ফাগুন প্রেম পর্বঃ ২৪

0
376

#___ফাগুন_প্রেম___
লেখনীতে : Bornali Suhana
পর্ব: ২৪
💛
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো বর্ণালীর। অনেকদিন হলো হাঁটতে যাওয়া হয় না। আগে যখন রুমু এসে থাকতো তখন প্রায়ই দুজনে একসাথে সকালে হাঁটতে যেতো। এখন আর রুমুও আসে না বর্ণালীরও হাঁটা হয় না। আজকেই একবার বলতে হবে রুমুকে এখানে এসে কয়েকটা দিন থাকতে। বর্ণালী রান্নাঘরে মায়ের কাছে যাচ্ছে। আজকে মাকে নিয়েই হাঁটতে যাবে।
-“মা চলো না একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।”
-“আরে সজিব একটু পর অফিসে যাবে তুই স্কুলে যাবি তোর বাবাও উঠবেন আমাকে নাস্তা বানাতে হবে আর তুই বলছিস হাঁটতে যেতে?”
-“তো কি হয়েছে? এখন ৬টা বাজে দুজনে অন্ততপক্ষে ৩০মিনিট হেঁটে আসি চলো না। তোমার শরীরের জন্যও হাঁটা জরুরি।”
-“হয়েছে এখন আর আমাকে ডাক্তারি করতে হবে না। চল।”
মা মেয়ে দুজনে বেড়িয়ে পড়লেন হাঁটতে। বাইরে কিছু দূর হেঁটে আসতেই জয়কে সামনে দেখতে পায় বর্ণালী। ওকে দেখতেই ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল। জয় এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বর্ণালী নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। জয় শারমিন বেগম কে সালাম দেয়।
-“আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি কেমন আছেন?”
-“এইতো বাবা ভালো আছি। তুমি?”
-“আমিও ভালো আন্টি। বর্ণালী কেমন আছো?”
-“জ্বি ভালো।”
-“হাঁটতে বের হয়েছেন নাকি আন্টি?”
-“হ্যাঁ বাবা আর বলো না বর্ণের জন্য বের হলাম। চলো তুমিও আমাদের সাথে কিছুদূর হেঁটে আসি।”
বর্ণালীর প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগে বিষয়টা। কেন মা একে সাথে যাওয়ার কথা বলতে গেলেন! ধ্যাৎ মজাটাই নষ্ট করে দিলেন। কিন্তু ও এই মুহুর্তে কিছু বলতেও পারছেনা। বাড়িতে গিয়েই মাকে কিছু একটা বলতে হবে। প্রায় অনেকদূর হেঁটে চলে এসেছেন সবাই। জয় বারবার আড় চোখে বর্ণালীকে দেখছে। কয়েকবার কাছে ঘেঁষে কথা বলারও চেষ্টা করেছে কিন্তু বর্ণালী এড়িয়ে গিয়েছে। এই সুযোগ তাকে দেয় নি। এসবে খুব বেশি অস্বস্থি লাগছে ওর।
-“মা চলো ফিরে যাওয়া যাক। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
-“হ্যাঁ চল।”
বাসায় এসেই শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে যায় বর্ণালী। মাকে কিছু বলতে চেয়েও বললো না। নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ে। স্কুলে আসতেই কাজ পড়ে ওর উপর। এইচএসসি পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্য একটা বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। তাই কলেজে অনেক কাজ আছে আর এইসব কাজ বরাবরের মতোই এসে পড়েছে বর্ণালীর উপর। যেকোন অনুষ্ঠানের সব রকম দায়িত্ব সবসময়ই ওর উপর এসে পড়ে। তাই তো কোমড় বেঁধে কাজে লেগে গেছে। কোথায় কিভাবে স্টেজ তৈরী করা হবে, কিভাবে সাজানো হবে, খাবারের মেনুতে কি কি থাকবে, নৃত্য, গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় সব রকমের আয়োজন কিভাবে আর কাদের দিয়ে করাবে, কোন কোন বিশেষ অতিথিকে দাওয়াত করতে হবে সব লিস্ট করতে বসে পড়েছে। হঠাৎ করেই কারো উপর চোখ থমকে যায় বর্ণালীর। সামনে ইভান দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণালী ওর দিকে এগিয়ে যেতেই প্রিন্সিপাল স্যার ওকে ডাকিয়ে নেন।
-“স্যার আসবো?”
