প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ২১

0
2170

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে। মাতাল হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে রিক্সা। সোডিয়াম বাতির আলোক ছটায় মেতে উঠেছে অন্ধকার শহর। হুরহুরে বাতাসেও মনে উচাটন আয়েন্দ্রির।

নিষ্প্রাণের এমন কাজে বিস্ময়ে আত্মা কেঁপে উঠে আয়েন্দ্রির। ছেলেটির হাতে ভাঙা ফুলদানি গেঁথে দিতেই গলগলিয়ে লহুর নহর বইতে থাকে। ততক্ষণে হুলস্থুল,কোলাহলে ভড়কে যায় পুরো পরিবেশ।চিৎকার,চেঁচামেচি আর হৈ হুল্লোড়ে মেলার ভেতরে দৌঁড়ে আসে প্রাবিশ আর সীমান্ত। ক্রোধে বিহ্বল নিষ্প্রাণ ফোঁস ফোঁস করছে। আয়েন্দ্রি একরাশ ভয় নিয়ে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের শান্ত কিন্তু প্রকুপিত মুখটার দিকে। কুসুম আর তৃণা ভয়ে সিটিয়ে আছে।

ছেলেটা স্থানীয় এলাকার বখাটেদের সর্দার। ইচড়ে পাকা আজকালকার ছেলেরা নিজেদেরকে কী ভাবে তা তাদের নিজেদেরও অজ্ঞাত!
ছেলেটার এই অবস্থা দেখেই সাথে থাকা বাকি দুটো ছেলেও ভয়ে আঁতকে উঠে। ঝড়ের তান্ডব মাতিয়ে লোক জড়ো করতে থাকে। ছুটে আসে আরো কিছু ছেলেপেলে। মুহূর্তেই ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।কিন্তু তার আগেই ভীড় ঠেলে নিষ্প্রাণকে বের করে আনে বাকিরা। দ্রুত আয়েন্দ্রি আর নিষ্প্রাণকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দেয়। তার পেছনেই আরেকটা রিক্সায় তৃণা আর কুসুমকে। প্রাবিশ আর সীমান্তকে ঠাওর করতে পারেনি ছেলেগুলো। খেলার ব্যাট,হকিস্টিক,রড কোনো কিছুরই কমতি হলো না। ছেলেগুলো তা হাতে নিয়ে পুরো মেলায় চিরুনি তল্লাশি চালায়। কিন্তু হাত লাগে না কিছুই।

নিষ্প্রাণের কোমল মুখটার দিকে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি।ভয়ে তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। ঢোক গিলতেও ভীষণ কষ্ট!
আয়েন্দ্রি ভয়কাতুরে গলায় বললো–

“এমন করলি কেন তুই?ছেলেটাকে এভাবে কেন মারলি?

নিষ্প্রাণ স্নিগ্ধস্বরে বললো–

“সীমান্ত করলে ওকে এই প্রশ্নটা করতি?

আয়েন্দ্রি গম্ভীর গলায় বললো–

“তুই আর সীমান্ত এক নস। সীমান্ত উড়নচন্ডী।কখন কী করে বসে ঠিক নেই।কিন্তু তুই তা নস।”

আয়েন্দ্রির দিকে মায়াভরা চোখে তাকায় নিষ্প্রাণ। সেই নজর সোজা গিয়ে আটকে আয়েন্দ্রির অধরে। ভারী গলায় বললো—

“তোর ক্ষেত্রে আমি এরচেয়েও ভয়ংকর।”

আয়েন্দ্রি ভয়চকিত গলায় বললো—

“এইসব কী বলছিস তুই?

নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় বললো—

“তোর দিকে হাত বাড়ানোর অধিকার আমি আমার ছায়াকেও দেবো না।”

আয়েন্দ্রি রূদ্ধবাকে আঁখিপল্লব প্রশস্ত করে অপলক চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণের দিকে। নিষ্প্রাণ কিয়ৎ কড়া গলায় বলে উঠে—

“থামান মামা।আমি নামবো।”

আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণে হাত টেনে ধরে বললো–

“কোথায় যাচ্ছিস তুই?

নিষ্প্রাণ আলগোছে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় আয়েন্দ্রির কাছ থেকে। রিক্সা থেকে নেমে নিষ্প্রভ গলায় বললো—

“বাসায় যা।আমার কাজ আছে। যান মামা। ঠিকমতো বাসায় পৌঁছে দেবেন। নিষ্প্রাণের প্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন আপনি।”

