পুনম পর্বঃ২৯

0
1119

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৯

রুমা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘামছে।মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে….দক্ষিণা জানলাটা খুলা তারপরও এভাবে ঘামছে কেন?রুমা বিছানায় উঠে বসে।শাড়ির আঁচল গায়ে জরিয়ে বসে…ঘরিতে রাত তিনটা বাজে! কিন্তু রুমার চোখে ঘুম নেই!চোখের নিচে কালি পড়েছে।ধীরপায়ে হেটে ড্রয়িংরুমে দরজার কাছে দাঁড়ায় রুমা।
রুমার চোখে জল এসে যায়…. হারুন কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।বাচনভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে খুবই রসরসে আলাপণ চলছে….রুমা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।পুনরায় আবার এসে বিছানায় শরীর মেলে দেয়।হারুনের সাথে কোন উচ্চ বাচ্চ করে না।এই দেড় মাস ধরে এসব চলে আসছে….সারাদিন হারুন বাড়ি থাকে না…রাতে এসে দুটো খেয়ে মোবাইল নিয়ে রসায়ন চালায় কারো সাথে। রুমার দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।আর রুমা পুরো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকাল হলে মিথ্যে সুখের অভিনয় করে।মেয়েদের সামনে, কাজের লোকদের সামনে, প্রতিবেশীর সামনে রুমা সর্বসুখী। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
যেদিন থেকে সুমনের সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা বেজেছে সেদিন থেকে হারুন বেপরোয়া! হারুনের মতে এসবে রুমার বাবার বাড়ির হাত আছে।তাই এর শাস্তি পাচ্ছে রুমা।আসলেই কি তা?রুমার কখনো মনে হয় হারুন যা বলছে ঠিক।আবার কখনো মনে হয় রুমা নিজে কিসের শাস্তি পাচ্ছে?এসবে তো তার হাত নেই!উল্টো হারুনের জন্য বাসার সবার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে রুমা। প্রথম যেদিন হারুনের এসব আচরণে প্রতিবাদ করলো রুমা….সেদিনই হারুন আবার তাকে চড় মেরেছে।তাই এখন আর কিচ্ছু বলে না।সমীকরণ কোথায় গিয়ে মিলবে সেই অপেক্ষায় আছে!
************
পুনম ভীরঠেলে বাসে উঠে বসে। শেষের দিকে একটা সিট ফাঁকা, সেখানে গিয়ে বসে পড়ে।কক্সবাজার থেকে এসেছে দুমাস হয়ে গেলো।পুনম আনমনেই ভাবে, সময় কত দ্রুত গড়ায়!
বাসের জানলা গলে পুনম বাহিরে তাকায়। কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটা দেখার আশায়, কিন্ত না সেই কাঙ্ক্ষিত মুখের মানুষটা যেন ভোজবাজীর মত হাওয়া হয়ে গেছে।পুনমের কেন যেন মনে হয় তানভীর আশেপাশেই হয়তো আছে।আগের মত আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে।হুট করেই একদিন সামনে এসে বলবে,”পুনমি এত নিষ্ঠুর কেন তুমি ? ”
সেদিন কি জবাব দেবে পুনম?
***********
তারুণের পরিক্ষা শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো।হাতে অফুরন্ত সময়। কিন্তু তারুণের মত পড়ুয়া ছেলের কাছে এই সময় কিচ্ছু না।তারুণ পড়ছিল কিন্তু আজ পড়ায় ঠিকমত মন দিতে পারছে না। বার বার মনে হচ্ছে কিছু হিসেব মিলছেনা।
তারুণের স্বপ্ন বাকি স্টাডি লন্ডনে গিয়ে কম্পিলিট করার!কিন্তু বাবার জন্য পারছে না।
কাল রাতে বাবাকে বলায় বাবা তাকে একটা কথা বলে থামিয়ে দিয়েছে।
“আমি চাই না তারুণ তুমি আমার থেকে দূরে যাও।আমার আদরের সন্তান দূরে থাকুক এটা চাই না।দেশের কোন ভার্সিটিতে পড়তে চাও বলো, আমার এতটুকু ক্ষমতা আছে সেখানে তোমাকে পড়ানোর।”

