প্রতিশোধ পর্ব_১১

প্রতিশোধ পর্ব_১১
💘

#লেখিকা_সুপ্রিয়া_নস্কর

আয়ুসী খাটের উপর বসে থাকে।ঘুম আসে না।জানলার পর্দাগুলো হাওয়ায় উড়ছে।ঘরের ভিতর থাকা ড্রেসিং টেবিলে ছোটো ছোটো লাইট জ্বলছে।তাতে ঘরের ভিতরে আলো আঁধারির রহস্যময় এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

আয়ুসী দেখে আয়ান একটি বালিশ মাথায় দিয়েছে আর সোফায় থাকা কুশানটা বুকের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।আয়ুসী হেঁটে যায় আয়ানের দিকে।তার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে।আয়ুসী আয়ানকে দেখছে।আয়ানের ঘুমন্ত শান্ত মুখ দেখে আয়ুসী একটা নিশ্বাস ফেলে।

নিজে নিজেই বলতে থাকে-কীভাবে সত্যিটা সামনে আনব জানি না।এতো বছর পর কী সম্ভব।কিন্তু চেষ্টা আমি করব।আপনার মনের ভুল ধারনাকে বদলে দেওয়ার।আমি জানি আমার বাবা এরকম করতেই পারে না।

আয়ুসী আয়ানের মাথায় হাত দিতে যায়।হঠাৎ মনে পরে যায় রিসেপশানের রাতের কথা।আয়ান কীভাবে তাকে খাট থেকে ফেলে দিয়েছিল।তাড়াতাড়ি সে চলে আসে খাটের উপর।ইচ্ছা করে হাউহাউ করে কাঁদার।কিন্তু পারে না।যদি আয়ান জেগে যায়।তাই মুখে হাত দিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে।

কাঁদতে কাঁদতে ভোরের দিকে আয়ুসী ঘুমিয়ে পরে।কিন্তু মুখে জলের ছিটা পরা মাত্রই সে ধরপর করে উঠে বসে।দেখে আয়ান ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে হাতে জলের জগ।

আয়ুসী কি হল বুঝতে পারে না।

আয়ান বলে-কত আর ঘুমাবে?আজ জলের ছিটা দিয়েছি।এবার থেকে দেরিতে উঠলে এক মগ জল ঢেলে দেব।

আয়ুসী আয়ানের কথায় ওর দিকেই তাকিয়ে থাকে।

কী হল তাকিয়ে আছো কেন?বাড়ির কাজ করে অফিসেও যেতে হবে।মনে নেই?-আয়ান

হুম,যাচ্ছি।-এই বলে আয়ুসী চলে যায়।

ফ্রেশ হয়ে সব কাজ করে ব্রেকফ্রাস্ট রেডি করে।আয়ানও রেডি হয়ে যায়।আয়ান খেতে বসে।দেখে আয়ুসী রেডি নেই।

কী হল তুমি রেডি হওনি?-আয়ান

না,মানে—-আমতা আমতা করে বলে আয়ুসী।

যাও রেডি হয়ে আসো।-আয়ান

আয়ুসী চলে যাচ্ছিল।আয়ান আবার ডাকে-ব্রেকফ্রাস্ট টা কে করবে।

এই বলে সে উঠে যায়।

আয়ুসী বুঝে গেছে না খেলে আরো ঝামেলা করবে।তাই সে খেয়ে রেডি হতে চলে যায়।

রেডি হয়ে নীচে এসে দেখে আয়ান গাড়িতে বসে আছে।আয়ুসী সবে গাড়িতে উঠতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির পিছন সিট থেকে লাভা চীৎকার করতে থাকে।আয়ুসী তো দেখে গাড়ি থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে।

আয়ান-কী হল ছুটে পালালে কেন?