আয়েন্দ্রির দিকে সরল দৃষ্টি রেখেই কথাগুলো বললো নিষ্প্রাণ। রিক্সা চালক তেমন কিছুই বুঝলো না। তবে বর্তমান যুগের প্রেমিকযুগলদের তাদের চিনতে ভুল হয় না।লিংক রুটের কাছে আসতেই নেমে যায় নিষ্প্রাণ।আয়েন্দ্রি কিছুতেই বুঝতে পারছে না নিষ্প্রাণ কেন আবার পেছন দিকে হাঁটা শুরু করেছে।
রিক্সা চলতে শুরু করে। আয়েন্দ্রি ঘাড় বাঁকিয়ে নিষ্প্রাণকে দেখছে। কৃত্রিম আলোর বাঁকে বাঁকে হেঁটে যাচ্ছে নিষ্প্রাণ। ক্ষণকাল পরেই ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায় সে।আয়েন্দ্রি ঘুরে বসে। তার উন্মনা,দিকভ্রষ্ট দৃষ্টি।
,
,
,

হসপিটালে স্যালাইন দিয়ে রেখেছে আহত ছেলেটাকে।তার সাথে এসেছে তার উশৃঙ্খল বন্ধু-বান্ধব। পাড়ায় বেহায়াপনা করে বেড়ানোর কারণে কোনো লিগ্যাল গার্ডিয়ান তার সাথে আসেনি। তবে বন্ধুদের আশ্বাসিত কথা,যে তার এই অবস্থা করেছে তাকে ঠিক খুঁজ বের করবে। এবং তারও ঠাই হবে এই হসপিটাল।ছেলেটার সাথে তার দুটো বন্ধুই বসেছিলো। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসতেই একজন চলে যায়। আরেকজন ঠায় বসে থাকে। তলপেটে চাপ পড়তেই ওয়াশরুমের জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। একটু আগেই ডক্টর রাউন্ড মেরে গিয়েছে। তাই এখন সকলে ব্যস্ত তাদের কাজে। নিষ্প্রাণ শান্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দেয়।

করিডোর আপাতত ফাঁকা। ছোটখাট নিম্নমানের হসপিটাল হওয়ায় তেমন কোনো সিকিউরিটির ব্যবস্থা নেই। নিষ্প্রাণ সেই সুযোগ কাজে লাগায়।কেবিনে ঢুকতেই দেখে ছেলেটা ঘুমে বিভোর। নিষ্প্রাণ ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যায়। শুভ্র বিছানার পাশে এসে স্থির হয়। গাঢ় চোখে ছেলেটাকে দেখে।এই ঘুমই তার শেষ ঘুম!

পকেট থেকে রুমাল সমেত হাতটা বের করে ছেলেটার নাকের উপর কিছুক্ষণ চেপে ধরে। ছেলেটা এইবার সত্যি সত্যিই নিশ্চেতন। স্যালাইনের প্লাস্টিকের বোতলের দিকে দৃষ্টি ফেলে নিষ্প্রাণ।তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা মোটা বই বের করে।তার মাঝে একটা ছোট্ট কাঁচের শিশি। বইয়ের মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গা কেটে সেই গর্তেই বসানো সেই শিশি।সেখান থেকে সিরিঞ্জের মধ্যে কিছুটা তরল নিয়ে স্যালাইনে পুশ করে যা একটু একটু করে প্রবেশ করছে ছেলেটা সমাহিত শরীরে। যা একটু পরেই ছেলেটার হৃদকম্পন থামিয়ে দেবে।

নিষ্প্রাণ একটু ঝুঁকে পড়ে ছেলেটার মুখের উপর। অদ্ভুত সেই সিটির আওয়াজ নিঃসৃত হয় নিষ্প্রাণে বলয় আকৃতির ওষ্ঠাধর থেকে। ছেলেটার হাতের দিকে তাকাতেই তার শান্ত চোখ দুটো ক্ষীপ্ত হয় উঠে। ব্যান্ডেজ করা হাতটার সবগুলো আঙুল ভেঙে ফেললো এক এক করে। ব্যান্ডেজ খুলতেই কাটা হাতটাতে হেয়ালি চোখে তাকিয়ে থাকে। তাতেও প্রশান্তি পেলো না সে। ছেলেটার হাতে লাগানো স্যালাইনের সূঁচটা খুলে নিয়ে তা টুকটুক করে ঢুকাতে থাকে ছেলেটার হাতে। রক্তে ভিজে উঠে সফেদ চাদর।পুলকিত হয় নিষ্প্রাণ।ছেলেটার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—

“ওকে আমি বাঁচাতে পারিনি ওদের ওই লালসা থেকে।কেড়ে নিয়েছে ওরা ওকে। রক্তাক্ত করেছে ওকে।হিংস্র হায়েনার মতো খুবলে খেয়েছে।আমি শুধু সেই আর্তনাদ শুনেছি। দেখেছি সেই রক্তের নদী। কিন্তু আমার ধ্রুবতারার দিকে হাত তো দূরের কথা,যে চোখ ওকে সেই নজরে দেখবে তার শ্বাস আমি কেড়ে নেবো।মৃত্যুই হবে যার ভবিতব্য।”

কেবিন থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে নিষ্প্রাণ। মৃদু আওয়াজে সেই সিটি। যা দেওয়ালে দেওয়ালে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here