-“হ্যাঁ বর্ণালী এসো।”
-“জ্বি স্যার বলেন।”
-“শুন তোমার সুবিধার্থে কয়েকজন স্টুডেন্ট সিলেক্ট করে একটা গ্রুপ বানিয়ে দিয়েছি৷ যারা তোমাকে সবকিছুতে হেল্প করবে।”
-“ওকে স্যার থ্যাংক ইউ।”
প্রিন্সিপাল পিয়নকে ডেকে বলেন,
-“গ্রুপের সবাইকে নিয়ে এসো তো।”
-“জ্বি স্যার।”
পিয়ন যাদের সাথে নিয়ে আসে তাদের দেখে বর্ণালী হা হয়ে যায়। ইভান, রাহাত, আসাদ, শিমুল, মালিহা আর মিথি এসেছে।
-“বর্ণালী?”
-“জ্বি স্যার।”
-“তারা সবাই তোমাকে হেল্প করবে। তুমি কাকে কি কাজ দিবে বুঝিয়ে দিয়ে দাও। আর আজ থেকেই কাজ শুরু করো। ডেকোরেশনের মানুষদের আসতে বলেছি তাদের কিভাবে কোথায় কি করা যায় সবকিছু বলে দিও।”
-“তোমরা সবাই যাও ম্যাডামের সাথে।”
-“জ্বি স্যার।”
সবাই হুরহুর করে বেড়িয়ে যায়। বর্ণালীও বেড়িয়ে যায় তাদের পিছু। ইভানের সাথে একবার কথা বলা প্রয়োজন। তাই ইভানকে আওয়াজ দেয় কিন্তু সবাই একসাথে আসে। তাই আর কোন উপায় না দেখে যার যার কাজ বুঝিয়ে দেয় সবাইকে। ইভানের উপর পড়ে ডেকোরেশন এর দায়িত্ব। যদিও বর্ণালী সবকিছু দেখাশোনা করবে।
অনেক্ষণ পর ইভানকে একা পেলো বর্ণালী। ওকে দেখে কেমন বদলে গেছে লাগছে। বর্ণালী ইভানের দিকে এগিয়ে যায়।
-“ইভান।”
-“জ্বি ম্যাডাম।”
-“এখানে কেউ নেই সো ম্যাডাম না ডাকলেও পারো।”
-“তো কি ডাকবো ম্যাডাম?”
বর্ণালীর বুকটা যেনো কেঁপে উঠে। ইভান ওর সাথে কেন এভাবে কথা বলছে!
-“ইভান এভাবে কথা বলছো কেন? আর আমাকে বললে না কেন তুমি যে ফিরেছ? গত দু’দিন কলটাও ধরলে না?”
-“কিভাবে কথা বলবো ম্যাডাম? আর আমি যে ফিরবো তা কি আপনাকে বলার কথা ছিলো?”
বর্ণালীর চোখে পানি জমে যায়। এভাবে কেন কথা বলছে ওর সাথে? কই ভেবেছিলো রাগ দেখিয়ে ও কথা বলবে না কিন্তু এখানে তো উলটো হচ্ছে। ইভান ওকে এভয়েড করছে।
-“কিছু কি হয়েছে ইভান? এভাবে কেন কথা বলছো? আমার উপর রেগে আছো?”
