প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ২০

0
2150

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

শহীদ মিনারের পেছনের দিকে একটি দীর্ঘকায় বট গাছ।তার চারপাশে গোলাকার লাল পাথরের বেদি।বিছানো সবুজ ঘাসের উপর শিয়র উঁচু করে দাঁড়ানো বটগাছটি বহু বছরের পুরোনো।তার পাশেই দুই রুমের দেয়াল আর উপরে টিনসেড দেওয়া একটি দোচালা ঘর।সেখানে থাকেন ভার্সিটির পুরোনো দপ্তরী আসমত মিয়া।তার ঘরের পাশ ঘেঁষে চাপকল।

সীমান্ত বোতলভর্তি করে পানি সেই চাপকল থেকে।’দুষ্টের শিরমনি লঙ্কার রাজা’ উপাধিতে ভূষিত সীমান্ত একটু আগেই প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের সাথে মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে।ছেলেটা প্রথম বর্ষের হলেও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।মাথায় আঘাত লাগায় সেখান থেকে রক্ত বের হতেই তা পরিষ্কার করার জন্য ভার্সিটির পেছন দিকে নিয়ে যায়।পানি দিয়ে সেই রক্ত পরিষ্কার করে ছেলেটিকে পার্শ্ববর্তী হসপিটালে পাঠিয়ে দেয়।প্রাবিশ তখন বাইরে থাকায় এমন অঘটন ঘটলো।এক ঝাঁড়ি মেরে বলে উঠে প্রাবিশ—

“পাগল হয়েছিস?মারামারি করতে গেলি কেন?

বটগাছের বেদির উপর শান্ত হয়ে বসে আছে সীমান্ত।নির্বিঘ্ন গলায় বললো—

“তোরে কৈফিয়ত দিতে পারমু না।”

সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত কুসুম ক্ষীণ স্বরে বললো—

“ছেলেটা একটা মেয়ের সাথে বেয়াদবি করছিলো।সীমান্ত শুধু ওকে ধমকই দিয়েছে।কিন্তু ছেলেটাই উল্টো..।”

নিষ্প্রাণ একটা শিশু গাছের সাথে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে।সে তখন মসজিদে ছিলো।ঘটনা ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি।তবে সবটা সামলে নেয় সারক।আয়েন্দ্রি সর্বপ্রথম তার কাছেই যায়।কারণ রাজনীতিতে বিশেষ ঝোঁক আছে তার।প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে সে রাজনীতির সাথে যুক্ত।ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছেলেরা তাকে বেশ সমীহ করে।
,
,
,
মাথার উপর বিশাল ধূসর আকাশ।চারদিকে মৃদু সমীরণের গুঞ্জন।যান্ত্রিক বাহনের বিক্ষিপ্ত শব্দ।তার মাঝেই হুরহুরিয়ে যাচ্ছে রিক্সা।আয়েন্দ্রির পাশেই বসেছে প্রাবিশ।নিষ্প্রাণ বসতে চেয়েছিলো।কিন্তু আয়েন্দি সেই সুযোগ দেয়নি।পেছনে রিক্সায় বসেছে কুসুম আর তৃণা।আরেকটা রিক্সায় সীমান্তের সাথে নিষ্প্রাণ।উসখুস করছে তার মস্তিষ্ক।ভেতরে দাবদাহ প্রকট হচ্ছে ক্রমাগত।কিন্তু বাইরে শান্ত,সমাহিত।

বেশ কিছু সময়ের মৌনতা ভেঙে বলে উঠে আয়েন্দ্রি।

“আমার তোকে কিছু বলার আছে।”

প্রাবিশ বিনা সংকোচে বললো—

“বল।”

আয়েন্দ্রি ভীত গলায় বললো—

“প্রাণকে আমার ভয় করে।”

ফিক করে হেসে ফেলে প্রাবিশ।ফিচেল গলায় বললো—

“এরচেয়ে যদি বলতি আমার পিঁপড়াকে ভয় করে তাহলে আমি নির্দ্বিধায় মেনে নিতাম।”

আয়েন্দ্রি মেজাজ দেখিয়ে বললো—

“আমি মজা করছি না।”

প্রাবিশ নড়ে বসে।বৈকালের সূর্যের ম্রিয়মান আভায়ও কিঞ্চিৎ উষ্ণতা বিদ্যমান।তাতে অস্বস্তিও আছে।কিন্তু প্রাবিশের এখন আয়েন্দ্রির কথায় বেশি অস্বস্তি হচ্ছে।সরল গলায় বললো—

“এমন কেন মনে হচ্ছে তোর?

আয়েন্দ্রি চোখ পিটপিট করে তাকায়।লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো গ্যালারির সেই কান্ডটার কথা ।এমনকি তাকে ধ্রুবতারা বলে ডাকার কথাও।মুচকি হাসে প্রাবিশ।খেয়ালিপনায় বললো—

“ও হয়তো তোকে পছন্দ করে।ছেলেটা কিন্তু জেমস বলতে পারিস।যদিও ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ততটা উচ্চ নয়।তবে,আমার মতে মানুষের পরিচয় সে নিজে।বংশ মর্যাদায় নয়।”

আয়েন্দ্রি নীরস গলায় বললো—

“আমার এখন এইসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই।বাবা এইসব পছন্দ করে না।”

“তুই নিষ্প্রাণকে পছন্দ করিস?