তারুণ বাবার কথার পৃষ্ঠে কিছু বলেনি।সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বাবা যখন এই কথা বলছিল তখন বাবার চোখে তারুণ কোন পিতাসুলভ মমতা দেখতে পায় নি!তারুণের কেন যেন মনে হয় বাবা আগের মত তাকে ভালোবাসছে না। তাছাড়া তারুণ ছোটবেলা বোডিং স্কুলে থেকে পড়েছে তাই তারুণ বাহিরের দেশে গেলে বাবার বেশি কষ্ট হওয়ার কথা না।তবে কি ভাই যা বলছে তা ঠিক? আমাদের বাবা সন্তানদের ভালোবাসতে জানে না।
তারুণ চুল খামচে ধরে, বাবাকে অবিশ্বাস করতে মনে চায় না।বাবাকে ভীষন ভালোবাসে যে!
হুট করেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কিছুদিন আগে বাবা মাকে প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় মেরেছে।যা রুম ক্রোসের সময় তারুণ দেখে ফেলেছো।সেদিন থেকেই তারুণের চিন্তারা খাপছাড়া।বাবা তার অসুস্থ মাকে কেন মারলো?কেন?

তারুণ স্লিপার পায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কিছু একটা ঠিক নেই?পাজল গুলো সরল অংকের মত গরল লাগছে! মাথা ঠিক করতে হলে এখন ভাইয়ের কাছে যাওয়া আবশ্যক! তারুণ ঠিক সেই মুহুর্তেই অনুধাবন করে তার ভাই আলাদা বাসায় থাকছে। বাবার সাথে ঝামেলা করে।কিন্তু ঝামেলাটা আসলে কি নিয়ে এটা এখনো তারুণ জানে না।আশ্চর্য!

************
পুনম দিনের টিউশনি গুলো বন্ধ করে দিয়েছে।টিউশনির জন্য ঠিকমত পড়ালেখা হচ্ছে না।সামনে মাস্টার্সের পরিক্ষা! এখন তার এই পরিক্ষায় মনোযোগ দেয়া উচিত। সকাল বেলাটা পড়াশোনা করে বিকেলের শিফটে একটা মোবাইল কোম্পানির রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করে।সন্ধ্যায় সেখান থেকে ফেরার সময় দুটো টিউশনি করে তারপর বাসায় ফিরে।কোচিং সেন্টারের থেকে এখানে ভালো টাকা দিচ্ছে তাই এই কাজটা নেয়া।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই কাজটির জন্য বেশির ভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
মেজ দুলাভাই চাকরি করছে তাই মেজ আপার টেনশন থেকে আপাতত মুক্ত পুনম। সংসারে যা খরচ তা এখন মোটামুটি সামলে উঠছে।
পুনম বল্টুর কাছে গিয়েছিল।ট্যুর থেকে আসার পর তানভীরের মত বল্টুও পুনমকে এড়িয়ে চলছে।তাই বন্ধুর রাগ ভাঙাতে গিয়ে লেট হয়ে গেছে….
বাসায় ঢুকেই বসার রুমে বড় আপাকে বসা দেখতে পায় পুনম। বাসার পরিবেশ থমথমে! সবাই গোমড়া মুখে বসে আছে। পুনম হাত ব্যাগটা চেয়ারে রেখে… টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে সবার সামনে যায়।
—-বাবা কি হয়েছে বাসায়? বড় আপা তুই কখন এসেছিস?
বড় আপা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়।রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
—-কেন এটা কি শুধু তোর বাপের বাড়ি?এখন এ বাসায় আসতে হলে তোর পারমিশন নিয়ে আসতে হবে?
পুনম শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
—শুধু শুধু ঝামেলা করবেনা। আমি এ কথা কখন বললাম?
রুমা ক্ষীপ্র গতিতে উঠে এসে পুনমের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। পুনম আকস্মিক থাপ্পড়ে পড়ে যেতে নিলে পাবনী এসে পুনমকে জাপটে ধরে।বাবা দাঁড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়ে।এসব কি হচ্ছে তার পরিবারে?তার এক মেয়ে আর এক মেয়েকে মারছে?এ দৃশ্য দেখার আগে তার মৃত্যু হলো না কেন?
মা সোফায় বসে আঁচলে মুখ গুজে কেঁদে ওঠে। লাবণ্য মরিচা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মেজ আপা পেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। জামালের উদ্দেশ্যে বলে, “বাবুর আব্বু আমাকে ধরো। আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।”
ঝুমার অন্তস্বত্তার বয়স সাতমাসে পড়েছে…সে ইদানীং টেনশন একদম নিতে পারে না।জামাল শক্ত করে জরিয়ে ধরে স্ত্রীকে।

