পাতাঝরার শেষে……
©মৌপর্ণা
অন্তিম পর্ব – প্রথম খন্ড!
পর্ব ১৮) তুমি আসবে বলেই!
অন্বেষা কে বাড়ি ড্রপ করে, মান অভিমানের পালা সেরে যখন মিস্টার রায় ঘরে ফিরলো তখন রাত এগারোটা!
হুড়হুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো মিস্টার রায়, তারপর মুহূর্তেই ফ্রেশ হয়ে বললো –
“চল শুভ্র! চল….চল….জেঠু অনেকক্ষণ না খেয়ে বসে….ইসস! চল…আজ বড্ডো দেরি হয়ে গেলো!…..রিরি …..রিরি…খেতে আয়…..নিচে……আমরা এগোচ্ছি…..হারাধন দা, জেঠুর খিদে পেয়েছে বড্ডো, ডিনার দিয়ে দাও টেবিলে! ইন ফ্যাক্ট আমারও খুব খিদে পেয়েছে……”
কথাগুলো বলতে বলতে মিস্টার রায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বসলো টেবিলে শুভ্রর সাথে…….
ফিসফিস করে শুভ্র বললো –
“কি ব্যাপার বলতো বেশ চার্জড আপ লাগছে? কেসটা কি?”
“বাজে বকিস না! পরে বলছি সব! পুরো রাস্তাতে একই কথা চল্লিশ বার বলে গেলো! কি চাপ ভাই! কি ঝগড়ুটে!
এই স্বর্ণলীও এরকম এক কথা টেনে বারবার ঝগড়া করে?”
“করেনা আবার! সব সেম….সব সেম…..
ওয়েলকাম টু ড ওয়ার্ল্ড অফ লাভ!
এখন থেকে এরকম পঞ্চাশ বার Sorry
বলা প্র্যাক্টিস করে নে……
একটা এইটুকু ভুলের জন্যে, তাও একটা কথা বলি অন্বেষা অনেকটা বেটার মনে হয়, মনে হলো মেনে যাবে তাড়াতাড়ি! নয়তো স্বর্ণালীর জন্মদিন ভুলে গেলে ও সিরিয়াসলি আমাকে মারধর লাগিয়ে দিতো! আর তারপর তুই সত্যি চেক দিয়েছিস….তুই পাগল….নাকি…..? চেকটা না দিয়ে গিফট দিতিস পাগল!”
“হমম ঠিক বলেছিস!”
“বাই দি ওয়ে, তোকে দুটো কথা বলার আছে, ওপরে গিয়ে মনে করাস…….”
“ওকে!”
****************************************************
রাতে খাবার সেরে ওরা নিজেদের ঘরে গিয়ে বসলো, খাটে পরে থাকা ল্যাপটপ মুহূর্তেই বন্ধ করে, ঝটপট সব ফাইল পত্র গুছিয়ে মিস্টার রায় বসে পড়লেন খাটে……
একটা কোল বালিশ কোলে নিয়ে বসে শুভ্র দিকে তাকিয়ে বললেন – বল, কি বলছিলিস দুটো কথা…….
শুভ্র মুহূর্তেই হাতের ফোনটা রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলে…..
তারপর ভালো করে উঠে বসলো খাটে, মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে বললো –
“দাদাভাই, দেখ আমি জানি অন্বেষা আর তোর ব্যাপারটা তোদের নিজেদের ব্যাপার!
তবুও আমি কিছু কথা বলতে চাই তোকে….”
“নো প্রব্লেম! বল না!”
“ইউ নো হোয়াট, বাবা যে মা কে ভালোবাসতো না ব্যাপারটা একেবারেই সেরকম নয়! বাবা, মা কে ভালোবাসতো, খুব ভালোবাসতো! তবে কি জানিস কখনো সময় দেয়নি!
সারাটাদিন, শুধু নিজেকে নিয়েই busy থাকতো!
মায়ের মনে জানিসতো একটা ক্ষোভ জন্মে গিয়েছিলো, একটা মানুষ যাকে বাবা সেরকম সময় দিতোনা, তার ছেলে – সেও কাকিমার সাথে থাকতো, ঠাকুরদা সময় এলে যোগ্য সম্মান টুকু দিলোনা, তোর কি মনে হয় দাদাভাই, সত্যি সব দোষটা মায়ের একার? না রে সব দোষ মায়ের একার ছিলোনা!
মা শঙ্খ কে নিজের মতন তৈরী করছিলো, ওর সব রকম জেদ মেটাতো, কেন জানিস ? যাতে শঙ্খ মায়ের সঙ্গে থাকে!
যাতে মা একা না হয়ে যায়!
দাদাভাই ইন শর্ট,
একটা মানুষকে শুধু মনেমনে ভালোবাসাটা যথেষ্ট নয়!
কারণ মনের ভেতরটা কেউ দেখতে পারেনা!
দীর্ঘ চার পাঁচ মাস
তুই অন্বেষা কে সময় দিস নি, আমি তোকে একফোঁটাও দোষ দিচ্ছিনা দাদাভাই! আমি জানি তুই আমার জন্যে ব্যস্ত ছিলিস, আমার জন্যেই তোর অফিসের কাজ পিছিয়ে গিয়েছে, আমার জন্যে!
তবে আমি তোকে সরি বলবোনা!
কি বলতো অনেক খারাপ সময় তুই দেখেছিস, আমি দেখেছি!
এখন কান্নাকাটির দিন পেছনে ফেলে আমি তোদের সবার সঙ্গে সামনের ভালো দিনগুলো কাটাতে চাই!
অফিস, অফিসের কাজ সব সময় থাকবে…..
