প্রাপ্তির হাসি পর্ব_০১

0
12116

আমার সামনে আমার পেশেন্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রাক্তন স্বামি রিশাদ সাথে তার বর্তমান স্ত্রী লিজা। ২ বছরের ডাক্তারি জীবনে কখনো এমন কিছুর সম্মুখীন হইনি। হঠাৎই মনে প্রশ্ন জাগলো তারা এখানে কি করছে ? দুজনকে দেখে তো কাউকেই অসুস্থ মনে হচ্ছে না। তাহলে এখানে আসার কারণ কি?

শুধু যে আমি তা কিন্তু নয়। রিশাদ ও আমাকে দেখে প্রচুর চমকে গিয়েছে। সে ও হয়তো আমাকে এই জায়গায় আশা করেনি।না করাটাই স্বাভাবিক। তার মতে যে আমি সবসময়ই সবকিছুর জন্য অযোগ্য ছিলাম।কখনো কারোর জন্য পার্ফেক্ট ছিলাম না।যাকগে আমি আর এসব ব্যাপার নিয়ে ভাবতে চাইনা।

আপনারা বসুন।তারপর সমস্যা গুলো আমাকে বলুন।- আমি

আমার কথা শুনে দুজনে সিটে বসে পরলো। তারপর তার স্ত্রী বলতে শুরু করলো,

আসলে ম্যাম বিয়ের ৫ বছর প্রায় হতে চললো। প্রথমে প্রথমে না চাইলে ও পরে আমার একটা বাচ্চার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো ফলাফল পাইনি।তাই আসলে আপনার কাছে আসা – লিজা

ঠিক আছে আমি বুঝেছি আপনাদের সমস্যা টা।কিন্তু রির্পোট না দেখে আমি আপাতত তো কিছু বলতে পারব না। এই নিন এই প্রেসক্রিপশন টা এখানে যে টেস্ট গুলো আছে সেগুলো করুন গিয়ে।রিপোর্ট দুই ঘন্টার ভিতরেই পেয়ে যাবেন।তারপর রিপোর্ট নিয়ে এসে আমার সাথে দেখা করেন। রিপোর্ট ছাড়া সমস্যা টা ঠিক বোঝা মতো যাবেনা – আমি

ওকে ম্যাম – লিজা

তারপর ওরা বাইরে চলে গেলো টেস্টগুলো করাতে। ওরা কেবিনে থেকে চলে যেতেই আমি চোখে থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের এক সাইটে রেখে দিলাম।তারপর ভাবতে লাগলাম

তুমি কখনো আমার যোগ্যই ছিলেনা। ড্রেসআপ যেমন ক্ষ্যাত চালচলন ও ঠিক এইরকম। সব কিছু পুরোই ক্ষ্যাত।কি করে ভাবলে আমার স্ত্রী হওয়ার কথা।তোমার তো কোনো যোগ্যতাই নেই আমার পাশে দাড়ানোর – রিশাদ
———

ম্যাম এখন রুটিন অনুসারে আপনার আজকের লাস্ট অপারেশনের সময় এটা। – নার্স

নার্সের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলাম।তারপর আলতো করে হেসে দিয়ে বললাম,,

রুমা আপু তুমি যাও গিয়ে ওটির সবকিছু রেডি কর । আমি ও তৈরি হয়ে আসছি – আমি

ঠিক আছে – রুমা আপু

তারপর উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম ওটিতে। ঢুকার পরই বুঝতে পারলাম আজকের অপারেশনে প্রচুর রিক্স রয়েছে। রোগীর অবস্থা খুব একটা ভাল না।তার মধ্যে উনার টুইন বেবি হবে।তারপর আমি নার্স রুমা আপুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

আপু যাও গিয়ে উনাদের সাথে কথা বলে এসো।অপারেশনে আজকে প্রচুর রিক্স রয়েছে। একটা বিপদ হতে খুব বেশি সময় লাগবেনা।পরে তো উনারা হসপিটাল আর ডাক্তারকেই দোষ দিবে।তুমি বরং গিয়ে এসব খুলে বলো।তারপর উনাদের ডিসিশন শুনে পেশেন্টের হাসবেন্ডের সাইন নিয়ে এসো। রোগীর ব্লাড গ্রুপ কি ? – আমি