পুনম একদৃষ্টিতে তখনও তাকিয়ে আছে বড় আপার দিকে।বড় আপা তখনও হিংস্রতার সাথে বলতেছে,
—এখন সবার সামনে অবুঝ সাজবি না।তুই কখনো আমার ভালো থাকা সহ্য করতে পারতিস না।একদম এভাবে তাকাবি না…তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু জানি না। তুই সারাদিন কষ্ট করিস বলে আমি কেন সুখে থাকবো?এই নিয়ে তোর হিংসার শেষ নেই।তাই তো তুই সুমনকে লেলিয়ে দিয়েছিস।আর আজ সে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করছে আর প্রতিদান হিসেবে হারুন আমাকে শাস্তি দিচ্ছে। তুই কি ভেবেছিস আমাকে কষ্ট দিয়ে তুই শান্তি পাবি?কখনো না।আজ থেকে আমার কাছে তুই মৃত পুনম!তুই মৃত!

পাবনী আঁতকে ওঠে বলে,—এ তুই কি বলছিস বড় আপা?তোর কোথাও ভুল হচ্ছে….

বড় আপা সমানে চেঁচিয়ে বলে,—-তোদের সবার মনে হচ্ছে তো আমি ভুল আর পুনম ঠিক?তবে আজ থেকে তোরাও আমার সাথে যোগাযোগ রাখবি না।

পুনম এতক্ষণ পরে আস্তে করে বলে,—সেজ আপা আমাকে ছাড়।
পাবনী ছাড়ে না আরো শক্ত করে ধরে।পাবনীর ভয় হচ্ছে, পুনম নিজের সাথে কখনো অন্যায় মেনে নেয় না।এখন যদি বড় আপাকে উল্টা পাল্টা কিছু বলে দেয়….
পুনম ঝাড়া মেরে পাবনীর হাত ছাড়িয়ে দেয়।শান্ত ভঙ্গিতে বড় আপার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
—বড় আপা! এই যে তুই আমায় মারলি। এতে আমার কোন রাগ হলো না।কেন বলতো? বরং তোর জন্য মায়া লাগছে। কেন জানিস? যে চোখ থাকতে অন্ধ থাকতে পছন্দ করে তার জন্য কিন্তু করুণাও আসে না।তবে আমার তোর জন্য করুণা আসছে। বড় আপা তোর স্বভাব আকাশে চক্ষু নিয়ে চলা…তাই জমিনে কি হচ্ছে তা তুই জানতে চাস না।যেদিন মুখ থুবড়ে পড়বি সেদিন যদি তোর অন্ধত্ব ঘুচে!

