প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ১৯

0
2459

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

একদলা বৃষ্টি মাথায় করে ধানমন্ডির একটি কফি হাউজের ছাউনিতে এসে থামে নিষ্প্রাণ।একজন চল্লিশ উর্ধ্ব ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।তার সামনে দাঁড়িয়েই বিগলিত হাসে নিষ্প্রাণ।ঝমঝমিয়ে নভোমণ্ডলের বুক চিরে ঝরছে অশ্রুজল।তাতেই অবগাহনে মত্ত ধরিত্রী মাতা।থৈ থৈ জলে নিমগ্ন চারপাশ। সমান্তরাল সড়ক পথ থেকে একটু উঁচুতে অবস্থিত কফি হাউজের ছাউনির খাঁজকাটা টিন বেয়ে পড়ছে জল তাতে অদ্ভুত মাদকভরা শব্দ।একপাশ দিয়ে বেড়ে উঠা কুঞ্জলতায় লাল,সবুজে আচ্ছাদিত টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে মনে হচ্ছে মনখুলে আজ নৃত্য করছে বৃষ্টির দল।টিন থেকে ঝরে পড়া পানি ভূমিতে পতিত হয়েই ছলকে উঠে।

ছাই রঙা ব্লেজার পরিহিত ভদ্রলোক কোমল হাসলেন।হাসি হাসি মুখে শুধালেন—

“কেমন আছেন?

নিষ্প্রাণ প্রাণবন্ত হেসে উত্তর করে।

“ভালো।আপনি?

“জ্বী,ভালো।”

নিষ্প্রাণ নমনীয় চোখে চেয়ে কৌতূহলী গলায় বললো—

“কেন ডেকেছেন?

ভদ্রলোক নিগূঢ় চোখে চেয়ে বললেন—

“রাশেদ সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন।”

চকিতে ভ্রু কুঞ্চি করে নিষ্প্রাণ।জিঙ্গাসু গলায় বললো—

“কেন?

ভদ্রলোক অমায়িক হেসে নিষ্প্রাণের দিকে একটা খাম এগিয়ে বললেন—

” এখানে চার হাজার টাকা আছে।আপনার জন্য।”

যারপরনাই তাজ্জব হয় নিষ্প্রাণ।শুষ্ক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কিন্তু এখন তো মাসের শেষ! এখন কেন টাকা পাঠালেন?আর এর জন্য কী আমার সামনের মাসের হাত খরচ কমিয়ে দেবেন তিনি?

ভদ্রলোক চোখে হাসলেন।মৃদু স্বরে বললেন—

“না।এইটা এই মাসের জন্যই।আপনি নিতে পারেন।”

নিষ্প্রাণ প্রফুল্লচিত্তে খামটা চট করে নিয়ে নিলো।সানন্দে বললো–

“ধন্যবাদ।
আর কিছু বলবেন?

ভদ্রলোক মৃদুহাস্য অধরে বললো—

“না।আপনি যেতে পারেন।তবে এই ঘন বর্ষাতে না ভেজাই আপনার জন্য উত্তম।”

“আসলে আমার একটা জরুরী কাজ আছে।দাদুকে আমার সালাম জানাবেন।আসি আমি।”

নিষ্প্রাণ রাস্তার দিকে তাকালো।দামাল বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে।রাস্তায় জমেছে পানি।নিষ্প্রাণ চোখের চশমাটা ঠিক করে নিলো।স্লিপার পরা পায়ের গোড়ালি থেকে প্যান্টটা একটু উঁচুতে ভাঁজ করে নিয়ে সেই পানিভর্তি রাস্তায় নামে।ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে শীতল প্রভঞ্জনে উড়িয়ে নিচ্ছে নিষ্প্রাণের অর্ধভেজা চুল।টুকটুক করে তার চশমার গ্লাসে জমছে পানি।সেই সব ডিঙিয়ে পানির মধ্যে ঢেউয়ের সৃষ্টি করে এগিয়ে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ।গায়ে পরা গাঢ় নীল রঙের টিশার্ট বুকে,পিঠে লেপ্টে গেছে।রাস্তার ওপ্রান্তে এসে একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়ে নিষ্প্রাণ।চশমার গ্লাস গলিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে নির্বিঘ্ন হাসলো।নিষ্প্রাণ দৃষ্টিসীমার আড়াল হতেই ভদ্রলোক নিজের মুঠোফোন হাতে নিলেন।রাশেদ কে কল করে আনন্দের সহিত বললেন—

“হি ইজ ফাইন।আমি আপনাকে অডিও রেকর্ডারটা পাঠাচ্ছি।শুনে নেবেন।”

