পিশাচ_দেবী ২য় পর্ব + ৩য় পর্ব

পিশাচ_দেবী
২য় পর্ব + ৩য় পর্ব
.
গতদিন সন্ধ্যার পর আকলার ঘরে না ফেরাটা অনেকের নজরে পড়েছিল। সকালে তাই গোষ্ঠীর একজন-দুজন করে মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে এলো। আকলা তাদের সবাইকে সেই ভয়ঙ্কর রাতের বর্ণনা শুনালো। ডাকাত , গুহা , দেবী হারমা। সকলে বিস্মিত হয়ে তার কথা শুনলো। প্রমাণ স্বরূপ আকলা তার ছেড়া , জরাজীর্ণ সেই পোশাকটা দেখালো। সেখানে এখনো বীর্যের দাগ লেগে রয়েছে।

কথাটা পুরো গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। তারা পিশাচ দেবী হারমা সম্পর্কে এমন অনেক কথা শুনেছিল। তবে সবই পুরোনো কাহিনী হিসাবে। এখনো বনে এখনো দেবী রয়েছেন জেনে সবাই কৌতূহলী আর উদ্বিগ্ন। ঘন্টা দুয়েক পরেই গোষ্ঠী প্রধান আকলার ঘরের সামনে হাজির হলেন। বৃদ্ধের বয়স ৭০ এর ওপরে। আকলা তার দোরগোড়ায় গোষ্ঠী প্রধান মানজা বু কে দেখে অবাক হলো। কোনো প্রয়োজনে গোষ্ঠী প্রধান মানুষদের ডেকে আনেন। নিজে আসেন না।

মানজা বু চকিতে বসতেই আকলা হাটু গেড়ে মেঝেতে বসলো। মানজা বু কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই বয়সেও তার চোখের নজর তীক্ষ্ণ। পড়তে চেষ্টা করছে মেয়েটার মন।

আকলা , প্রিয় মা। তুমি কী জানো তুমি কী করছো ?

আকলা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে আরো চুপসে গেল। বৃদ্ধ :

এটা কি ঠিক হচ্ছে তুমি পুরো গোষ্ঠীতে একজন পিশাচ শয়তানের মহত্ত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছ? তুমি কী জানো না আমাদের গোষ্ঠীতে এই পিশাচের নাম নেয়াও মহাপাপ। পিশাচ সাধনার কারণে আমরা আমাদের কত পূর্ব-পুরুষ , আত্মীয় , ভাই হারিয়েছি ? কত রক্তপাত ঘটেছে। সেই সব কাহিনী কী সব মিথ্যা মনে করো তুমি?

কিন্তু বু , আমি বানিয়ে কিছুই বলছি না। যা আমার সাথে ঘটেছে তাই বলছি। সত্যিটা!

মায়ার জগতে সত্য , মিথ্যা বলে কিছু নেই , মা আকলা। এর সবটাই মিথ্যা। এই পিশাচের ভয়ঙ্কর মায়া সম্পর্কে কিইবা জানো তুমি ? আমি আমার বাবা , ভাই, দুই সন্তানকে হারিয়েছি এই পিশাচের কারণে। তুমি যে বললে ডাকাতের কথা , তাদের অত্যাচারের কথা। কিন্তু তোমার গায়ে কী কোনো দাগ আছে ?

আমি বলেছি বু , ওই কুয়োর পানি দিয়ে গোসল করার পর সব কষ্টের সাথে দাগগুলোও মুছে গেছে।

বোকা বানানো হয়েছে তোমাকে। ফাঁদে ফেলা হয়েছে। মায়ার ফাঁদ! তুমি ভাবছো তুমি ডাকাত দলটাকে বোকা বানিয়ে মায়ার জগতে আটকে দিয়েছ পিশাচটার সাহায্যে। কিন্তু হতেও তো পারে এই ডাকাতের দলটাও মায়ার একটা অংশ। তাদের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমিই মায়ায় আটকে গেছ। তোমার যা মনে হচ্ছে রাতে ঘটেছে , তার কিছুই ঘটেনি।

কিন্তু এই ছেড়া কাপড়, লেগে থাকা দাগ! একই রকম নতুন কাপড় পিঁড়ি থেকে আমিই পরেছি। এই দেখুন এখনো আমার পরনে!