আয়ুসী-আমি গাড়িতে যেতে পারব না।আমি বাসে চলে যাচ্ছি।

আয়ান-তোমার মাথা ঠিক আছে।আমি গাড়িতে যাব আর তুমি বাসে।সবাই জানলে কী ভাববে।তাই গাড়িতে উঠে এসো।

আয়ুসী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আয়ান ধমক দিয়ে ওঠে-কী হল বললাম না উঠে এসো।

আয়ুসী কোনো উপায় না দেখে গাড়িতে উঠে বসে।আর লাভা সে আয়ুসীর সিটে পা দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে।

আয়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়।আয়ুসী তো ভয়ে ভয়ে বারবার লাভাকে দেখছে।আয়ান এদিকে আয়ুসীকে দেখে হেসে ফেলে।আয়ুসীর চোখ তা এড়ায় না।ভীষণ রাগ হয়।

রাগের মাথায় সে বলে-সত্যি আপনি মানুষের মধ্যে পরেন না।

আয়ুসীর কথায় আয়ান গাড়ির ব্রেক কষে।গাড়িটাকে এক পাশে দাঁড় করায়।আর আয়ুসীর দিকে তাকিয়ে বলে-কী বললে তুমি,আবার বল।

আয়ুসী-যেটা বলেছি ঠিক বলেছি।

আয়ান আয়ুসীর হাত ধরে টানে।তাতে আয়ুসী আয়ানের কাছে চলে আসে।

আয়ান বুঝতে পারে নি।তার এক হাত আয়ুসীর হাতটা শক্ত করে ধরে।আর অন্য হাতটা আয়ুসীর কোমরের কাছে।

আয়ান-কী বললে আমি মানুষ নয়।

এদিকে আয়ুসীর অস্বস্তি হতে থাকে।সে কিছু বলতে পারে না।

আয়ান এদিকে বলে চলেছে-বল কী বললে আবার।

আয়ুসী-প্লিজ ছাড়ুন।

আয়ান-কেন ছাড়ব?বলার সময় মনে থাকে না।

আয়ুসী আড় চোখে আয়ানের হাতের দিকে চায়। যে হাতটা আয়ুসীর কোমরের কাছে।আয়ান আয়ুসী চোখের দিকে চায়।দেখে আয়ুসী আয়ানের হাতের দিকে চাইছে।এবার আয়ান বুঝতে পারে।সে আয়ুসীকে তখনই ছেড়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে।

ধ্রুবর বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে লাভাকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়।কিছুক্ষণ পরে দেখে আয়ানের সাথে ধ্রুবর মা কল্যাণী দেবীও বেড়িয়ে আসছেন।আয়ুসী দেখে গাড়ি থেকে নামে।

কী রে ভালো আছিস?কাল ধ্রুব বলছিল তোর শরীর খারাপ।ও তো অনেক আগেই বেড়িয়ে গেছে।-কল্যাণী দেবী।

হ্যাঁ,ভালো আছি।তুমি ভালো আছো?-আয়ুসী

হ্যাঁ ভালো আছি ।একদিন সময় করে আসবি।-কল্যাণী দেবী।

আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে-কী রে নিয়ে আসবি তো।

আয়ান হেসে বলে-নিয়ে আসব।তাহলে আমরা আসি।বাড়ি ফেরার সময় লাভাকে নিয়ে যাব।

এই বলে তারা ওখান থেকে বেড়িয়ে অফিসে আসে।অফিসে আয়ুসীর পি এ এর পোস্ট বদলিয়ে অন্য ভালো পোস্ট দেওয়া হয় এবং আয়ান বলে আয়ুসী এখন অফিসের কাজকর্ম সব দেখবে।যা আয়ান দেখত।সবাই আয়ানের কথায় মাথা নাড়ায়।কিন্তু অনেকেই আয়ুসীকে দেখে খুশি হয় না।

আয়ুসী নিজের কেবিনে চলে যায়।ভাবে কী সব বলল?আমি ওনার কাজ করব!

এদিকে আয়ানের ফোনে ফোন আসে।

আয়ান ফোনটা ধরে বলে-হ্যাঁ,ভালো আছি আঙ্কেল।অবশ্যই যাব।

এই বলে সে ফোন রেখে আয়ুসীর কেবিনে যায়।দেখে আয়ুসী কাজ করছে না।গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবছে।আয়ান গিয়ে আয়ুসীর সামনের চেয়ারটা টেনে বসে।আয়ানকে হঠাৎ দেখে আয়ুসী ভয় পেয়ে যায়-আপনি এখানে!কিছু বলবেন?

