প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-১৫

0
945

“প্রিয় দিও বিরহ ”

১৫.

ভাতের শেষ লোকমাটা নিশিতার মুখে তুলে দিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। নিশিতা বাচ্চাদের মতো পানিটুকু পান করে বলে,

‘তুমি খুব ভালো, আর অনেক সুন্দরও। ‘

মেহতিশা কথা শুনে মৃদু হাসে। এ বাড়িতে আসার পর নিশিতা মেয়েটাকে ওর অস্বাভাবিক মনে হতো। প্রথম প্রথম এই ঘরের আশেপাশে আসতেও লাগতো প্রচুর ভয়। যতসম্ভব দূরেই থাকতো সে। তবে, কাল থেকে মেহতিশার বারবার মনে হচ্ছিল যদি কোনোভাবে নিশিতার সঙ্গে একটু কথা বলা যায় তাহলে হয়তো কিঞ্চিৎ পরিমাণ রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হবে৷ তারপরই সকালে একবার এই ঘরে এসেছিলো। ওকে দেখে নিশিতা তেড়েফুঁড়ে এসেছিলো মারতে। যেই মেহতিশা হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিলো অমনি নিশিত হেঁসে উঠলো। চকলেটের প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করলো। মেহতিশার মায়া লাগলো দেখে।
মেয়েটাকে দেখে ক্ষুধার্ত লাগছে। হয়তো কিছু খেতে দেয়া হয়নি তাকে। মেহতিশা খেয়াল করেছে লালিমা নিশিতাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। যেনো বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে আঁটকে রাখছে। বাঁচল কী মরলো কিছুই যায় আসে না। মেহতিশা রান্না ঘরে ঢুকে একটা প্লেটে ভাত, সবজি, আর মাছ নিয়ে আসে। মেখে খানিকটা নিশিতার মুখের সামনে ধরতেই নিশিতা গপগপ করে খেয়ে নেয়। এক বসায় সম্পূর্ণ ভাতটাই খায় নিশিতা। মেহতিশা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে নিশিতার পাশে বসে। নিশিতা আপনমনে পড়নের শাড়ির আঁচল টেনে খেলা করছে। মেহতিশা হাসিমুখে বলে,

‘আপু, আপনি অসুস্থ কতদিন ধরে? ‘

নিশিতা মুখটা অবুঝের মতো করে বলল,

‘আমি অসুস্থ না তো!

মেহতিশা মনে মনে নিজেকেই বকে। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কী কখনো নিজেকে অসুস্থ স্বীকার করে! সে কিনা বোকার মতো জিজ্ঞেস করছে।
মেহতিশার হাত ঝাকিয়ে নিশিতা ঠোঁট উল্টে বলে,

‘শোনো শোনো, আমি অসুস্থ না তো। আমি রাগ করেছি। ‘

মেহতিশা মাথা নাড়িয়ে তাল মেলায়। যেনো কোনো ছোট বাচ্চাকে প্রসন্ন করার প্রয়াস। নিশিতা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘বুঝেছো, আমি রাগ করেছি অনেক রাগ। তাই তো বারবার রেগে যাচ্ছি। ‘

‘আচ্ছা! ‘

‘হ্যা..তাইতো। ‘

‘কিন্তু, কীসের জন্য এতো রেগে আছো আপু?’

নিশিতা চুপ করে থাকে ৷ হাতটা কয়েকবার মোচড়ামুচড়ি করে টলটলে চোখে তাকায়। মেহতিশা ভড়কে গেলো। সে নিশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘কী হলো আপু?তুমি কাঁদছো কেনো?’

‘আমি তো রোজ কাঁদি, আরও কাঁদবো! খুব খুব কাঁদবো!’

‘কেনো কাঁদবে! ‘

নিশিতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে দাঁড়ায়। ছন্নছাড়া পায়ে বালিশের নিচ থেকে ফটো ফ্রেমটা বের করে। মেহতিশা কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। নিশিতা ছবিটা এনে মেহতিশার সামনে ধরে। মেহতিশা ছবিটায় দৃষ্টিপাত করে। ছবিতে সুদর্শন যুবকটিকে দেখে বুঝতে পারে এটা বুঝি দর্পণের বড় ভাই অর্পণ। যে কিনা নিশিতার স্বামী। পাশ দিয়ে কম বয়সী একটা মায়াবী মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। চমকায় মেহতিশা। ছবিটায় নিশিতাও আছে। কী অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে একসাথে! অথচ এখন নিশিতার দিকে তাকালে একসমুদ্র বিষাদ ঝলমল করে ওঠে। চোখের নিচটায় কালসিটে আস্তরণ। মুখটা শুকনো৷ দুই একটা ব্রণ। ছবিতে যেখানে কোমড় জড়িয়ে আছে দীর্ঘ কেশরাশি। সেখানে এখন কাঁধটাও পাড় করছে বহু টেনেটুনে। কী উষ্কখুষ্ক লাগছে। বহুদিন অবহেলার ছাপ শরীরে। অথচ, ঘরটা! কোনো এক সময় হয়তো একটা স্বপ্নপুরী ছিলো। দুজন ভালোবাসার মানুষের হাতে বোনা স্বপ্ন গুলো এখনো দেয়াল জুড়ে আছে। হাতে বানানো কালারিং প্রজাপতি, কাগজের নকশা,রোমাঞ্চকর ওয়াল পেইন্টিং সহ আরও অনেক কিছু। বারান্দার দিকে তাকালেও বোঝা যাবে সেখানেও অসংখ্য অমলিন স্মৃতিরা ঘুরে বেরায়।

মেহতিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিশিতা তখন ছবিটার দিকে তাকিয়ে অশ্রুপাত করছে। মেহতিশা কিছু বলার আগেই নিশিতা বললো,

‘তুমিই বলো, সবাই বলে ও আর নাকি আসবে না। কিন্তু ও আমার হাত ছুঁয়ে বলেছে ও আসবে। আমাকে কখনো ছাড়বেনা। ‘

মেহতিশা একবার বলে উঠছিলো, তুমি এতো ভালোবাসো যাকে সে আবার আসবে, তাঁকে তো তোমার টানে আসতেই হবে! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো মৃতরা কখনো ফিরেনা। মিথ্যা আশ্বাস কীভাবে দেবে সে! মেহতিশা মলিন মুখে বলে,

‘সে আর আসবেনা আপু, আপনি অপেক্ষা করা ছেড়ে দিন৷ ‘

নিশিতা ফুঁসে ওঠে। মেহতিশার দিকে চিৎকার দিয়ে বলে,

‘বেরিয়ে যাও তুমি! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও! আর কখনো আমার সামনে আসবেনা। তুমিও খারাপ! সবাই খারাপ। ‘

মেহতিশা চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিশিতা দৌড়ে খট করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। দরজার পাশেই ধপ করে ছবিটা নিয়ে বুকে চেপে বসে।
সে পাগল হলেও ভালোবাসা বোঝে। সে সব বোঝে। শুধু প্রিয় মানুষের মৃত্যুই বুঝতে পারেনা। নাকি বুঝেও মানতে চায়না, কে জানে! নিশিতা আকাশের কালো মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে নির্নিমেষ অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,

‘আমি তোমার অপেক্ষা করবো প্রিয়, শেষ নিঃশ্বাস অব্দি অপেক্ষা করবো। তুমি এসো, তোমার না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। ‘

আকাশে তখন অবাধ্য মেঘের গর্জন। রাতের আকাশে থমকে থমকে গর্জে উঠছে। একে নাকি বলা হয় শীত নামানো বৃষ্টি।
তীব্র বৃষ্টির ছিটা এসে ঢুকে যাচ্ছে ঘরের জানালা ভেদ করে। অকর্মণ্যতায় ঝিমাচ্ছে মেহতিশা। নিশিতার কাছ থেকে আসার পর মন খারাপ করে কতক্ষণ এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করলো। সকাল থেকেই আজ রিনিঝিনি বৃষ্টি। দর্পণ অফিসের ফাইলপত্র ঘাঁটছে।
মেহতিশা সেদিকে খানিকক্ষণ তাকায়। মিনমিন করে বলে,

‘শুনছেন?’

‘……..’

‘এই শুনুন না!’

দর্পণ হাতের কলমটা সাইডে রেখে তাকায়। মেহতিশা দেখে দর্পণের চোখে কালো ফ্রেমের চশমাটা বড্ড মানিয়েছে। লোকটাকে সব কিছুতেই মানায়। এই যে এতক্ষণ গম্ভীর চোখমুখে ফাইলের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কীসব ভাবছিলো তখন তাকে মেহতিশার তুর্কী নায়ক বুরাক ডেনিযের মতো লাগছিলো। এখন আবার যেই মুখটা গম্ভীর থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তৎক্ষনাৎ চোখমুখ ফিরে পেলো তার আসল সত্ত্বা। লোকটা সম্পূর্ণটাই রহস্যে ভরপুর। যাই হোক, মেহতিশা ভালোবাসে এখন এই লোকটাকে। আত্মা দিয়ে ভালোবাসে। এক পৃথিবী সমান ভালোবাসে। সরল স্বীকারোক্তি মনে মনে। বাহিরটা নিরুত্তাপ। মেহতিশাকে অন্য রকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে, দর্পণ কপালে ভাজ এনে বলল,

‘কী বউজান?তাকিয়ে থাকার জন্যই কী ডাকলেন?’