এই রকম কাপড় এই গোষ্ঠীতে অন্তত পঞ্চাশ ঘরে পাওয়া যাবে। তুমি জঙ্গলে পেয়েছিলে এই গোষ্ঠীরই কারো ফেলে দেওয়া পুরোনো ছেড়া কাপড় , তুমি যেই কাপড় পরে জঙ্গলে ঢুকেছিলে আর এখন যে কাপড় পরে রয়েছে , দুটো একই। পোশাক পাল্টানোর প্রয়োজন হয়নি তোমার। মায়া তোমাকে ভুল বোঝাচ্ছে!

আকলার কিছুতেই বু এর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। বু তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। আর বলেন :

এইভাবেই প্রতিবার শুরু হয় তার আগমন। একজন সরল মানুষকে ফাঁদে ফেলে। সে তার কথা ছড়িয়ে দেয় গোষ্ঠীতে। এরপর শুরু হয় অনাচার, হত্যা , ধ্বংস। তোমাকে বুঝতে হবে আমার সাহায্য ছাড়া তুমি এতদিন এই বসতিতে থাকতে পারতে না। বাবার পরিচয় হীন একটা মেয়েকে বসতিতে রাখার নিয়ম নেই। তবুও আমি সদয় হয়েছি। কিন্তু পিশাচ শয়তানটাকে নিয়ে আর একটুও কথা হলে ধরে নেব তুমি এই বসতি ছেড়ে চলে যেতে চাইছ। এই নোংরা , কাপড়টা এখনই পুড়িয়ে ফেল , আমার হুকুম।

এই বলেই মানজা বু ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। ঘরের মাঝখানেই একটা পাতিলে আগুনে পুড়ছে সেই কাপড়টা যা গত রাতের তার ওপর হওয়া অত্যাচারের আর দেবীর দয়ার একমাত্র প্রমান। সে যে পিতৃপরিচয়হীন এটা মনে করিয়ে দেওয়ায় তার মনটা খারাপ হয়ে এলো। সে পিতৃপরিচয়হীন না। আসল কথা হলো তার পিতার পরিচয় গোষ্ঠীর আর কেউ না জানলেও আকলা নিজে জানে। এই বুড়ো গোষ্ঠী প্রধানই তার পিতা। বুড়ো নিজেও জানে না আকলার মা মরার আগে কানে ফিসফিস করে তার বাবার নাম প্রসঙ্গে প্রধান মানজা বু এর নাম নিয়েছিলেন। ছোট বেলা থেকে যদিও সে বুঝতে পারতো লোকটা তার প্রতি একটা টান অনুভব করেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর পিতার দাবি নিয়ে সে কখনো মানজা বু এর কাছে যায়নি । কী লাভ ? কী প্রমাণ আছে তার ? উল্টো গোষ্ঠী ছাড়া হবে সে।

গোষ্ঠী প্রধানের লাঠিয়াল লোক পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। পিশাচ শয়তান হারমা এর নাম যে মুখে আনবে বা আলোচনা করবে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের চাবুক পেটা করা হবে। গোষ্ঠীর কেউ তাই প্রকাশ্যে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ করে দিল। কিন্তু তাদের মনের ভেতরের এই ঘটনার ছাপ মোছার ক্ষমতা কোনো গোষ্ঠী প্ৰধানের নেই।

এক প্রকার নজরবন্দি করেই রাখা হলো আকলাকে। সে টয়লেটে গেলেও যে তার ওপর কেউ নজর রাখছে তা বুঝতে পারে সে। ঘরের সামনেই মাটির চুলো। কাঠের জোগাড় করে দিয়েছেন বু এর লোক।