এই প্রশ্নের জবাব আয়েন্দ্রি দিতে পারলো না।প্রাবিশের ধারণা হলো,হয়তো আয়েন্দ্রি তার প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছুক নয়।তাই সে আর এই বিষয়ে কথা বললো না।

আয়েন্দ্রির সব কথা ব্লুটুথের মাধ্যমে শুনে ফেলে নিষ্প্রাণ।এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরে ঝোলায় ক্লান্ত হাসি।তাদের রিক্সা এসে থামে বনশ্রীতে।আজ এখানে একটা ছোট্ট মেলা বসেছে।সীমান্ত আসতেই চাইছিলো না।মেয়েদের ভীড়ভাট্টা থাকে এইসব মেলাতে।কিন্তু নিষ্প্রাণের দেহপিঞ্জরে চলে শিরায় শিয়ায় নিষ্পেষণ।আয়েন্দ্রিকে কোনোভাবেই একা ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।তাই প্রাবিশ আর সীমান্তকে তার হৃদয় ভেজা কথায় গলিয়ে নেয়।

মেলার দরজার কাছে আসতেই সীমান্তের অক্ষিযুগল তটস্থ হয়।একগাদা মেয়ে মানুষের ঢলাঢলি।বিশ্রি কান্ড!
তারা তিনজন ভেতরে গেলো না।মেলার পাশেই কয়েকটা বড় আমগাছ।তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।আয়েন্দ্রি,তৃণা আর কুসুম ভেতরে যেতেই দেখে এলাহিকান্ড।মানুষে গিজগিজ করছে।মেয়েলি জিনিসের উপস্থিতি বেশি।একজন মহিলা ডালাভর্তি রঙ বেরঙের রেশমি চুড়ি নিয়ে বসেছেন।আয়েন্দ্রি উৎফুল্ল দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই ডালার সামনে বসে।মাথায় আধঘোমটা দেওয়া শীর্ণ দেহের মহিলা মৃদু হাসলেন।আয়েন্দ্রি কালো রঙের একমুঠ চুড়ি হাতে গলিয়ে নেয়।কুসুমের সামনে হাত নাড়াতেই রিনিঝিনি শব্দ হয় তাতে।উচ্ছ্বসিত গলায় বললো—

“সুন্দর না চুড়িগুলো?

সেই চুড়ির শব্দ পৌঁছে যায় নিষ্প্রাণের কর্ণরন্ধ্রে।আর সেখান থেকে তার বুকের কম্পিত মাংসপিন্ডে।গম্ভীর শ্বাস ফেলে নিষ্প্রাণ।প্রাবিশ ব্যস্ত তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে।সীমান্তের বিরক্তিকর কন্ঠ—

“তোগো এই মাইয়া মানুষের নেওটামি একদম ভাল্লাগে আমার।”

নিষ্প্রাণ সেই কথা শুনলো না।তার মস্তিষ্ক ঝাঁঝিয়ে উঠলো ওপাশের অমসৃণ কন্ঠে।নিষ্প্রাণ শান্ত গলায় বললো—

“তোরা বস।আমি আসছি।”

“কই যাস তুই?

“মেলার ভেতরে।দাঁড়া এখানে তোরা।”

সীমান্ত ভ্রু কুঞ্চি করে তাকায়।নিষ্প্রাণ দৃঢ়চিত্তে লম্বা লম্বা পা ফেলে মেলার ভেতর প্রবেশ করে।

আয়েন্দ্রির হাত ধরে রেখেছে ছেলেটি।তার চুড়ি পরা হাতে আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে মুখ দিয়ে অশ্লীল ভাবভঙ্গি করে।আয়েন্দ্রি জোর হাতে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।তপ্ত গলায় বললো–

“এইটা কী ধরনের অসভ্যতা?

চোখে কালো রোদ চশমা পরে থাকা অপরিচিত ছেলেটি বাঁকা হেসে বললো—

“আপনার হাতটা খুব সুন্দর।ধরে দেখছিলাম।আসলে আমার গার্লফ্রেন্ডেরও চুড়ি ভীষণ পছন্দ।দেখতে শুনতে আপনার মতোই।”

অদ্ভুতভাবে আয়েন্দ্রির সারা শরীরে চোখ বোলায় ছেলেটি।মুহূর্তেই ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটে গেলো।আচমকা ছেলেটির হাতটা কেউ ধরে তার হাতের মধ্যখানে কাঁচের তৈরি ভাঙা একটা ফুলদানি উপুর করে গেঁথে দেয়।আর্তনাদ করে উঠে ছেলেটি।হুলুস্থূল শুরু হয়ে যায় স্বাভাবিক পরিবেশে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here