জানিস দাদাভাই একটা অদৃশ্য ফিনফিনে রেখা আছে, বিটউইন ফ্যামিলি এন্ড ওয়ার্ক! তোকে সেটাই ব্যালান্স করা শিখতে হবে!
নয়তো অন্বেষা আসতে আসতে একা হয়ে যাবে রে! মায়ের মতন!
হয়তো ও মুখে কিছু বলবে না, তবে কষ্ট পাবে!
তুই ওকে কষ্ট দিয়েছিস দাদাভাই, রিলেশানে থাকলে একটা বেসিক এক্সপেক্টশনস থাকে জানিস!
আজ একদিন কষ্ট দিলি, কাল আবার দিবি, ও একদিন কাঁদবে, দুদিন কষ্ট পাবে, তারপর দেখবি ও নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নেবে!
যতই চাপ থাকুক না কেন, ওকে একটু সময় দিস দাদাভাই, নয়তো কাজ কাজ করে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার পর তোর মনে হবে অনেক গুলো রঙিন দিন তোদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে, সেগুলো কিন্তু তখন চেয়েও আর ফিরিয়ে আনতে পারবিনা তুই!
কাল ধর তুই সারাটাদিন কাজ করলি না!
অন্বেষার সাথে বেরোতে গেলি……
কি হবে? একদিন পিছিয়ে যাবি! একমাসের প্রফিট কম হবে, তবে তার বদলে অন্বেষা কে খুশি দেখে তুই যতটা খুশি হবিনা দাদাভাই, দেখবি সেটা তোর কনফিডেন্স টা অনেক বেশি বুস্ট আপ করছে! তুই বুঝছিস রাইট?”
“হমম!” বলেই মিস্টার রায় জড়িয়ে ধরলেন শুভ্র কে…..
“তাহলে কাল বেরোচ্ছিস তো – অন্বেষার সাথে?”
“না, মানে শোন না নেক্সট উইক! পাক্কা! আসলে কাল তুই জানিস না…..কত…..”
“দ্বিতীয় কথাটা বলি?”
মিস্টার রায় অদ্ভুত ভাবে থেমে গেলেন শুভ্রর কথা শুনে…..
“হ্যাঁ বল!”
“কাল সকাল বেলায়, সরি ভোর বেলায়, ছোটোখাটো একটু আধটু খুচরো কাজ কিছু বুঝিয়ে দিস…..
তোর মতন IIM পাসআউট নয়, তবে মাস্টার্স ইন ইকোনমিক্স! তুই শিখিয়ে পরিয়ে দিলে, একটু আধটু তো করেই নেবো…..শিখিয়ে দিবি তো?”
“শুভ্র তুই কম্পানি জয়েন করবি? সত্যি?”
মিস্টার রায়ের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো এবার!
“হ্যাঁ রে দাদাভাই! এক হাতে তুই অনেক কিছু সামলেছিস!
আর কতদিন এভাবে চলবে বলতো?
জয়েন্ট কম্পানি তে, সবাই প্রফিটটা নিচ্ছে তবে এফোর্ট তুই একা দিচ্ছিস!
নট ডান! এমনিও আর ইচ্ছে করছেনা নেট এর বই খোলার, তাই সময় নষ্ট না করে সোমবার তোর সাথে অফিস যাবো….আমাকে সবটা বুঝিয়ে দিবিতো?”
মিস্টার রায় শক্ত করে শুভ্রর কাঁধটা ধরে বললো –
“সবটা শিখিয়ে দেব! সব! তুই শুধু চল আমার সাথে! ভাই এবার সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস! সবটা…..”
“হ্যাঁ! সব ঠিক করে দেব আমি আর তুই!
দাদাভাই আমি তোকে কথা দিলাম, তুইও কথা দে আমায়, আমাদের বড়োরা যে ভুলগুলো করে সংসারটা ভেঙে দিয়েছে, আমরা সেগুলো করবোনা! নিজেদের মধ্যে প্রব্লেম হলে, কথাবলে সঙ্গে সঙ্গে সল্ভ করে নেব! সবসময় দুজন দুজনের পাশে থাকবো! আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি হতে দেবনা, সেটা ঘরে হোক বা কম্পানি তে! কথা দে দাদাভাই!”
মিস্টার রায় জাপ্টে ধরে শুভ্র কে বুকের মাঝে! চোখদুটো বুজে শুভ্র কে জড়িয়ে ধরে বলে –
“কথা দিলাম! প্রমিস!”
একফোঁটা জল চোখ বেয়ে নেমে আসে গালে…..
“হয়েছে অনেক কান্নাকাটি! শোন না দাদাভাই, তাহলে কাল বেরোচ্ছিস তো? আমি কাজগুলো এগিয়ে রাখবো, সব রেডি করে রাখবো, তুই রাতে ফিরে একবার সবটা ক্রস চেক করে নিস…..
কিন্তু কাল তুই একটু ঘুরে আয়…..যাবি তো?”
“হমম! যাবো!”
“যা এবারে একটু ফোন করে নে বৌদি কে!
আমিও স্বর্ণালী কে……”
“এখন?”
“হ্যাঁ এখন!”
“না কাল সকালে বলতাম বেরোবো! বা সারপ্রাইজ দিতাম….”
“হ্যাঁ সে তোর ব্যাপার, তবে আজ রাতে কথা বল!”
“কি বলবো?”
“এ আবার কি? আমি কি ভাবে জানবো তুই কি বলবি? পাগল নাকি তুই? তুই কে রে?”
“না! না! তুই স্বর্ণালী কে কি বলিস রাতে ফোন করে!”
“সেটা আমি তোকে কেন বলবো…..”
“আরে বাবা, লোকে এরকম…. অকারণে রাতে ফোন করে কি বলে…”
“বলে কি করছো? কেমন আছো? খেয়েছো কি না….”
