পিশাচ_দেবী ১ম পর্ব

পিশাচ_দেবী
১ম পর্ব
.
মেয়েটার ওপর সব রকম শারীরিক অত্যাচার করার পরও মেয়েটা যখন বুঝতে পারলো ডাকাতের দল তাকে না মেরে আরো কিছুদিন বয়ে বেড়াবে এরকম অত্যাচারের জন্য , তখন সে অসহায় ভাবে কেঁদে বলল :

আমাকে যেতে দিন । আমার বাড়িতে ছোট দুটি বোন আছে। তারা রাতে ভয় পাবে।

ডাকাতদের দলনেতার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে মেয়েটার আরো কাছে এসে থুতনিতে চাপ দিয়ে মুখ উঁচু করে জানতে চাইলেন , বয়স কত ওদের?

মেয়েটা এবার আরো আড়ষ্ট হয়ে গেল। কী একটা কথা যেন ভুল করে ভুল মানুষের সামনে বলে ফেলেছে। মেয়েটা কথা বলছে না দেখে সর্দার তার এক অনুসারিকে চোখের ইশারা করতেই কাপড়ে পেঁচিয়ে এক পাশ গরম লোহাটা নিয়ে এলো। মেয়েটার উরু থেকে গলা পর্যন্ত এই লোহার মাথার আগুনের অসংখ্য পোড়া ছাপ। আড়চোখে তাই লোহার টুকরোটা দেখে শিউরে উঠলো সে। বিড়বিড় করে বলল, ১৪ আর ১৬ ।

সরদার ছাড়া দলের বাকি ৮ জনই সমস্বরে হৈহৈ করে চেঁচিয়ে উঠলো। গুপ্তধন পেয়ে গেছে যেন তারা। সবার চোখ লোভে চকচক করছে।

মেয়েটা প্রথমে তার বাসায় এই দলটাকে নিয়ে যেতে চাইলো না। কিন্তু গরম লোহার স্পর্শ আবার উরুসন্ধিতে পেতেই আকাশ কাঁপানো চিৎকার দিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো। একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই পেছন থেকে গুঁতো খেতে খেতে সামনে বাড়লো সে। দলের বাকি সবাই উৎসুক হয়ে ফিসফিস করতে করতে তার পিছু নিল।

অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। জঙ্গলের গভীরের দিকে হারিকেনের আলোতে শ্লথ গতিতে চলেছে দলটা। সর্দারের আদেশে নীরবতা পালন করে এগোচ্ছে। একজন অনুসারী বলে উঠল , জঙ্গলের এত গভীরে কারো বাড়ি হয় নাকি! মেয়েটার কোনো হুস নেই নয়তো বোকা বানাচ্ছে। এলোমেলো দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।

আরেকজন উত্তর দিল , এমনটা মনে হয় না। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেছে লোহাটাকে। এখন যা করতে বলবি তাই করবে ও লোহার আঁচ থেকে বাঁচতে। জঙ্গলের এইদিকে শুনেছি নদীর একটা দিক বয়ে গেছে। তার তীরে কয়েক ঘর কাঠুরে থাকে।

কয়েক ঘর! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো বাকি সবাই। সর্দারও একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালেন। জঙ্গলের এই দিকে আগে না আসলেও বনভূমি সম্পর্কে ধারণা আছে ওর।