-“ম্যাডাম আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা আপনি আমাকে কি বলতে চাচ্ছেন? কোন কথা থাকলে বলেন নয়তো আমি কাজ করবো। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে শেষ করতে হবে সব।”
মালিহা এতোক্ষণ দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের কথা বলা দেখছিলো। আর সহ্য করতে না পেরে এগিয়ে যায় ওদের দিকে।
-“ইভান কোন হেল্প লাগবে? ম্যাডাম কিছু কি করতে হবে নাকি? আমাকে বলেন?”
বর্ণালী খালি গলায় ঢোক গিলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা এক করছে না। এক করলেই জলটা গড়িয়ে পড়বে আর ও এই চোখের জল ইভানকে দেখাতে চায় না।
-“কিছুনা তোমরা এদিকটা দেখো আমি আসছি একটু।”
কথাটা বলেই বর্ণালী আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করে। চোখের পাতা এক করতেই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। ওয়াশরুমে গিয়েই চোখের জল ছেড়ে দেয়। ইভানের এমন ব্যাবহারে ও কাঁদছে? কিন্তু ও কেন কাঁদছে! কেন এতো খারাপ লাগছে ওর! কেন কেন কেন? বুকের ভেতর কেমন যেনো ব্যাথা করছে। চোখের জল অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। ফোন বেজে উঠতেই ও ওয়াশরুমেই কল রিসিভ করে। রুমু কল করেছে। সকালেই তাকে কল দিয়েছিলো কিন্তু রিসিভ করেনি এখন ব্যাক করেছে।
-“হ….হ্যাঁ রুমু বল।”
-“তুই কাঁদছিলি?”
বর্ণালী খানিকটা অবাক হয়। রুমুকে কখনোই কোন কিছু মুখ খুলে বলতে হয় না বলার আগেই ও বুঝে নেয়। বর্ণালীর কান্নার মত্রাটা আরো বেড়ে যায়।
-“বর্ণালী তুই কোথায় বল আমি এখনি আসছি। এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে জান বল?”
-“ন…নাহ তোকে আসতে হবে না। আমি ঠিক আছি।”
-“তাহলে এভাবে কাঁদছিস কেন?”
-“ওই ই….ভান।”
-“কি হয়েছে ইভানের?”
-“ইভান আমার সাথে কথা বলছে না।”
-“হে খোদা এই কথা? একটু কথা না বলাতেই বেগম সাহেবা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন?”
-“আসলে….”
-“শুন কথা বল ওর সাথে জানার চেষ্টা কর কি হয়েছে? আর ও কেন এমন করছে?”
-“কিন্তু ও তো কথাই বলতে চাইছেনা।”
-“জোর করে কথা বল। এতো সোজা নাকি কথা বলবে না? যা এখনি যা।”
-“যাবো?”
-“হ্যাঁ জান এখনি যাবি। রাখছি আমি আমাকে পরে সব জানাবি।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে যাচ্ছি।”
বর্ণালী চোখ, মুখ ধুয়ে বাইরে যায় সোজা ইভানের কাছে।
-“ই….ইভান তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
-“হ্যাঁ বলেন।”
-“এখানে না।”
-“তো কোথায় যেতে হবে?”
-“যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে।”
-“সরি আমার অনেক কাজ আছে।”
বর্ণালী খানিকটা রাগ দেখিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসে।
-“শুন আজকে কাজ এখানেই সমাপ্তি দিচ্ছি। তোমরা সবাই সব ক্লাসে গিয়ে গান, নাচ, অভিনয় আর কবিতা আবৃত্তিতে যারা নাম দিতে চায় তাদের নাম নিয়ে নাও। যদিও এটা কোন প্রতিযোগিতা নয় তবুও যারা ভালো পারে তাদের নাম নিবে। তাদের দিয়ে পারফরম্যান্স করানো হবে।”
-“ঠিকাছে ম্যাম।”
-“ইভান তুমি আমার সাথে চলো কাজ আছে।”
মালিহা তো হন্তদন্ত হয়ে যায়। কিভাবে ইভানকে আটকানো যায় ম্যাডামের সাথে যাওয়া থেকে
-“ম্যাডাম ইভানের সাথে আমার একটু কাজ ছিলো আপনি যদি অন্য কাউকে নিয়ে যেতেন।”
ইভান ব্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মালিহার দিকে। মনে মনে ভাবতে লাগলো আমার সাথে ওর কি প্রয়োজন?