তুমি মনে হয় এই জগতে ছিলে না?তা কী ভাবছ।আমার কাছ থেকে পালাবে কী করে?-আয়ান

আয়ুসী হাসে।আয়ান রেগে যায়।

হাসছ কেন?-আয়ান

যে নিজেই ধরা দেয় সে কী করে পালাবে।-আয়ুসী

আয়ুসীর কথায় আয়ান আয়ুসীর দিকে তাকিয়ে থাকে।দেখে আয়ুসীর শান্ত মুখে এখনও হাসির আভাস।

আয়ান উঠে পরে।আয়ুসীর মুখের দিকে সে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না।

চলে যেতে যেতে বলে-আজ বিপ্লব আঙ্কেল আমাদের জন্য একটা পার্টি দিয়েছে।তাই তাড়তাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।

আয়ুসী আয়ানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।সারাদিন কাজের শেষে আয়ুসী ক্লান্ত হয়ে পরে।টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে।এদিকে আয়ান আয়ুসীর কেবিনে এসে আয়ুসীকে দেখে কী করবে বুঝতে পারে না।সে নিজের ফোন থেকে আয়ুসীর ফোনে ফোন করে।ফোনের আওয়াজে আয়ুসীর ঘুম ভেঙ্গে যায়।ফোন ধরতে যাবে দেখে আয়ান।

চল,বাড়ি যেতে হবে।-আয়ান

হুম-আয়ুসী

আয়ুসী আর আয়ান বেড়িয়ে পরে।বাড়ি ফিরে রেডি হয়।আয়ুসী আজ একটা নীল রঙের শাড়ি পড়েছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিন্দুরটা নিয়ে কপালে ঠেকায়।আয়ান তা দেখে।নিজের অজান্তেই আয়ুসীর দিকে এগিয়ে আসে।আয়ুসীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়।আয়ুসী আয়নায় আয়ানকে দেখতে পেয়ে আয়ানের দিকে ফেরে।দেখে আয়ান তার দিকে তাকিয়ে।আয়ুসী আয়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আয়ান পথ আটকায়।আয়ুসী বুঝতে পারে না।আয়ান কী করতে চাইছে।আয়ুসীর গালে হাত রাখে।আয়ুসী আরো কাছাকাছি চলে আসে।আয়ানের এতো কাছে আয়ুসী একবারই এসেছিল।তা হল বিয়ের পরদিন।এদিকে আয়ান আয়ুসীর দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ আয়ুসী আয়ানকে ধাক্কা দেয়।আয়ান পিছনে সরে যায়।

আয়ুসী বলে-আমি নয় অসভ্য মেয়ে।আপনি কী?কী করছিলেন এতক্ষণ।

আয়ানের ঘোর কেটে গেছে।সে কী বলবে বুঝতে পারছে না।

আয়ান আয়ুসীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে-তুমি কী ভাবলে তোমাকে আমি—-।ভুল।আমি চাই তুমি অস্বস্তিতে পড়।তাই এমন করেছি।আর তুমি পড়েছ।এইভাবেই আমি তোমার কাছে আসব।যেটা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়।তাই এররকম ভাবেই আস্তে আস্তে আমি তোমাকে শেষ করব।তুমি অনুভব করবে আমার ছোঁয়া কিন্তু শেষে আমি তোমাকে ঠেলে ফেলে দেব।প্রতিমুহূর্তে ভাববে আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু না।আমি তোমাকে তিলে তিলে শেষ করব।

এই বলে আয়ান চলে যায়।আয়ুসী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না।

বসে পরে।মনে হয় পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।এদিকে আয়ান এসে বলে-দেরি হয়ে যাচ্ছে।যেতে হবে।

আয়ুসী কলের পুতুলের মতো আয়ানের গাড়িতে গিয়ে বসে।গাড়ি গিয়ে বিপ্লব আঙ্কেলের বাড়ির সামনে থামে।আয়ুসীকে দেখে শ্রেয়া ও সুষমা দেবী খুব খুশি হন।এদিকে বিপ্লব আঙ্কেল আয়ানকে দেখে জড়িয়ে ধরে।বলে-মাই বয়,ইউ আর ভেরি নটী।

আয়ান-কেন আঙ্কেল?

