে, কারণ শুভ্র তা হতে দেয়নি, শুভ্র দিনের পর দিন দীর্ঘ চার বছর
ওই কেমিক্যাল flush করে দিয়েছে টয়লেটে, মিথ্যে বলেছে নিজের মা কে! তারপর একদিন সবটা ধরা পরে যায়, ওর ওপর আরও টর্চার শুরু করেন রজনী দেবী এটা জানতে পেরে যে ও একদিনের জন্যেও মেশায়নি ওই কেমিক্যাল!

তারপর শুভ্র কে ছেড়ে শঙ্খর ওপর দায়িত্ব পরে, শঙ্খ মায়ের ছেলে, ঠিকভুল সে জানেনা, জানতে চায়ও না! দিনের শেষে এক গ্লাস মদ পেলে সে মানুষও খুন করতে পারে!
জানেন মিস মিত্র! শুভ্র অনেকবার….. অনেকবার…… বদলে দিয়েছে মিস্টার রায়ের ঘরে রাখা পারফিউম ও অন্য কসমেটিক!
নিরন্তর ও চেষ্টা করেছে অরুণজিৎ রয় কে বাঁচানোর!

বাড়িতে রজনী দেবীর সামনে কোনোভাবেই একথা ও খুলে বলতে পারবেনা অরুণজিৎ বাবু কে, রজনী দেবী সারাক্ষণ ছেলেকে দুচোখের সামনেই রাখে!
তাই বহুবার অফিসে দেখা করার চেষ্টা করেছে ও
অরুণজিৎ বাবুর সাথে!
কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে সেই দেখা করা সম্ভব হয়নি!

উল্টে আপনি বিশ্বাস করবেন না কি ভাবে জানিনা,
তবে রজনী দেবী বুঝতে পেরে গিয়েছেন যে ও মিস্টার রায়ের সাথে দেখা করতে চায়,
বলে দিতে চায় সব!
মিস্টার রায়ের ফোন, অফিস ল্যান্ডলাইন নাকি সব ট্যাপ করা, যদিও আমরা সিওর নই এই ব্যাপারটাতে! তবে এই কথাটা রজনী দেবী বলেছেন শুভ্র কে!

রজনী দেবী এটাও বলেছেন কাল
এই ব্যাপারটা সবার সামনে এলে শুভ্র কেই পুলিশ Arrest করবে প্রথমে! আফ্টার অল শুভ্রর নামে ওই কেমিক্যাল পারচেজ করা হয়েছে দিনের পর দিন!

সব মিলিয়ে শুভ্র খুব কষ্টে আছে মিস মিত্র!
দগ্ধ্যে দগ্ধে মরে যাচ্ছে ও ভেতর থেকে! ইদানিং ও ঠিক জানেনা কখন শঙ্খ ওই কেমিক্যাল মেশায়, ও আন্দাজেই মাঝে মাঝে গিয়ে সব কসমেটিক চেঞ্জ করে দেয়, তবে ততদিনে বোধহয় মিস্টার রায় ওই কেমিক্যাল একটু আধটু ইউস করে ফেলেন, মানে ও তো জানেই না যে ওরা আর কোথায় ওই কেমিক্যাল মেশাচ্ছে! কবে মেশাচ্ছে?
ও তো না জেনেই………
…….অনেকবার ও ভেবেছিলো একটা বেনামি চিঠি রেখে দেবে লুকিয়ে মিস্টার রায়ের ঘরের আলমারিতে! তবে তারপর মনে হয় সেই আলমারি তো শঙ্খ খোলে, যদি ওই চিঠি অরুণজিৎ বাবুর হাতে না পরে অন্যদের হাতে পরে যায়!
বিশ্বাস করুন, সব আশার আলো যখন একটু একটু করে নিভে আসছিলো, একদিন, একদিন ও আপনাদের গাড়িতে দেখে একসাথে! ও জানতে পারে আপনিও ওই একই কম্পানিতে চাকরি করেন, তারপর ও খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে আপনাদের বেড়ে ওঠা বন্ধুক্ত বা সম্পর্কের কথাটা! আসলে আপনাদের ব্যাপারটা অনেকেই অফিসে আন্দাজ করতে পারেন!
তাই ও আমাকে বলে আপনাকে সবটা খুলে বলতে!
ও নিজে যা যা জেনেছে, যা যা শুনেছে রুদ্রনীল বাবুর কাছে, সেগুলো সবটা, সমস্তটা ও আমায় জানিয়েছে,
ও আজ এখানে আসতে পারেনি, ও চায়না অকারণে ওকে ফলো করতে গিয়ে কেউ আপনাদের হদিশ পেয়ে যাক, মিস মিত্র রজনী দেবী কতটা বিষাক্ত আপনাদের ধারণার বাইরে!
আপনি যদি ভেবে থাকেন ওই দরজা লাগানোটা পার্মানেন্ট সল্যুশন তাহলে আপনি খুব ভুল ভাবছেন!
আমরা সবাই চলুন কিছু একটা করি!
কিছু একটা!
অরুণজিৎ রায়কে বাঁচানোর জন্যে, শুভ্র কে এই যন্ত্রনা থেকে বের করে আনার জন্যে!”

রিয়া: শুভ্র তোমার…..