প্রায় ২০ মিনিট মেয়েটার পিছু পিছু হাঁটার পর নদী দিয়ে পানি বয়ে যাওয়ার কলকল শব্দ শুনতে পেল তারা। এবার কিছুটা গতি বাড়িয়ে দিল তারা। আরো ১০ মিনিট হাঁটার পরেই ঝোপ-ঝাড় গাছের সংখ্যা কমে এলো। পরিষ্কার জায়গায় বেরিয়ে এলো তারা । হতচকিত ভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। চোখে গভীর কৌতূহল আর তৃষ্ণা। তাদের থেকে ৫০ ফুট দূরে হবে নদীর তীর। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এই রাতে নদীর কিনারে দুজন তরুণী গোসল করছে। পরনে তাদের এক টুকরো কাপড়ও নেই। দলটাকে দেখে ভয় পেয়ে আৎকে না উঠে উল্টো কামুক দৃষ্টিতে সর্দার আর সবার দিকে তাকিয়ে হাসলো দুই তরুণী। তারপর শরীরে কোনো রকম কাপড় জড়িয়ে হেটে হেটে কুঁড়েতে পৌঁছে চোখ ইশারায় ডাকল তাদের।

সাথে সাথে পাশের দুইটা কামরার দরজাও খুলে গেল সেখানেও তারা দেখলো কয়েকজন তরুণী মেয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মায়া ভরা হাসি আর চোখে তাদের আহবান করছে। তারা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলো না নিজেদের চোখকে। তারপর আত্মহারা হয়ে গেল।

হারিকেন আর এই মেয়েটাকে ফেলে আনন্দে নাচতে নাচতে দলনেতা সহ সবাই সেদিকে ছুটলো। তারা মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল আজ অমাবস্যার রাত। চারদিকে এতো জোৎস্না থাকার কথা না। আর যে মেয়েটাকে অনুসরণ করে তারা এসেছে এখানে , সেই মেয়েটার আসলে এই বয়সী কোনো বোন কোনো কালে ছিলই না, মেয়েটা ফাঁদে ফেলার জন্য মিথ্যে কথা বলে তাদের এখানে নিয়ে এসেছে।

মেয়েটা বিস্মিত হয়ে হারিকেনটা তুলে নিয়ে সামনে ধরলো । অবাক হয়ে ডাকাতের দলটাকে একটা গুহার ভেতর ঢুকে যেতে দেখলো। চারপাশে ঝোপ-ঝাড় আর গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। দলটা কী এমন দেখলো যে এত আনন্দে আলো ছাড়াই এই অন্ধকার গুহার ভেতর ঢুকে গেল!

তবে কী লোকে যেটা বলে সেটা সত্যি ! এই জঙ্গলে কী সত্যিই দেবী হারমা বাস করেন ! সেই মায়ার দেবী ! এই বনের সবচেয়ে ক্ষমতাবান স্বত্তা। বন যার ভাই , নদী যার বোন , সূর্য যার পিতা, মাটি যার মা।

তাদের গোষ্ঠীতে হঠাৎ এক বৃদ্ধলোক এসেছিল। সে এই দেবীর গল্প সবাইকে শুনিয়েছিল। এই বনেই তার বাস। যে তার পূজা করে তাকে বিশ্বাস করে , তার উপাসনা করে এমন কিছু আশা , উপকার নেই যে সে পূরণ করতে পারে না।

মেয়েটার নাম আকলা। এই পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই তার। গোষ্ঠীর সঙ্গে বনের পাশের একটা আবাসে থাকে। বিকেলে একটা গাছের চারা খুঁজতে জঙ্গলে ঢোকে। খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা হয়ে যায় আর সে অনেক গভীরে চলে আসে। তবে তার ভয় নেই , সব রাস্তা তার চেনা । সূর্যের আলো তখনো মিলিয়ে যায়নি। এরকম ভুল তার আগে কখনো হয়নি। পথ ভুলে উল্টোপথে চলে আসে সে। এরপরেই সামনে পড়ে এই ডাকাত দলের। পরের ইতিহাসটা করুণ। পশুর মতো আচরণ করেছে তারা তার সাথে। মৃত্যু কামনা করছিল মেয়েটা নিজের। সেই সময় জানতে পারে তারা তাকে ধরে নিয়ে যাবে দাসী হিসেবে। আরো নির্যাতন ! তখনই শেষ ভরসা হিসেবে দেবী হারমা এর নাম ঝপ করতে থাকে। যদিও সে শুনেছিল এই দেবী পিশাচ। আর তাদের গোত্রে পিশাচ সাধনার সাথে কাউকে জড়িত পেলেই পুড়িয়ে মারার নিয়ম। তাছাড়া এই দেবী অভিশপ্ত হয়ে বন ছেড়ে চলে গেছেন।