“কি বোকা বোকা! রাতে কি করবে? ঘুমোবে এখন! বা ফেসবুক করছে, বা ওর রুমমেটের সাথে গল্প করছে, এখন তো নাচ গান করবে না, আর এইতো একটু আগে ভালোই ছিল! ভালোই থাকবে……”
শুভ্র এবারে হোহো করে হেসে উঠলো, তারপর বললো –
“তোর দ্বারা হবে না! তুই ছেড়ে দে! তুই একটা কাজ কর! তুই ফোন করে আরও একবার সরি বলে বল, যে কাল তুই বেরোতে চাস….ফাইন….বুঝে গিয়েছিস…..এবার আমি টেরাসে যাই…..স্বর্ণালীর সাথে কথা বলতে……
নয়তো তোর প্রেম সামলাতে গিয়ে আমারটা কেঁচে যাবে…..”
হাসতে হাসতে শুভ্র এগিয়ে গেল ছাদের সিঁড়ির দিকে,
মিস্টার রায় খানিকক্ষণ ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলেন তারপর অন্বেষার নম্বরটা ডায়াল করে দিলেন….
দু তিনটে ring হতেই অন্বেষার গলা শুনতে পেল মিস্টার রায়….
“বলো….কি হয়েছে? আজ হঠাৎ এতো রাতে?”
মৃদু তবে রাগী আওয়াজে বললো অন্বেষা!
“এখনো রেগে আছো? Sorry! আর হবেনা!”
খানিকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ বসে রইলো ফোন ধরে, তারপর অন্বেষা বললো –
“শুধু এটাই বলার ছিল, নাকি আরও কিছু বলবে?”
এবারে গলাটা একটু স্বাভাবিক মনে হলো মিস্টার রায়ের!
ফাইনালি একচল্লিশতম সরি টা কাজ করলো মনে হয়!
“মিস্টার রায়!”
এবারে একটু আদুরে গলা শুনলো মিস্টার রায়!
“হ্যাঁ বলছিলাম কি করছো? কেমন আছো? খেয়েছো?”
“কি?? এটা কি ছিল? মিস্টার রায়! এটা কেউ বলেছে বলতে আপনাকে….
এরকম একসাথে পরপর তিনটে প্রশ্ন! মানে আপনার পার্সোনালিটির সাথে ঠিক যাচ্ছে না! কে শিখিয়েছে? ওয়েট! ওয়েট! বুঝলাম শুভ্র দা শিখিয়েছে এটা তাইনা?”
“নাতো! না না ও কেন শেখাবে! ও শেখায়নি…..”
আটকে আটকে কথাটা শেষ করলো মিস্টার রায়!
এবারে একটা হাসির আওয়াজ শুনতে পেলো মিস্টার রায়!
কোনোরকমে হাসি থামিয়ে অন্বেষা বললো –
“আপনি ছেড়ে দিন! আপনার দ্বারা হবেনা! ” বলেই হাসতে শুরু করলো আবার!
তারপর আবারও হাসিটা থামিয়ে বললো
“ওকে! আমি এখন রাখি! একটা ওয়েব সিরিজ দেখছিলাম…..”
“শোনো না!”
“বলো!”
“মাঝে মাঝে আপনি বলো কেন, তুমি, আপনি আপনি
বললে ভালো লাগেনা আমার!”
“বেশ! চেষ্টা করবো সবসময় তোমাকে তুমি বলার! আর কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ!”
“কি?”
“কাল বেরোবে? সেকেন্ড ডেট?”
“আজকে কি হলো হঠাৎ! কাজ আছে তো অনেক তোমার, ইটস ওকে মিস্টার রায়, আমি রাগ করেছি বলে সব ফেলে আমার রাগ ভাঙাতে হবেনা! আমি জানি একটা এতবড়ো কম্পানি ….”
“কম্পানি তো সবসময় থাকবে! তবে কম্পানি কম্পানি করে সবসময় ব্যস্ত থাকলে আমরা আমাদের সময়টা হারিয়ে ফেলবো! ফ্যামিলি এন্ড ওয়ার্ক এর মধ্যে বোধহয় একটা অদৃশ্য ফিনফিনে দাগ আছে অন্বেষা, প্লিজ আমায় হেল্প করো, ওই দাগটার ওপর দাঁড়িয়ে দুটো দিক সমান ভাবে ব্যালান্স করতে?”
অন্বেষার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো এবার!
মিস্টার রায় একটু থেমে আবার বলে উঠলো –
“তাহলে …….কাল কটায়?”
“আমি ফ্রি সারাদিন! যখন তুমি বলবে!”
“সকালে দুটো মুভির টিকেট কাটছি…..
কি মুভি দেখবে?”
“যেকোনো বাংলা সিনেমা!”
“আচ্ছা ডান….বাই দি ওয়ে …..আমি কোনোদিনও সিনেমা হলে যায়নি…..”
“সিরিয়াসলি! আপনি সত্যি এলিয়েন!”
বলেই আবার হেসে উঠলো ওরা!
“আবার আপনি…..”
“Sorry”
“তাহলে….মুভি….. লাঞ্চ…..তারপর দেখা যাক….”
“ওকে ফাইন…..”
“ওকে….রাখি….. এখন…..বাই……”
“হমম বাই……গুড নাইট…..”
“গুড নাইট….”
***************************************************
পরের দিন দুপুরে গাড়ি গিয়ে দাঁড়ালো বিশাল একটা শপিং মলের সামনে……
গাড়িটা পার্কিংয়ে রেখে অন্বেষা ও মিস্টার রায় এগিয়ে চললো PVR এর দিকে!
চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে ওরা পৌঁছলো সিনেমা হলের্ বিশাল করিডোরে!
অন্বেষাও এর আগে কখনো এরকম বড়ো সিনেমা হল দেখেনি…..
সিনেমা শুরু হওয়ার মিনিট দশেক আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো ওরা, তাই একটু
এদিকে ওদিক ঘুরলো ওরা বেশ কিছুক্ষণ…..
সিনেমা হলের করিডোরে পপকর্ন, সফ্ট ড্রিংকস, ও বিভিন্ন স্ন্যাকস কাউন্টার…..
ডিজিটাল বোর্ডে বসানো স্ন্যাকসের দাম….
“মিস্টার রায়!”
“কি পপকর্ন খাবে? দাঁড়াও….”
বলতে বলতে নিমেষেই মিস্টার রায় মানি ব্যাগ বের করে একটু এগিয়ে যাচ্ছিলই কি, অন্বেষা মিস্টার রায়ের হাতটা টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো –
“না! ধুর! কেমন একটা বিকট
গন্ধ পপকর্ণে!”
“তোমার মাথাটা গিয়েছে! সারাক্ষণ শুধু ওই গন্ধই পাও তুমি! কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ডেট করা বড়ো প্রব্লেম, সারাক্ষণ কেমিক্যালের গন্ধ পায়! কোনো গন্ধ নেই, আমি আনছি….”
“নাঃ প্লিজ আমি খাবোনা….তারপর এতো দাম! প্লিজ বাইরে গিয়ে অন্য কিছু…প্লিজ….”
“পুরো পাগল তুমি! পুরো পাগল! বেশ ঠিক আছে!”
ওদের কথাটা শেষ হতে না হতেই হল নম্বর ৩ খুলে দিলো হাউসকিপিং স্টাফ!
ওরা ঢুকে পড়লো সিনেমা হলে!
ভেলভেটে মোড়া সিঁড়ি, লাল ভেলভেট কভারে মোড়া বড়বড় সোফা!
ভেলভেটের সিঁড়ি দিয়ে খানিক নেমে গিয়ে ওরা বসলো নিজেদের সিটে……
খানিকক্ষণ অন্বেষা ওদের বাড়ির পাশের সিনেমা হল নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো, মিস্টার রায় মন দিয়ে সেসব গল্প শুনতে থাকলেন!
সিনেমা হল নিয়ে কথা বলতে বলতে আজ হঠাৎ সে গোপালমাঠ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো!
আজকেই মিস্টার রায় জানতে পারলেন অন্বেষার বাড়ি প্রপার দুর্গাপুরে নয়, দুর্গাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আরও ঘন্টা খানেকের রাস্তা, ড্রাইভ করে গেলে হয়তো ৪০-৪৫ মিনিট, জায়গাটার নাম গোপালমাঠ……
দুর্গাপুর শহর থেকে ৩৫-৪০ কিলোমিটার ভেতর দিকে……
ছোট্ট শহর, গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা!
সব মিলিয়ে বেশ ছিমছাম পরিবেশ, উঁচু উঁচু বিল্ডিং মাল্টিপ্লেক্স নেই সে ছোট্ট এলাকায়,
তবে লম্বা চৌরা দীর্ঘ মাঠ আছে সেখানে, যেখানে আজও ছেলেরা বৃষ্টির জলে কাদা মেখে ফুটবল খেলে খালি পায়ে,
ভিডিওগেম ছেড়ে!
আজও সেই মাঠ জুড়ে আছে আম, জাম, কাঁঠাল গাছ!
আজও আছে সেই স্কুল, সেই
মাস্টারমশাই
যারা হয়তো ফ্লুয়েন্ট কর্পোরেট ইংরেজি বলতে শেখাতে পারেনা, পারেনা তারা বডি ল্যাংগুয়েজ, প্রেসেন্টেশন স্কিল নিয়ে ঘন্টাখানেক বকবক করতে,
তবে তারা নিজের ছাত্রছাত্রী দেড়
বাঁচতে শিখিয়েছি, তাদের জীবনের ঠিকভুল পথগুলো চিনিয়েছে, বড়দের সম্মান করতে শিখিয়েছি, মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে!
সেই ছোট্ট এলাকার শেষ প্রান্তে রয়েছে অন্বেষাদের বাড়ি, লাল কালো মেঝেতে আজও অন্বেষার মা আল্পনা দেয় ঠাকুর ঘরের উঠোনে প্রতি বৃহস্পতি বার,
অন্বেষার বাবার সাইকেল টা আজও হেলান দিয়ে দাঁড় করানো থাকে উঠোনের বৃহৎ নারকেল গাছের ডালে!
সেই সাইকেল, যে সাইকেলের পেছনের লোহার সিটে বসে পড়তে যেত মাস্টারের বাড়ি অন্বেষা, যেত স্কুলে, একটু একটু করে প্রতিদিন এগিয়ে যেত সে নিজের স্বপ্নের দিকে, তারপর বাবার সেই কথা –
“দাদা! আমার মেয়ে এবারও প্রথম, এবারও….কত স্বপ্ন, কত আশা, সেসব কথাগুলো বলতে বলতে অন্বেষার চোখ দুটো জলে ভোরে এলো আবার!
মিস্টার রায় মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন অন্বেষার কথা, হঠাৎ অন্বেষার ভাঙা গলা ও চোখ বেয়ে নেমে আসা জল দেখে নিজের হাতটা দিয়ে আলতো স্পর্শ করলেন অন্বেষার মাথায়!
আলতো গলায় বললেন –
“এই অন্বেষা! কি হলো হ্যাঁ? পাগল মেয়ে একটা! তুমি বাবা কে খুব ভালোবাসো না? খুব মিস করোনা ওদের?”