সারাদিন সেই রাতের জঙ্গলের কাহিনী স্মরণ করেছে আকলা। ভয়ংকর অনুভূতি গুলো এতই তাজা যে সে এখনও নিশ্চিত তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কোনো মায়া না। দেবী হারমা সত্যিই তাকে রক্ষা করেছেন। আপন মনেই ভক্তি জাগলো দেবীর প্রতি। শ্রদ্ধার সাথে তার নাম জপতে জপতে শুয়ে পড়লো আকলা।

সে বুঝতে পারছে সে স্বপ্ন দেখছে। তবুও এত বাস্তব সবকিছু ! সে একটা মাটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। জোৎস্নায় ফকফকে চারপাশ। এই জায়গায় সে আগে আসেনি। হঠাৎ একটা মিষ্টি কন্ঠের সুরেলা খিলখিল হাসির শব্দ শুনে চমকে উঠলো সে। প্রথমে মনে হলো শব্দটা মাটির ঘর থেকে আসছে। পরবর্তীতে বুঝতে পারলো উঠানের সামনে ঝোপের পেছন থেকে শব্দটা আসছে। সে ঝোপের ভেতর গলে সামনে বেরিয়ে গেল।

চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে পুকুরের পানি। সেই পুকুরে অপরূপ রূপবতী একটা মেয়ে গোসল করছে। এত ফর্সা গায়ের রং , টানা চোখ , লম্বা চুলের মেয়ে আগে কখনো দেখেনি আকলা। পুরো দেবী!মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে পানিতে নামতে ইশারা করলো। আকলা পানিতে নামতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারা দুজন দুজনের দিকে।

হঠাৎ খেয়াল করলো আকলা, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ মেয়েটা আসলে তারই প্রতিবিম্ব। হুবহু তার মুখায়ব। শুধু আরো সুন্দর। আকলার শ্যামা রং , দুধে আলতা মিশিয়ে যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিড়বিড় করে প্রতিবিম্ব বলল :

মাথা নোয়া দেবীর সামনে আশীর্বাদ পেতে।

কে দেবী !

আমাকে চিনতে পারছিস না! যে তোর লজ্জা লুকাল , তোর সতিত্ত্ব ফিরিয়ে দিল। তাকে ভুললে চলবে ?

আপনি দেবী হারমা ?

তোর কী মনে হয় ?

আপনি আমার মতো দেখতে!

আমিতো তোদের সবার মতই দেখতে। আমি যে তোদের মা। তোদের সবার ভেতরে আমার বাস।

সবাই যে বলে আপনিতো অভিশপ্ত ! আর ডাকলেও আসতে পারবেন না কারো সামনে!

তোরাই আমাকে পরিত্যাগ করেছিস! রক্ত, সম্পদ , ক্ষমতা উন্নতির পথ বন্ধ করে অভিশপ্ত পথ বেছে নিয়েছিস। খেত, খামার করে, ঔষধ বিক্রি করে কোনোমতে বেঁচে আছিস। তোরা কী তোদের পূর্ব পুরুষের উন্নতির , সাহসের , গর্বের গল্প শুনিসনি? আমার দয়া ছাড়া আর কে তোদের গোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ উন্নতিতে পৌঁছে দিয়েছিল। কে না তোদের গোষ্ঠীর লোককে না চিনতো? তাদের দেখলেই মাথা নত করে পালাতো সবাই। আমি এমন কোন ইচ্ছা আছে যা পূরণ করিনা! তবুও কেন আমায় পরিত্যাগ করলো সবাই ?

আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।

কতযুগ পর কেউ আমার নাম এমন বিশ্বাসের সাথে স্বরণ করলো! আমাকে মুক্ত করলো অভিশাপ থেকে। তাইতো তোকে আমার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলাম। তোর কাছে এলাম। তুইই এখন ফিরিয়ে আনতে পারবি তোর গোষ্ঠীর মর্যাদা আমাকে তোদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করে।

কিন্তু , ওরা সবাই যে বলে আপনি ডাইনি!

আমার ক্ষুধার কারণে বলে। কার ক্ষুধা নেই বল ? আমি তোদের সব দিব । তার বদলে তোরা আমার ক্ষুধা মিটাবি না! আমার পূজা করবি না! বিনিময় দিবি না?

বিনিময়!