পিশাচ দেবী হারমা এই জঙ্গলে এক অদ্ভুত মায়ার জগৎ সৃষ্টি করতে পারতেন। তার একটা মায়ার গুহা রয়েছে । ঐদিকে তাকিয়ে মানুষ যা চিন্তা করে , যা দেখতে চায় তাই তাকে দেখানো হয়। পুরো বাস্তবের মতো মনে হলেও এটা ভয়ংকর মায়া। কেউ এই মায়ায় পরে গুহার ভেতর একবার ঢুকলেই আর বেরোতে পারে না।

জঙ্গলের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানায় এটা নেই। গভীর রাতে দেবী হারমা এর নাম ঝপতে ঝপতে হাটতে হয়। দেবী চাইলে সেই গুহাটা তার সামনে হাজির করেন। যারা এটা জানে তাদেরও এই গুহার মায়া কাটিয়ে ফিরে যেতে কষ্ট হয়। কাঙ্খিত এমন কিছু এমন ভাবে মায়ার মাধ্যমে দেখানো হয় যে এর আকর্ষণ থেকে মুখ ফেরানো অসম্ভব। এগোতে ইচ্ছা করে সামনে।

ডাকাতের দল যেন সেই মায়ায় পড়েছে। দেবী তাকে রক্ষা করেছে। আকলা বিস্মিত দৃষ্টিতে গুহার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়েই উল্টো-পথে হাটা ধরলো। ঐদিকে তাকিয়ে থাকলে হয়তো সেও কোনো মায়ায় আটকে যাবে।

পুরো শরীর জ্বালা করছে তার। পরিধেয় কাপড়কে আর কাপড় বলা যায় না। কয়েক টুকরো শুধু কোনোমতে শরীরের সাথে লেগে রয়েছে। এখন মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে কিছুতেই গোষ্ঠীতে ফিরে যেতে পারবে না ।

হঠাৎই হারিকেনের আলোয় সে দেখলো তার সামনে ইট দিয়ে বাঁধাই করা একটা কুয়ো , সাথে রশি দিয়ে বাঁধা বালতি। আরো আশ্চর্য সে যেই কাপড় পরে জঙ্গলে এসেছিল হুবহু ঐরকম একটা নতুন কাপড় পিঁড়িতে রাখা। এটা কোনো মায়া! কিছুই ভাবতে ইচ্ছা করছে না তার। হারিকেন আর কাপড় এক জায়গায় রেখে কুয়ো থেকে পানি তুলে গায়ে ঢাললো। আশ্চর্যরকম একটা শান্তি অনুভব করলো সে। হঠাৎ খেয়াল হলো শরীরের জ্বালা আর নেই। হারিকেনের আলোতে নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব না হয়ে পারলো না। শরীরের কোথাও এক ফোঁটা আগুনের ছেঁকার দাগও নেই।

কাপড়টা পড়ে , টুকরো ছেড়া-কাপড় গুলো কী মনে করে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলল। অসম্ভব ! কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পেল সে। তার পুরো শরীর অবিশ্বাসে কাঁপছে। এই এক রাত যে তার আর তার গোষ্ঠীর জীবনে কী পরিবর্তন ঘটাবে তার কোনো আন্দাজও নেই আকলার। এত রাতে কেউ জেগে নেই। সে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আকস্মিক এই ঘটনার উত্তেজনায় তখনো তার শরীর কাঁপছে। ………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা : #Masud_Rana

[ শুরুর জন্য পর্বটা ছোট হলো। পরবর্তী পর্বগুলো আরো বড় হবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here