অন্বেষার ভেজা গালে একটা স্বচ্ছ হাসির রেখা ফুটে উঠলো আবার!
হাত দিয়ে গালটা ভালো করে মুছে নিয়ে বললো –
“মিস্টার রায়, তুমি প্লিজ গোপালমাঠের কথা জিজ্ঞেস করবেনা সবসময়! আমার নস্টালজিক লাগে!”
অন্বেষার কথাটা শেষ হতে না হতেই নিভে গেলো সিনেমা হলের আলো!
শুরু হলো সিনেমা!
মিনিট কুড়ি পর…..
অন্বেষা খুব ফিসফিস করে বললো
“মিস্টার রায়, তুমি সামনের দিকে দেখোনা! সিনেমা দেখোনা…..আমার দিকে চেয়ে আছো কেন?”
মিস্টার রায় খুব ফিসফিস করে উত্তর দিলেন – “কেন? তুমি দেখো সিনেমা!”
“মিস্টার রায়! আমি বেরোবো! ভালো লাগছেনা….একটু কেমন লাগছে! এখানে…..”
“কেমন লাগছে?”
“প্লিজ বেরোবো! সরি….অনেক দাম টিকেটের …..তবে ভালো লাগছেনা…..কেমন লাগছে……প্লিজ….প্লিজ…..”
“আচ্ছা সরি, আর ওভাবে তাকাবো না তোমার দিকে, ওকে? চলো মুভি দেখি….”
“তার জন্যে নয়! প্লিজ চলুন না! প্লিজ!”
“ওকে ম্যাডাম ফাইন….চলো…..”
“সরি, তুমি রাগ করলে না!”
“না আমি রাগ করিনি, এসব বাইরে গিয়ে আলোচনা করি, ফিসফিস করে কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে…..”
“ওকে!”
***************************************************
সিনেমা হল থেকে বেরিয়েই অন্বেষা বেশ কয়েকবার সরি বলে চললো,
মিস্টার রায় ইটস ওকে ইটস ওকে বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে ঢুকলো একটা বেশ বড়োসড়ো রেস্তোরায়…..
রেস্তোরায় ঢুকতেই অন্বেষা প্রসঙ্গ পাল্টে
এবারে নীচু আওয়াজে ফিসফিস করে বললো – “মিস্টার রায়! এখানে অনেক দাম হবে সব কিছু! আপনি টাকা কেন নষ্ট করেন?”
মিস্টার রায় কোনো উত্তর দিলোনা, একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর একটা চেয়ার টেনে একটা হালকা হাসি হেসে বললেন –
“বসো….”
“মিস্টার রায়….এখানে অনেক দাম….”
এবারে মিস্টার রায় খুব আসতে আসতে খানিক টা অন্বেষা কে মিমিক করে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে, ফিসফিস করে বললো –
“তাতে কি হয়েছে? একদিন তো! রোজ তো আসি না! প্লিজ মিস মিত্র আজকে প্লিজ এখানে লাঞ্চ করি….প্লিইইজজ…..”
অন্বেষা কিছু বললো না!
চেনা মিস্টার রায় কে আবার এক অন্য রূপে দেখলো অনেকদিন বাদে, মৃদু হাসি হেসে খানিকক্ষণ চুপচাপ মাথা নীচু করে বসে রইলো তারপর বললো –
“Sorry! মিস্টার রায় আসলে…..তখন হলে….”
“তুমি কি এইরকমই নাকি? মানে একটা ভুল করলে মোটামোটি চল্লিশ পঞ্চাশ বার Sorry বলো, আবার আমি ভুল করলেও মোটামোটি পঞ্চাশ বার Sorry বলা করাও….”
অন্বেষা আবার মৃদু হাসি মেখে,
চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে, কিছু বললো না!
মিস্টার রায় জলের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে
বলে চললেন –
“এন্ড বাই দ ওয়ে, তুমি কোনো ভুল করোনি আজকে, আমি জানি কেন
তোমার অকওয়ার্ড লাগছিলো হলে?”
“এই না না! আপনি যেটা ভাবছেন সেটা নয়, মানে আপনি আমাকে দেখছিলেন বলে নয়!”
অন্বেষার গলাটা উঁচু থেকে শুরু হয়ে শেষ কথাটা এসে মিলিয়ে গেলো ঠোঁটে, একটু অদ্ভুত লাগলো বলতে যে, মিস্টার রায়ের চেয়ে দেখাটা তার কাছে অকওয়ার্ড ছিলোনা!
মিস্টার রয় আবার সেই একভাবে তাকিয়ে রইলো অন্বেষার দিকে কিছুক্ষণ, তারপর খুব মৃদু স্বরে বললো –
“আমি জানি আমি একনজরে তোমায় চেয়ে দেখলে তোমার অকওয়ার্ড লাগে না, আমি বললাম আমি জানি তোমার এক্সাক্টলি কেন
অকওয়ার্ড লাগছিলো!”
“কেন বলুন তো? দেখি আপনি কি বুঝেছেন?”
“তুমি আবার কিন্তু আপনি আপনি করা শুরু করেছো অনেকক্ষণ!”
অন্বেষা কিছু বলার আগেই টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো রেস্তোরার স্টাফ!
এদিকে অন্বেষার মনটা তখনও ছটফট করছে মিস্টার রায় কি বুঝেছে সেটা জানার জন্যে!
“অন্বেষা! ওই অন্বেষা! কি ভাবছো হ্যাঁ?
কখন থেকে জিজ্ঞেস করছি…”
“কি মিস্টার রায়?”
“কমপ্লিমেন্টারি ড্রিংক কি নেবে”
“তুমি কি নেবে?”