বর্ণালী টেনশনে পড়ে গেলো। এখন কি করে ইভানকে সাথে নেয়া যায়? তখনি ইভান বলে,
-“তোর সাথে পরে দেখা করবো৷ আপাতত ম্যাডামের সাথে কাজটা সেরে আসি।”
-“কিন্তু।”
-“মালিহা!”
-“আচ্ছা।”
মালিহা রাগে কটমট করতে করতে চলে গেলো। বর্ণালী একটা স্বস্থির নিশ্বাস নিলো। ইভান আর কোন কিছু না বলেই বর্ণালীর পিছু পিছু যায়। বর্ণালী রিকশাওয়ালাকে ডাকতে চাইলেই ইভান বলে,
-“আমার সাথে গাড়ি আছে চলুন।”
-“হুম চলো।”
ইভান ওর সাথে আপনি করে কথা বলছে? কি হয়েছে ওর?”
দুজনে গাড়িতে উঠে বসে।
-“কোথায় যাবেন বলেন।”
-“সোজা চলো।”
ইভানও আর কোন কথা না বলে সোজা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। দুজনের মাঝেই গভীর নীরবতা পালন হচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না। বর্ণালী টেনশনে মরে যাচ্ছে। যতক্ষণ না জানতে পারবে কি হয়েছে ততক্ষণ ওর মন শান্ত হবে না। গাড়ি অনেকদূর চলে শহরের কোলাহল থেকে বের হয়ে এসেছে। একটা খালি জায়গায় এসেই বর্ণালী বলে,
-“গাড়ি থামাও।”
-“সাথে সাথে ইভান গাড়ি থামায়।”
বর্ণালী ওর দিকে ফিরে বলে,
-“কি হয়েছে ইভান?”
-“কই? কিছু না তো।”
-“আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো অন্যদিকে কেন তাকাচ্ছো?”
ইভান বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে গাড়ির মাঝে জোরে হাত দিয়ে একটা ঘুষি মারে। সাথে সাথে ও কেঁপে ওঠে। ইভানের এমন ব্যাবহারকে প্রচন্ড ভয় পায়।
-“কি হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে? কি হয়েছে তো আমার জিজ্ঞেস করার কথা বর্ণালী।”
-“কি বলছো এসব ইভান? কি কারণে তুমি এতো রেগে আছো?”
-“তুমি আমার জন্য একটু অপেক্ষা করলে না? আমার ভালোবাসার কোন দাম নেই তোমার কাছে?”
-“এসব কথা কেন বলছো ইভান? কি করেছি আমি?”
বর্ণালী কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। ইভানের চোখ লাল হয়ে আছে। ওর চোখের কোণেও পানি। রাগে ওর শরীর কাঁপছে আর ফুসছে। ব্রু কুচকে তাকিয়ে আছে বর্ণালীর দিকে।
-“জয়ের সাথে কি করছিলে তুমি?”
বর্ণালী যেনো বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলো। এখন সবকিছু ওর কাছে পরিষ্কার। সকাল বেলা ইভান ওদের একসাথে দেখেছে। তাই এতো রেগে আছে। সেদিন ইভান ওকে বার বার বলেছিলো জয়কে ওর আশেপাশে যেনো না দেখে। কিন্তু মায়ের জন্যই সকালে ওই জয়টা সাথে গেলো। এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে জয়টাকে মেরে ফেলতে। সব সময় ওর কারণেই ইভান রেগে যায়।
💛
#______চলবে………..
.
গত পর্ব – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=125517939118565&id=103632171307142

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here