এ+ রোগীর রক্তের গ্রুপ – রুমা আপু

এই রক্ত কি আমাদের ব্লাড ব্যাংকে আছে এখন৷? – আমি

হুম আছে – রুমা

তাহলে ঠিক আছে। – আমি

তারপর আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে অপারেশন শুরু করে দিলাম।দীর্ঘ ৩ ঘন্টা অপারেশনের পর আমরা বাচ্চা দুটোকে সাথে তাদের মাকে ও বাঁচাতে সক্ষম হই।পুরো অপারেশন থিয়েটার জুরে বাচ্চাদের কান্নার শব্দ। বাচ্চাদের কান্নার শব্দ শুনতেই কি মিষ্টি লাগে। সত্যি বাচ্চা মানেই হয়তো খুশি। তারপর পুরোপুরি সব শেষ করে নিজের কেভিনে চলে আসি আমি।এসেই দেখি লিজা আর রিশাদ বসে আছে।তাদের হাতে রিপোর্টের ফাইল রয়েছে।আমি তাদের দেখে বলে উঠলাম,

সরি আপনাদের অপেক্ষা করানোর জন্য। আসলে একটা ইমারজেন্সি কেস ছিল আবার অনেক রিক্স ও ছিল সেই কারণেই এত লেট হলো।- নিজের সিটে বসতে বসতে বললাম আমি

সমস্যা নেই মেম।এই যে সবগুলো রিপোর্ট – রিপোর্ট গুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো লিজা

আমি রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম।রিপোর্ট দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার মতো অবস্থা হয়ে গেলো।আমি আবারো ভাল করে রিপোর্ট গুলো দেখতে লাগলাম।না কোনো পরিবর্তন নেই।তারমানে রিশাদ কখনোই পারবে না বাবা হতে।

কি লিখা আছে রিপোর্টে ? – রিশাদ

আসলে আপনাদের দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে মিস্টার রিশাদ কখনো বাবা হতে পারবে না – আমি

আমার কথা শুনে দুজনই পুরো নীরব হয়ে গেলো।তাই আমি বললাম,

আসলে উনার সমস্যা টা এমন যে আমি ঔষধ দিতে তো পারি।তবুও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।এখন আপনারা বলুন আমি কি করবো? – আমি

এসব ভুল রিপোর্ট। এমন কখনো হতেই পারেনা। আমার কোনো দূর্বলতা নেই।তুমি একটা নকল ডাক্তার। তাই তুমি বুঝতেই পারছো না আসল সমস্যা কি।আমি আরো বড়বড় নাম করা ডাক্তারের কাছে যাব।তোমার মত দুই টাকার ডাক্তারের কাছে আসাই আমার ভুল হয়েছে – সিটে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো রিশাদ

এমন ভাবে কথার বলছো কেন তুমি? উনার রিপোর্ট তোমার ঠিক মনে হয়নি ঠিক আছে। আবার টেস্ট করাও।কিন্তু উনি একজন ডাক্তার উনার সাথে বাজে বিহেভ করার অধিকার তোমার নেই।উনাকে সরি বলো – লিজা

মিসেস লিজা আপনার হাসবেন্ডের হয়তো মাথায় ও সমস্যা আছে।উনাকে ভালো দেখে একটা ডাক্তার দেখান।নাহলে পরে পাবনা পাঠানো লাগতে পারে – আমি

আই এম রিয়েলি ভেরি সরি মেম। ওর ব্যবহারে আমি ভীষণ লজ্জিত। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি- লিজা