তোর প্রাণ বাঁচালাম। তোর সব রক্ষা করলাম। তুই কী কৃতজ্ঞ না? তুই তার মূল্য দিবি না? আমার যে খুব ক্ষুধা!

আপনি কী চান?

যা তোরা অপচয় করিস। মাটিকে খাওয়াস। অথচ মাটির তা প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন আমার।

কিন্তু দেবী….।

হঠাৎ করেই আকলা বুঝতে পারে তার নিয়ন্ত্রণ তার কাছে নেই। সে মাথা ঝুকিয়ে পানির নিচে বসে পড়েছে। ভাসা ভাসা ভাবে দেখা দেবীর পা দেখে স্পর্শ করল। দেবীর হাত তার মাথায় স্পর্শ করতেই ঘুম ভেঙে গেল তার ।

হতভম্ব হয়ে নিজের ভেজা কাপড়, শরীর আর ভেজা বিছানা হাতড়াতে থাকে । সে এমন ভাবে ভিজে আছে যে মনে হচ্ছে মাত্র পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসে বিছানায় শুয়েছে কাপড় না পাল্টে। অথচ পুরোটাইতো স্বপ্নে ঘটলো ! ……………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.

#পিশাচ_দেবী
.
৩য় পর্ব
.
এরপর প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। আকলার জীবন আবার আগের মতো চলতে লাগলো। সেদিন স্বপ্নে দেবী হারমাকে দেখার পর থেকে এই পর্যন্ত আর তার কোনো অস্তিত্ব তিনি জানান দেননি আকলাকে। গোষ্ঠীর লোকেদের মাঝে যে ফিসফিসানি ছিল পিশাচ দেবী হারমাকে নিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

আকলার মন থেকে অবশ্য তিনি গেলেন না। সে দিনের অনেক সময়ই দেবীর কথা ভাবে। এমনকি ঘুমানোর আগেও। এই দেবীর কারণে কী এমন ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল এই গোষ্ঠীতে, যে দেবীকে তারা বিতাড়িত করল! এমন কী তার নাম নেয়াও নিষিদ্ধ! কিছুই জানে না আকলা। এই সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে গোষ্ঠীর বৃদ্ধরা। কিন্তু তারা বেশির ভাগই মানজা বু এর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এই বিষয়ে কথা বলবেন না।

দেবীকে সেদিন স্বপ্নে নিজের রূপে পুকুরে দেখার পর থেকে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো আকলার দেবীকে। এক অজানা অনুভূতি শরীরটাকে কাঁপিয়ে তোলে দেবীর কথা মনে এতেই। দেবীকে সে ভুলে থাকতে চাইছিল। কিন্তু পারছিল না কিছুতেই।

অনেকদিন পর আজ রাতে সে ঘুমানোর আগে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো , ” হারমা , হারমা , হারমা , হারমা…..”

স্বপ্নে আবার সেই মাটির ঘরের সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। সামনে ঝোপের কারণে কিছু না দেখা গেলেও আকলা জানে সেখানে একটা পুকুর আছে। তবে আজ সেদিনের মতো জোৎস্না নেই। ঘরের সামনে ঝুলে থাকা হারিকেনের আলোতে চারপাশে তাকালো একবার। নিস্তব্ধ অন্ধকার। এরপর ঘরের ভেতর থেকে অসুস্থ কণ্ঠের একটা গোঙানির শব্দ শুনলো সে। কিছুটা চমকে হারিকেন হাতে নিয়ে ধীরও পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আলোতে , চকিতে শুয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর মেয়েটাকে দেখতে পেল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না আকলা। হারিকেনের আলো ফেলে অপলক ভাবে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এত সুন্দর মুখ!

ধীরে ধীরে মুখায়বটা পরিচিত লাগতে লাগলো। তার মায়ের মুখ! শুধু মুখের রংটা আরো ফর্সা, চোখগুলো আরো বেশি সুন্দর , মুখ নিখুঁত। আর সবচেয়ে অপরিচিত , বেমানান লাগলো মুখে লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটা। সে তার মাকে এত মিষ্টি করে হাসতে কখনই দেখেনি।

মা!