মেহতিশা ভড়কায়। তবে লজ্জা পায়না। কারণ ততোদিনে তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা কতখানি এগিয়েছে তা বলার বাকি রাখেনা। মেহতিশা সোফা থেকে উঠে এলো। দর্পণ খাটের পাশটায় আধশোয়া হয়েছিলো। তাকে চমকে দিয়ে মেহতিশা দর্পণের হাত থেকে ল্যাপটপ সহ বাকি কাগজপত্র সরিয়ে জগাখিচুরি বানিয়ে সেসবের জায়গা দখল করে আদুরে ভঙ্গিতে বসে দর্পণের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অশান্ত মনের শান্তি প্রয়োজন। দর্পণ হাসলো। কিছু বললো না। মেহতিশা চোখ বুজে শুয়ে রইলো। বাহির থেকে বৃষ্টির ছিটা এসে গায়ে লাগছে। ঘরের বাতিগুলো সব নিভানো। বাহিরের থেকে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ ঘরকে স্বর্গের ন্যায় অনুভূত করাচ্ছে। দর্পণের মধ্যেকার সুপ্ত পুরুষ সত্ত্বা তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। অতি নিকটে শায়িত সুদর্শনা নারীটি তাকে পোড়াচ্ছে।
রমনীটির পিঠ এলিয়ে থাকা রেশমী চুলগুলো আছড়ে আছে খাটে। বুকের উপর থেকে শাড়ি অনেকটাই সরে আছে। দৃশ্যমান হয়েছে ফর্সা কাঁধ, গলা। হাঁটুর কাছাকাছিতে এসে গেছে শাড়ির নিম্নাংশ। ফর্সা গোলাপি পা যুগল বেরিয়ে আছে। দর্পণ অভিমানী সুরে বলে,

‘বউজান, আমার হিংসে হচ্ছে। ‘

মেহতিশা চোখ খুলে বলে,

‘কাকে হিংসে হচ্ছে?’

‘বৃষ্টিকে। ‘

‘মানে?’

মেহতিশা ভ্রু কুচকে থাকে। দর্পণ মেহতিশার কপালে অঁধর ছোঁয়ায়। আদুরে কন্ঠে বলে,

‘এই যে, দেখুন বৃষ্টিগুলো আপনাকে কীভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে! আমার রাগ হচ্ছে বউজান। ভীষণ রাগ হচ্ছে। বৃষ্টিরা খুব দুষ্ট। ওরা যাচ্ছে না কেনো! ‘

দর্পণের বলার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেঁসে ফেলে মেহতিশা। আলতো হাতে ধাক্কা বসিয়ে দেয় দর্পণের কাঁধে। দর্পণের মোহাচ্ছন্নতা কাটে না। সে এগিয়ে আসে মেহতিশার মুখ বরাবর। দর্পণের উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাস এসে তার মুখ স্পর্শ করতেই শিউরে ওঠে মেহতিশা। দর্পণের অবাধ্য ঠোঁট মেহতিশার সারা মুখ, গলদেশ ছুঁয়ে দেয়। নাক ঘষে মেহতিশা কাঁধে। মেহতিশা খেয়াল করে এতো ঠান্ডা পরিবেশ থাকার পরও সে ঘামছে। দরদর করে ঘামছে। দর্পণকে সরিয়ে সে উঠে যেতে চাইলো। দর্পণ মুচকি হেসে তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলো। ঘোর লাগানো গলায় বলল,

‘বৃষ্টির মতো আমিও আপনাকে ছুঁয়ে দিতে চাই। ‘

মেহতিশা উপেক্ষা করে চলে যেতে পারেনা। সে নেশাগ্রস্তের মতো কাছে চলে আসে। কেঁপে কেঁপে সে দর্পণের পড়নের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে। দর্পণের পুরুষালি হাতজোড়া পেচিয়ে রাখে মেহতিশার সর্বাঙ্গ। মেহতিশাও মত্ত হয়ে পড়ে মুহুর্তেই। অথচ,এমনটা করার অনুমতি তার নেই। তাকে ধরে বেঁধে দেয়া হয়েছে কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সে নিষেধাজ্ঞা ভাঙলেই ধেয়ে আসবে ঘোর বিপদ। তবুও, মেহতিশা ভুলে বসে সব কিছু। যদিও অনেকটা সময় পর মেহতিশার কানে বাজে বাবার কথাগুলো, দর্পণকে ভুলেও নিজের কাছে আসতে দেয়া যাবে না। ভালোবাসাও যাবেনা। করা যাবে না কোনো স্বীগারোক্তি। বাঁধ ভেঙে ফেলে মেহতিশা। হার মানে ভালোবাসার মানুষের কাছে। এমনকি একসময় আওড়েও ফেলে,

‘ভালোবাসি দর্পণ সাহেব। আপনার আরশীজালে আমি বাজে ভাবে ফেঁসে গেছি। ‘

কেটে যেতে থাকে একটা অন্যরকম রাত্রি। দর্পণের ঘুমন্ত মুখমণ্ডল তখন মেহতিশার গলায় মুখ গুঁজে রাখা। সে যেনো কতকাল নিদ্রাহীন থেকেছে। মেহতিশা তখন আধোঘুম আধোজাগ্রত। সময়টা তখন মাঝরাত। কোথায় যেন গান বাজছে। দূর থেকে ভেসে আসছে মনমোহিনী বিষাদমাখা সুর,

তারে আমি দূর হতে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব।
তারে আমি দূর হতে সাধিব,
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব…

চলবে-
লেখিকা -নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here