“ফ্রেশ লাইম সোডা…”
“ওকে আমিও….সেম…..”
টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্টাফ একটা ছোট্ট থ্যাংক ইউ বলে নিমেষেই চলে গেলো ওদের সামনে থেকে,
এরইমধ্যে টেবিলের সামনে রাখা ফিটেড ওভেনে কিছু কাবাব স্টিক রেখে গেলো অন্য একজন স্টাফ!
তারপর সেও চলে গেলে, অন্বেষা একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো –
“হ্যাঁ যেটা বলছিলাম,
কি বলছিলে তুমি, কি বুঝেছো তুমি, আমার কেন অকওয়ার্ড লাগছিলো?”
মিস্টার রায়ের মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো এবার, মৃদু হাসি মুখে বললো –
“বলতেই হবে?”
“প্লিজ বলো না!”
“ওকে! এক হল অন্ধকার ছিল, দুই আমি পাশে বসে ছিলাম, তিন হল টা ফাঁকা ছিল প্রায় আর চার ……চার……”
“চার কি?”
“চার, সামনে বসে থাকা ওরা দুজন, ওয়াস কিসিং….”
ভীষণ দ্রুত কথাটা শেষ করে মিস্টার রয় মাথা নীচু করে গ্রিল স্টিক থেকে, দ্রুত
চিকেন, Prawn, মটন ফর্ক দিয়ে বের
করে গোছাতে শুরু করলো অন্বেষার প্লেটে…..
অন্বেষার কানদুটো লাল হয়ে এলো এবার,
কিছুক্ষণ প্লেটের দিকে বসে রইলো সে, তারপর এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের পুরো জলটা শেষ করে কোনোরকমে বললো –
“হমম ঠিক…..সেই জন্যেই একটু অকওয়ার্ড লাগছিলো!…..মিস্টার রয়…….আসলে….”
“আসলে কি?” মিস্টার রায় আবার চেয়ে দেখলো অন্বেষার দিকে….
“আসলে আমার একটু …..”
“সময় চায় ব্যাপার গুলোর জন্যে!
অকওয়ার্ড লাগছিলো ওভাবে ওদের কে দেখে…..
এদিকে আমিও পাশে বসে!
জানি আমি…..নাও খাও এবার!
রিলাক্স আমার তাড়াহুড়ো নেই!
ছাড় এসব কথা, তখন সিনেমা শুরুর আগে কি বলছিলে গোপালমাঠের ব্যাপারে?
না না ওয়েট! গোপালমাঠের কথা বললে তুমি আবার নস্টালজিক হয়ে যাবে, তুমি বরং বাড়ির সবাড়ির কথা বলো, তোমার বাবার, মায়ের, বাড়ির সবাড়ির, তোমার ছেলেবেলার গল্প বলো….”
“ছেলেবেলার কেন? আমি ছেলে নাকি, মেয়েবেলার বলুন! আপনারা সব কিছুতেই ছেলে কথাটা কে এমফাসাইজ কেন করেন বলুন তো?”
“ওঃ! বাবা! পাক্কা ফেমিনিস্টস!”
“হ্যাঁ আমি ফেমিনিস্ট তো!”
“আর খুব ঝগড়ুটেও….”
“কি?? আমি ঝগড়ুটে? এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না কিন্তু!”
“আচ্ছা বাবা! sorry
তুমি নয়, আমি ঝগড়ুটে ফাইন!
তাড়াতাড়ি শেষ করো, ওদিকে তোমার লাইভ চাট কাউন্টার, ফুচকা আছে! ফাও ফুচকা টা কিন্তু আজকে আমার, মনে আছে তো?”
*********************************************************
দুপুরের খাবার সেরে যখন ওরা শপিংমল থেকে বেরিয়ে এলো, পশ্চিম আকাশের সূর্য তখন ঝলমল করছিলো আকাশ জুড়ে,
ঝলমলে রোদের আলোয় গাছের পাতা গুলো আরো সবুজ দেখাচ্ছিল,
অন্বেষাকে ছায়ায় দাঁড় করিয়ে মিস্টার রায় এগিয়ে চললো পার্কিং এর দিকে, তারপর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে আবার ফেরত এলো অন্বেষার সামনে….
অন্বেষা গাড়িতে উঠে সিট্ বেল্ট লাগাতে লাগাতে প্রশ্ন করলো –
“এবার কি প্ল্যান? বাড়ি?”
“না! একদম না! চলো বিকেল থাকতে থাকতে আরও একবার মন্দির ঘুরে আসি….যাবে তো?”
“মন্দির মানে, দক্ষিনেশ্বর?”
“হমম!”
“মাংস খেয়ে মন্দিরে? পাপ হবে মিস্টার রয়!”
হেসে হেসে কথা শেষ করলো অন্বেষা!
“পাপ, পুন্য ব্যাপার টা নির্দিষ্ট নয় জানো অন্বেষা!”
কথাটা বলতে বলতে মিস্টার রায়ের হাসিটা মিলিয়ে গেলো নিমেষে……
“কি হলো? এরকম চুপচাপ হয়ে গেলে যে হঠাৎ!”
“মাঝেমাঝে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে জানো অন্বেষা, একটা কথা বলতো অন্বেষা রজনী রয় একাই দোষী ছিল? আর আমরা সবাই ঠিক ছিলাম! পাপ সে শুধু একাই করেছিল, বাকি সবাই ঠিক ছিল…?”
“মিস্টার রয়! প্লিজ…..তুমি প্লিজ আবার শুরু করোনা! খুব অদ্ভুত লাগে আমার ভাবতে যে মানুষটা……তোমায় দিনের পর দিন…..”