চিনতে পারিস?

আপনি দেবী ? বহুরূপী দেবী ! আমার মায়ের মতো দেখতে।

রূপতো আমার শরীরের অংশ বিশেষ রে। আমার রূপ ইতো তোদের সবার ভেতর রয়েছে। তোদের সবার রূপ আমার ভেতর।

আপনি বাস্তবে আমার সামনে আসেন না , কেন ?

তোরা ডাকলেই আমি আসবো। আমিতো তোদের জন্যই।

কিন্তু ওরা যে বাধা দেয় আপনার নাম মুখে নিতে। বু আর লোকেরা।

ওরা সঠিক পথ রেখে ভুল পথ বেছে নিয়েছে। সহজ পথ ছেড়ে জটিল পথ। সবাই আবার সঠিক পথে চলে আসবে। শুধু শুরু করতে হবে তোকে। তুইই আমাকে আবার তোদের গোষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবি। ফিরিয়ে আনতে পারবি হারানো গৌরব।

কিভাবে?

বিনিময়! এর মাধ্যমেই সব মঙ্গল হবে। উপকারের বিনিময়ে উপকার। আমার ক্ষুধা মেটাতে হবে তোদের। আমার যে খুব ক্ষুধা! তোদের গোরস্থানে আমার প্রবেশ নিষেধ। ওখানে আমি যেতে পারি না । গেলেই দুর্বল হয়ে যাই। তোরাই পারবি আমার ক্ষুধা মেটাতে।

এবার চোখ-মুখ শুকিয়ে আসে আকলার। এখানে গোরস্থানের কথা আসছে কেন ! তার মনে পড়ে দেবীর বলা সেই কথা , ” যা তোরা মাটিকে খাওয়াস। অথচ মাটির তার প্রয়োজন নেই । প্রয়োজন আমার!”

তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ নারী মূর্তিকে এই প্রথম ভয়ঙ্কর লাগলো তার কাছে। বুঝতে পারলো কেন এই দেবীকে সবাই পিশাচ বলে। স্বপ্নেও আকলা প্রচুর পানি পিপাসা অনুভব করতে পারল। ইচ্ছা করলো ছুটে পালায়। সে আৎকে দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠে :

এ আমি কিছুতেই পারবো না। কেউই পারবে না। কেউই করবে না! এ অন্যায়, অনাচার!

কেন করবে না? এর বিনিময়ে কী এমন জিনিস , ইচ্ছা , চাহিদা আছে তোদের যা আমি মেটাবো না ? তোকে রক্ষা করেছি। তার বিনিময় নাই দিলি। কিন্তু তোকে যদি তোর পিতৃপরিচয় জানিয়ে দেই আমি। তবে ?

আকলা দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার আবার বিছানায় শুয়ে থাকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল :

আপনি অন্তর্যামী! আপনি জানেন আমি আমার পিতার নাম জানি!

তুই মনে করে দেখতো তোর মা একবারও বলেছিল কিনা যে তোর বাপ মানজা বু ? সে শুধু তোর বাবার ব্যাপারে বলতে গিয়ে এই নামটা নিয়েছিল। মানজা বু যে তোর বাবা তা বলেনি। পুরো কথা শেষ করার আগেই মারা যায়। মনে করে দেখ!

ভাবনায় ফেলে দেয় কথাটা আকলাকে। সে জেদের সঙ্গে বলে :

আমি ঠিক জানি ! তিনিই আমার বাবা। আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন।

তোর মা এমন একটা পাথর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তোর বাবার নাম কখনো প্রকাশ করবে না সে। এটাতো তোকে তোর মা অনেক বার বলেছে ? তুই জানিস তোদের গোষ্ঠীর সেই পবিত্র পাথরের প্রতিজ্ঞা কেউই ভাঙে না শত বিপদেও। তোর মাও ভাঙেনি। সে মানজা বু এর নাম এই কারণে নিয়েছিল কারণ তোর পিতার কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। এটাই সে বলতে চাইছিল।

আর কেউ জানে না!