ইটস ওকে – আমি

তারপর ওরা চলে যাই।আর আমি ভাবতে থাকি রিশাদের রিপোর্টের কথা। আমাদের হসপিটালে আজ পযন্ত কখনো কোনো রোগীর ভুল রিপোর্ট তৈরি করেনি।নাতো হসপিটালের বিরুদ্ধে এমন কোনো কেস আছে। নাতো আমি ভুল কিছু বলেছি।তারমানে সত্যিই হচ্ছে রিফাত কখনো বাবা হতে পারবেনা।এগুলো ভাবতে ভাবতেই আমার মুখে ফুটে উঠে তাচ্ছিল্যের হাসি। যেই মিথ্যা অপবাদটা আমার উপর দিয়েছিল আজকে সেই ঘটনাটাই ঘটছে।শুধু পার্থক্য আমার ক্ষেত্রে সেটা ছিল মিথ্যা আর রিশাদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে সত্যি। প্রকৃতি সত্যিই পাপের শাস্তি মানুষকে দেয়।হয়তো ১০ দিন নয়তো ১০ মাস নয়তো ১০ বছর পর।প্রকৃতি যে কখনো কাউকে ছেড়ে দেয়না।

আসুন আপনাদের সাথে পরিচিত হয়ে নেই আমি প্রাপ্তি চৌধুরী। পেশায় একজন ডাক্তার। আপন বলতে পৃথিবীতে শুধু আমার বাবাই আছে। বাকি সবকিছু গল্পে জানতে পারবেন।

ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি রাত ৯ টা বাজে।তারপর বাসায় চলে গেলাম।

পরদিন সকালে সবকিছু আগের রুটিনমাফিক চলতে থাকলো।উঠে তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলাম।তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম হসপিটালের উদ্দেশ্য। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আমার গাড়ির সামনে এসে পরে।আমি গাড়ি থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে যাই না তেমন বেশি গুরুতর কিছু হয়নি।শুধু হাতে একটু ছিলে গেছে।কিন্তু বাচ্চা মানুষ যে তাই ব্যাথায় ভয়ে চোখ পুরো পানিতে ভরে গিয়েছে। আমি বাচ্চা টাকে কোলে তুলে নিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম।তারপর বলতে লাগলাম,

তোমার আম্মু কোথায় মামনি ? – আমি

পাপা তো বলেছে আমার আম্মু আকাশে স্টার হয়ে আছে – বাচ্চা মেয়েটি

ওহ আচ্ছা বাবু তোমার নাম কি ? – আমি

আমার নাম রিয়ানা আহমেদ। তোমার নাম কি? – রিয়ানা

আমার নাম প্রাপ্তি চৌধুরী।তোমার তো হাতে ব্যাথা লেগেছে আমি ব্যান্ডেজ করে দেই? – আমি

না পরে যদি আমি ব্যাথা পাই – রিয়ানা

আমি তোমাকে প্রমিজ করলাম একটুও ব্যাথা পাবানা – আমি

ওকে তাহলে কর – রিয়ানা

তারপর আমি গাড়ি থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসে ওর হাত ভাল করে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেই।আর কথায় কথায় ওর মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে যাই। নাও হয়ে গেছে তোমার ব্যান্ডেজ করা – আমি

ও অবাক হয়ে বললো

কখন করলে আমি তো টেরই পেলাম না ? – রিয়ানা

এটা ম্যাজিক সোনা – আমি

ঠিক আছে। আজকে থেকে আমি তোমাকে ভাল আন্টি বলব। – রিয়ানা

হঠাৎই কেউ পিছনে থেকে বলে উঠলো,

আমার মেয়েকে আপনি কোন সাহসে এখানে নিয়ে এসেছেন।বাচ্চাদের চুরি করার ধান্দা করেন নাকি।রিয়ান আহমেদের মেয়েকে আটকে রাখার জন্য আপনাকে কঠিনতম শাস্তি ভোগ করতে হবে

চলবে 🥰🥰

#প্রাপ্তির_হাসি
#পর্ব_০১
DI YA

( গল্পটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের।একটু নতুন ভিন্ন ধরনের গল্প ট্রাই করলাম এবার। হ্যাপি রিডিং 🥰)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here