ভদ্রলোক নিষ্প্রাণের সাথে হওয়া পনেরো মিনিটের ভয়েজ রেকর্ডিং সেন্ট করে রাশেদের নম্বরে।
নিজের পাড়ায় আসতেই নভোলোকের অশ্রুনীর বন্ধ হওয়াতে স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিষ্প্রাণ।টানা বর্ষনের পর ঝকঝকে নভোলোকে শুরু হয়েছে শুভ্র জলদের আনাগোনা।তার ভাঁজে ভাঁজে নীলাভ অম্বরের লুকোচুরি।

একটা রিচার্জের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।খামের ভেতর থাকা চার হাজার টাকা বিকাশ করে সীমান্তের অ্যাকাউন্টে।বিকাশ সাকসেসফুল হতেই ব্যস্তসমস্ত নিষ্প্রাণ কল করে সীমান্তকে।
স্নেহার্দ্র গলায় প্রশ্ন করে নিষ্প্রাণ—

“তোর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছি।দেখতো গিয়েছে কিনা?

সীমান্ত চেক করেই খুসখুসে গলায় বললো—

“টাকা পাইলি কই তুই?

“মামা পাঠিয়েছে।ফসল বিক্রি করেছে তাই।”

সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে সীমান্ত—

“টাকা ধার নিয়া করছিলি কী তুই?

নিষ্প্রাণ শিথিল গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“বই কিনেছিলাম।”

সীমান্ত চওড়া গলায় বললো—

“একদিন এই বই কিনতে কিনতেই তুই ফকির হইয়া যাবি হারামি।বউরে খাওয়াবি কী!

নিষ্প্রাণ আদুরে হাসে।ব্যস্ত হয়ে বললো—

“কোথায় আছিস এখন?আজ তো এলি না।”

“আইতে পারমু না।আব্বা থাপড়াইবো।”

“কেন?

সীমান্ত বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো—

“আর কইস না।ভাইয়ার লাইগা মাইয়া দেখতে যাইবো।আমি কেন যামু ক তো।পাঁচবছর ধইরা প্রেম কইরা এখন আমারে লইয়া মাইয়ারে আবার দেখতে যাইবো।মানে রঙের তামাশা দেইখা আর বাঁচি না আমি।শালা জীবনডা বেদনা!

নিষ্প্রাণ মুচকি হেসে বললো—-

“ভালো কিছুও তো হতে পারে।গিয়ে দেখ ভাইয়ার কোনো শ্যালিকা থাকলে তোরও একটা গতি হয়ে যাবে।”

“দুর ছাতার মাথা।এইসব পিরিতি ফিরিতি আমারে দিয়া হইবো না।আচ্ছা রাখি এখন।ভাইয়া ডাকতাছে।”

“ওকে।বাই।”
,
,
,
ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই আয়েন্দ্রির পাশ ঘেঁষে বসে আছে নিষ্প্রাণ।পেছন বেঞ্চে বসা নিষ্প্রাণ এখন সামনে বেঞ্চেই তার ঘাঁটি গেড়েছে।আয়েন্দ্রির টলটলে চাহনি উপেক্ষা করে বিগলিত হাসে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি চট করেই বললো—

“তোর মোবাইলটা দে।”

নিষ্প্রাণ বিনা প্রতিক্রিয়ায় তার মোবাইলটা আয়েন্দ্রির হাতে দেয়।আয়েন্দ্রি গ্যালারির লক দেখিয়ে বললো—

“এইটা খোল।”

অধরের কোণ প্রসারিত করে নিষ্প্রাণ।সহজ গলায় বললো—

“ধ্রুবতারা।”

চোখের পাল্লা নেচে উঠে আয়েন্দ্রির।ধ্রুবতারা লেখতেই লক খুলে যায়।কিন্তু আয়েন্দ্রির বিস্ময় আকাশ ছোঁয়।গ্যালারিতে কিছুই নেই।ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ।নরম গলায় বললো—

“ভয় পেয়েছিস?

“লক করে কেন রেখেছিস?

নিষ্প্রাণ হেয়ালি গলায় বললো—

“ভালো লাগে তাই।”

আয়েন্দ্রি নাক কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো–

“যত্তসব!

অধর ছড়িয়ে উৎফুল্ল হাসে নিষ্প্রাণ।স্যার ক্লাসে ঢুকতেই দৃঢ় হয়ে বসে সকলে।সীমান্ত পেছন থেকে ঠেস মেরে বলে উঠে—

“বাঁইচা থাকিস নিষ্প্রাইন্না।”

নিঃশব্দে হাসে নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রির বুকের ভেতর ঢিবঢিব করছে।হট করেই আয়েন্দ্রির দিকে চোখ ফেলে নিষ্প্রাণ।হৃষ্ট গলায় বললো—

“তোর এই বেলি ফুলের ঘ্রাণ সত্যিই আমার প্রাণ নিয়ে নিবে ধ্রুবতারা”

রুদ্ধশ্বাসে নিষ্প্রাণের চকচকে অক্ষিযুগলের দিকে দৃঢ় আর ভীত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আয়েন্দ্রি।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here