আর জানে তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অন্তর্যামী। একবার ভেবে দেখ আমি চাইলেই গোষ্ঠীতে তোর বাবার নাম প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। কেউ আর তোকে পিতার পরিচয়হীন বলবে না। তোকে ছোট করে দেখবে না। শরীরের দিকে তাকা। এই উৎলে ওঠা যৌবন আটকে রাখবি কী করে ? তুই জানিস পিতৃপরিচয়হীন কন্যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একা থাকবে। না স্বামী , না সন্তান। একা ঘরে কুমারীত্ব নিয়ে ধুকে ধুকে বৃদ্ধ অবস্থায় মরবি। যেমনটা তোদের গোষ্ঠীর অনেক মেয়ের পরিণতি হয়েছে। তুই কী এমনটাই চাস?

আকলার কাছে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। দেবীর কথাগুলো এলোমেলো হলেও সত্যি। পরিচয়হীনতার কারণে তাকে কেউ বিয়ে করবে না , সম্মান পাবে না সে , তার বৈধ সন্তান হবে না , চাইলেই একটা সময় জোরপূর্বক তাকে ভোগ করলেও কাউকে বু শাস্তির আওতায় আনবে না। এই নিয়ম! এটাই তার মতো পিতৃপরিচয়হীন মেয়ের জীবনের পরিণতি। এটাকেই মেনে নিতে হয়! ভাবনার মাঝেই সে বুঝতে পারলো তার নিয়ন্ত্রণ নিজের মধ্যে নেই। সে ঝুঁকে দেবীর পা স্পর্শ করল। তার মাথায় তার হাতের স্পর্শ পেতেই ঘুম ভেঙে যায়।

তিন দিন পর , মাঝরাত ।

পিশাচদের বসবাস এই অঞ্চলে প্রায় হাজার বছর ধরে। গোরস্থানটাও শত বছরের পুরনো। এই গোষ্ঠীর পূর্ব-পুরুষেরা বুঝতে পারে পিশাচদের কারণে মৃত্যুর পরেও তারা নিরাপদ না । অনেক সময় দেখা যায় কবর দেওয়ার রাতেই গোরস্থানে পিশাচের আগমন ঘটেছে। ছিন্ন-ভিন্ন করে ছিড়ে লাশটা খেয়ে শুধু হাড্ডিগুলো ফেলে যেত। আবার মাঝেমধ্যে পুরো লাশটা নিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেত , কোনো নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিয়ে ক্ষুধা মেটানোর জন্য। কিছু কিছু পিশাচ মায়াবলে লাশ নিয়ে যাওয়ার পর কবরটা আবার আগের মতো করে রাখতো যাতে লাশ চুরির ব্যাপারটা কেউ টের না পায়।

এইসব বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পূর্বপুরুষেরা গোরস্থানটাকে নানান রীতিনীতি করে এমন ভাবে রূপ দিয়েছে , মন্ত্রবলে দীর্ঘদিন সাধনা করে এমন মায়ার বাধা সৃষ্টি করেছে যে পরবর্তীতে আর কোনো পিশাচ এই গোরস্থানে প্রবেশ করতে পারবে না । হয়েছেও তাই। কয় যুগ হবে এই গোরস্থানে কোনো পিশাচের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু মানুষের প্রবেশ করতে তো দোষ নেই। গোরস্থানটাই তো মানুষেরই!

সেই মায়া শক্তিই গোরস্থানকে পিশাচদের থেকে রক্ষা করেছে এতদিন। অনেক পিশাচ অন্যত্র চলে গেছে , মারা গেছে ক্ষুধার্ত হয়ে। আবার তাদের অলৌকিক শক্তির উদারতা অনেক পিশাচকে পূজনীয় করে তুলেছে মানুষের কাছে। তাদের মায়া শক্তি , মানুষের সব চাহিদা পূরণের অলৌকিক শক্তির ব্যবহার অনেক মানুষকেই প্রলুব্ধ করেছে তাদের অনুসারী হয়ে খাবার যোগানের। বিনিময় , বিনিময়, উপকার , উপকার খেলা!