বড় আপা পুনমের কথার বিপরীতে কিছু না বলে রাগ নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।যাওয়ার সময় টি টেবিলে রাখা পানির জগটা সশব্দে ফ্লোরে আছাড় মারে।
পুনম শান্ত পায়ে হেঁটে মেজ আপার কাছে বসে। তার ফোলা পেটের উপর হাত বুলিয়ে দেয়।মেজ আপার কোলে মাথা রাখতে রাখতে বলে,
—-মেজ দুলাভাই প্লিজ আপনি বড় আপার সাথে একটু যান।বড় আপার রাগ উঠলে মাথার ঠিক থাকে না।পথে যদি বিপদ হয়।একা তো!আপনি কুমিল্লা পৌঁছে দিয়ে তারপর আইসেন।আমি আছি মেজ আপার কাছে।

জামাল হতভম্ব মুখ নিয়েই ব্যস্ত পায়ে বেড়িয়ে পড়ে।বাসার প্রতিটি মানুষ আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে পুনমের দিকে।যে মানুষটা একটু আগে পুনমকে মারলো…এত কথা বললো…তার জন্য পুনম চিন্তা করছে! পাবনী তাকিয়ে দেখে বাবা অশ্রুসজল চোখে পুনমের দিকে তাকিয়ে আছে।

বোকা মেজ আপাও পুনমের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে।মেয়েটার ফর্সাগালে পাঁচ আঙুলের দাগ পড়ে গেছে।
পুনম মৃদুস্বরে বলে,
—-মেজ আপা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদিস না তো।বাবুর কষ্টু হবে।আচ্ছা মেজ আপা, পুচকুটা আসবে কবে বলতো?

মেজ আপার কান্না বন্ধ হয় না আরো বাড়তে থাকে।মরিচা লাবণ্যও কেঁদে দেয়।
পুনম মেজ আপার কোলেই মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলে,
—বড় অঘটনা চাপা দিতে মানুষ ছোট ছোট ঘটনা ঘটায়!
যাতে ছোট অঘটনটা দ্বারা বড় অঘটনটা ঢেঁকে যায়! বড় আপা তুই এত বুদ্ধিমতী হয়েও বড় দুলাভাইর চাল বুঝলিনা? উল্টো আমায় দোষারোপ করলি…..তুই আমায় মৃত বললি…আমার যে বড় কষ্ট হচ্ছে বড় আপা!বড় কষ্ট!

**********
কলিং বেলের শব্দে তানভীরের রান্নার কাজে ব্যঘাত ঘটে। রাত বাজে নটা এখন আবার কে এলো? তানভীর বিরক্তি নিয়ে দরজার কাছে যায়।দরজা খুলে যে মানুষটাকে দেখে তাকে এইখানে এই মুহুর্তে আশা করে নি তানভীর!দরজার ওপারে দাঁড়ানো মানুষটা হাস্যজ্জোল মুখে বলে,
—-মে আই কাম ইন ভাই?
তানভীর জবাব দেয় না কোন।আস্তে করে দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। তারুণ রুমে প্রবেশ করে ভাইকে দেখে টাসকি খায়।একটা থ্রী কোয়াটার প্যান্ট,ঢোলাঢালা টিশার্ট পড়া।হাতে মসলা মাখা।কিছটা হলুদ মরিচ টিশার্টে লেগে আছে।নাকমুখ লাল। তারুণ ভীতি দৃষ্টিতে বলে,
—তোমার এ অবস্থা কেন ভাই?
–রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম……. বলে তানভীর হেসে দেয়।বড় নির্মল হাসি।মা বলে তারুণের হাসি নাকি বেশি সুন্দর কিন্তু তারুণের মনে হয় মা ভুল বলে।তার ভাইয়ের মত এত সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে না।কেউ না!

চলবে,
ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে এই পর্ব লিখেছি।জানি না কি লিখেছি।ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কোরবানির ঈদের জন্য কাল গ্রামের বাড়ি যাবো।নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকবে বাড়িতে… ভালো থাকবেন সবাই আর সুস্থ থাকবেন আশা করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here