তুমি বিয়ে করবে আমাকে আগে জানাওনি কেন?-বিপ্লব আঙ্কেল

আয়ান কিছু বলে না।এদিকে বিপ্লব আঙ্কেল অন্য গেস্টদের দেখাশুনা করতে থাকে।আয়ুসী আয়ান এক পাশে দাঁড়িয়ে।শ্রেয়া ওদের জন্য জুস নিয়ে আসে।কিন্তু আয়ুসীর মন এতই খারাপ যে সে নিজের মধ্যে ছিল না।জুসটা নিতে গিয়ে শাড়িতে পরে যায়।তাই ওয়াশরুমের দিকে যায়।কিন্তু ওয়াশরুম টা অন্য দিকে।হঠাৎ এমন কিছু কথা শোনে যে সে দাঁড়িয়ে পরে।জানলা দিয়ে দেখতে থাকে।যে কথাটা বলছে তাকে দেখতে পায় না।সে একটু অন্ধকারের দিকে।

আয়ুসী শুনতে পায়।

আয়ান কিছু যেন জানতে না পারে।আর তোমাকে বলেছি না আমার সাথে দেখা না করতে।তাহলে কিন্তু তোমার ছেলেকে—-

না,না,স্যার এমন করবেন না।আমি একটু ছেলের সাথে দেখা করতে চাই।—-

কিন্তু কী হবে দেখা করে।সে তো জানেই না তুমি ওর বাবা।ওসব ওর মনেও নেই।—-

কিন্তু স্যার বাবার মন তো—-

যাও,যাও বাড়ি ফিরে যাও।—-

কিন্তু স্যার—-

হঠাৎ লোকটি হুংকার দিয়ে বলে-বলছি তো যাও।

লোকটি চলে যায়।আয়ুসী লোকটির সাথে কথা বলতে যাবে দেখে আরো একটি লোক ঘরে ঢুকছে।কিন্তু সেই লোকটি এমনজায়গায় দাঁড়ায় আয়ুসী লোকটির ছায়া ছাড়া কিছু দেখতে পায় না।

স্যার—-

আরে উকিল বাবু,কী ব্যাপার?—-

স্যার,আয়ানকে এবার জানিয়ে দেওয়া উচিত।—-

কী?—-

এই যে আয়ানের পরিবারের নিয়ম আয়ানের স্ত্রী আর আয়ানের সম্পত্তিতে সমান ভাগ।ওর উইল সব তো আমাদের কাছে।এবার ওকে দিয়ে দেওয়া উচিত—-

লোকটি রেগে যায়।বলে-কী হবে বলে?ভেবেছিলাম আয়ান ফিরলে নিজের মেয়ের সাথে বিয়ে দেব।তারপর আয়ানের মনে যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়েছি তাতে আয়ান বাবা মার হত্যাকারী এই ভেবে অজয়ের মেয়ের সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করবে যাতে আমি পরবর্তীকালে মেয়েটিকে মেরে ফেলে আয়ানের উপর চাপিয়ে আয়ানকে জেলের ঘানি টানাব।আর সম্পত্তি আমি নিজের মেয়ের নামে লিখিয়ে নেব।কোটি টাকার সম্পত্তি আমার।কিন্তু আয়ান কী করল।মেয়েটিকে বিয়ে করল।আমার সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিল।এবার অন্য কিছু করতে হবে।

কিন্তু স্যার এরকম করা কী ঠিক—-

আরে উকিল বাবু আপনি তো ভয় পেয়ে গেলেন পুলিশ বাবুর মতো।চলুন চলুন।

এই বলে তারা ঘর থেকে বার হয়ে যায়।আয়ুসী লোকটির মুখ দেখার জন্য তাড়াতাড়ি করে এগোতে যাবে।তখন আয়ান সামনে এসে দাঁড়ায়।

কী ব্যাপার বলত পালাবার প্ল্যান করছ।-আয়ান

আয়ুসী কিছু বলতে যাবে।

চল,সবাই অপেক্ষা করছে।-আয়ান

আপনি চলুন,আমি যাচ্ছি।-আয়ুসী

না,একসাথে যাব।-আয়ান

আয়ুসী কী আর করে আয়ানের সাথে যায়।কিন্তু সে যা শুনল তা শুনে তার চলার শক্তি নেই।কারা এরা কী বলছে।

এদিকে আয়ুসীর মন টেকে না।সে সব লোকদের দিকে ঘুরে ফিরে দেখতে থাকে।কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না।

পার্টি শেষ হয়ে যায়।বাড়ি ফিরে আসে।আসার সময় লাভাকে ধ্রুবর বাড়ি থেকে নিয়ে ফেরে।আয়ুসীকে দেখে ধ্রুব বুঝতে পারে আয়ুসীর কিছু তো হয়েছে।তার সাথে একটাও কথা বলেনি।

আয়ুসী কী ধ্রুবকে সব বলবে?

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here