স্বর্ণালী: হ্যাঁ বয় ফ্রেন্ড! বিশ্বাস করো রিয়া এসবে ওর কোনো দোষ নেই! ও বারবার অন্য একটা ভ্যাপসা গন্ধ যুক্ত হার্মলেস কেমিক্যাল ছড়িয়েছে ও ঘরে, যাতে মিস্টার রায় ব্যাপারটা খানিক আঁচ করতে পারে, তবুও কোনো লাভ হয়নি!
তাই সেদিন ও শেষ প্ল্যান করে, অন্বেষা ঘরে ঢুকলো ওই গন্ধযুক্ত হার্মলেস কেমিক্যাল ও পুরোটাই ঢেলে দেয় টেবিলের ওপর! সেদিন অনেক কষ্টে, ওর পেটে ব্যাথা হচ্ছে বলে ও সানডের ক্লাবের পার্টি তে যায়নি,
শুধু মাত্র অন্বেষাকে একটা হিন্ট দেবে বলে! তাইতো ও সেদিন ঘরের দরজা টাও আধখোলা রেখেছিলো ইচ্ছে করে!
মাস্ক পরে অকারণে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওই অন্ধকার ঘরটা তে!
আমার শুভ্র কোনো দোষ করেনি মিস মিত্র!
বারবার ও আপনাকে আড়চোখে দেখেছে শুধু সত্যি টা আপনাকে বলবে বলে! একটু মুক্ত হবে বলে!
মিস্টার রয় অবধি পৌঁছনো যাবেনা, অফিসে ঢুকলে কেউ স্পাই করছে ওকে, রিরি এসব বুঝবেনা!
তাই এমন কাউকে ও খুঁজছিলো,
যে সাহসী, যে সবটা শুনে, বাঁচাবে ওর দাদাভাই কে!
ও কোনো পাপ করেনি মিস মিত্র! আপনি আসল দোষী কে সাজা দিন আর ওকে এই যন্ত্রনাটা থেকে মুক্তি দিন প্লিজ! প্লিজ!”

বলেই স্বর্ণালী ভেঙে পরে কান্নায়!

**************(ফ্ল্যাশব্যাক শেষ)**************

অন্বেষা নিজের হাতটা মিস্টার রায়ের কাঁধের ওপরে রাখে!
মিস্টার রায় স্টিয়ারিং এর দিকে চেয়ে এক মনে!
বিন্দু বিন্দু জল চোখের কোল বেয়ে আবার নেমে আসছিলো ভেজা গালে……

“মিস্টার রায়! এটা সেদিনের কথা ছিল! এখনও আপনার পুরো সত্যিটা জানা হয়নি!
আজ শুভ্র দা আমাকে আর স্বর্ণালী
দি কে কনফারেন্স কল করেছিল একটু আগে!
স্বর্ণালী দি বলেছিলো সেটা করতে!

আপনি যে নম্বর টা আমার ফোনে দেখেছেন ওটা কিন্তু শুভ্র দার নতুন সিম, ওই নম্বর কেউ জানেনা!

আজ ওরা বলে ওরা জানতে পেরেছে
রজনী দেবী আপনার বাবা কে ওই কেমিক্যাল দিয়েই মেরে ফেলেছেন, slow
Poisoning!
ওই কেমিক্যাল দিনের পর দিন রুম ফ্রেশনারে মিশিয়ে স্প্রে করা হতে থাকে তার অফিস ক্যাবিনে আর এখন সেই একই ঘটনা রজনী দেবী আপনার সাথে করতে চান…..
কারণ আপনি ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় উনি বুঝে গিয়েছেন আর সে আগেকার মতন আপনার কস্মেটিকে ওই কেমিক্যাল মেশাতে পারবেন না, আর তাই পনেরো বছর আগেকার একই ফর্মুলা আবার Apply করা হবে আপনার ওপর!

আপনার কিছু একটা হয়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো মিস্টার রায়!”

অন্বেষার গলাটা ভেঙে আসে আবার!
মিস্টার রায় চেয়ে দেখে অন্বেষার দিকে, এক ফোটা জল গাল না স্পর্শ করেই কোলে এসে পরে অন্বেষার!
অন্বেষা ভাঙা গলায় বলে চলে –

“মিস্টার রায়! তখন আপনি বলেছিলেন আপনাকে আমি কতটা ভালোবাসি,
আমি আপনাকে এতটা ভালোবাসি যে বুকের কলিজা শক্ত করে আমি আপনার জন্যে ওই বিষাক্ত মহিলার সাথে লড়তে পারি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে!
আমি আপনাকে বাঁচানোর জন্যে যে কোনো এক্সটেন্টে যেতে পারি,
আর সব শেষে হেরে গেলে – আপনাকে না বাঁচাতে পারলে, আমি নিজের জীবনটাও….”

“অন্বেষা!”
মিস্টার রায়ের দুটো আঙ্গুল অজান্তেই স্পর্শ করে ফেললো অন্বেষার ভেজা দুটো ঠোঁট কে!
“আর কোনোদিনও একথা বলবেনা তুমি! কোনোদিনও না! কোনোদিনও না!”

মিস্টার রায় ভাঙা গলায় কথাটা শেষ করতেই দুহাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন অন্বেষা কে! আলতো স্পর্শ করে রইলো মিস্টার রায়ের ডান হাতটা অন্বেষার মাথায়, ও বাঁ হাতটা স্পর্শ করে রইলো অন্বেষার
বাঁ কাঁধ টাকে!
অন্বেষা চোখদুটো বুজে চুপচাপ রইলো বসে মিস্টার রায়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে!

“আমিও তোমায় খুব ভালোবাসি অন্বেষা! খুউব! চিরকাল এভাবেই থাকবে তো তুমি!কখনো কোনোদিনও আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো?”

“কোনোদিনও না! কোনোদিনও না!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here