“অন্বেষা! আমি জানি উনি দিনের পর দিন অন্যায় করেছে, ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছে,
কিন্তু কেন করেছে এটা কেউ জানতে চেয়েছে, কাল শুভ্র একটা দামি কথা বললো জানো, বললো
সব দোষ ওর মায়ের ছিলোনা…
দোষ সবাই করেছে, কেউ কম, কেউ বেশি….
Arrest হওয়ার পর কোনো প্রোটেস্ট করলো না মানুষটা!
কিচ্ছু বললো না! সবটা মেনে নিলো!”
“মিস্টার রয়! না মেনে কি করতো? যত এভিডেন্স পুলিশ পেয়েছে তারপর কি….”
“নাঃ গো! ব্যাপারটা শুধু এভিডেন্সের নয়!
তুমি জানো শেষদিন কোর্টরুমে উনি সব কিছু কেন কনফেস করেছিল….
যখন ওরা Lawyer এর কথা জিজ্ঞেস করেছিল উনি কি বলেছিলেন তুমি জানো….”
“কি?”
“বলেছিলো! রয় ম্যানশন ছাড়ার সাথে সাথে ওনার মনে জমে থাকা ঘেন্নাও ওনাকে ছেড়ে দিয়েছেন!
ওই বাড়িটা শুধুই ওনার হেরে যাওয়ার সাক্ষী!
ওই বাড়ি এবং বাড়ির মানুষ সবটা কেড়ে নিয়েছে ওনার থেকে!
উনি অনুতপ্ত নন! যা করেছে ভালো করেছে!
আবার কখনো কখনো এটাও বলছেন বাড়িতে ফিরলে তো সেই রুদ্রনীল বাবুর থেকে টাকা নিতে হবে, তার কাছ থেকে যে কোনোদিন ওই কম্পানির কাজে হাতও দেয়নি!
ইউ নো অন্বেষা হোয়াট! কেউ বোঝেনি মানুষ টা কে কখনো!
আজকে মানুষটার মানসিক অবস্থা টাই ঠিক নেই, অথচ সে জেলে!”
“মানসিক অবস্থা ঠিক না থাকলে, কেউ কাউকে মার্ডার করার প্ল্যান করতে পারেনা!”
“পুরো উল্টো বললে এটা তুমি,
মানসিক অবস্থা সুস্থ থাকলে মানুষ যতো বড়ো সমস্যা তেই থাক না কেন, সে কাউকে আঘাত করেনা কারণ সে জানে তার কাছের মানুষ তার সঙ্গেই আছে, যাই হয়ে যাক না কেন,
তার নিজের মানুষটা শুন্য পথে ঠিক তার হাতটা এসে ধরবে, তাই সে কাউকে আঘাত করেনা, সে স্বপ্ন দেখে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে! জেঠিমার ক্ষেত্রে কোনোদিনই তার সঙ্গে কেউ ছিলোনা!
কেউ না!
কোনো অপরাধী সুস্থ স্বাভাবিক হয়না অন্বেষা! সুস্থ নয় বলেই তো সে সব ধ্বংস করতে চায়!”
অন্বেষা কিছু বলে না, চুপচাপ জানালার বাইরে চেয়ে থাকে!
“অন্বেষা! প্লিজ আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি গো! আমি জানি তুমি যা করেছো…”
“আমি হার্ট হয়নি, মিস্টার রায়! আমি জানি আপনি ঠিক বলছেন! তবে আমার ভালো লাগেনা আপনাকে আপসেট দেখতে! ইটস ওকে মিস্টার রায়! যেটা হওয়ার হয়ে গিয়েছে! একই জিনিস নিয়ে কতদিন কষ্ট পাবেন….”
“ওকে আর কষ্ট পাবনা! তবে, তুমি কবে থেকে কন্সিস্টেন্টলি আমায় তুমি বলে ডাকবে বলতো?”
“দেখা যাক কবে থেকে হয়! তবে তুমি সিরিয়াসলি বলতো আমরা সত্যি মন্দিরে যাচ্ছি…..”
“হ্যাঁ!”
“তবে আজ তাহলে পুজো দেবোনা! আর মন্দিরের ভেতরেও ঢুকবোনা!
বাইরে থেকে প্রণাম করে গঙ্গার ধারের সিঁড়ি তে গিয়ে বসবো, ওকে?”
“কেন ননভেজ খেয়েছো বলে?”
“হ্যাঁ!”
“সিরিয়াসলি অন্বেষা! ননভেজ যখন খেয়েছো পাপ টা তখনই করে ফেলেছো! এখন মন্দিরে….”
“প্লিজজ মিস্টার রয়!”
“আচ্ছা বাবা! ওকে!”
ওরা যখন গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসলো পড়ন্ত রোদের আলো তখন এসে পড়েছে গঙ্গার জলে!
মাঝেমাঝে দমকা হাওয়ায় অন্বেষার চুলগুলো বাঁধনহারা হয়ে উড়ে চললো, অজান্তেই স্পর্শ করে চললো বারবার মিস্টার রায় কে!
“অন্বেষা!”
“হমম বলো!”
“তোমার বাবা সবটা মেনে নেবে বলো? মানে জেঠু বললো আজ বিকেলে কথা বলবে! ভালোই টেনশন হচ্ছে! ভগবান জানে কি হবে?”
“বাবা না মানলেও তোমাকে মানাতে হবে!”
“মানাতে হবে মানে….
তুমি তো বললে মেনে গিয়েছে!”
“হ্যাঁ ওই আর কি! মোটামোটি!
মিস্টার রয়….
ইটস ওকে…..
মেনে যাবে……
কেন এতো ভাবছো বলতো তুমি!
সব ঠিক হয়ে যাবে…..প্লিজ….