আজ সকালেই মারা গিয়েছিল গোষ্ঠীর ফিরো , আর আনারা এর ৮ বছরের বাচ্চা মেয়েটা সাপের কামড়ে। দুপুরেই সব আয়োজন শেষ করে মানজা বু এর অনুমতি নিয়ে এই গোরস্থানে কবর দেওয়া হয় তার। সেই কবরটাই এখন খুঁড়ছে আকলা হারিকেনের মৃদু আলোতে।

অনেক দিন ধরে এই গোরস্থানে লাশ চুরি হয়না বলে কেউ পাহারায় থাকে না। তবুও কাঁপছে-ঘামছে আকলা , সতর্ক দৃষ্টিতে চার-পাশে তাকাচ্ছে বারবার ।

সেই রাতের পরে আরো একবার স্বপ্নে দেবীর সঙ্গে কথা হয়েছে তার। দীর্ঘ আলাপন শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় যাতে তার পিতার পরিচয় গোষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত হয় আর তার জীবনটা সহজ হয় সেই পথেই যাবে সে। দেবী হারমা তার উপকার করবেন। কিন্তু বিনিময় লাগবে! সেই বিনিময়ই জোগাড় করছে সে। লাশের কাছে পৌঁছে গেছে সে। ওপরের মাটি সরাতেই কলা পাতা দিয়ে মোড়া লাশটা দেখতে পেল সে।

ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এখনো চিন্তা করছে কাজটা কী তার উচিত হচ্ছে কিনা। না, সময় নষ্ট করা যাবে না! মেয়েটার ওজন বেশি না। সহজেই কবরের ওপর তুলে কবরটা আবার মাটি দিয়ে ভরে দিল সে। অনেকটা সময় লাগলো।

এক হাতে হারিকেন নিয়ে পাঁজাকোলা করে লাশটা নেওয়া যাবে না। বাহুর সঙ্গে লম্বালম্বি করে জড়িয়ে লাশটা নেয়ার সাহস হচ্ছে না আকলার। সেক্ষেত্রে লাশটার মাথা থাকবে তার কাঁধে। তার মনে হবে যেকোনো মুহূর্তে লাশটা চোখ খুলে তার ঘাড়ে কামড়ে দেবে বা শক্ত করে তার পিঠটা চেপে ধরবে। যদিও এছাড়া আর উপায় নেই। জঙ্গলের ভেতর ভয়ানক অন্ধকার।

সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কলা পাতা মোরা লাশটা লম্বালম্বি করে বুকের সাথে লেপ্টে নিল। এমন সময়েই লাশটার মুখের ওপর থেকে কলা পাতা সরে যেতেই অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আকলার গলা থেকে। ইচ্ছা করছে লাশটা এখানে ফেলে পালায়। কিন্তু এটা সম্ভব না। হারিকেনটা তুলে কাঁপতে কাঁপতে, দেবী হারমার নাম নিতে নিতে গোরস্থানের পথ পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে এগোলো আকলা।

আরুল, মানজা বু এর লাঠিয়াল বাহিনীর লোক। রাতে গোষ্ঠীর লোকদের গুদামগুলো পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছে সে। এক নতুন ধরনের নেশার জিনিস পেয়েছে কয়দিন আগে। বুড়োর বয়স হলেও এইসব গন্ধ টের পেয়ে যায়। তাই সেটাই কলকেতে নিয়ে আগুন ধরাতে জঙ্গলের এইদিকে চুপিচুপি এসেছে সে। এখনো একটাও টান দেয়নি। এমন সময় মনে হলো একটা মেয়ে লোককে , কোলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলো সে। হাতে হারিকেন! এত রাতে কে যাবে জঙ্গলে ! সে কী ভুল কিছু দেখেছে ! নেশাতো এখনো শুরু করেনি! ঝাপসা আলো!

কলকেটা এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে হারিকেন আর লাঠি হাতে নিয়ে সেও ধীরে ধীরে জঙ্গলে ঢুকে গেল অনুসন্ধানের জন্য। ……………………………..
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here