শুনছো তুমি…..
মিস্টার রয়…..কি হলো….কি…..”
***************************************************
(এক মাস পর)
মিস্টার রায় – রা যখন অন্বেষাদের বাড়ির সামনের সদর রাস্তায় এসে দাঁড়ালো, শেষ
সন্ধ্যের আকাশ তখন একটু একটু করে আঁধার মাখতে শুরু করেছে গায়ে….
সদর রাস্তা থেকে ঢুকে গিয়েছে কাঁচাপাকা লাল মাটির রাস্তা…..
সদ্য বৃষ্টি হয়েছে বোধহয় একটু আগে! বাতাসে তখনও ভেজা মাটির গন্ধ! রাস্তা গুলোও ভেজা খানিকটা….
ফেকাসে টিমটিমে স্ট্রিট আলোয় মিস্টার রায় দেখলো, অন্বেষার খুড়তো ভাইয়েরা একমুখ হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে….
মিস্টার রায় কে তারা প্রথম দেখেছিলো Amri তে….
সমরেশ বাবুর Accident এর সময়….
তাই প্রথমেই তারা মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে বললো –
“স্যার ভালো সবাই আপনারা? আপনাদের আসতে ভীষণ কষ্ট হলো না?”
“হ্যাঁ ভালো আছি….তবে আসতে একটুও কষ্ট হয়নি….তোমরা সবাই ভালো?”
“হ্যাঁ স্যার! চলে যাচ্ছে আমাদেরও…”
“প্লিজ স্যার বলোনা! আমার সত্যি খুব অস্বস্তি হচ্ছে!”
“আচ্ছা আচ্ছা বেশ! চলুন…”
দু-একটা কথা বলতে বলতে ওরা ছয় জন,
এগিয়ে চললো অন্বেষাদের বাড়ির দিকে….
অন্বেষা দিন দুয়েক আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো বাড়ি,
প্ল্যানমাফিক দিন দুয়েক পর এসে পৌঁছলো মিস্টার রায়রা,
মিস্টার রায়রা মানে রুদ্রনীল রায়, শুভ্র, অরুণজিৎ রায় ও রিরি,
শেষদিন অবধি কে যাবে, না যাবে অনেক হিসেব নিকেশ করে ওরা সবাই চলে এলো আজ!
ব্যাপারটা ভীষণই অদ্ভুত, কিন্তু শেষদিন অবধি ওরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলোনা রিরি কে একা রেখে কি ভাবে ওরা আসবে,
রুদ্রনীল বাবু ও মিস্টার রায় কে তো আসতেই হতো, এদিকে শুভ্র পাশে না থাকলে ইদানিং যেন সব কিছু গুলিয়ে যায় মিস্টার রায়ের!
তার ওপর আবার অন্বেষাদের বাড়ি! অন্বেষার বাবার সামনে যেতে হবে ভেবেই মিস্টার রায়ের কেমন যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিলো!
এতো টেনশন তো CAT দেওয়ার সময়েও হয়নি”
বাড়ির সামনের লাগানো গ্রীলটা খুলে,
ভেজিয়ে রাখা সদর দরজায় একটু ধাক্কা দিয়ে অন্বেষার দুই ভাই এগিয়ে চললো বাড়ির উঠোনের ভেতর,
পেছন পেছন এগিয়ে চললো মিস্টার রায়রা….
অন্বেষার মুখে শোনা কথাগুলো আজ হুবহুব মেলাতে পারছিলো মিস্টার রয়…
যেন এ ছবি সে আগেই দেখেছে অন্বেষার চোখ দিয়ে…..
উঠোনের ঠিক মাঝামাঝি জায়গাতে
বসানো তুলসী মঞ্চ!
সন্ধ্যে প্রদীপ তখনও টিমটিম করে জ্বলছিল শেষ সন্ধ্যে বেলায়…..
খোলা উঠোনের মাথার ওপর বৃহৎ কালো আকাশ, আজ চাঁদ ছিলোনা আকাশে, তবে কিছু তারা মিটমিট করে জ্বলছিল আকাশের বুকের ওপর!
এই বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আজ মিস্টার রায় বুঝতে পারছিলো আকাশটা অন্বেষার এতো প্রিয় কেন!
উঠোনের ডানদিক দিয়ে উঠে গিয়েছে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি,
লোহার সিঁড়ির পাশেই বাঁধানো কলপাড়….
কলপাড়ের ধার ঘেসে বাথরুমের মাথার ওপর দিয়ে উঠে গিয়েছে একটা নারকেল গাছ…
তবে গাছটার ডালে আজ কোনো সাইকেল শোয়ানো নেই…..
উঠোনের বাকি তিনদিকে বাঁধানো খোলা কালোমেঝের বারান্দা…..
কালো বারান্দার ওপর নিখুঁত হাতের আঁকা সাদা আল্পনার কাজ তখন
সদ্য হওয়া বৃষ্টির কারণে জায়গায় জায়গায় হালকা হয়ে এসেছিলো……
মিস্টার রায় তখনও একদৃষ্টিতে চেয়ে সেই আল্পনার দিকে,
মনে আঁকা ছবি গুলোর সাথে আজ যেন কেমন সব মিলে যাচ্ছিলো হুবহুব!
“নমস্কার রুদ্রনীল বাবু!
আপনাদের আসতে খুব কষ্ট হলো বোধহয়! আসলে বাড়ির বাইরে গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই, তাই রাইয়ের বাবা, মানে অন্বেষার বাবা আপনাদের বললো ট্রেনে আসতে…..”
মেনকা দেবীর আওয়াজে মগ্নতা কাটলো মিস্টার রায়ের!
(চলবে…..)